উতল হাওয়া (তৃতীয় পর্ব)

উতল হাওয়া (তৃতীয় পর্ব)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব...]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ঢাকা থেকে ফিরে এক দিন করাচি কাটিয়ে ইয়াহিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর লারকানার পথে রওয়ানা হয়েছেন। ইয়াহিয়ার মনে কোনো শান্তি নাই। মুজিব সমস্ত হিসেবে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিয়েছে। গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসানও একটা অথর্ব, তাকে বলা হয়েছিল মুজিবের দল যাতে কোনোভাবেই বেশি আসন না পায় সে লক্ষ্যে কাজ করার জন্যে। কিন্তু গাধাটা কোনো কাজ করে নি। সে খাজাকে দিয়ে ইসলামপন্থী দলগুলোকে রাজ্যের টাকা দিয়েছে, কিন্তু ৭৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে ওরা মাত্র দুটি আসন পেয়েছে। হাতের এই বাটনটা দিয়ে আহসান আর খাজাকে চাবকাতে পারলে মনটা শান্ত হতো।

ইয়াহিয়ার সফরসঙ্গী হয়েছেন তার জেনারেলরা। জেনারেল পিরজাদা, জেনারেল গুল হাসানও আছেন। লারকানায় শীতের সময় দলে দলে পরিজায়ী পাখিরা এসে নামে। এখানে হাঁস শিকারের ফাঁকে ফাঁকে সবাই মিলে ঠিক করবে পূর্ব-পাকিস্তানের কালো বাঙালিগুলোকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়। ওদের গায়ে অনেক চর্বি জমেছে, গা থেকে চর্বি কমানোর ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্লেনে বসে আকাশ দেখতে দেখতে ইয়াহিয়া এ কথাই ভাবছিলেন আর দেখছিলেন সিন্ধু নদের সৌন্দর্য। কত ঘটনা কত কালের সাক্ষী এই নদ।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ বছর আগে পত্তন হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার। এর আয়তন ছিল ১২,৬০,০০০ কিলোমিটার। বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় পুরো অংশ, ভারতের গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, আফগানিস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল আর ইরানের বেলুচিস্থান নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই সিন্ধু সভ্যতা। ১৯২১ সালে ইংরেজের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন অধিকর্তা স্যার জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলায় ইরাবতী নদীর তীরে প্রথম এই উন্নত নগরসভ্যতা আবিষ্কার করেন। পরে ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে, সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলায়, মহেনজোদারো নামক স্থানে আরেক উন্নত নগরসভ্যতার সন্ধান পান।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা ছিল মূলত একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। পোড়া ইট দিয়ে বাঁধানো  রাস্তাগুলি ছিল ৯ ফুট থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া। রাস্তার দুদিকে বাঁধানো ফুটপাতে ছিল ল্যাম্পপোস্ট ও ডাস্টবিন। মূল রাস্তার দু’দিকে, পোড়া ইট দিয়ে তৈরি তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি ছিল। এসব বাড়ির জানালাগুলো ছিল বাড়ির ভেতর দিকে। নগরসভ্যতার অঙ্গ হিসেবে পথের দু’দিকে ছিল ১-২ ফুট গভীর নর্দমা। প্রতিটি বাড়ির শৌচাগারের জল এইসব নর্দমা দিয়ে বাইরে পাঠানো হতো। জলাশয়ের নোংরা জল নিকাশ ও তাতে পরিষ্কার জল পূর্ণ করার ব্যবস্থা ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা পোশাক-পরিচ্ছদ হিসেবে প্রধানত সুতি ও পশম ব্যবহার করত। নারী ও পুরুষ উভয়ে লম্বা চুল রাখত এবং উভয়েই অলংকার ব্যবহার করত। মেয়েরা সোনা ও রুপার পোশাক-পরিচ্ছদ ফিতে দিয়ে নানা ধরনের খোঁপা করত। তারা প্রসাধন ও অলংকার সামগ্রী, সুগন্ধি এবং তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা, রুপা ও পাথরের তৈরি জিনিস নানা আকারের হার, কানের দুল, চুড়ি, আংটি, মল, কোমরবন্ধ ও মালা ব্যবহার করত এবং মেয়েরা চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক জাতীয় রং ব্যবহার করত। ভ্যানিটি ব্যাগের ব্যবহারও এই যুগের মেয়েদের অজানা ছিল না।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার পতন শুরু হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন এই সময়ে সিন্ধু নদের ভয়াবহ বন্যায়  এই শহর দুটি ধীরে ধীরে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। হাজার বছর পর  নতুন মানুষ এসে আবার এখানে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে নতুন সভ্যতা। ভুট্টোর বাবা শাহ্নেওয়াজ ইংরেজদের কাছ থেকে আড়াই লাখ হেক্টরের লারকানার এই জমিদারি বন্দোবস্ত  নেন। সিন্ধুর একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল এই লারকানা।

