সুরের আকাশের শুকতারা

সুরের আকাশের শুকতারা

আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর (২০১৮) প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস। ২৯ বছর আগে এই দিনে তিনি না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতি ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ এই লেখাটি পত্রস্থ করা হলো।

সত্যি বাংলা গানের দিগন্তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শুকতারার মতোই জ্বলজ্বল করছেন। তিনি নেই, অথচ তিনি আছেন। কেননা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরতে পরতে মিশে গেছে। তাঁকে ফেলা মানে নিজেদেরই কিছুটা জীবন ফেলে দেওয়া। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের যে অহংকার, রোমান্টিসিজম, তাই তিনি লালন করেছেন তাঁর কণ্ঠে। আমরা গানের মধ্যদিয়ে হৃদয়ের কথা বলার বাসনা করি, তা-ই তিনি মূর্ত করেছেন তাঁর কণ্ঠে, তাঁর গানে।

এ প্রসঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি: ‘আমার গানের জীবনের পঞ্চাশ বছরের পর আজ যদি জীবনের সেরা পঞ্চাশখানা গান কেউ খুঁজে বের করে দিতে বলে, তেমন লিস্ট যদি তৈরি করতে পারি (পারব যে না তা বিলক্ষণ জানি) তবে তার অধিকাংশই হবে প্রেমের গান।’

হেমন্তের গাওয়া প্রেমের গানগুলোর মধ্যে ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেল না, ‘আমি দূর হতে তোমাকে দেখেছি’, ‘ডাগর ডাগর চোখে’, ‘তুমি কি যে বলো বুঝি না’, ‘স্মরণের এই বালুকা বেলায়’, ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে’, ‘গভীর রাতে হঠাৎ জেগে’, ‘ও যদি রাধাই হলো’, ‘কত দিন পরে এলে’, ‘তুমি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছ’, ‘আজ দু’জনার দুটি পথ ওগো’ ইত্যাদি আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে।

তবে হেমন্তের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রেমের গান হচ্ছে ‘মনের জানালা উঁকি দিয়ে গেছে, যার মুখ তাকে আর মনে পড়ে না।’ সলিল চৌধুরী সুরারোপিত এ এমন একটি গান যেখানে প্রেমের একটি শব্দও ব্যবহৃত হয় নি।  জীবনের প্রথম রেডিও প্রোগ্রামে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে দুটি গান গেয়েছিলেন, সেখানেও ছিল প্রেমের ছোঁয়া। একটি ভাটিয়ালী, অন্যটি কবি বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী/বাণীময় নীলিমায় শুনি তব চরণধ্বনি’ (উল্লেখ্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় গানটি লিখেছিলেন কমল দাশগুপ্ত সুরারোপিত ‘তোমার হাসিতে জাগে নবীন প্রাণের বাসন্তিকা’ এই গানটির ছন্দের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে)।

এমনকি জীবনের প্রথম রেকর্ডেও রোমান্টিসিজমের প্রাধান্য। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত সেই রেকর্ডের দু’পিঠের গান দুটি ছিল: (ক) বলো গো বলো মোরে এবং (খ) জানিতে যদি গো তুমি পাষাণে কি ব্যথা আছে। (কথা: নরেশ্বর ভট্টাচার্য, সুর: শৈলেশ দত্ত গুপ্ত)।

শুধু তাই নয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী জীবনের প্রথম হিট গান ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোন’ (কথা: অমিয় বাগচী/ সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশকাল: ১৯৪৩ সাল)—এটিও কিন্তু একটি প্রেমের গান। এর পরই জয়যাত্রা শুরু হলো হেমন্তের। কেননা, তাঁর রয়েছে কণ্ঠের সরলতা। কেনো প্যাঁচগোচ, কায়দা দেখানো বাহাদুরি নেই। যা ওর নিজস্ব। এবং এই সিম্পলিসিটি অব এক্সপেশনের জন্যেই কী রবীন্দ্রসংগীত, কী আধুনিক—যে গানই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, আমাদের চুপ করে শুনতে হয়।

