দেখলি তুর্য, মেয়েটার কী বড় বড় চোখ!
মৃদুল প্রশ্নটা করতেই তুর্য তাকায় তার দিকে। কোন মেয়েটা? আসতে আসতে তো কয়েকটা মেয়েকেই দেখলাম।
যার কথা বলছি, তাকে তুই ঠিকই দেখেছিস! জানি আমি। আমি দেখে থাকলে তুই দেখবি না? তোর যা নজর!
না দেখে উপায় আছে বল? যেভাবে তোর দিকে তাকিয়ে ছিল! তুর্য হাসতে হাসতে বলে।
শালা, আমার না, তোর দিকে তাকিয়েছে মেয়েটা। নায়কের মতো চেহারা তোর। আমি তো কালো ভূত। ভুল করেও মেয়েরা আমার দিকে তাকায় না। মেয়েটার চোখ দুটো কী বড়, তাই না? এমন বড় চোখ আমি এই প্রথম দেখলাম। আর চাহনিটাও খুব তীক্ষ্ণ!
এত বিশ্লেষণ না করে দ্রুত হাঁট তো। যে কাজে এসেছি সে কাজ করতে আমাদের রাত হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। চল।... আমাদের কিন্তু আরও দুদিন আগেই আসা উচিত ছিল। খামোখা তুই এদিক-সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট করলি!
সময় ঠিক নষ্ট করেছি বলা যায় না। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। মানুষের সাথে একটু কথা-টথাও তো বলেছি।
পানি ছাড়া এখানে দেখার আর কী আছে! চারদিকে শুধু খাল আর পুকুর। তাও যদি সে পানি খাওয়া যেত। সব পানিতে লবণ!
সব জায়গাতেই দেখার মতো কিছু না কিছু থাকে। আমার কাছে তো জায়গাটা খারাপ লাগল না। সারাক্ষণ সুন্দরবন থেকে একটা হাওয়া আসছে। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে জায়গাটাতে।
শান্তি না ঘোড়ার ডিম! এক দুদিন ঘুরলেই সব জায়গাই অমন ভালো লাগে। তাই বলে মাসের পর মাস...আমার পক্ষে এখানে আর বেশিদিন চাকরি করা পসিবল হবে নারে দোস্ত।
এত ভাবিস না। এই কেইসটা সলভ্ হোক, দেখবি ভালো জায়গায় পোস্টিং পেয়ে যাবি।
আমার সাদা দৃষ্টিতে তো কালো কিছু দেখতে পারব না, তাই তোকে ডেকে আনলাম। তবে তুই যেন আবার নিজের আসল পরিচয় দিস না কারও কাছে। আমার নামে, মৃদুল বলেই পরিচয় দিবি নিজেকে।
সে ভাবিস না। আমাকে কেউ চিনবে না। জানবে, তুই-ই তোর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইনকোয়ারি করেছিস।
কথা বলতে বলতে গন্তব্যে পৌঁছে যায় ওরা।
তুর্য এদিক-ওদিক চোখ ঘুরায়। চারপাশের মাটিতে ছাই। অর্ধদগ্ধ কাঠ, কাপড়, কাগজ। অর্ধগলিত প্লাস্টিকের রোল। ঘরটা রাস্তা ঘেঁষে। রাস্তার পাশেই খাল। খালের পাড়ে তালগাছের গোড়ায় হাত তিনেক উঁচুতে বাঁশের মাচা বাঁধা। দুপুরের গরমে শুয়ে-বসে থাকার জন্য এমন মাচা বানায় এই অঞ্চলের লোকেরা। আসার পথে অন্য বাড়িতেও এমন মাচা দেখেছে তুর্যরা। তালগাছটার পাশেই বোধহয় আরেকটা গাছ ছিল। সদ্য কাটা গোড়া দেখে মনে বুঝা যায় সেই গাছটা কাটা হয়েছে বেশিদিন হয় নি। মাচা থেকে তাকালে সরাসরি খালের ওপাশ দেখা যায়। ওপাশেও একটা তালগাছ। মাচার নিচে কিছু কাঁচা গোবর। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ। আধপোড়া পাটের কাঠি। তুর্য চোখ ফেরায়। মূল ঘরের একপাশে লাগোয়া দরজাবিহীন রান্নাঘর। রান্নাঘরের মেঝেতে কয়েকটা বোতল পড়ে আছে। বেড়ার গায়ে সবুজ গামছা। ঘরের আরেক পাশেই গোয়ালটা। সেখানে দুটো গাভি বসে আছে। ওদের দেখে একটা গাভি অলস চোখে তাকায়।
২
আপনার নামই তো শৈলেন বাড়ৈ? মাঝবয়সী লোকটাকে প্রশ্ন করে তুর্য।
হ্যাঁ।
পুড়েছে তো আপনার ঘরই?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা কারা? এসব প্রশ্ন কেন করছেন?