ভুট্টো এয়ারপোর্টের ছোট লাউঞ্জে পায়চারি করছেন। ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা যে ফলপ্রসূ হবে না ভুট্টো সেটা জানতেন। সেজন্যেই তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে তার পৈতৃক স্থান লারকানার জমিদারিতে বুনোহাঁস শিকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। ভুট্টো ভালো করেই জানেন তাকে ছাড়া ইয়াহিয়ার চলবে না। গণপরিষদের নির্বাচন দিয়ে ইয়াহিয়া নিজেই ফেঁসে গেছেন, না দিয়েও কোনো উপায় ছিল না। এখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দেশ শাসনের ভার তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে- এটা পকিস্তানের আর্মির জেনারেলরাও মেনে নেবে না।

প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার কাছ থেকে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর বিগত ১২ বছরে আর্মি জেনারেলরা ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের যে স্বাদ পেয়েছে, সেসব থেকে তাদের আর দূরে সরিয়ে রাখার উপায় নেই। পাকিস্তানের পুরো বাজেটের ৩০ শতাংশ চলে যায় সামরিক খাতে। আর্মিরা চাচ্ছে সরাসরি সেনাশাসন না থাকলেও তাদের সামরিক বাজেট যেন অক্ষত থাকে, তাদের সুখ-ভোগের যেন কমতি না থাকে। এটা ভুট্টো ভালোভাবেই জানেন বলেই জেনারেল পিরজাদা, জেনারেল ওমর এবং জেনারেল গুল হাসানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেনা অধিনায়কদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন।

ইয়াহিয়ার সামনে বিকল্প একটা পথই খোলা আছে- যে কোনো অজুহাতে নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে  ভুট্টোর হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেওয়া। তিনিই এখন পশ্চিম-পাকিস্তানের পপুলার নেতা, নির্বাচনে তার দল পশ্চিম-পাকিস্তানে ৮১টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো বাঙালিদের নিয়ে, এই কৃষক-মজুরের দল কী করে পাকিস্তানের শাসনকর্তার ভূমিকা পালন করবে সেটা তার মাথায় আসে না।

ভুট্টো বাঙালিদের কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছেন না। কথায় কথায় বাঙালি হারামখোরগুলো দফা পেশ করে- ১১ দফা, ৬ দফা,  শুধু দফা আর দফা। ওদের সকল দফা পাছা দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে। ওই রকম নেংটি পরা, মূর্খ,  ইডিয়েটগুলো পাকিস্তানের শাসক হয়ে বসবে, পশ্চিম-পাকিস্তানের উপর খবরদারি করবে- এটা চিন্তাই করা যায় না। কোনো আদব, লাহাজ, সহবত কিছু জানে ওরা? সারাক্ষণই চিৎকার, চেঁচামেচি, মিছিল-মিটিং এসব নিয়েই আছে।

শেখ মুজিবের কথা মনে হলেই ভুট্টোর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। লোকটা সমস্ত হিসাব-কিতাবে গন্ডগোল লাগিয়ে দিয়েছে। ১৬২  আসনের মধ্যে ২টা বাদে সবগুলোই জিতে নিয়েছে তার দল। এদিকে তার পিপলস পার্টি ১৩৮টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ৮১টি, যদিও পশ্চিম-পাকিস্তানে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তবু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের তুলনায় অর্ধেক আসন। তারপরও শেখ মুজিবকে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না, এতে যদি পূর্ব-পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয় তো হোক। কোনো এক অছিলায় নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। যদি বাঙালিরা ঝামেলা করে, তাহলে ওদের পায়ের তলায় পিষে মারতে হবে।

