রজতজয়ন্তী বর্ষে দাঁড়িয়ে ‘অন্যদিন’ আরও অনেক কিছুর মতো গর্ব করতে পারে কয়েক বিশিষ্ট বাঙালি স্মরণে কিছু বিশেষ স্মরণসংখ্যার জন্য। তাঁদের মধ্যে কারও কারও প্রয়াণের আগেই জন্মদিন বা বিশেষ বই-প্রকাশ উপলক্ষেও দু’একটি স্মারক-সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে ‘অন্যদিন’ স্মরণের আবরণে ঢেকে রাখতে চেয়েছে মরণেরে, সৃষ্টির স্মৃতিতে জাগরূক রাখতে চেয়েছে প্রয়াত প্রিয়দের। এসব সংখ্যায় স্মৃতিচারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিবিড় বিশ্লেষণী লেখা, নিবেদিত কবিতার পাশাপাশি স্থান পেয়েছে দুর্লভ আলোকচিত্রমালা, প্রাজ্ঞ প্রবীণদের সঙ্গে লেখক-তালিকায় এসেছেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা। গুণে-মানে আর অন্তর্সম্পদে অন্যদিন স্মরণ ও স্মারকসংখ্যাগুচ্ছ হয়ে উঠেছে পাঠক এবং গবেষকের মূল্যবান সংগ্রহ।
২
কালজয়ী কথাকার হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশাতেই ‘অন্যদিন’-এর অনেক বিশেষ আয়োজন হয়েছে তাঁকে এবং তাঁর বই ঘিরে। তবে ২০১২ সালে তাঁর প্রয়াণোত্তর ১৭ বর্ষ, সংখ্যা ১৪ প্রকাশ পায় বিশেষ ‘হুমায়ূন আহমেদ স্মরণসংখ্যা’ রূপে। দেড় শতাধিক পৃষ্ঠার এ অসাধারণ সংখ্যাটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র অবলম্বনে। এই সংখ্যার সূচিতে হুমায়ূন-স্মরণে সমবেত হয়েছেন এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বরেণ্যজনেরা; যেমন—আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুশ শাকুর, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, গোলাম মুরশিদ, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ইমদাদুল হক মিলন, নাসরীন জাহান, জুয়েল আইচ, হরিশংকর জলদাস, ধ্রুব এষ, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম, সিরাজুল কবির চৌধুরী, আবদুল্লাহ্ নাসের, মোমিন রহমান প্রমুখ। তাঁর উপন্যাস, গল্প, চলচ্চিত্র, গান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলজীবন, প্রবাসযাপন, জীবন, মৃত্যু, ধর্মচেতনা এমনকি তাঁর ‘বডিগার্ড’ নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনা পাওয়া যাবে এই সংখ্যার সীমানায়। ‘সম্পাদকীয়’-তে উদ্ধৃত বাক্য-কতকে দৃষ্টি দিলে মনে হবে অত্যন্ত সঙ্গত এমন উচ্চারণ:
“হুমায়ূন আহমেদ স্মরণসংখ্যায় গুণীজনেরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন করেছেন, স্মৃতিতর্পণ করেছেন নানাভাবে। তাঁর ঘনিষ্ঠজনের লেখাও অন্তভুর্ক্ত হয়েছে এই সংখ্যায়, যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন জীবনের নানা পর্যায়ে। এই আয়োজন থেকে পাঠকেরা ব্যক্তি আর শিল্পী হুমায়ূনের নতুন কিছু পরিচয় পাবেন, এ বিশ্বাস আমাদের।”
একই বছর অর্থাৎ ২০১২-তেই প্রয়াত বাংলা ভাষার কিংবদন্তি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়াত হলে বর্ষ ১৭, সংখ্যা ১৯ অন্যদিন প্রকাশিত হয় ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণসংখ্যা’ হিসেবে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে:
‘লেখক হিসেবে সুনীল আকাশের মতো বর্ণিল হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চিরটা কাল একই রকম থেকেছেন। তবে কখনো তিনি পুরোনো হন নি। সুনীল ছিলেন চিরনবীন।’
চিরনবীন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চকিত দেখা মিলবে স্বয়ং সুনীলের ‘আত্মপ্রকাশ’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক গদ্য আর সেই সঙ্গে তাঁর প্রাণের বন্ধু বেলাল চৌধুরী, সুনীল-সঙ্গী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, ফরিদুর রেজা সাগর, হারিসুল হক, তারিক সুজাত, শাকুর মজিদ, সাকিরা পারভীন, মাজহারুল ইসলাম, মোমিন রহমানের লেখায়। সুনীল স্মরণে কবিতা লিখেছেন রবিউল হুসাইন ও পিয়াস মজিদ। ‘শেষ যাত্রায় বাংলাদেশের হয়ে খাটিয়ায় কাঁধ দিয়েছিলাম’ শিরোনামে হৃদয়দ্রাবী স্মৃতিলেখে বেলাল চৌধুরীর অশ্রুর অক্ষর এই সংখ্যার অক্ষয় সম্পদ:
‘অন্তিম মুহূর্তে শবাধার থেকে নামামোর সময় খানিকটা হলেও তার খাটিয়ায় কাঁধ দিলাম। ওর পরের মুহূর্তগুলি আমি আর ভাবতে চাই না। সমুখে শান্তিপারাবার, চারপাশে সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতে মুখরিত বিদ্যুৎ চুল্লীতে ঢোকানোর মুহূর্তে এক ঝলক তার সেই বলিষ্ঠ চাঁদপানা মুখাবয়বে সুগভীর প্রশান্তি, সঙ্গে আর কি কোনো কবিতার বিদ্যুৎ ঝলকানো পঙ্ক্তির মায়াবী আলো জড়িয়ে ছিল?’
