সুগন্ধিবিলাস

সুগন্ধিবিলাস

সুরভিত জীবন বলতে অনেকে বলবেন জীবনে সুগন্ধের উপস্থিতি আবার অনেকে বলবেন জীবনে ভালোবাসার সাত রঙের কথা কারও আবার মনে হতে পারে একটা সুষ্ঠু পরিবেশে বাঁচতে পারলে সেটাকেই বলা যায় সুরভিত জীবন আবার অনেকের কাছে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনাই হচ্ছে তার জীবন এবং সুরভি তবে একটি বিষয় সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য আর সেটি হচ্ছে সুগন্ধি বা পারফিউম এই সুরভি, জীবন এবং সুগন্ধির ত্রিকোণ সম্পর্ক নিয়ে এই রচনা।

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সৌরভ

কেবল মানুষের বাস্তব জীবনে নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রয়েছে সৌরভ বা সুগন্ধির ছোঁয়া। উপন্যাস, কবিতা, গান বা ছোটগল্প যাই বলি না কেন, এর প্রমাণ মেলে কয়েকটি উদাহরণ পেলেই। 

সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে ফুটেছে এটাই যে, প্রকৃতি সৌরভময়: ‘টিলাজুড়ে কার্পাস ফুল ফুটে আছে। সাদা কার্পাস ফুল ছুঁয়ে শবরী টিলা বেয়ে নামতে থাকে। ওর মনযোগ না পেয়ে ময়ূরী আরও নিচে নেমে গেছে। সাদা ফুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওটা এখন পেখম ছড়িয়ে নাচছে। বাড়ির পেছনে কঙ্গুবিনা ফলের গাছ, ফল পেকেছে। তা দিয়ে হাঁড়িয়া বানিয়েছে শবরী। ও কার্পাস গাছে পা ছড়িয়ে বসে। ঝুমঝুমি মল বেজে ওঠে। চারদিকে নীলাভ অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে, বুনোফুলের তীব্র গন্ধ দিকবিহীন ছুটছে, ঝিম ধরে শবরীর মাথায়।’

আবার সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’তে দেখা যায় এর নায়ক বাবর নানা নারীর দেহের মধ্যে খুঁজে পায় নানা গন্ধ। 

 কবিতার প্রতি দৃষ্টি দিলেও পাওয়া যাবে নানা উদাহরণ। যেহেতু কবি মহাদেব সাহা একজন প্রকৃতিসংলগ্ন কবি সেহেতু তার উদাহরণই দেওয়া যাক। আর এ ক্ষেত্রে বোধহয় তার ‘শিউলি ফুলের ঋতু’ কবিতাটি যথাযোগ্য। এই কবিতার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শিউলি ফুলের গন্ধে ভরা শরৎ ঋতুর প্রতি অনুরাগ। আবার আল মাহমুদের ‘চক্রবর্তী রাজার   অট্টহাসি’ কবিতায় দেখা যায়, কবি বিভিন্ন নারীর কাছে থেকে নানা গন্ধ পান— লেবু ফুলের গন্ধ, মৃগনাভির ঝাঁঝালে গন্ধ, ধূপের গন্ধ এবং লবণের গন্ধ। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পাই—‘পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ— কলমির ঘ্রাণ/হাঁসের পালক, শর; পুকুরের জল, চাঁদা-সরপুটিদের/মৃদু ঘ্রাণ(আকাশে সাতটি তারা)। এমনিভাবে নজরুল,   অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালসহ আধুনিক বহু গীতিকবির গানে সৌরভের সন্ধান পাই। এমনকি চলচ্চিত্রের গানেও— ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলাতে চাই…।’

 কবিতা ছেড়ে যদি বাংলা গানের দিকে আসি তবে তাও সৌরভময়। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে সুগন্ধি ঘুরে ফিরে আসে— ‘পাগল হইয়া বনে ফিরি/ আপন গন্ধে মম/কস্তুরী মৃগ সম/ ফাল্গুন রাতে দক্ষিণ বায়ে/ কোথায় দিশা খুঁজে পাই না/ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/ যাহা পাই তাহা চাই না (উৎসর্গ), ‘আজি গন্ধ বিধুর, সমীরণে/ কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে   (গীতাঞ্জলি)।