ভুট্টো ঠিক করেছেন কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে, পাকিস্তান আর্মিকে বাঙালির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে হবে। রক্তপাত যদি ঘটাতে হয় আর্মি ঘটাবে। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেব তিনি তার ইমেজ নষ্ট করতে চান না। ইয়াহিয়া দুর্বলচিত্তের মানুষ, তাকে দিয়ে হবে না। সেজন্যেই তিনি যা বলার জেনারেল পিরজাদাকে বলে দিয়েছেন। ইয়াহিয়া জেনারেলদের বাইপাস করে একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর্মি নিজেদের স্বার্থেই পথের কাঁটা সরাবে।

লারকানার স্থানীয় এই ছোট বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে ভুট্টো এসব কথাই ভাবছিলেন। বহুদিন পর তাঁর স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আইয়ুব খানের সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীনই তিনি ভেবেছিলেন সামরিক জান্তাকে হটিয়ে যদি কখনো বেসামরিক সরকার কায়েম করা যায়, তাহলে তিনিই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সে লক্ষ্যেই তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জমিদারি থেকে প্রচুর টাকা পলিটিক্সে লগ্নি করেছেন। ভুট্টোর জমিদারিও কম বড় নয়। আড়াই লাখ হেক্টরের বিশাল ল্যান্ড। সেখানে যাওয়ার জন্যে এয়ারপোর্ট থেকে স্পেশাল ট্রেন ব্যবস্থাও আছে।

শুধু টাকা লগ্নি করেই ক্ষান্ত হন নি ভুট্টো। ইয়াহিয়া খানের নেক নজরে পড়ার জন্যে হেন কাজ নেই যা তিনি করেন নি। গুচ্ছের টাকা ঢেলেছেন আকলিমার পায়ে। ভুট্টো ভেবে খুবই অবাক হন- ছয় সন্তানের জননী কাশ্মীরি নারী আকলিমা কী করে হয়ে উঠল পাকিস্তানের সবচেয়ে পাওয়ারফুল ওমেন- ‘জেনারেল রানি’। জেনারেলদের ঘনিষ্ঠজন বলে সবাই আকলিমাকে জেনারেল রানি বলে ডাকে। ভুট্টোর মতো একজন অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েটকে ইয়াহিয়ার নেকনজরে পড়ার জন্যে জেনারেল রানির কাছে ধর্না দিতে হয়েছে।

রানির মতোই আকলিমার শান-শওকাত ক্ষমতা। পাকিস্তানের সব বড় ব্যবসায়ী, জেনারেল আর আমলারা ইয়াহিয়ার নেকনজরে পড়ার জন্য, কাজ আদায়ের জন্যে জেনারেল রানির পায়ের কাছে এসে পড়ে থাকে। ইয়াহিয়ার সাথে কথা বলার জন্যে রানিকে দিয়ে অনেকে পার্টি এরেঞ্জ করায়। ভুট্টো নিজেও সেসব পার্টিতে ইয়াহিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটা পার্টিতে খরচ বাবদ এক লক্ষ টাকা নেয় রানি।

নির্বাচনের আগে একদিনের কথা। রানির মহালে ভুট্টো আর পিপলস পার্টির তরুণ নেতা ইফতেখার বসে আছেন রানির সাথে দেখা করার জন্যে। ভুট্টো একটু সকাল সকালই গেছেন। কারণ অভ্যাগতদের ভিড়ে বিকেলে রানিকে একা পাওয়া মুশকিল। গোয়েন্দা, সাংবাদিকরাও খবরের লোভে সব সময় জেনারেল রানির দিকে নজর রাখে।

রানি বসবার ঘরে ঢুকেই ভুট্টোকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলে, আপ কা কোয়ি কমন সেন্স নাহি হ্যায় ভুট্টো সাহাব। এ কোয়ি মোলাকাত কারনেকা টাইম হ্যায়, না তরিকা হ্যায়?