‘অন্যদিন’ স্মরণসংখ্যায় লেখা ও রেখার সৃজনকারেরা আলোচিত, স্মরিত হয়েছেন সমান গুরুত্বে। তাই তো, অনন্য চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর আকস্মিক প্রয়াণের অব্যবহিত পর ‘পথিকৃতের প্রস্থান’ প্রচ্ছদ-আয়োজনে শিল্প-সমালোচক আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর আত্মজৈবনিক আলাপনের প্রকাশ ঘটে। আবুল হাসনাতের সঙ্গে আলাপনে আরও যুক্ত ছিলেন মাজহারুল ইসলাম ও মোমিন রহমান। এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলার প্রিয় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর দেওয়া এমন উত্তর তাঁর দেশগত শিল্পসত্তাকে মূর্ত করে আমাদের কাছে:
‘আমি কোনোরকম হতাশ নই কারণ বাংলাদেশে আমরা যা করেছি এবং সেগুলো করতে যে সমর্থন পেয়েছি তা অনেক কিছু। আমরা চেষ্টা করেছি যে আমাদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে কালটাকে ধরে রাখার।’
বর্ষ ১৯, সংখ্যা ২১ (১-১৫ ডিসেম্বর ২০১৪)-এর এই তাৎক্ষণিক শ্রদ্ধার্ঘ্যর পর একটু বিরতিতে বর্ষ ২০, সংখ্যা ৫ (১৬-৩০ এপ্রিল ২০১৫) প্রকাশ পায় পূর্ণাঙ্গ ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণসংখ্যা’ হিসেবে। সংখ্যাটি সমৃদ্ধ হয়েছে আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, হাসান আজিজুল হক, মুস্তাফা মনোয়ার, তাহেরা খানম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক, মনসুর উল করিম, শিশির ভট্টাচার্য, লুভা নাহিদ চৌধুরী আর ধ্রুব এষের লেখায়।
কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিশ্বখ্যাত নাট্যজন উইলিয়াম শেকসপিয়ারের কালোত্তীর্ণ নাটক ‘হ্যামলেট’-এর বাংলা রূপান্তর সম্পন্ন করলে, এই অসাধারণ সাহিত্য-ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘অন্যদিন’ বর্ষ ২১, সংখ্যা ১৪ (১-১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬) প্রকাশ করে “সতত সৃষ্টিশীল সৈয়দ শামসুল হক: এবার ‘আমার হ্যামলেট” শীর্ষক বিশেষ সংখ্যা। সম্পাদকীয়তে যথাব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে এক লেখকের একটি বইকে ঘিরে এই প্রথা-অচেনা আয়োজন নিয়ে:
“বাংলা ভাষার শেকসপিয়ারের নাটকের সেরা অনুবাদকও তিনি। এর প্রমাণ তিনি রেখেছেন অতীতে, অতি সম্প্রতি রাখলেন ‘হ্যামলেট’ অনুবাদ করে।। মাত্র ১৭ দিনে এই অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন তিনি—গত ২ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই এই সময়ে। অন্যদিন-এর এবারের প্রচ্ছদ রচনা গড়ে উঠেছে এই ‘হ্যামলেট’-কে ঘিরেই।”
অনুবাদ প্রসঙ্গে সৈয়দ হকের ‘সবিনয় নিবেদন’ আর ‘হ্যামলেট’ অনুবাদক সৈয়দ শামসুল হক এবং এই অনূদিত ভাষ্যের নির্দেশক আতাউর রহমানের সঙ্গে নাট্যবিদ শফি আহমেদের আলাপন সংখ্যাটিকে অবশ্য-সংগ্রহশীল করে তুলেছে।