আপনি যে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, ঘর পোড়ার কারণে ঋণ মওকুফের জন্য আবেদন করেছেন, আমরা সেই এনজিও থেকে এসেছি। আপনার ঘর পোড়ার ব্যাপারে একটু জানতে।
আমার ঋণটা মাফ হবে তো? আগ্রহের স্বরে শৈলেন জানতে চায়।
হয়তো পুরোটা মাফ হবে না। তবে বেশির ভাগই মাফ হবে। কিন্তু আগুনটা যদি নিজে থেকে লাগে তাহলেই।
নিজে থেকে কি আর আগুন লাগে! কেউ হয়তো লাগিয়েছে শত্রুতা করে।
তেমন হলেও আপনি সুবিধা পাবেন। আচ্ছা, আপনি কখন টের পেলেন যে আপনার ঘরে আগুন লেগেছে?
রাত ... কয়টা হবে তখন... একটা দেড়টা হবে। যদিও আমি ঘড়ি দেখি নি। তবে এমনই হবে সময়টা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘরভরতি ধোঁয়া।
অত রাতে তো ঘরের ভেতর অন্ধকার থাকার কথা। আপনি অন্ধকারে ধোঁয়া দেখলেন কীভাবে?
দেখলাম মানে বুঝতে পারলাম আর কী। ধোঁয়ার একটা গন্ধ আছে না?
হুম, তা আছে। আচ্ছা, আপনি একাই ছিলেন ঘরে?
না। আমার স্ত্রীও ছিল, পাশেই শোয়া। সে আমার আগেই উঠেছে। আসলে তার কাশির শব্দেই আমার ঘুমটা ভেঙেছে।
আপনারা ঘর থেকে বের হলেন কী করে? আগুন তো সারা ঘরেই জ্বলছিল।
জানালা দিয়ে বের হয়েছি।
জানালা দিয়ে কেন? দরজা দিয়েই তো বের হওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবে।
দরজার দিকে আগুনটা বেশি ছিল। আবার দরজায় তালাও দেওয়া ছিল।
তালা! আপনারা ঘরে থাকতে দরজায় কেন তালা দিয়ে রেখেছিলেন?
তালা কি আমরা দিয়েছি? দরজায় তালা দিলে ঘরে ঢুকব কী করে! যে ঘরে আগুন দিয়েছে, নিশ্চয়ই সে-ই তালাটা দিয়েছে। যেন ঘর থেকে বের না হতে পেরে আমরা জীবন্ত পুড়ে মরি।
আপনি বুঝলেন কী করে যে দরজায় বাইরে থেকে তালা দেওয়া আছে? ঘরের ভেতর থেকে তো সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই।
তখন আসলে আগুনের জন্যই দরজার দিকে যাই নি। তবে পরে যখন বের হলাম তখন লোকজন বলাবলি করছিল যে তোমাদের ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল।
আচ্ছা কার সাথে আপনার এত বড় শত্রুতা, যে দুজন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চাইবে?... আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ না। আমি জানি কে আমাদের মারতে চায়। এর আগেও আমাদের পুকুরে বিষ দিয়ে মাছ মেরেছে। গোয়ালঘরে আগুন দিয়েছে।
পাশের গোয়ালটা কি আপনারই?