কিউ, কিয়া হুয়া রানিজি?

রানি ক মহালমে সুবা সুবা নেহি আনা চাহিয়ে।

আগার কিউ?

রানি ক কাম কিয়া হ্যায়? আপকে তারা আশিক ওয়ালে লোগক মুহাব্বত পে ফাঁসানা। মুহাব্বত কে লিয়ে, সারারাতকে লিয়ে রাতপে আনা জরুরি হ্যায়, ইতনা সুবা সুবা নাহি।

ওহ এই কথা?

আল্লাজী নে রাত কিউ বানায়া? পিয়ার করনেকে লিয়ে, পিয়ার। মুঝে কোয়ি শোনে নাহি দেতা।

ম্যায় তো পিয়ার নেহি মাঙ্গা।

জানতা থহু। সিন্ধি লোগ বেনিয়া হোতি হ্যায়, বহুতই লোভী হোতি হেয় ঠিক আপকে তারা। ও পিয়ার নাহি জান্তা। ও স্রেফ ধান্দা করতে হ্যায়। আপকে জো পেহেলা ওইয়াইফ থা শিরিন, জানে ও কিউ চলা গায়া? কিউকি আপ পিয়ার নাহি জানতি। আওরাত স্রেফ পায়সো নাহি চাহাতা, জিনেকে লিয়ে ও পিয়ার চাহিয়ে, কেয়ার চাহিয়ে। ম্যায় তো ডিসাইড কর লিয়া থা অর কোয়ি সিন্ধি লোগক সাথ মেয় নাহি মিলোঙ্গি। সিন্ধি ওয়ালে বহুত কঞ্জুস আর হারামি হোতি হ্যায়।

হা হা হা! রানির এত বড় একটা খোঁচা জুলফিকার আলী ভুট্টো হাসি দিয়ে ঢেকে দিলেন।

হাসিয়ে মাত ভুট্টো সাহাব। আপ মেরে পাশ কিউ আয়া? ইমাদাত কে লিয়ে আয়া। ইলেকশান আ রাহি হ্যায়। ভোট হোগা, ফির আপ লোগ এমএলএ বনেগা, প্রাইম মিনিস্টার বনেগা। মেরা ক কিয়া ফায়দা?

ইসি লিয়েই তো হাম লোগ আপকে পাস আয়া।

আচ্ছা! কিয়া জাদু দেখাইগে আজ?

জাদু নাহি। আসলি প্ল্যান। আপ পাঞ্জাব কা গভর্নর বনেগি।

ম্যায় বানু পাঞ্জাব কা গভর্নর! হা হা হা, এ কিয়া তামাশা হ্যায়?

তামাশা নাহি রানিজি। পার্লামেন্ট পে আওরাত কে লিয়ে জো পাঁচ আসন রিজার্ভ হ্যায়, আপ ক এক আসন দিয়া যায়ে।

নেহি নেহি আপকা এ প্ল্যান নাহি চলেগা।

জরুর চলেগা। আপ বহুতই ইনফ্লোয়েনশিয়াল পারসন হ্যায়। প্রেসিডেন্ট সাহাব আপকা এডভাইস পার ডিপেন্ড করতি হ্যায়। আপ চাহে তো পাঞ্জাব ভি চালা সাকতে হ্যায়।

ঠিক হ্যায়, ম্যায় সোচকে দেখুঙ্গি।

সোচনে ক কোয়ি বাত নেহি হ্যায়। ম্যায় সোচ সামহালকে আপকে লিয়ে এ প্ল্যান বানায়ি। আপ কে পাস জো তাগদ হ্যায়, জো ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি হ্যায়, জো ডিপ্লোমেসি আপ জানতে হ্যায়, আপকে লিয়ে স্রেফ একহি জাগা হ্যায়- ও হ্যায় পাঞ্জাব।

আকলিমা ভেবে দেখল, এ জিসম কি বিজনেস হামেশা নাহি চালেগি। সহি ওয়াক্ত সহি ডিসিশান লেনা পাড়া। আব্বাজি জো বুড্ডা পুলিশ ওয়ালকে সাথ শাদি দে থি, সহি ওয়াক্ত পে ও শাদি নাহি তোরা তো আজ জেনারেল রানি নেহি বান পায়ি। আকলিমা ভুট্টোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে বলে, ঠিক হ্যায় জো আপকে মরজি, আব মেরা কেয়া করনা পারেগি?