যা হোক, হেমন্তের প্রেমের গানগুলোর দিকে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক। আমরা যখন ‘কেন দূরে থাকো...’ এই গানটি শুনি, তখন আমাদের মননে ও শ্রুতিতে এমন এক প্রেমিক হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে যার জীবনের প্রথম প্রেমের রূপ অস্পষ্ট। যেন তাঁর প্রিয়া ‘পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়’, দূরে দূরে থাকে। আর সেই নেপথ্যচারিণীকে সে কাছে পেতে চায়। অবশ্য দূর থেকে প্রিয়াকে দেখে হৃদয়ে প্রেমের স্পষ্ট ছবি যে আঁকা হয় না, এমনও নয়।—‘আমি দূর হতে তোমাকে দেখেছি/আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি..’। তারপর যুগল জীবনের পথ চলার মাঝে পৃথিবীটাকে অন্য রকম মনে হয়: ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো/ যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।’ (কথা: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/ ছবি: সপ্তপদী)। প্রেম মুগ্ধ সেই অবস্থায় নীরবতার কথোপকথন শোনা যায়—‘তোমার আমার কারও মুখে কথা নাই, বাতাসের নাই সাড়া/জেগে জেগে যেন কথা বলে ওই দূর আকাশের তারা’। সেই আকাশভরা চন্দ্র তারার নির্জন রাত একান্তই নিজস্ব, শুধু দু’জনার—‘এ রাত তোমার আমার,’ (কথা: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার/ সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/ ছবি: দীপ জ্বেলে যাই)। কিন্তু এই মিলন তো ক্ষণস্থায়ী, তার পর...? হ্যাঁ, সুখের পরে দুঃখ, আনন্দের পরে বেদনার মতোই তারপর ‘বিরহ।’ স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন; ‘আমার মধ্যে আমি দু’টো জিনিসের খুব প্রভাব দেখতে পাই। এক বিরহ। আর দুই, গানের মধ্যে জোরালো রোমান্টিসিজম। এই দুটোর একটা থাকলেই আমার মধ্যে একটা শিহরণ জাগে, লোম খাড়া হয়ে ওঠে।’ (আমি যে গান গেয়েছিলেম/ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শারদীয়া আনন্দলোক, ১৩৮৮) হেমন্তের এই বিরহের গানগুলো আমাদের খুবই নাড়া দেয়। যেমন—‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোন’ ‘জানি জানি একদিন ভালোবেসেছিলে মোরে’, ‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’, ‘আকাশ মাটি ওই ঘুমালো ঘুমায় রাতের তারা’, ‘তোমার বিরহ চোখে আনে জল’ ‘গভীর রাতে হঠাৎ জেগে’, ‘এই ব্যথা কি যে ব্যথা’, ‘স্মরণের এই বালুকা বেলায় চরণ চিহ্ন আঁকি’ ইত্যাদি।

আমরা যখন শুনি ‘আজ দু’জনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে/তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি, আমার এ পথ আঁধারে গেছে যে ঢেকে...’ (কথা: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার/ সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/ ছবি হারানো সুর)। তখন কি আমার আলোড়িত হই না? আমাদের কারও কারও হৃদয় কি বেদনায় কাতর হয় না? স্মৃতি জাগানিয়া এই গান কি তার কথা মনে করে দেয় না ‘যে নাকি শপথের মালা খুলে চলে গেছে দূরে।’ হ্যাঁ, আমরা তখন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই: ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে/স্মৃতি যেন আমারই হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে...’(কথা: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার/ সুর: হেমন্ত মুখেপাধ্যায়/ছবি: লুকোচুরি)। আমাদের মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা, যে দিনগুলো গানে গানে মুখর ছিল; মনে পড়ে যায় দুজনার সেই সুখ স্মৃতির কথা, যখন প্রাণে প্রাণে মিলন ছিল। যদিও আজ সেই মধুর মিলন মেলা ভেঙে গেছে; ভেঙে গেছে সেই হাসি আর রঙের খেলা—তবু তাকে তো ভোলা যায় না।—‘বসে আছি পথ চেয়ে/ ফাগুনের গান গেয়ে/ যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না, মন মানে না....’(কথা: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার/সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/ ছবি: শাপমোচন)। হ্যাঁ, ‘বেদনার শতদলে/স্মৃতির সুরভি জ্বলে...’ এবং ‘পাওয়া না পাওয়ার মাঝে/অচেনার সুর বাজে...’ তবু ‘তুমি ওগো তুমি মোরে/বেঁধেছ কি মায়া ডোরে/সে বাঁধনে দু’নয়নে ঘুম আসে না...।’

এমন ভাবে বাঙালিরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে নিজেদের সুরময় অস্তিত্বকে নানাভাবে শনাক্ত করে। কখনো দূর থেকে মানসী প্রিয়াকে মুগ্ধ চোখে দেখে; যুগল জীবনের পথচলার মাঝে পৃথিবীটাকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে অনুভব করে; ফাগুনের গান গেয়ে প্রিয়ার পথ চেয়ে বসে থাকে; কখনো মুছে যাওয়া ফেলে আসা দিনগুলোকে বারবার স্মরণ করে; মনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সুরের আকাশের শুকতারাটিকে অভিনন্দন জানায়; কখনো একগুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে প্রাণের দোসর খুঁজে নিতে প্রেমমুগ্ধ হৃদয়ে ভালোবাসার অমৃতের সন্ধান করে।

তাই তো ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্যক্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হলেও, শিল্পী হেমন্ত মুখেপাধ্যায়ের মৃত্যু নেই। সেই যে তাঁর একটি গান রয়েছে না ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে/পান্থপাখীর কূজন কাকলি ঘিরে/ আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোন/আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে/ তবু আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে...।’

হ্যাঁ, তাঁর গানের স্বরলিপি বাঙালি হৃদয়ে চিরদিন লেখা থাকবে। কেননা ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’ এই আক্ষেপ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নয়; ‘সারা আকাশ এমন’ গানে গানে যিনি ভরিয়ে দিয়েছেন— তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসার অন্ত নেই।

Leave a Reply

Your identity will not be published.