এর কিছুকাল পর সৈয়দ হক প্রয়াত হলে বর্ষ ২১, সংখ্যা ২১ (১-১৫ জানুয়ারি, ২০১৭) ‘অন্যদিন’ অবয়ব ‘সৈয়দ শামসুল হক স্মরণসংখ্যা’র। অপ্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ, অপ্রকাশিত উপন্যাসের ভূমিকাংশ, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, সৈয়দ হক-হুমায়ূন আহমেদ আলাপনের আকর্ষক আয়োজনের পাশাপাশি তাঁর জীবন ও সাহিত্যে অবলোকনের আলো ফেলেছেন— বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসনাত আবদুল হাই, আনোয়ারা সৈয়দ হক, রশীদ হায়দার, মফিদুল হক, আলী ইমাম, আতাউর রহমান, শফি আহমেদ, শান্তনু কায়সার, ফরিদুর রেজা সাগর, অনুপম হায়াৎ, মহীবুল আজিজ, মোমিন রহমান, মোস্তফা তারিকুল আহসান, এস.এম.আব্রাহাম লিংকন, কবির বকুল, অনন্ত হিরা, পিয়াস মজিদ, পূজা সেনগুপ্ত। ‘নিবেদিত কবিতা’ পর্বে যুক্ত হয়েছেন রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, শিহাব সরকার, মো.আব্দুল মান্নান। সৈয়দ শামসুল হকের বইবিশ্ব নিয়ে কাজী জাহিদুল হকের প্রামাণ্যপঞ্জি এ সংখ্যার বিশেষ সংযোজন।
‘অন্যদিন’ এর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ স্মারণিক আয়োজন ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিসংগ্রামী, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে নিয়ে। যদিও তাঁর আয়ুসীমার আশি-অতিক্রান্তির শুভলগ্নে বর্ষ ২২, সংখ্যা ১৬-তে প্রকাশিত হয়েছে ‘আনিসুজ্জামান সময়ের বাতিঘর’ হিসেবে। এই সংখ্যায় লিখেছেন ফজলে হাসান আবেদ, সনৎকুমার সাহা, আবুল আহসান চৌধুরী, বেগম আকতার কামাল, সৈয়দ আজিজুল হক, শফি আহমেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ। রয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের নিবেদিত কবিতা এবং আনিসুজ্জামানের গ্রন্থপঞ্জি। আবদুল্লাহ্ নাসের আর মোমিন রহমানের অনুসন্ধানে উঠে আসা ‘প্রবাসী আনিসুজ্জামান’ এই সংখ্যাকে করেছে বিশেষ বর্ণময়।
আনন্দধারার পর আসে বেদনার গাথা। তাই বর্ষ ২৫, সংখ্যা ৬ (সেপ্টেম্বর ২০২০) ‘অন্যদিন’ প্রকাশ করতে হয় ‘আনিসুজ্জামান স্মরণসংখ্যা’- রূপে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা-দুর্যোগের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অন্যদিন-এর সম্পাদনা পর্ষদ ও এর কর্মীদের অন্তর-যোগে ও সশ্রম প্রেমে প্রকাশ সম্ভব হয় আনিসুজ্জামান স্মরণে এই তাৎপর্যবহ সংখ্যাটি। তাঁর জীবনসঙ্গী সিদ্দিকা জামানের ‘আমার বিপুলা পৃথিবী’ শীর্ষক ধারাবাহিক রচনার প্রথম কিস্তি পাঠকের জন্য সম্মোহক করেছে সংখ্যাটিকে। আনিসুজ্জামান-তনয় আনন্দ জামান, ক্লিনটন বুথ সিলি শামসুজ্জামান খান, রওনক জাহান, সমরেশ মজুমদার, চিন্ময় গুহ, ভূইয়া ইকবাল, সেলিনা হোসেন, আবুল আহসান চৌধুরী, আবুল হাসনাত, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, ইমদাদুল হক মিলন, আবুল মোমেন, ফরিদুর রেজা সাগর, গোলাম কুদ্দুছ, মারুফুল ইসলাম, পিয়াস মজিদ প্রমুখের লেখা স্থান পেয়েছে এই সংখ্যায়। শোকার্ত সম্পাদকীয়তে উল্লেখিত হয়েছে এমন আশাবাদ:
“দীপ্র মনীষা আনিসুজ্জামান, ‘অন্যদিন’ পরিবারের একজন, তিনি আমাদের চেতনার আকাশে চিরদিন জ্বলজ্বল করবেন। তাঁকে ঘিরে প্রকাশিত হলো এই স্মরণসংখ্যাটি। এখানে গুণীজনেরা তাঁর লেখালেখি, গবেষণাকর্ম এবং নানাক্ষেত্রে অবদানের মূল্যায়ন করেছেন; স্মৃতিতর্পণ করেছেন নানাভাবে। এ আয়োজন থেকে পাঠকেরা ব্যক্তি এবং লেখক-গবেষক আনিসুজ্জামানের নতুন কিছু পরিচয় পাবেন।”
‘অন্যদিন’ এর আর সব স্মরণসংখ্যার মতোই এ সংখ্যার ঋদ্ধ পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হবে, এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলা হয় নি ‘সম্পাদকীয়’তে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.