ইলেকশন কেম্পেইন কে লিয়ে ফান্ড চাহিয়ে।

কিতনা?

পাঁচ ক্রোর।

পাঁচ ক্রোর! বাপরে। ইতনা তানখা ম্যায় কাহা সে পাউ?

বহুত বাড়ি বাড়ি পাকিস্তানি বিজনেসম্যান আপকে ফ্যান হ্যায়। আপ চাহে তো ডোনেশন লে সাকতে হ্যায়।

হা হা হা, আপই তো বড়া বিজনেসম্যান হ্যায় ভুট্টো সাহাব। কিতনা চতুর আদমি হ্যায় আপ! মাছলি কি তেল পেই মাছ ভাজেঙ্গে। ইসি লিয়েই শিরিন ভাবিজি চলা গায়া।

ভুট্টো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন তার প্রথম স্ত্রী ও মামাতো বোন শিরীনকে নিয়ে এই রেন্ডি আকলিমা তাকে যে অপমান করল, সময়মতো তিনি এর প্রতিশোধ নেবেন। জেনারেল রানির কথা ভাবতে ভাবতে ভুট্টোর চোয়াল শক্ত হয়েছিল। এইমাত্র বিমান থেকে ইয়াহিয়া খানকে নামতে দেখে ভুট্টো সংবিত ফিরে পেলেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে ইয়াহিয়া খানকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভুট্টো বললেন, ওয়েলকাম টু লারকানা, ওয়েল কাম টু আল-মুরতাজা মিঃ প্রেসিডেন্ট। আপনার জন্যে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই ট্রেনে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম আয়েশ করতে করতে আমরা আল-মুরতাজায় যাব।

সত্যিই রাজকীয় ব্যবস্থা। তিন বগির ট্রেনের ভেতরে ফার্স্টক্লাস ব্যবস্থাপনা। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সাহেব যাবেন এই ট্রেনে করে, সে জন্যে সব ঝেড়ে-মুছে চকচকে করা হয়েছে। প্রথম বগিতে থাকছে প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটির একটি দল। দ্বিতীয়টিতে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট, ভুট্টো, আরও দুজন খাস জেনারেল। আর শেষ বগিতে খানা-পিনার ব্যবস্থা। ১৭ জন কুক রান্নাবান্নার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। আজ দুপুরের প্রধান ডিস হলো মোরগ মোসল্লাম।

লারকানা সফরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আরও আছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এস.জি.এম পীরজাদা। সে হলো সামরিক সরকারে ভুট্টোর সবচেয়ে কাছের লোক। জেনারেলদের জন্যে অন্য এক টেবিলে আলাদাভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আগে থেকেই এখানে চলে এসেছেন পাঞ্জাব আর সিন্ধের দুই পিপিপি নেতা- গোলাম মুস্তাফা খার এবং মমতাজ ভুট্টো।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, দুধারে বিশাল শ্যস্যের মাঠ পেরিয়ে মৃদু-মন্দ গতিতে এগিয়ে চলছে ট্রেন। আবহাওয়া খুবই মনোরম। শীত শেষ হয়ে আসছে আর কিছুদিন পর গরম পড়তে শুরু করবে। পাকিস্তানের সবচেয়ে উষ্ণতম প্রভিন্স হলো লারকানা, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে চলে যায়।

ইয়াহিয়া নির্ধারিত আসনে বসতে বসতে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, ভুট্টো সাহাব। আড়াই লাখ হেক্টর ল্যান্ডের মালিক আপনি, পুরো লারকানাই তো আপনার।

