শম্পা কী চায়?: প্রথম পর্ব

শম্পা কী চায়?: প্রথম পর্ব

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার র‌্যাডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাক মেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? জানতে হলে, পাঠক, পড়ুন এই উপন্যাসটি।]

এতদিন জানতাম ওর নাম শ্রাবণী, এখন শুনি শম্পা।

কিন্তু নামে কী আসে যায়, যখন শম্পা আমার সংসারে ধ্বস নামিয়ে দিতে পারে?

অথচ কী চমৎকার আরম্ভ হয়েছিল আজকের সকালটা! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে নতুন ক্লাস আরম্ভ হবে। প্রথম বর্ষের প্রথম লেকচার। সারা দেশের সব তুখোড় প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা এসে জড়ো হয়েছে লেকচার থিয়েটারে। মধ্যবয়সী কুলেস্ট প্রফেসর হিসেবে আমার একটা দুষ্টু দুষ্টু খ্যাতি আছে। সে ব্যাপারে আমি ভীষণ সচেতন। আমি সব সময়ই লেকচার আরম্ভ করি সাম্প্রতিকতম কোনো ইংরেজ কবির টইটম্বুর প্রেমের কবিতা দিয়ে। এতে ছাত্রীদের মন গলানো সহজ হয়। আজ আমি সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে এসেছি, গলায় হালকা বাদামি মাফলার। সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাদের সবাইকে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে স্বাগতম। আজ শুরু থেকেই আমরা ইংরেজি কবিতার রূপসাগরে মন্থন করব। দেখব কীভাবে ওরা প্রতিটি বর্ণের শরীরে আবেগের রঙ চড়ায়। এখনকার ঝাকানাকা ইংরেজ কবি হলেন ক্যারল অ্যান ডাফি। ওদের এক সময়ের রাজকবি। ওনার একটা প্রেমের কবিতা শোনো,

I want to call you thou, the sound

of the shape of the start

of a kiss—like this—thou—

and to say, after, I love,

thou, I love, thou I love, not

I love you.

মানে হলো, তোমাকে আমি ‘তোমাকে’ না বলে ‘তোকে’

বলতে চাই,

সে উচ্চারণে ওষ্ঠ চুমুর আকার নেয়,

এই যেমন বলছি, ‘তোকে’,

বলছি ভালোবাসি,

ভালোবাসি তোকে, তোকে ভালোবাসি,

তার তুলনায় দ্যাখো কেমন মামুলি শোনায়

যদি বলি, ‘তোমাকে ভালোবাসি’?

এইটুকু বলে আমি সামনে তাকালাম। নানা রঙের শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ পরা তন্বী মেয়েগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। শব্দের ব্যঞ্জনায় মুগ্ধ হওয়ার জন্যই ওরা ইংরজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছে। এ কারণেই ওদের চোখে মুখে এখন ডাবের পানির মতো নির্মল আর ক্ষীরের মতো ঘন মুগ্ধতা। এখন এই মুহূর্তটিকে টেনে আমাকে আরও অনন্য উচ্চতায় তুলতে হবে।

সাম্প্রতিক কালের কবিতার একটা আভাস তো এইমাত্র দিলাম, আমি এখন ওদের মনে ধ্রুপদী কবিতার গোলাপজল ছিটাব। সবার দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বললাম, এই যে প্রেম, প্রেমই হলো সাহিত্যের প্রাণ। আর প্রেমের প্রাণ হলো সমর্পণ। প্রেমের সমর্পণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৪ বলেছিলেন, তোমার চরণে দেব হৃদয় খুলিয়া।’ আচ্ছা, কেউ কী তোমরা পারো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে?

একসঙ্গে চার-পাঁচটা মেয়ে হাত ওঠাল। আমি একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা মিষ্টি চেহারার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী নাম তোমার?

রঞ্জনা।

বাহ, আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

বাকি মেয়েগুলো ঝিলমিল করে হেসে দিল। আমি বললাম, রঞ্জনা, শোনাও তাহলে এই গানটি।

রঞ্জনা গাইল,

কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দেব হৃদয় খুলিয়া

আমি বললাম, ধন্যবাদ রঞ্জনা, আমাদের রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। আসলে প্রেম কোনো সম্পর্ক না, প্রেম হলো প্রেম, একেবারেই একমুখী, একপাক্ষিক সমর্পণ, নাথিং এলস। প্রেমকে ধ্বংস করে প্রত্যাশা। এবার শোন ডব্লিউ বি ইয়েটস কী বলেছেন। ১৮৯৯ সালে উনি লিখলেন, I have spread my dreams under your feet; মানে তোমার চরণে দিলাম স্বপ্ন ঢালিয়া। দেখেছ কীভাবে মিলে গেল দু’ কবির পংক্তি? অথচ এমন না যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন অনূদিত হয়েছে। ওনারা বন্ধুও হয়েছেন আরও তেরো বছর পর। তাহলে কীভাবে এত মিল হলো দুজনের প্রকাশে?

প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে আমি আবার সামনে তাকালাম। মেয়েগুলো অবাক নয়নে, উদগ্রীব হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। মেয়েগুলোর রক্তিম ঠোঁট আর ঘন আঁখিপল্লবের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, রাজার কাননে ফুটেছে গোলাপ, পারুল, রজনীগন্ধ্যা। আহা! ওদিকে ক্লাসের ছেলেগুলো ওদের মাঠ দখল করে নিচ্ছি দেখে বেশ বিরক্ত। কেউ কেউ কুট কুট করে মোবাইল টিপছে, কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু থেমে বললাম, প্রেমের পাগল করা সমর্পণ দুই কবির হৃদয়বীণার একই তন্ত্রীতে ঝংকার তুলেছিল। একই রকম বেদনায় ওনারা কাতর হয়েছিলেন আর একই রকম আনন্দে হয়েছিলেন আপ্লুত।

এভাবে বাণী দিতে দিতে ঝড়ের বেগে এক ঘণ্টা কেটে গেল। ক্লাস খালি হয়ে যাওয়ার পর আমি যেই দরজা দিয়ে বেরুতে যাব ঠিক তখনই পায়ের সামনে কোত্থেকে একটা বই এসে পড়ল। আমি বইটা মেঝে থেকে উঠাতেই চমকে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণী, কাল রাতের মেয়েটা। শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, প্রেম ওদের হৃদয়বীণায় একই তন্ত্রীতে বেজেছিল বুঝি? তো কাল যে আমাকে সরোদ বানিয়ে সারা সন্ধ্যা ঝংকার তুললে, কেমন লেগেছিল তোমার?

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.