চার শ’ বছরের পুরনো সেই মোঘল আমল থেকে আমাদের ঢাকা শহর নানারকম মুখরোচক খাবারের জন্য বিখ্যাত। বিশেষত ঢাকার নবাবদের হাত ধরে মোঘলদের নানা পদের মুখরোচক সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিচিত হয় আমাদের আদি ঢাকাবাসী।
ঢাকার নবাবদের আদিনিবাস ছিল কাশ্মীরে। তারা মোঘলদের কাছ থেকে পাওয়া খাদ্যসংস্কৃতি ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ঢাকার নবাবরাই মূলত ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। পুরনো ঢাকার বিরিয়ানি, তেহারি, নিহারি, কোরমা, পোলাও, কোপ্তা, কালিয়া, রমজানের রকমারি ইফতারি, অন্যদিকে বিকেলের খাবারের মধ্যে হরেকরকম কাবাব, মোগলাই পরাটা, তন্দুর রুটি, নান রুটি, হালিম, বাকরখানি, মালাই চা, লাচ্ছি শরবত, ফালুদা, মাঠা, ছানা, জর্দা, ফিরনি থেকে শুরু করে আরও অনেক পদের খাবার পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যকে এখনো কেউ পেছনে ফেলতে পারে নি।
ঢাকার অনেক অধিবাসী এখনো তেহারি, বিরিয়ানি, নিহারির সাথে নান রুটি ছাড়া সকালের নাস্তা করে না। ঢাকাইয়াদের কাছে উপরোক্ত খাবার ছাড়া জীবন অর্থহীন। এটা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ। সেখানকার অনেক বাসাবাড়িতে এখনো সকালের নাস্তা বাসায় তৈরি করা হয় না, বাইরে থেকে কিনে এনে খেতে ওরা অভ্যস্ত। ঠিক যে কারণে সকালের দিকে পুরনো ঢাকার নাস্তার হোটেলগুলোর সামনে প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ করা যায়। সকালের নাস্তা ছাড়াও পুরনো ঢাকার অনেক বাসিন্দা তিন বেলার খাবারও হোটেল থেকে কিনে খেতে ভালোবাসে কিংবা পছন্দ করে থাকেন। মোট কথা অধিকাংশ আদি ঢাকাবাসী হোটেলের খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
হতাশার বিষয়, সময়ের পরিক্রমায় পুরনো ঢাকার অনেক জনপ্রিয় খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। সেইসব খাবারের দক্ষ কারিগরদেরও আজকাল তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাচ্ছে এমন মজাদার খাবারের তালিকা বেশ বড়। এখানে কয়েকটির কথা তুলে ধরা হলো—
১। নামাস: তীব্র শীতের সকালে ঢাকাবাসী এই খাবারটি খেতেন। খাঁটি গরুর দুধ একটি পাত্রের ভেতর ঢেলে সেই পাত্রটি একটি পরিচ্ছন্ন কাপড় দিয়ে ঢেকে সারা রাত বাড়ির বাইরে রেখে দেয়া হতো। খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগে সেই দুধে চিনি মিশিয়ে একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে সেই পাত্রের দুধ ভালো করে ঘোটা দিলে দুধ থেকে ফোমের মতো ক্রিম বের হয়ে আসত। সেই ফোমযুক্ত ক্রিমগুলো পাত্র থেকে সংগ্রহ করে সকালে খাওয়া হতো। বর্তমানে পুরনো ঢাকার বংশাল, নাজিরাবাজার ও লালবাগ এলাকায় সকালে গরুর দুধ থেকে তৈরি মাঠা ও মাখন বিক্রি করতে দেখা যায়। এই মাঠা মানুষের শরীর ও পেট ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। খাঁটি দুধের অভাবে আজকাল মাঠা ও মাখনের স্বাদ ও গুণাগুণ কমে গেছে। ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্র সরোবরের কাছে সকালে লালবাগ থেকে আসা একজন লোককে মাঠা বিক্রি করতে দেখা যায়। ভেজালের এই যুগে মাঠার ঘনত্ব ও স্বাদ ঠিক আগের মতো নেই।
২। খাসির গ্লাসি: পুরনো ঢাকার জনপ্রিয় এই খাবার মেন্যু খাসির মাংসের বড় আকারের টুকরো দিয়ে কোর্মার মতো করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করে প্লেইন পোলাও দিয়ে খাওয়া হয়। এই রান্নাটি এখনকার বাবুর্চিরা সঠিকভাবে করতে পারে না। এক সময় পুরনো ঢাকার লায়ন সিনেমা হলের কাছে ‘পাগলা বাবুর্চি’ নামে পরিচিত এক রান্নার কারিগর নিপুণ হাতে অত্যন্ত সুস্বাদু এই খাসির গ্লাসি রান্না করতেন। তার মৃত্যুর পর সেই স্বাদ ও মানের গ্লাসি এখনো কেউ রান্না করতে পারে নি। পাগলা বাবুর্চির রান্না করা খাসির গ্লাসির স্বাদ যারা একবার পেয়েছেন একমাত্র তারাই বলতে পারবেন পার্থক্যটা কত বড়।
৩। ঢাকার পনির: সুস্বাদু এই জনপ্রিয় খাবারটি খেতে ঢাকাবাসী বেশ অভ্যস্ত। বিকেলের নাস্তায় বাকরখানি কিংবা অন্য খাবারের সাথে পনির খেতে সবাই পছন্দ করে। পুরনো ঢাকার প্রায় প্রতিটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের খাবারের মেন্যুতে পনিরের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। মূলত: ঢাকা শহরে পনির আসে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থেকে। ঢাকার বাজারে পনির এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গেলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পনিরের মান ও স্বাদ ঠিক আগের মতো নেই।
