‘অন্যদিন’ নামটাই বলে দেয় এই পত্রিকা আর পাঁচটার তুলনায় ভিন্ন; সে ‘অন্য’ কিন্তু তাই বলে ইংরেজি ‘দি আদার’ যেমন তাচ্ছিল্যের মতো শোনায় কিংবা কৃপার বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত দেয় তেমন কিছু তুচ্ছ বা নিকৃষ্ট নয়। ‘অন্যদিন’ অন্যদের চেয়ে শ্রেয় কিনা তাও বলে না, সেই বিবেচনা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পাঠকের ওপর। ‘অন্যদিন’ বিনয়ের সঙ্গে বলতে চেয়েছে পত্রিকা হিসেবে তার পরিচয় ভিন্ন, কেননা গতানুগতিকতা পরিহার করে চলার সংকল্প রয়েছে তার। গতনুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছে ‘অন্যদিন’ যা পাঠককে দেবে ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। কিছুটা হলেও এই ভিন্ন অভিজ্ঞতা পাঠকের জীবনকে বদলে দিতে পারে, এমন একটা আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি প্রচ্ছন্ন রয়েছে নামটায়। নামে কী আসে যায়? যায়, যায় অন্যদিন-এর পৃষ্ঠাগুলো পড়লে সেই উপলব্ধি হতে দেরি হয় না।
অনেকদিন থেকে ‘অন্যদিন’ নামটা গল্প-উপন্যাসের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। কথাসাহিত্যে এর লক্ষ্য ও বিষয় সময়কে নিয়ে, এমন এক সময়ের বর্ণনা থাকে গল্প-উপন্যাসে যা বর্তমানের চেয়ে পৃথক, পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে যার তুলনা করা যায় না। এইদিক দিয়ে পত্রিকা হিসেবে ‘অন্যদিন’-এর মিল রয়েছে কথাসাহিত্যে একই নামের কোনো বইয়ের সঙ্গে। কিন্তু এই মিল কেবল উপরিতলের, সুপার ফিশিয়াল, কেননা অন্যদিন পত্রিকা যেমন বর্তমানের বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে, একই নামের উপন্যাস তেমন করে নয়; শেষেরটি বাস্তব নয়, কল্পনার সৃষ্টি। যা হতে পারে সে কথা বলে ‘অন্যদিন’ নামের কোনো উপন্যাস। অপরদিকে ‘অন্যদিন’ বলে যা হয়েছে বা হচ্ছে সেই চলমান বাস্তবতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা। এই ভবিষ্যৎ অদূর নয়, সুদূর তো নয়ই, একেবারে হাতের কাছে যা ইচ্ছা করলে ধরতে পারা যায়। পার্থক্যটা এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে ‘অন্যদিন’ জীবনযাপনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করার উদ্দেশ্যে, পাঠককে কিছু বিষয় সম্বন্ধে অবহিত করতে চায় যেন বিষয়গুলোর বক্তব্য তাদের বোধগম্য হওয়ার পর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আরও আনন্দময় হয়ে উঠে। হ্যাঁ, ‘অন্যদিন’ পত্রিকা জীবনযাপন শৈলীকে আরও একটু উন্নত, পরিশ্রুত এবং তৃপ্তিদায়ক করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ছাপা হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছাচ্ছে।
১৯৯৬ সালে ‘অন্যদিন’ যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে সেই সময় লাইফস্টাইল বা জীবনযাপন শৈলী বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা ছিল না। যেসব পত্রিকা ছিল শ্রেণি বিভাগ করলে সেগুলি সমসাময়িক ঘটনাভিত্তিক, সাহিত্য এবং বিনোদনমূলক, এই তিন শ্রেণিতে পড়ে। ‘অন্যদিন’-ই প্রথম লাইফস্টাইল পত্রিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের পাঠকের সামনে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গল্প-উপন্যাসের মতো কল্পিত এক সুখী ও প্রসন্ন সময়ের কথা বলার জন্য না, সমকালীন জীবনেই নতুন ছন্দযোগ এবং আরও ভালোভাবে জীবন উপভোগের সম্ভাবনার কথা বলতে এসেছে ‘অন্যদিন’। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জীবন-যাপনকে আনন্দময় এবং তৃপ্তদায়ক এক অভিজ্ঞতা করে তোলা। এর ফলে পাঠকের দৈনন্দিন জীবন সম্পূর্ণ বদলে যাবে না, তবে সেখানে নতুন কিছু থাকবে যা আগের তুলনায় জীবন উপভোগকে করে তুলবে স্নিগ্ধতর, আরও সুন্দর এবং কিছুটা বেশি করে স্মরণীয়। পুনরাবৃত্তিতে মলিন হয়ে যাওয়া রুটিন অভ্যাস একেবারে বর্জন না করে সেগুলি পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে আরও বেশি তৃপ্তিদায়ক করে তোলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল ‘অন্যদিন’ আজ থেকে ২৫ বছর আগে। খুব বাড়তি ব্যয় না করে, বিদ্যমান আর্থিক সঙ্গতির ভেতর থেকেই জীবনচর্চা বা লাইফস্টাইলকে আরও উপভোগ্য করে তোলা যায় কেবল নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্যম এবং সৃজনশীলতার সাহায্যে সে কথা জানিয়েছে অন্যদিন তার পাঠককে প্রথম দিন থেকেই। যাপিত জীবনে যা করা হয়ে থাকে সে সবের ভেতরই রয়েছে জীবনযাপন শৈলী বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা, এর ওপর জোর দিয়েছে ‘অন্যদিন’ তার পাতায় এমন সব ফিচার বা বিভাগ যুক্ত করে যা এর আগে আর কোনো পত্রিকায় ছিল না অথবা থাকলেও নিয়মিতভাবে নয়, পরিসর ও আয়োজনের দিক দিয়েও বলা যাবে না। ‘অন্যদিন’-এর অভিনব সব বিভাগ এবং বিশেষ সংখ্যার বিষয়বস্তুর মাধ্যমে বলা হয়েছে গতানুগতিক জীবন-যাপন শৈলী বদলে দেওয়ার উপায়গুলো। সেইসঙ্গে রঙিন ঝলমলে মলাট, আর্ট পেপারে সুন্দর করে ছাপা এবং রঙিন ছবিতে সচিত্র করে লেখা বিভাগগুলি অচিরেই হয়ে গিয়েছে ‘অন্যদিন’-এর ট্রেডমার্ক। কেবল সূচিপত্রের বিষয়ের বৈচিত্র্য নয়, তাদের নান্দনিক উপস্থাপনাও গুরুত্ব পেয়েছে, যার জন্য ‘অন্যদিন’ হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ এক পত্রিকা। এখন খুব সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে কী সেই বিভাগগুলি বা বিশেষ সংখ্যা যার জন্য অন্যদিন ভিন্ন আকার এবং প্রকারের পত্রিকায় পরিণত হয়েছে।
মানুষের জীবনযাপনের জন্য প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হলো আহারের জন্য খাদ্য। এই খাদ্য আদি মানব সংগ্রহ করত বনে-জঙ্গলে ঝুঁকি নিয়ে; তার উত্তর পুরুষ সেসব কিনেছে বাজার থেকে, প্রস্তুত অবস্থায় অথবা কাঁচা রূপে। আমাদের মতো দেশে বাজার থেকে কাঁচা শাক-সবজি, তাজা মাছ-মাংস কিনে এনে গৃহিণীর হাতে অথবা পাঁচকের সাহায্যে রান্না করা নিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। বংশপরম্পরায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত রন্ধন প্রণালির পৌনপুনিকতার জন্য প্রায় ক্ষেত্রেই এইসব রান্নায় বৈচিত্র্য থাকে না, স্বাদেও হয় না তারতম্য। কিন্তু নিকট অতীত থেকে ধীরে ধীরে রন্ধন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। একই উপকরণ ও মাল মসলা দিয়ে দৈনন্দিনের খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের রান্না করা সম্ভব হয়েছে শুধু রেসিপি বা রন্ধন প্রণালি বদলে দিয়ে। এর জন্য কোনো বাড়তি খরচের প্রয়োজন পড়ে নি, শুধু মসলা ব্যবহার করে মিশ্রণ পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আর রান্নার সময় সম্বন্ধে সচেতন হয়েই পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ পালা-পর্বণ আর উৎসবের জন্য যে খাবার সেসবও ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির অনুসরণ করেই হয়ে থাকে। এখানেও একই উপকরণ ও মাল-মসলার সাহায্যে নতুন কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘অন্যদিন’ প্রথম থেকেই লাইফস্টাইলের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে রান্নাকে বিবেচনা করেছে এবং এই উদ্দেশ্যে প্রতি সংখ্যায় নিয়মিত ‘রান্না’ বিভাগের লেখায় নতুন করে পুরাতন খাবারগুলি রেঁধে রসনায় ভিন্ন স্বাদ এনে দেবার আয়োজন করে আসছে। এর আগে আর কোনো পত্রিকা এমন নিয়মিতভাবে ‘রান্না’ ফিচার রেখে অতি পরিচিত, অল্প পরিচিত এবং কখনো কখনো অপরিচিত খাবারকে নতুনভাবে প্রস্তুত ও পরিবেশনের আয়োজন করে নি। পাঁচমিশালি রান্না ছাড়াও ‘অন্যদিন’ মাঝেমাঝে রান্নার ওপর বিশেষ ফিচার বের করে রন্ধনশিল্পে বৈচিত্র্যের মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রসঙ্গে অতি সম্প্রতি ইলিশ মাছের ওপর যে প্রচ্ছদ সংখ্যা বের করা হয়েছে তার উল্লেখ করা যায়। এক ইলিশ মাছ দিয়েই যে কত রকমের লোভনীয় ও সুস্বাদু রান্না সম্ভব তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এই সংখ্যায় লেখা সব রেসিপিতে। আর প্রতিটি পদের খাবারের রন্ধন প্রণালির সঙ্গে যে রঙিন ছবি ছাপা হয়েছে তাতেও অর্দ্দধংভোজনং হয়ে যাবার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে পাঠকের। এমন জীবন্ত সেইসব রঙিন ছবি, যার প্রত্যেকটিকে বলা যায় একটি শিল্পকর্ম।
এমন এক সময় ছিল যখন মানুষ পোশাক পরত লজ্জা নিবারণের জন্য এবং শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে। এখনো পোশাক পরিধানের এই প্রাচীন উদ্দেশ্য অক্ষুণœ আছে। কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদ অনেকদিন থেকেই দৈনন্দিনের প্রয়োজন মেটাবার বাধ্যবাধকতার ঊর্ধ্বে উঠে লাইফস্টাইলের অংশ হয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে। এর ঢেউ আমাদের দেশে এসেও লেগেছে। পোশাক পরিহিতরা বুঝতে পেরেছেন যে-কোনো উপায়ে শরীর ঢাকলেই হবে না, তা হতে হবে সুশোভন, দৃষ্টিনন্দন ও শিল্পিত। পোশাক নিত্য ব্যবহার্য কিন্তু প্রয়োজনীয় বস্তুতেও শিল্প-সৌন্দর্য যুক্ত করা যেতে পারে এবং তা করা হলে পোশাক আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে ওঠে। যার জন্য সেই পোশাক পরিহিত অনেক প্রশংসার দৃষ্টি লাভ করে। এর পাশাপাশি অবশ্য পোশাকের মাধ্যমে পরিধানকারীর অর্থ-বিত্তের পরিচয় দেওয়ারও প্রয়াস থাকে যার জন্য ডিজাইনার পোশাক ধনী শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে পশ্চিমের দেশগুলিতে।