হ্যাঁ। আমারই।
দেখে তো মনে হয়, গরুগুলো খুব উন্নত জাতের। দামি নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ। এক একটার দাম দেড় লাখের বেশি হবে।
গরু কিনতেও কি আপনি ঋণ নিয়েছেন নাকি?
হ্যাঁ। কিছু ঋণ নিয়েছি একটা ব্যাংক থেকে। আর আমার জমিও বিক্রি করেছি একটু।
আচ্ছা, আপনি বলছিলেন কারও সাথে আপনার শত্রুতা আছে। কী নিয়ে বিরোধ?
জমি। সে চায় না আমি এখানে বসবাস করি। ... তার ইচ্ছা আমি এখান থেকে চলে গেলে আমার জমি সে দখল নিবে।
আপনার গোয়ালের আগুনটা বোধহয় অল্প কিছুদিন আগেই লেগেছিল?
হ্যাঁ। আমার দুটো গরু পুড়ে মরেছে সেই আগুনে।
তখন আপনার গরু কয়টা ছিল?
পাঁচটা। এখন আছে তিনটা।
ঋণের টাকায় কেনা গরুগুলো মরে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ আগুনে ওই দুটোই পুড়েছে। বাকি কটাকে বাঁচাতে পেরেছি।
আপনার ছেলেমেয়ে?
নাই। আমার স্ত্রীর সমস্যা। বহু ডাক্তার দেখানো হয়েছে, ফল হয় নি কোনো।
ওহ্। আচ্ছা, আপনি তপতী নামে কাউকে চিনেন?
তপতী! না... তেমন কাউকে তো...
তপুকে চিনেন?
হ্যাঁ, ওকে তো চিনি জন্ম থেকেই।
৩
আচ্ছা, আপনার নাম কী?
মালিনী। মালিনী বাড়ৈ।
ঘরে যখন আগুন লাগল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আগুনের তাপে আমার ঘুমটা ভেঙেছে।
আপনারা সাধারণত রাত কয়টার দিকে ঘুমান?
এই... দশটা সাড়ে দশটা।
আপনার স্বামীও কি একই সময়ে ঘুমান?
সে মাঝে মাঝে দেরি করে। বন্ধুদের সাথে তাস খেলে।
আগুন লাগার রাতে কখন ঘুমাতে এসেছেন উনি?
আমরা একসাথেই শুয়েছি। দশটার একটু পরে।
আপনার ঘুম আগে ভেঙেছে, নাকি আপনার স্বামীর ঘুম আগে ভেঙেছে?
মালিনী একটু ভাবে। ঘুম যে কার আগে ভাঙলো? মনে হয়, আমারই পরে ভেঙেছে।
মনে হয় বললে হবে না। আপনি ঠিক করে বলুন, কার ঘুম আগে ভেঙেছে?
আমার ঘুমই পরে ভেঙেছে।
আচ্ছা, আপনারা বের হলেন কী করে?
কারা যেন ঘরের বেড়া কেটেছিল। সেদিক দিয়েই বের হয়েছি।
কেন দরজা দিয়ে বের হওয়া যেত না?
সে উপায় ছিল না। আগুনটা দরজার দিকেই বেশি ছিল।
আচ্ছা, আগুনে ঘর যখন পুড়ছিল তখন কি কোনো গন্ধ পেয়েছিলেন?
ওই ধোঁয়ার গন্ধ। মাংস পোড়ার গন্ধ। ঘরে মুরগির খোঁয়াড় ছিল তো। মুরগি কটাও পুড়েছে আগুনে।
আর কোনো গন্ধ পান নি? কেরোসিন বা এই জাতীয় কিছুর!