এ সবই আমার আব্বার করা। আমি জাস্ট কেয়ারটেকার।

আপনাদের আল মুরতাজার জমিদারি, শান-শওকাত গোটা পাকিস্তানের জন্য গৌরবের।

ভুট্টো উৎসাহিত হয়ে বলল, প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা আমার আব্বার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, উনি তো প্রতি বছরই শীতে এখানে হাঁস শিকারে আসতেন।

এতবড় জমিদারি ফেলে বিদেশে পড়াশুনা করে আপনি রাজনীতিতে এলেন কেন ভুট্টো সাহাব? হার রোজ ইয়ে পাবলিক ডিলিং আচ্ছা কাম নেহি হ্যায়। ম্যায় তো বোর হ গায়া। পাবলিক হামেশাই ডিমান্ডপে মিলতি-ঝুলতি হ্যায়। সুবা সে সাম তাক, ফির সাম সে সুবা তাক ডিমান্ডপে ডুবা রাখা, এ চাহিয়ে ও চাহিয়ে...রাস্তা চাহিয়ে, ইলেট্রিসিটি চাহিয়ে, রুটি-কাপড়া মাকান সবকুচ চাহিয়ে।

হা হা হা!

হাসিয়ে মাত ভুট্টো সাহাব! আরে ম্যায় সবকুচ দিও তো আল্লামিয়া ক কিয়া কাম? ও বেকার বৈঠে রাহে আসমান পার।

হা হা হা! আল্লা মিয়া ক কিয়া কাম হা হা হা...সহি বলা আপ। ইংরাজ লোগ ইন্ডিয়া ছোড়কে গায়া, পাকিস্তান ছোড়কে গায়া। ছোড়নেক পেহেলে ও এক জিনিস দেকে গায়া। ইন্ডিয়াক দিয়া ভগবান অর পাকিস্তান ক দিয়া আল্লামিয়া।

হা হা হাসহি বলা। আচ্ছা এক বাত পুঁছু, আপ ইতনা বড়া জমিদার হ্যায়, পয়সাঅয়ালে লোগ হ্যায়, আপ ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট ভি বান সাকতি থি! বাট আপ রাজনীতি পার কিউ আয়া?

ইয়াহিয়ার প্রশ্ন শুনে ভুট্টো বোঝার চেষ্টা করছেন ইয়াহিয়া আসলে কী বলতে চাইছেন। পাকিস্তানে সবচেয়ে হারামি জাত হচ্ছে আর্মি। আর্মিকে কখনোই বন্ধু ভাবতে নেই। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা হাঁস শিকার করতে যে সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে নিয়ে তাদের আল মুরতাজার জমিদারিতে এসেছিলেন, সেই আইয়ুব খানই পরের বছর ইস্কাদার মির্জাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন। আবার আইয়ুব খানকে হটিয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এই ইয়াহিয়া। গণপরিষদের নির্বাচনের পর যখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা, তখন যদি ইয়াহিয়া বলে ‘আপনি রাজনীতিতে কেন এলেন’, তার মানে হলো ইয়াহিয়ার মনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে।

মনে মনে এসব কথা চিন্তা করে ভুট্রো বললেন, এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার আব্বা শাহ্নেওয়াজ ভুট্টোর অনেক বড় ভূমিকা আছে। আমি বাবার অনুপ্ররণাতেই বড় হয়েছি। আসুন একটু গলা ভিজিয়ে নিন। দুপুরবেলা আপনার পছন্দের ককটেল তৈরি করা হয়েছে। রাম, টাকিলা, ভদকা, ফ্রুটস জুস আর কুচি বরফ দিয়ে এই ককটেল। এই নিন।

ইয়াহিয়া গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন, বাঃ এ তো শারাবান তহুরা, সত্যিই চমৎকার!