ইতিহাস যা বলে

এতো গেল সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সুরভি বা সুগন্ধির ব্যবহার। কিন্তু সুগন্ধি বা সুরভি যাই বলি না কেন এর ব্যবহার কিন্তু কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যুগে যুগে রাজা-বাদশারা বিভিন্ন সময় নানা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এই সুরভি নিয়ে, যা ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী হয়ে আছে।

১৪৫২ সালের দিকে বাদশাহ হুমায়ূন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজ্যছাড়া। এমন সময় তাঁর স্ত্রীর কোলজুড়ে এল এক পুত্রসন্তান। নামকরণ করা হলো আকবর। পুত্রসন্তানের জন্মসংবাদ হুমায়ূনকে দেন জওহর আবতাবচি। হুমায়ূন আবতাবচিকে বলেন, তোমার কাছে যে মৃগনাভিটি গচ্ছিত রেখেছি সটা নিয়ে আসো, আর একটা ছুরি আনো। 

জওহর আদেশ পালন করলেন। হুমায়ূন নিজের হাতে মৃগনাভিটি ভাগ করে তার সঙ্গী আমীরদের হাতে দিয়ে বললেন, আজ আমার চরম দুঃসময়। আমি পুত্রের জন্মের আনন্দ করব, আপনাদের সবাইকে উপহার দেব, সে সামর্থ্য আমার নেই। মৃগনাভির একটি করে টুকরো আপনাদের দিলাম, আপনারা প্রার্থণা করুন যেন আমার পুত্রের যশ মৃগনাভির সৌরভের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হুমায়ূন-আকবরের এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে সৌরভ শুধু মৃগনাভির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মানুষের কীর্তি আর মহিমার মাঝেও লুকিয়ে আছে।  

সুরভির রসায়ন

সুরভি অথবা সুগন্ধি যাই বলি না কেন এর রসায়ন কিন্তু শুরু হয় আমাদের নাক থেকে। কেননা সুগন্ধির ফলেই আমরা উজ্জীবিত হই। আর তা এটা মনে করিয়ে দেয় আমাদের মিলন বা বিচ্ছেদের স্মৃতি। সুরভির এই রসায়ন বোধহয় বদলানো সম্ভব নয়। 

সুরভিত জীবনের জন্য মানুষ নানা কিছুর আশ্রয় নেয়, কিন্তু প্রতিদিন সুরভিত থাকা এতো সহজ নয়। এর একটা চটজলদি সমাধান দিতে পারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তৈরি পারফিউম। 

 

পারফিউম শব্দের অর্থ
পারফিউম শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ পার আর ফুমুস থেকে। পার শব্দের অর্থ ‘মধ্য দিয়ে’ আর ফুমুস শব্দের অর্থ ‘ধোঁয়া’। 

 পারফিউম তৈরির ইতিহাস
 প্রাচীন যুগে সুগন্ধি তৈরি হতো গাছ-গাছড়ার ছাল-বাগল পিষে ও সিদ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে এটা বিভিন্ন নির্যাসের সঙ্গে তেল ও অ্যালকোহলের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার মিশ্রণের মাধ্যমে তৈরি করা হতো। পারফিউম তৈরির এই ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীনকালে যখন কাঠে কাঠ ঠুকে আগুন জ্বালানো হতো, তখন থেকে সুগন্ধি কাঠের আবিস্কার। মিশরীয়   ইতিহাসে পাওয়া যায় তারাই প্রথম সুগন্ধি তৈরি করে। তবে তারা ওই সময় বিভিন্ন উদ্ভিদের তেল এবং চর্বি মিশিয়ে এক ধরনের মলম তৈরি করতো। আর সেই মলম তারা পারফিউম হিসেবে পায়ে মাখত। তবে ধর্মযাজকেরাই কেবল সুগন্ধি ব্যবহার করত। ধীরে ধীরে তা রাজা রাজপরিবারের দখলে চলে আসে। তারা ওই সময় পারফিউম তৈরি   করত বিভিন্ন সুগন্ধি লতা ও গুল্ম পুড়িয়ে। মেসোপটেমিয়ার তাপ্পুতি নামক এক কেমিস্ট-এর নাম পাওয়া যায়, যিনি দুই হাজার খ্রিষ্টাব্দপূর্বে পারফিউম তৈরি করেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে সূচিত্র হয় কৃত্রিম সুগন্ধির। রসায়নবিদ্যার প্রসারে উৎপন্ন হয় অ্যারোমেটিক যৌগ। তখন থেকেই তৈরি হতে থাকে নানা সুরভিযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ।