অত তো খেয়াল করি নি। বলে, মালিনী একটু ভাবে। তবে, এখন তো মনে হচ্ছে যেন কেরোসিনের গন্ধ পেয়েছিলাম।
আপনি কি রান্নার সময় কেরোসিন ব্যবহার করেন?
আমাদের তো গ্যাসের সিলিন্ডার নেই। গরিব মানুষ, লাকড়িতেই রান্না করি। ওই আগুনটা জ্বালানোর সময় খানিক কেরোসিন দিতে হয়। তাতে আগুন সহজে ধরে।
আচ্ছা, মাসে কতটুকু কেরোসিন লাগে আপনার?
সে কি আর হিসেব রেখেছি!
তবু একটা আন্দাজ দিন।
সে এক বোতল হলেই হয়ে যায়। সব সময় তো কেরোসিনে আগুন ধরাই না। শুকনো পাতা আছে। পাটকাঠি আছে। তা দিয়েও চুলা জ্বালাই।
আচ্ছা, আপনাদের তো সন্তান নেই। এই নিয়ে সংসারে কোনো ঝামেলা হয় না?
মালিনী সাথে সাথে জবাব দেয় না। একটু চুপ থেকে বলে, সংসার হলো ঝামেলারই জায়গা। একটু আধটু ঝামেলা, ঝগড়া সব সংসারেই হয়।
আসলে ঝামেলা বলতে, সন্তান না থাকাতে আপনাদের কোনো সমস্যা হয় না? আমি বোধহয় ভালো মতো বুঝাতে পারলাম না প্রশ্নটা।
ও আমি বুঝেছি। আমাদের বিয়ে হলো দশ বছর। ভগবান দেন নি সন্তান, তা কী আর করব! ডাক্তার দেখালাম। কবিরাজ-বদ্যি সবই দেখালাম। কপালে নেই সন্তান।
আচ্ছা আপনার স্বামী কেমন মানুষ?
ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। সেও তেমনই। তবে তারে খারাপ বলা যায় না।
আপনার কপালে কিসের দাগ?
ও পড়ে গিয়ে হয়েছে। মালিনী আঁচলে কপাল ঢাকার চেষ্টা করে।
আচ্ছা আপনার স্বামীর প্রিয় রং কী আপনি জানেন?
জানি, সবুজ। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন!
না এমনি হঠাৎ মনে হলো। তাই করলাম প্রশ্নটা।... আচ্ছা, আপনি কি আপনার খুব কাছের কাউকে ঘৃণা করেন?
ঘৃণা? মালিনী অবাক চোখে তাকায় তুর্যর দিকে।
আচ্ছা থাক এই প্রশ্নটার উত্তর আপনাকে দিতে হবে না। আরেকটা প্রশ্ন করছি। মাস তিনেক আগে আপনাদের গোয়ালে আগুন লেগেছিল। একটা দুধের গাভি বাছুরসহ পুড়ে মারা গিয়েছিল। সেই কারণে কি আপনাদের কোনো ধরনের ঋণ মাফ করা হয়েছিল?
হ্যাঁ। একটা এনজিও থেকে আশি হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরুটা কিনেছিলাম। সেই টাকার অর্ধেক মাফ করে দেওয়া হয়েছিল।
গোয়ালে কোন সময়টাতে আগুন লেগেছিল?
সন্ধ্যাবেলা। তখন চারপাশে আঁধার নেমেছে মাত্র।
আপনি নেই সময়ে কোথায় ছিলেন?
আমি বাড়িতেই ছিলাম। কাজ করছিলাম।
কোথায় কাজ করছিলেন?
মালিনী ইতস্তত করে বলে, গোয়ালে।
আপনার স্বামী বলেছেন, আপনাদের সাথে কারও শত্রুতা আছে। সেই শত্রুতা থেকেই গোয়ালে আগুন দিয়েছে, ঘরে আগুন দিয়েছে। সেই শত্রু কারা?