‘অন্যদিন’ পোশাককে বিলাস দ্রব্য বা শৌখিন বিষয় হিসেবে না দেখে সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকা লাইফস্টাইলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইটেম হিসেবে দেখে এসেছে। খাদ্যের মতো নিয়মিত না হলেও যে আইটেমের ফিচার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো ফ্যাশন। ফ্যাশন নিয়ে ‘অন্যদিন’ বের করেছে বিশেষ সংখ্যা, বিশেষ করে ঈদ উৎসবের সময় যখন নতুন পোশাক কেনা হয়ে থাকে। ফ্যাশন সংখ্যা বের করে ‘অন্যদিন’ একদিকে যেমন তার পাঠককে সুন্দর ডিজাইনের পোশাক কেনার উৎসাহ দিয়েছে, অন্যদিকে দেশের পোশাকশিল্প, বিশেষ করে বুটিকগুলিকে তাদের পণ্য প্রচারে সাহায্য করেছে। এইসব পোশাক তৈরি হয়েছে সবই দেশে এবং এর ডিজাইন ও প্রস্তুত সবকিছুই হয়েছে দেশীয় শিল্পী ও কারিগরদের হাতে। পোশাক সম্বন্ধে ‘অন্যদিন’-এর দৃষ্টিভঙ্গি বলা যায় উদার। এই প্রসঙ্গে দেশীয় পোশাক ডিজাইনে বিদেশি পোশাকের মোটিফ ব্যবহারে তার কোনো আপত্তি নেই, কেননা খাবারের মতো পোশাকেও আন্তর্জাতিকার মাত্রা যুক্ত হয়েছে অনেকদিন থেকে। কিন্তু এই সংমিশ্রণে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিসর্জন দিতে রাজি হয় নি ‘অন্যদিন’। খাবারের ক্ষেত্রে যেমন পোশাকেও আমাদের হতে হবে মনে প্রাণে বাঙালি, এই নীতিতে বিশ্বাস করেছে ‘অন্যদিন’। তার লাইফস্টাইলে উন্মুল এবং খেয়াল খুশি তাড়িত কোনো অভ্যাসের চর্চা নেই। এর পেছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এবং সংস্কৃতির দর্শন প্রচ্ছন্ন।
‘অন্যদিন’ ঈদ উপলক্ষে বের করেছে পোশাক সংখ্যা। ‘অন্যদিন’-এর ঈদ ফ্যাশন ইভেন্ট পোশাক ব্যবহারকারী এবং প্রস্তুতকারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। লাইফস্টাইল বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘অন্যদিন’-এর পোশাকশিল্পগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঈদের জন্য এই বিশেষ আয়োজন হলেও পোশাক সম্বন্ধে সচেতনতা সারা বছরের পোশাক পরিধানে প্রতিফলিত হয়েছে, এ কথা বলা যায়।
জীবনযাপন উপভোগ করার জন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া একটা প্রধান শর্ত। সুস্থ না থাকলে জীবনের কোনো কিছুই উপভোগ করা যায় না, লাইফস্টাইলের কথা তখন চিন্তা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। যে পর্যায়ের লাইফস্টাইলই হোক না কেন তার জন্য স্বাস্থ্য রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে ‘অন্যদিন’ তার লাইফস্টাইল উদ্যোগের মধ্যে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যের ওপর ফিচার ছেপেছে। এই ফিচারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন এবং বিভিন্ন অসুখের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য করণীয় বিষয় সম্বন্ধে পাঠককে অবহিত করেন। এর আগে আর কোনো পত্রিকায় নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ফিচার রেখে বিশেষজ্ঞদের লেখা ছাপা হয় নি। এটা ‘অন্যদিন’-এর লাইফস্টাইল সম্পর্কে সার্বিক (হোলিস্টিক) দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়।
জীবনযাপন উপভোগ্য করতে হলে শুধু কাজ করা, তিনবেলা খাবার গ্রহণ আর রুচিসম্মত পোশাক পরাই যথেষ্ট নয়। তার জন্য মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতে হয় যেন কাজের অবসাদ কাটিয়ে ওঠা যায় এবং নতুন পরিবেশে গিয়ে দেহ-মন সতেজ-প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। এইজন্য ‘অন্যদিন’ তার লাইফস্টাইলের কর্মসূচিতে ভ্রমণ শাখা অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রতি সংখ্যাতেই ভ্রমণ সম্বন্ধে প্রতিবেদন থাকে যেখানে ভ্রমণ সংক্রান্ত সব তথ্য পাওয়া যায়। এইসব ভ্রমণ দেশের ভেতর হওয়ার