শাহাবুদ্দিন: মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী

শাহাবুদ্দিন: মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী

শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী। শিল্পের পীঠস্থান প্যারিসে বসবাস ও শিল্পচর্চা, খ্যাতি ইউরোপ ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে। মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে গেরিলা ও সম্মুখসমর উভয় ক্ষেত্রেই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে, বিজয় দিবসে, শাহবাগের রেডিও অফিসে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাও উত্তোলন করেন তিনি।

১১ সেপ্টেম্বর শাহাবুদ্দিন আহমেদ চুয়াত্তর বছরে পদার্পণ করেছেন। তাঁর জন্য নিরন্তর শুভেচ্ছা।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে ছুটে চলেছে একদল মুক্তিযোদ্ধা, মিসাইলের মতো তারা সমুখে আগুয়ান... একজন মানুষ, দেহখানির মধ্যে তার হাত একপর্যায়ে এসে কুয়াশার মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন প্রলম্বিত হয়ে যেন মহাকাশ ছুঁতে চাইছে... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিথর পড়ে রয়েছেন, সিঁড়িতে, অদূরে পড়ে রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত পাইপ... মাদার তেরেসার সৌম্য মুখ— এইসব ইমেজ ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে উঠেছে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের তুলিতে। প্যারিস প্রবাসী এই চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মে বারবার রেখাপাত ঘটে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার। কেননা মুক্তিযুদ্ধ তাঁর অনুপ্রেরণার মহান উৎস। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে জয় বাংলা হোল্ডিং ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন। প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ঢাকাকে শত্রুমুক্ত করার অভিযানে তাঁর ভূমিকা ছিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শাহাবুদ্দিনের ছবিতে বারবার দেখা যায় বাংলাদেশের পতাকা হাতে আগুয়ান মুক্তিযোদ্ধাকে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য হলো, ‘আমি আমার দেশের পতাকা নিয়ে জনতার সঙ্গে হেঁটেছি। সে এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি! ঢাকা শহরে আমার হাতে আমার দেশের পতাকা— আমার সঙ্গে জনতা। কী তুমুল উত্তেজনায় কাঁপছি! কত রকমের বোধ কাজ করে যাচ্ছে তখন। কত মানুষের কত ত্যাগ কত মানুষের জীবনদান— তারপর এই দেশের জন্ম আর তার পতাকা আমার হাতে।’ এ ধরনের ছবিতে শাহাবুদ্দিন একটি সংগঠিত অবস্থা বুঝাতে চান। একটা জাতি যে সংঘবদ্ধ হয়েছিল, তার রূপ ফোটাতে চান।

শক্তি ও গতির প্রতিও শাহাবুদ্দিনের পক্ষপাত, ভালোবাসা। তাই বারবার তাঁর ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠে এই দুটি বিষয়। এর পেছনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং পাশ্চাত্য জীবনের সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের সম্পৃক্ততা ক্রিয়াশীল। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, ‘প্যারিসে যাওয়ার ফলে পাশ্চাত্যের লোকদের স্পিড, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গতি—আমাকে প্রভাবিত করেছে।’ এই শক্তি ও গতির প্রকাশ শাহাবুদ্দিনের ছবিতে অন্য মাত্রা দান করে। আর এই শক্তি ও গতির প্রকাশ শুধু মানুষের দেহাবয়বে নয়, বাঘ ও ঘোড়ার মতো জন্তুর মাধ্যমেও শাহাবুদ্দিন তা প্রকাশ করেছেন। আর এক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য জীবন প্রভাব ফেলেছে শাহাবুদ্দিনের চিত্রকর্মে। তার ভাষায়, ‘যখন ফ্রান্সে গেলাম, সেখানে হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া দেখে আমি আকৃষ্ট হয়েছি। কেননা আমাদের আর ওদের ঘোড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। সেখানকার ঘোড়ার মুভমেন্ট, গতি, যখন দৌড়ায় মাশলগুলি ভেরি অ্যাট্রাক্টটিভ।’

শক্তি কিন্তু ধারণ করে বীরেরা। বীরের মধ্যে যে অসীম শক্তি রয়েছে তা শাহাবুদ্দিন বারবার চিত্রিত করেছেন বঙ্গবন্ধু, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথকে ক্যানভাসে মূর্ত করার মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল শাহাবুদ্দিনের পরিবারের এবং বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁকে ঘিরে বহু স্মৃতি রয়েছে শাহাবুদ্দিনের। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে অমিত তেজ, যে বীরত্ব ছিল সেটির প্রকাশ ঘটাতে বারবার ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুকে আঁকেন শাহাবুদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়-ঔদার্যের প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত শাহাবুদ্দিনের ভাষ্য হলো, ‘বঙ্গবন্ধুর কলিজাটা হলো মহিষের মতো।’ উল্লেখ্য, শাহাবুদ্দিন প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন আগরতলায় জঙ্গলের মধ্যে ট্রেনিং নেওয়ার সময়।