আমাদের জমি নিয়ে তাদের সাথে বিরোধ। সেই কারণে হয়তো আমাদের মেরে ফেলতে চায় তারা।
আমি গতকাল সারা দিন আপনাদের এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। তাতে আমার মনে হয়েছে, সেই শত্রু শুধু আপনাকেই মারতে চায়। আপনার স্বামীকে না।
মালিনী চুপ করে থাকে। কথা বলে না।
আপনাকে ধাক্কাও দেওয়া হয়েছিল একবার। তাতেই কপালে দাগ হয়েছে, তাই না?
এ কথা আপনাকে কে বলেছে?
আমি জেনেছি যে ভাবেই হোক। কেউ হয়তো চায়, আপনি মরে যান। আপনি মরলেন, এনজিওর ঋণও মাফ হলো। এক ঢিলে দুই পাখি শেষ!
কেউ মারলে তো ভালোই। মালিনী উদাস স্বরে বলে। মাঝে মাঝে আমার নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে করে।
মরবেন কেন! নিজের জন্য হলেও বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবেন। অন্তত একা হলেও বেঁচে থাকুন। আমরা যাই। আপনি কিন্তু ভুলেও মরার কথা ভাববেন না।
৪
সন্দেহ করার মতো কিছু পেলি নাকি তুর্য? খালের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে মৃদুল প্রশ্ন করে।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুর্য গুনগুন করে গেয়ে উঠে— ‘নদীর ওপার পাখির বাসা, মনে বন্ধু বড় আশা...।’
কিরে তুর্য, আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গান গাচ্ছিস!
অত অস্থির হচ্ছিস কেন? কাজ মাত্র তো শুরু করলাম। শেষ করতে দে।... চল, বড় চোখওয়ালী মেয়েটার সাথে কথা বলি। দেখ—যেখানে দেখে গিয়েছিলাম, মেয়েটা এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওই মেয়ের সাথে কী কথা! দেখ দোস্ত, এটা কিন্তু ঢাকা না। মেয়েটা সিনক্রিয়েট করলে সমস্যায় পড়ব। যে কাজ করতে এসেছি, সেটা করাই ভালো।
আমার উপর আস্থা রাখ। দেখি, মেয়েটার চোখে কিছু দেখা যায় কি না।
আমি একটু আপনার সাথে সাথে কথা বলতে চাই।
আমার সাথে! আমার সাথে কী কথা? আমি কি আপনাকে চিনি?
না। চিনেন না। কিন্তু মানুষ প্রয়োজনে অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলে না?
তা বলে। আচ্ছা, আপনি কী জানতে চান বলুন।
আমি কিন্তু কিছু জানতে চাই নি। বলেছি, কথা বলতে চাই।
মেয়েটা একটু হকচকিয়ে যায়। বড় বড় চোখে তাকায় তুর্যর দিতে। মানে, আমার মনে হলো আপনি হয়তো কিছু জানতে চাইবেন। আপনাকে একটু আগে শৈলেনের বাড়িতে যেতে দেখলাম।
শৈলেন! অতবড় মানুষকে আপনি নাম ধরে ডাকেন নাকি?
মেয়েটি অবাক চোখে তুর্যর দিকে তাকিয়েই ছিল। বলে, নাম ধরে ডাকব কেন! উনি তো আমার খুড়ো। আপনার সাথে কথা বলছিলাম বলে নাম বলেছি।
আপনি কোত্থেকে দেখলেন যে আমরা শৈলেনের বাড়ি গিয়েছি?
ওই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই আমাদের বাড়ি। মাঝখানে শুধু খাল। বাড়ি থেকেই দেখলাম আপনাদের।
তার মানে তাল গাছে বাঁধা মাচাটায় বসলে আপনাদের বাড়ি দেখা যায়, তাই না?
মেয়েটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
আচ্ছা আপনার নাম তো তপু?
মেয়েটা কেমন চোখে তাকায় তুর্যর দিকে। হ্যাঁ, আমার নাম তপু। তপতী বালা তপু। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?