পারফিউমের শহর
ফ্রান্সের এক পাহাড়ি অঞ্চলের এক ছোট শহর গ্রেস। অধিকাংশ পারফিউমের ঠিকানাই এই ছোট্ট শহরটি। বিখ্যাত পারফিউম বা ফারফিউমের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই এই গ্রেস বা তার আশপাশের অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে পারফিউম গাছ, ফুল এবং লতাগুল্ম। 

 

বিভিন্ন ব্রান্ডের পারফিউম এক নজরে দাম

লেডিস ফার্স্ট বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। মেয়েদের পারফিউমের কথাই আগে বলা যাক। 

  • ফুলের সৌরভে যারা সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের জন্য রয়েছে ফ্লোরাল ফ্লেভার। এতে রয়েছে গুচির এনভি মি, গিল্টি এবং ইনটেল। পাওয়া যাবে ৪ হাজার ১৭০ থেকে ৮ হাজার ২৫০ টাকার মধ্যে। 
  • মৌসুমী ফল বা চকলেট ফ্লেভারের পারফিউম ব্যবহার করতে চাইলে বেছে নিতে পারেন এসকাডা, মোশিনো এবং থেরি মাগলারের মতো ব্রান্ডগুলো। এসকাডার ব্রান্ডের মধ্যে রয়েছে ডিজাম্মার মি, এ্যাবসোলিস্ট মি, ইক্সডিবল মি, চেরি ইন দ্য এয়ার, আইল্যান্ড কিস এবং রকিং রিও নামের পারফিউম। পাওয়া যাবে ৩ হাজার ২শ’ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকার মধ্যে। 
  • ফরাসি সুগন্ধি ব্রান্ড ক্রিডের রয়েছে ফ্লোরাল ফ্লেভারের লাভ ইন হোয়াইট এবং লাভ ইন ব্লাক নামের পারফিউম। ব্যবহার করতে পারবেন ছেলেমেয়ে উভয়ই। তবে এই ব্রান্ডের পারফিউমের দাম একটু বেশিই পড়বে, ১৬ হাজার টাকা। 
  • শুরুতে একটু ঝাঁজালো গন্ধ, অথচ কয়েক মূহুর্ত পরই অন্য এক সুবাস— এমন সৌরভকে বলে স্পাইসি ফ্লেভার। এই ধরনের পারফিউম তৈরি করে অ্যাজার, ডিএসকোয়ার্ড টু। 

 

পারফিউম বাজার
আমাদের দেশে শুধু পারফিউমের দোকান খুব কম রয়েছে। তবে বর্তমানে কিছু জায়গায় এই ধরনের দোকান চোখে পড়ে। এর মধ্যে পারফিউম ওয়ার্ল্ড রয়েছে সবচেয়ে এগিয়ে। এর শো-রুম রয়েছে বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, ধানমন্ডির প্লাজা এ আর, বনানী ১১ ও চাঁদনিওয়ালা ম্যানশন, উত্তরা পলওয়েল কার্নেশন ও যমুনা ফিউচার পার্কে। গুলশানের পিংক সিটি মার্কেটে রয়েছে রেইনবো পারফিউম নামের একটি দোকান। স্টার এশিয়া মূলত তাদের নিজস্ব আমদানিকৃত পারফিউম এ সকল দোকানে সরবরাহ করে থাকে।

আতর
পারফিউম হিসেবে আতরের ব্যবহার প্রচলিত আছে বহুদিন ধরে। আজকের দেশি-বিদেশি ব্রান্ডের পারফিউমের মাঝেও পারফিউম হিসেবে আতর টিকে আছে। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে পুরুষদের আতর ব্যবহারের রেওয়াজ লক্ষনীয়। ঢাকায় আতরের প্রধান বাজার বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বর সংলগ্ন এলাকা ও চকবাজার শাহী মসজিদ চত্বর।

Leave a Reply

Your identity will not be published.