জন্য খুব বেশি সময় এবং অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে না। যাকে বলে ইকোনমি বাজেট। তার সাহায্যেই সপরিবারে দেশের আকর্ষণীয় স্থানগুলি বেড়িয়ে এসে আবার পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করা যায়। পর্যটনশিল্পের প্রসারে ভ্রমণকে এইভাবে জনপ্রিয় করে তোলার যে খুব প্রয়োজন তা ‘অন্যদিন’ প্রথম থেকেই বুঝেছে। ‘অন্যদিন’ শুধু তার পাঠককে নয়, পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত সবাইকে তার সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
বিনোদনের জন্য খেলাধুলার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। দেশের মানুষের ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে ‘অন্যদিন’ বিশ্ব ফুটবল ও বিশ্ব ক্রিকেট প্রতিযোগিতা উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের করেছে। সচিত্র এইসব অ্যালবাম ক্রীড়ামোদীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে এবং তারা এগুলি সযত্নে তাদের সংগ্রহে রেখেছেন। ভবিষ্যতেও এই ধরনের অ্যালবাম বের হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ঈদ উপলক্ষে ‘অন্যদিন’-এর সবচেয়ে বড় আয়োজন এর ঈদসংখ্যা যেখানে শুধু গল্প-কবিতা-উপন্যাস থাকে না, থাকে রান্না, খেলাধুলা, সিনেমা, স্বাস্থ্যসহ সব বিষয়ের বিভাগ। ১৯৯৭ সালে প্রথম ঈদসংখ্যার পৃষ্ঠা ছিল ৪০০ যা সবশেষের সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়ায় ৭৫০ পৃষ্ঠায়। এত বড় কলেবরের ঈদসংখ্যা এই পর্যন্ত বাংলাদেশে আর কেউ বের করতে পারে নি। ‘অন্যদিন’ ঈদসংখ্যায় দেশের নামিদামি লেখকদের লেখা ছাড়াও অতিথি হিসেবে লিখেছেন কলকাতার খ্যাতনামা লেখকরা। ‘অন্যদিন’ ঈদসংখ্যার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ১৯৯৯ সাল থেকে এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন যা তিনি আর কোনো পত্রিকার জন্য করেন নি। লেখার সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের জন্য ঈদসংখ্যা ‘অন্যদিন’ বর্তমানে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগশিপ সাহিত্য পত্রিকা, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। উল্লেখযোগ্য যে, ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত প্রায় গল্প-উপন্যাসই পরবর্তী সময়ে বের হয়ে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
ঈদসংখ্যা ছাড়াও ‘অন্যদিন’-এর সাহিত্যশাখায় নিয়মিত গল্প-কবিতা-উপন্যাস এবং ভ্রমণকাহিনি ছাপা হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে যে বইসংখ্যা বের হয় সেখানে দেশি-বিদেশি বই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। লেখকদের ওপরও আলোচনা হয়েছে, কখনো প্রবন্ধের আকারে, আবার কখনো ইন্টারভিউ হিসেবে। অন্যদিন সাহিত্য পত্রিকা না হলেও সমকালীন সাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অন্যপ্রকাশ’ প্রতিবছর অনেক জনপ্রিয় বই বের করে ‘অন্যদিন’-এর সাহিত্য অবদানের সম্পূরক ভূমিকা পালন করেছে।
‘অন্যদিন’ দেশের প্রয়াত লেখকদের স্মৃতি রক্ষার জন্য সরেজমিনে গবেষণা করে তাদের ওপর লেখা প্রস্তুত করেছে। প্রায় একাই, নিজ উদ্যোগে একটি পত্রিকার পক্ষে এ ধরনের আর্কাইভ গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত বিরল। এটি অন্যদিন পত্রিকার শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচায়ক।