জেনেছি। নাম জানা তেমন কঠিন কিছু নয়। বয়স কত হবে আপনার?
মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। জানেন না?
জানি। কিন্তু আপনার মতো স্মার্ট মেয়েও ওসব মানে, তা জানতাম না।
ওমা, আমি যে স্মার্ট—সে কথা আপনাকে কে বলল?
আপনার সাথে কথা বলে, দেখে বুঝতে পারছি। বলবেন না, বয়স কত?
আমার বয়স আঠারো বছর সাত মাস।
আঠারো হয়ে গেছে? দেখে কিন্তু আপনাকে পনেরোর বেশি মনে হয় না।
তপু কিছু বলে না। সে এই তথ্য জানে। অনেকেই এই কথা বলেছে তাকে।
আপনি দেখতে খুব সুন্দর। আর কথা বলে যা মনে হচ্ছে, আপনার বেশ বুদ্ধিও আছে।
তপু একটু যেন অপ্রস্তত হয়। বলে, আপনি কি এসব বলার জন্যই আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন?
ধরুন তাই। কেন, আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে আপনার?
না খারাপ লাগবে কেন? অ্যাট্রাকটিভ পুরুষদের সাথে কথা বলতে আমার খারাপ লাগে না।
আমি অবশ্য অতটা অ্যাট্রাকটিভ না। ওই পোশাকে-আশাকে একটু স্মার্ট বলতে পারেন। তবে আমারও বুদ্ধি খারাপ না। সেটা মনে হয় অনেকটাই আছে।
মৃদুল ফিসফিস করে বলে, কী করছিস? এতক্ষণ মেয়েটার সাথে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। এটা তোর ক্যাম্পাস না। এমনিতে তুই আমার হয়ে তদন্ত করছিস। বস জানতে পারলে আমার চাকরিটাই থাকবে না।
চিন্তা করিস না। তোর চাকরি আরও পোক্ত হবে। আমি মেয়েটার সাথে খামোখা ফ্লার্ট করছি না। আমাকে কথা বলতে দে।... আচ্ছা তপু, যেদিন শৈলেনের বাড়িতে আগুন লাগে, ওইদিন রাত সাড়ে দশটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
অত রাতে কোথায় আবার থাকব! বাড়িতেই ছিলাম। নিজের রুমে।
শৈলেনের বাড়িতে কখন আগুন লেগেছে বলতে পারবেন?
মোটামুটি দেড়টার দিকে।
সময়টা আপনি জানলেন কী করে? ওই সময় তো আপনার ঘুমে থাকার কথা।
তপু যেন একটু চমকায়। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমার রুম থেকে আগুন দেখেছি। আমি একটু বেশি রাত করেই ঘুমাই। ফেসবুকে ছিলাম। আগুন লাগার সময়টা মোবাইলে দেখেছি।
আপনার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে বের হওয়া যায়, তাই না? তুর্য আন্দাজে একটা ঢিল ছোড়ে।
তুর্যর ছোড়া ঢিল জায়গা মতো লেগেছে। তপুর প্রতিক্রিয়ায় তা বোঝা যায়। সে অবাক চোখে তুর্যর দিকে তাকিয়ে থাকে।
বের হওয়া যায়, না?
তপু মৃদু স্বরে বলে, হ্যাঁ আমার রুমের জানলা দিয়ে বাইরে বের হওয়া যায়।
আপনার বাবা কী করে তপু?
মাছের ব্যবসা।
আপনারা ভাই বোন কয়জন?
আমরা চার বোন। ভাই নেই। আমি এখন বাড়ি যাব। আপনার সাথে আর কথা বলতে পারছি না।
তুর্যকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তপু চলে যায়।
ওই মেয়েকে কেন এতসব প্রশ্ন করলি তুর্য? মৃদুল জানতে চায়।
তোর কেইসে কামিনীর ছায়া আছে, তাই।
মানে! তোর কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। কামিনীর ছায়া মানে?