অবিভক্ত ভারতের নেতা গান্ধীও বারবার শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে ওঠেন। অহিংসার পূজারী গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে শাহাবুদ্দিনকে। গান্ধী সম্পর্কে শিল্পী বলেন, ‘গান্ধীজির যে শক্তি, তিনি এমন এক পদ্ধতিতে কথা বলেছিলেন—যা তার নিজস্ব।’ গান্ধীর এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশ দেখা যায় শাহাবুদ্দিনের ছবিতে।

আর বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ। সংগতকারণেই একজন বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রদ্ধেয়। বারবার তাই শাহাবুদ্দিনের ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ।

শুরুতে শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে নারীর উপস্থিতি ছিল কম। কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের মাঝামাঝি দেখা গেল তার ক্যানভাসে নারীদের মুখর পদচারণা। সেইসব নারীর মধ্যে রয়েছে স্নানরতা নারী, মৌনতায় মগ্ন নারী আর ভরতনাট্যমের মুদ্রায় নৃত্যরতা নারীও।

শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাহাবুদ্দিন আহমেদ শুধু চিত্রশিল্পীই নয় মুক্তিযোদ্ধাও। কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে সেই সময়ে, একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো কীভাবে কাটিয়েছেন তিনি? কীভাবে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, শত্রুর মুখোমুখি হয়েছেন। একটা প্লার্টুনের নেতেৃত্বে দিয়েছেন তিনি, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, দেখেছেন সহযোদ্ধার আত্মাহুতি। বেঁচে থাকার আকুতিও দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সেইসব মর্মস্পশী ঘটনা সবাইকে জানানোর জন্য একদা কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন  ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ। ১২৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ।

শাহাবুদ্দিনের জন্ম ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ঢাকায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরায়। শাহাবুদ্দিনের বাবা তাইবউদ্দিন আহমেদ রায়পুরা ও ধানমন্ডি আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আগরতলা শরণার্থী শিবিরের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তবে শাহাবুদ্দিনের শিল্পীজীবনে তাঁর মা ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। মায়ের উৎসাহ ও অবদানেই শাহাবুদ্দিন চিত্রশিল্পী হতে পেরেছেন। ছোটবেলায় ছবি আঁকা, খেলাধুলাসহ নানা দুরন্তপনায় মা সব সময় ছেলেকে সমর্থন জুগিয়েছেন। মা তাঁর শিল্পী জীবনের সফলতার একটি পর্ব দেখে গেছেন। এ জন্যে শাহাবুদ্দিন ভীষণ আনন্দিত।

শাহাবুদ্দিনের শৈশব-কৈশোরের অম্ল-মধুর সময় নরসিংদীতে গ্রামের বাড়িতে কেটেছে। সেখানে ছিল নদী। এই নদী শাহাবুদ্দিনের চিত্রকর্মে প্রভাব ফেলেছে। তাঁর ছবিতে একটু মনোযোগী হলে দেখা যাবে—কোথায় যেন একটি পানি পানি গলে পড়া ব্যাপার রয়েছে। প্রভাব এটাই এবং এটাই শিল্পী শাহাবুদ্দিনের স্টাইল। যেহেতু তাঁর ছবিকে আধুনিক করার জন্য তিনি ল্যান্ডস্কেপ করেন নি, কিন্তু তারপরেও তাঁর ছবিতে ল্যান্ডস্কেপ আছে, যা তাঁর একটি চিত্রভাষা বা স্টাইল। এটা অন্যদের নেই, ইউরোপের অনেক চিত্রশিল্পীরই নেই। শাহাবুদ্দিনের ছবির এই যে স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য এর পেছনে কাজ করেছে নদীমাতৃক বাংলাদেশে তাঁর জন্ম নেওয়া, তাঁর উপরে বৃষ্টি-বাদলের প্রভাব। এটি শাহাবুদ্দিনের রক্তের মধ্যে খেলা করে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একজীবনে শাহাবুদ্দিন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৪ সালে আগস্টে ফ্রান্সের ‘নাইট ইন দি অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার’। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- পাকিস্তানের সেরা শিশু চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক (১৯৬৮); বাংলাদেশের সেরা চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক (১৯৭৩); বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রজতজয়ন্তি প্রদর্শনী (১৯৭৩), স্বর্ণপদক, সেলন দ্যু প্রাইনটেমস, প্যারিস (১৯৭৪), রৌপ্য, পদক, সেলন দেস আর্টিস্টিস ফ্রানসাইস, প্যারিস (১৯৭৫); স্বর্ণপদক সেলন দ্যু প্রাইনটেমস, প্যারিস (১৯৮১); সেরা পুরস্কার, তরুণ চিত্রশিল্পী শিল্প প্রদর্শনী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর (১৯৮২); সম্মাননা পুরস্কার, তৃতীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, ঢাকা, বাংলাদেশ (১৯৮৬); অলিম্পিয়াড অব দি আর্টস ‘সমকালীন শিল্পকলার ৫০জন মাস্টার চিত্রশিল্পী’, বার্সেলোনা, স্পেন (১৯৯২), স্বাধীনত দিবস পুরস্কার (২০০০)।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.