‘অন্যদিন’ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র এবং নাটকের চর্চা ও প্রোডাকশনেও সহায়কী ভূমিকা পালন করেছে। ইমপ্রেস টেলিভিশনের সহযোগিতায় যৌথভাবে ‘অন্যদিন’ পরপর তিন বছর পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। বর্তমানে এটি স্থগিত থাকলেও ভবিষ্যতে আবার শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। একই আকারে না হলেও এক্ষেত্রেও ‘অন্যদিন’-এর অবদান সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে ‘অন্যদিন’ ১৪০৯ সাল থেকে পরপর ৪ বছর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেই সংখ্যায় শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেশি লেখকদের লেখা ছাপা হয়েছে। কয়েক বছর থেকে বের না হলেও ভবিষ্যতে আবার বৈশাখী সংখ্যা বের করা হবে এমন আশা করা যায়। কেননা বর্তমানের সংকট কেটে গেলে সাংস্কৃতিক জীবন আবার উদ্দীপ্ত এবং বেগবান হয়ে উঠবে। বৈশাখী সংখ্যা কলেবরে এবং গুরুত্বে ঈদসংখ্যার সমতুল্যও হয়ে উঠতে পারে এমন আশা করা যায়।
যা কিছু নিয়ে ‘অন্যদিন’-এর লাইফস্টাইলের আয়োজন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো। বলা বাহুল্য, এই লাইফস্টাইল মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তারাই ‘অন্যদিন’-এর লক্ষ্য এবং পাঠক। এর কারণ বেশ স্পষ্ট। উচ্চবিত্ত শ্রেণির লাইফস্টাইল তাদের স্বনির্বাচিত এবং বিদেশি প্রভাবান্বিত। শখ করে তারা মাঝে মাঝে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও তাদের মন পড়ে থাকে বিদেশি লাইফস্টাইলে—এই নিয়ে বোধ করি ‘অন্যদিন’-এর কোনো বক্তব্য নেই, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়ে অন্যের রুচিতে হস্তক্ষেপ করা তার উদ্দেশ্য নয়। তবে তার পৃষ্ঠায় বাঙালি লাইফস্টাইলের যেসব দৃষ্টান্ত সেইসব দেখে যদি উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা কিছুটা প্রভাবান্বিত হয় তাহলে তা হবে ‘অন্যদিন’-এর বাড়তি পাওনা।
নি¤œবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণির লাইফস্টাইল এখন পর্যন্ত ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ আর লজ্জা আচ্ছাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকায় ‘অন্যদিন’-এর লাইফস্টাইল তাদের জন্য নয়। তবে ‘অন্যদিন’ আশা করে নি¤œবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণি, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করবে। তখন তারাও অন্যদিন-এর লাইফস্টাইল সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সচেতনভাবে তাদের জীবন যাপন শৈলী বদলাবার জন্য পদক্ষেপ নেবে। এই লক্ষ্যে ‘অন্যদিন’ কর্তৃপক্ষ এবং বিত্তশালীদের করণীয় সম্পর্কে তার সম্পাদকীয়তে বক্তব্য রেখে যাবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য। ‘অন্যদিন’-এর লাইফস্টাইল দরিদ্রদের নয় বলে তাদের কথা বলা হবে না, এমন দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাস নিয়ে কাজ করছে না ‘অন্যদিন’, আমার এই বিশ্বাস।
‘অন্যদিন’-এর পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.