বুঝবি কী করে? তুই তো মেয়েদের চোখের ভাষা পড়তে পারিস না।
ওহ, কিসের মধ্যে কী যে বলিস তুই! কামিনী তো ফুলের নাম।
হ্যাঁ ফুলের নাম। আবার মেয়েদের নামও হয়। কিন্তু কামিনীর আরও অর্থ আছে। পড়ালেখা তো করলি না জীবনে! তোর সেসব না জানারই কথা। শোন, কামিনীর ছায়া পড়লে ভালো মানুষও বিগড়ে যায়। বুদ্ধিমান পুরুষও নির্বোধ হয়ে যায়। আবার বোকাও সাহসী হয়ে ওঠে। তবে যারা বুদ্ধিমান কিন্তু অভিজ্ঞ— তারা সহজে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তবে সেই কামিনী ফুলের গন্ধ নেওয়ার জন্য পথ তৈরি করে নেয়। শৈলেন তেমনই একজন মানুষ।
তোর কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আচ্ছা ওই মেয়ের রুমের জানলা দিয়ে যে বের হওয়া যায়, তা তুই কীভাবে জানিস? এই মেয়েকে তো তুই আজকের আগে দেখিসই নি!
ওটা আন্দাজে বলা। এখানে অনেক বাড়ির জানালা আমি দেখেছি, যেটাতে গ্রিল জাতীয় কিছু নেই। আন্দাজ মিলে গেছে।...তবে মেয়েটাকে আমি গতকালও দেখেছি। আচ্ছা তুই বল, মেয়েটা কি সুন্দরী?
আমার কাছে তো তেমন আহামরি সুন্দর মনে হচ্ছে না। কিন্তু তুই যেভাবে মেয়েটার প্রশংসা করলি! স্মার্ট। সুন্দর। হেনতেন।
দেখ, আমার কথা শুনে কিন্তু মেয়েটার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। অন্তত লজ্জা-টজ্জাও পায় নি।
তাতে কী হয়েছে? হয়তো সে তোর কথা বিশ^াস করে নি। ভেবেছে, বখাটে ছেলে অল্পবয়সী মেয়েকে একা পেয়ে পটানোর চেষ্টা করছে।
তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? ওই মেয়েকে পটিয়ে আমার কী লাভ? তবে ব্যাপার হলো, মেয়েটা আমার প্রশংসা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। তার মানে সে হয়তো নিয়মিত কারও কাছ থেকে প্রশংসা শোনে। প্রশংসা যে করে সে একজন পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পুরুষ! মানে কোনো ছেলে না?
এই তো তোর বুদ্ধি খুলেছে। অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত পুরুষ শব্দটা ব্যবহার করি না। যদিও তারাও পুরুষ।
সে বুঝলাম। কিন্তু সব মিলে কী হলো?
সব মিলে হলো— খালের ওপার পাখির বাসা, মনে বন্ধু বড় আশা।
কী হেঁয়ালি শুরু করলি বল তো! কেইসটার গতি কিছুটা বুঝতে পারলে সেটা বল প্লিজ।
কিছুটা না, পুরোটাই বুঝে গেছি আমি।
তাই! দ্রুত সব বল দোস্ত। আমার প্রথম থেকেই বিশ^াস ছিল তুই পারবি।
শৈলেনের রান্নাঘরের মেঝেতে কয়েকটা কাচের বোতল পড়েছিল। দেখেছিস?
আবার প্রশ্ন? হুম দেখেছি তো।
বোতলগুলো সব খালি ছিল। তার মধ্যে একটা হয়তো কেরোসিনের। আচ্ছা, মালিনী কী বলেছিল? এক বোতল কেরোসিনে তার কত দিন যায়?
প্রায় মাস চলে যায় বলেছিল।
আজকে মাসের কয় তারিখ?