৪। টেক্কা: ঢাকা শহরের একসময়ের জনপ্রিয় খাবারের নাম হচ্ছে টেক্কা। খাসি কিংবা গরুর মাংসের রান থেকে টেক্কার মাংস সংগ্রহ করে প্রথমে কাঁটাচামচ দিয়ে মাংসের টুকরোগুলোকে অসংখ্যবার ঘাঁই দিয়ে নরম ও ছিঁদ্র করা হয়। তারপর এই মাংসের টুকরোগুলোর ওপর নানা ধরনের প্রয়োজনীয় সুঘ্রাণযুক্ত মসলার আবরণ মিশিয়ে মাটির তৈরি তন্দুর চুলার ভেতরে রোস্ট করা হয়। মাংস শেঁকানো শেষে এই মাংসগুলোকে তন্দুর চুলা থেকে বের করে ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো করে খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয়। মসলার সুবাসিত এই টেক্কাগুলো খেতে অনেক সুস্বাদু হলেও কালের বিবর্তনে জনপ্রিয় এই খাবারটি এখন আর কোথাও দেখা যায় না।
৫। মিষ্টি: নানারকম সুস্বাদু মিষ্টির জন্য ঢাকা একসময় বিখ্যাত ছিল। এসব মিষ্টির মধ্যে মুকুটি, নেসাস্তা, ক্ষির, পায়েস, চালের পুডিং-এর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। মুকুটি ও নানা রঙের সাজানো নেসাস্তা ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলোতে এখন আর আগের দিনের মতো চোখে পড়ে না। বছর কুড়ি আগে টিকাটুলির একটা বড় মিষ্টির দোকানে মেসেস্তা বিক্রি হতে দেখেছি।
৬। নিহারি: নিহারি শব্দের অর্থ প্রভাত। এটি ফার্সি শব্দ। পুরনো ঢাকায় নিহারি একটি জনপ্রিয় সকালের নাস্তার ডিস। অত্যন্ত সুস্বাদু এই নিহারি প্রস্তুত করতে খাসির পায়ের গোড়ালির হাড়গুলো একটি পাতিলে করে সারা রাত হালকা আগুনে জ্বাল দিয়ে রেখে দিলে সকালে সুস্বাদু নেহারি খাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এই সুবাসিত গন্ধযুক্ত নেহারি ভোজনরসিকরা সকালবেলা অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকেন। সকালের নাস্তার জনপ্রিয় এই ডিসটি তৈরি করার প্রক্রিয়াটি অনেক কঠিন ও কষ্টসাধ্য হওয়ার কারণে ঢাকাবাসীদের খাদ্য তালিকা থেকে এই ডিসটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
৭। কাশ্মীরী চা: ঢাকার বিখ্যাত কাশ্মীরী চা সাধারণত মিষ্টি অথবা হালকা লবণাক্ত হয়ে থাকে। একটি পাত্রে গ্রীন টি, ক্রিম, বেকিং সোডা ও চিনির সাথে পানি মিশিয়ে ঘণ্টাখানেক সময় জ্বাল দিয়ে কাশ্মীরী চা তৈরি করা হয়। চায়ের রং হয় হালকা পিংক ধরনের। এই চা অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। মানুষের শরীরের ক্লান্তি দূর করে ও মনকে চাঙা করে তোলে।
৮। ক্রাস: এটা অত্যন্ত সুস্বাদু মচমচে একটি জনপ্রিয় বিস্কুট। এই বিস্কুট তৈরির সময় ভেতরের স্তরে মাংসের চর্বির টুকরো বসিয়ে তন্দুর চুলায় বেক করা হয়।
৯। মুটানজান: এটা মূলত একটি ডেজার্ট ধরনের খাবার। একটি পাতিলে পরিমাণমতো পানি ঢেলে তার মধ্যে শুকনো খেজুর, চাল, চিনি, ও সুঘ্রাণযুক্ত জাফরান মিশিয়ে অত্যন্ত মজাদার এই খাবারটি তৈরি করা হয়ে থাকে।
১০। চিংড়ির মালাইকারী: পুরনো ঢাকার জনপ্রিয় খাবার তালিকার মধ্যে চিংড়ির মালাইকারীকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গলদা চিংড়ি গরম তেলে ভেজে তারপর ভাজা মাছগুলোর ভেতর লম্বা কাঠি ঢুকিয়ে গাওয়া ঘি, দুধের মালাই, পাউডার দুধ ও নানা রকম মসলার সাথে জাফরানের জল মিশিয়ে মজাদার এই চিংড়ির মালাইকারী তৈরি করে প্লেইন পোলাওয়ের সাথে পরিবেশন করা হয়। অতিথি আপ্যায়নে এই মালাইকারীর জুড়ি মেলা ভার।
উপরে উল্লেখিত পুরনো ঢাকার অধিকাংশ সুস্বাদু খাবারগুলোই কালের স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক খাবার ঢাকার ইংলিশ রোডে অবস্থিত ‘হোটেল আল-রাজ্জাক’-এ এখনো রান্না করে পরিবেশন করা হয়। নতুন ও পুরনো ঢাকার ভোজনরসিক বহু মানুষ হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় এইসব খাবারের স্বাদ নিতে প্রায়ই এই হোটেলে এসে ভিড় জমায়। ঢাকাবাসীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকাইয়া খাবারগুলো যেন কখনো হারিয়ে না যায়, সেইজন্য মাঝেমধ্যে পুরনো ঢাকায় বড় আকারে খাদ্য উৎসবের আয়োজন করলে নতুন প্রজন্মের ঢাকাবাসী তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারবে এবং তাদের খাদ্যসংস্কৃতির বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যকে বংশপরম্পরায় ধরে রাখতে পারবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.