এটি আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা।

আপনার মা তো হিন্দু ছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ, আমার মা ছিলেন সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়ে। ওনার নাম ছিল লক্ষ্মী বাই। আমার আব্বাকে বিয়ে করার আগে মা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাবা যদিও মুসলিম লীগ করতেন কিন্তু আমাদের বাড়িটি ছিল একেবারেই ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত। পারস্য, হিন্দু এবং আধুনিক মুসলিম কালচারের সমন্বয়ে আমরা বড় হয়েছি। ইংরেজ শাসনামলে, ১৯২৬ সালে, আমার আব্বাই প্রথম সিন্ধু থেকে বম্বের ইম্পারিয়েল লেজিসটেটিভ এসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। লাহোরের গোলটেবিল বৈঠকে আমার আব্বা মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনি যে বলছিলেন আমি কেন রাজনীতিতে এলাম? আসলে রাজনীতি আমার রক্তে মিশে আছে।

আব ম্যায় সামাজগায়ি আপ পলিটিক্সপে কিউ আয়া। বাট হামারা এ পাকিস্তান, শেখ মুজিব ছিন লেনা চাতি হ্যায়।

ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছ থেকে এরকম প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলেন। দুজনেরই কমন গোল- মুজিবকো হটাও। ভুট্টো বললেন, এ কাভি নাহি হো সাক্তি হ্যায় মিঃ প্রেসিডেন্ট।

ইয়াহিয়া ভুট্টোকে বাজিয়ে দেখার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করেন, কিউ নেহি? ইলেকশনে তো শেখ মুজিবের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাঁকে আপনি হটাবেন কী করে? আর সে তার ৬ দফা দিয়ে সংবিধান তৈরি করতে চাইলে পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সিন্ধু, পাঞ্জাব, বাংলা আলাদা আলাদা রাজ্যে পরিণত হবে।

ভুট্টো বললেন, ইন্ডিয়াও এটাই চায়। শেখ মুজিব ইন্ডিয়ার দালাল, তার আগরতলার ষড়যন্ত্র এটাই প্রমাণ করে। আমার গায়ে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে শেখ মুজিবকে সে সুযোগ কোনোদিনই দেওয়া হবে না।

এসব সিরিয়াস কথার মাঝখানে ইয়াহিয়া হঠাৎ ভুট্টোর কানের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বললেন, নুরী কি এসেছে। তাকে এখানে আসতে বলেছিলাম।

নুরী মানে কি নুরজাহান?

তাকে কি খবর দেওয়া হয়েছিল?

না, সেরকম কথা তো আমাকে কেউ বলে নি।

বুনোহাঁস শিকারে যাবেন অথচ বনহংসী নেই। শিকার কি জমবে?

ভুট্টো হা হা শব্দে হেসে উঠলেন। ভুট্টোকে হাসতে দেখে অন্য টেবিল থেকে জেনারেল পিরজাদা ও গুলহাসান দুজনেই ককটেলের গ্লাস নামিয়ে উৎসুক হয়ে তাকালেন। ইয়াহিয়ার নারীপ্রীতির কথা সবাই জানে। দেশের এরকম ক্রান্তিলগ্নেও তিনি বান্ধবীর কথা ভোলেন নি দেখে ভুট্টো খানিকটা অবাক হলেন। ইয়াহিয়া দুজনকে ইশারায় নিজের টেবিলে ডাকলেন। তারপর চিয়ার্স বলে গান ধরলেন- দুনিয়া কিসিসে পিয়ার মে জান্নাত সে কাম নেহি, এক দিলরুবা হ্যায় মে জো জো হুরসে কাম নেহি-

জেনারেলরাও তাদের হেঁড়ে গলায় কোরাস গান ধরল, পার্টি জমে গেল। ভুট্টোর বানানো ককটেল দ্রুত উজাড় হতে থাকল। সে খানিকটা হতাশ চোখে ইয়াহিয়ার দিকে তাকাতেই ইয়াহিয়া তাকে পয়েন্ট করেই পরের লাইন ধরল- তু বাদশা হ্যায় হুসনে নে হ, হুসনে জাহান-

হু-জেনারেল পিরজাদা ভুট্টোকে চোখ টিপে একই গানে গলা মিলিয়ে বলল...তু বাদশা হ্যায় হুসনে নে হ, হুসনে জাহান হু-ভুট্টো মনে মনে বলল, বাদশা তাকে হতেই হবে, শেখ মুজিবের সাধ্য নেই তাকে আটকায়।

(চলবে…)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.