এগারো তারিখ।
তার মানে, ওই বোতলে অন্তত অর্ধেক কেরোসিন থাকার কথা। সেটা ছিল না। অন্য বোতলের কোনোটাতে হয়তো রান্নার তেল ছিল। কিন্তু খালি ছিল সব বোতলই। আর আমরা জানি, যে-কোনো কিছুর ওপর তেল ছিটালে সহজেই আগুন ধরে।
তার মানে শৈলেনের ঘরের উপর তেল ছিটানো হয়েছিল?
হ্যাঁ, যাতে আগুনটা দ্রুত ধরে। আচ্ছা, বেড়ার গায়ে একটা সবুজ গামছা দেখেছিলি?
দেখেছি তো!
মালিনী শৈলেনের প্রিয় রং কী বলেছিল, মনে আছে তোর?
বলেছিল, সবুজ।
আচ্ছা, তুই খেয়াল করেছিস— তপুর হাতে কাচের চুড়ি ছিল।
চোখে তো পড়েছে। দু’ হাতেই চুড়ি ছিল। কিন্তু তোর এলোমেলো এসব প্রশ্নের মানে তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
আরেকটু অপেক্ষা কর, বুঝতে পারবি। ... সেই চুড়ি কী রঙের ছিল খেয়াল করেছিস?
স... সবুজ! আচ্ছা তুর্য, সামহাউ তুই ওই মেয়েটার সাথে শৈলেনের কোনো কানেশন তৈরি করছিস নাতো?
কানেকশন আমি কী করে তৈরি করব! যদি কানেকশন আগে থেকে থাকে, সেটা ভিন্ন কথা।
তার মানে তুই ভাবছিস কানেকশন আছে! নদীর ওপার...খালের ওপার পাখির বাসা...ওইটুকু মেয়ের বাপের বয়সী লোকটাকে নাম ধরে ডাকা। আই থিঙ্ক কানেশনটা আমিও ধরতে পেরেছি।...পথের কাঁটা দূর করতে বউকে পুড়িয়ে... সেজন্যই দুজনের টাইম ঠিকঠাক মনে আছে! তাই না?
গতকালকে সারাটা দিন আমি ম্যালা খোঁজ-খবর নিয়েছি। তোর কাছে যেটা ছিল অনর্থক ঘোরাঘুরি, সেটাই ছিল আমার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক। তখনই তপুর ব্যাপারে জানতে পেরেছি। আর শৈলেনের সাথে যাদের জমি নিয়ে বিরোধ, একাধিকবার মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে, তারা থাকে ঢাকায়। সেই তারা গত এক মাসেও বাড়ি আসে নি। শৈলেনের গোয়ালে যে আগুন লেগেছিল, সেটাও বাইরের কেউ লাগায় নি। সেটা ছিল শৈলেনের প্র্যাকটিস।
আগুনটা কি তাহলে তপুই দিল?
হতে পারে। অথবা দুজনে মিলে। অন্তত শৈলেন তো আছেই। ওই যে বেড়ার গায়ে সবুজ গামছা। আগুন দিয়ে সে-ই হয়তো বেড়া কেটে ঘরে ঢুকেছে।
ও মাই গড, কী সাংঘাতিক লোকটা! শুনেছি পুলিশ তদন্ত করেছে, তারা কিছু পায় নি?
সে কথা আমি কী করে বলব? তবে যতদূর জেনেছি, লোকটা ব্যাংক আর তোর প্রতিষ্ঠানেই গিয়েছে শুধু, পুলিশের কাছে যায় নি। তোর প্রতিষ্ঠান যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে। শৈলেনের ঋণ মওকুফের আবেদন অগ্রাহ্য হবে। এবার চল, আমাকে স্টেশনে দিয়ে আসবি। আমি সন্ধ্যার আগেই চলে যেতে চাচ্ছি। আর শোন শালা, কামিনী মানে নারী। এটা ক্লাস ফাইভে পড়া আমার ভাগিনাও জানে। আর আমাদের কামিনী হলো তপু।
Leave a Reply
Your identity will not be published.