একটা প্রবাদ আছে যে, বাংলাদেশে যে কেউ যখন-তখন একটা কবিতা লিখতে পারে। যেমন প্রবাদ আছে যদি জার্মানিতে একটা ঢিল মারা হয়, সেই ঢিলটা একজন পিএইচডির গায়ে লাগে। বাংলাদেশেও এ রকম ঢিল ছুড়ে মারলে যে-কোনো কবির গায়ে লাগবে। আমি কোনো কবিকে ছোট করতে চাচ্ছি না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সঙ্গীতপ্রিয়, কবিতাপ্রিয়। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তারা যে অনেক ধারণা রাখে সেটা সারা পৃথিবীর সবাই জানে। আমাদের ঢাকাকে বলা হয় বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক রাজধানী। কলকাতা এবং ঢাকায় প্রচুর পত্র-পত্রিকা গত পঞ্চাশ বছর ধরে বের হচ্ছে। যে পত্রিকাগুলো কবিতা-গল্পনির্ভর অর্থাৎ সাহিত্যনির্ভর, সেগুলি প্রচুর বের হয় এই দুই বাংলা থেকে। আমার মনে হয় না ঢাকা ও কলকাতা থেকে যে পরিমাণ পত্র-পত্রিকা বের হয় তা বাংলাদেশ বা ভারতের অন্য কোথাও থেকে বের হয় না।
এরই মধ্যে ২৪ বছর আগে বের হলো পাক্ষিক অন্যদিন। এই পত্রিকার মধ্যে নানা রকম চমকের সমাহার ছিল। একটা দৃষ্টিনন্দন পত্রিকা ছিল। অন্য পত্রিকাগুলো দেখলে মনে হতো দুর্বল, রুগ্ন পত্রিকা। কখনো কখনো সবল বা সুন্দর পত্রিকা যে বের হয় নি তা নয়। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, অন্যদিন-এ ২৪ বছর ধরে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপারটা শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা কিন্তু অন্য কোনো পত্রিকার ক্ষেত্রে কখনো হয় নি। আমরা দেখছি যেভাবে বের হয়েছিল অন্যদিন, আজ এই পত্রিকাটি আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে; শুধু বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে নয় চোখে দেখার দিক থেকেও। এখন পৃথিবী বদলে গেছে। বিষয়বস্তু ভালো তবে তা পরের বিষয়। আগে দেখতে হবে পত্রিকার অবয়ব। আমি দেখেছি যে অন্যপ্রকাশের বইয়ের সঙ্গে অন্যদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেলায় গেছে। সেখানে লোকজন বইয়ের সঙ্গে এই পত্রিকাটিও উল্টিয়ে দেখছে। বাংলা ভাষার পত্রিকা তারপরেও অন্যভাষী মানুষেরা এটি দেখছে। কারণ হলো পত্রিকার ভেতর ছবি ও নানান জিনিস তাদের আকর্ষণ করেছে।
অন্যদিন প্রমাণ করেছে এটি শুধু পত্রিকা নয়, এটি বাংলাদেশের পাঠকদের এবং বাংলাদেশের যারা শিল্প-সাহিত্য ভালোবাসে তাদের সবার সঙ্গেই আছে। এ জন্য অন্যদিন ক্লোজআপ-এর সঙ্গে গল্প প্রতিযোগিতা করেছে। অন্যদিন ইমপ্রেস-এর সঙ্গে মিলে পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। এই পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ডের নানা রকম বৈশিষ্ট্য ছিল। আমার মনে আছে এই অনুষ্ঠানটি অন এয়ারে গিয়েছিল এটিএন বাংলায়। সেদিন ঢাকা শহরে সত্যি সত্যি ট্রাফিক জ্যাম কমে গিয়েছিল। অন এয়ারের সময় সবাই টেলিভিশনের সামনে বসে সেই অনুষ্ঠানটা দেখেছে। উপভোগ করেছে। ‘অন্যদিন-ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ডে’র যখন পরিকল্পনা করা হয় তখন ভাবা যায় নি যে সেটা এত সাড়া ফেলবে। কারণ সেই সময় এই ধরনের কোনো পুরস্কার ছিল না। আজ আমি যখন মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের অনুষ্ঠানে যাই এবং শুনি যে ২০তম পুরস্কার হচ্ছে, তখন আমার বুকটা হাহাকার করে। কেননা তার আগে এই ধরনের পুরস্কার অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম আমরা, অন্যদিন-এর সঙ্গে যৌথভাবে, ১৯৯৭ সালে। সেটা যদি ধারাবাহিকভাবে আজ থাকত তাহলে এর বয়স ২১ বছরের মতো হতো। তিনবারের পরে আর নানা কারণেই অনুষ্ঠানটি চালানো সম্ভব হয় নি। কিন্তু যে তিনটা অনুষ্ঠান হয়েছে সেই তিনটি অনেক বড় চমকে ভরপুর ছিল। অনেক গবেষণা করে অনুষ্ঠানগুলো করেছি আমরা। আবেদ খান উপস্থাপনা করেছিলেন, মুনমুন আহমেদ উপস্থাপনা করেছিলেন। সেই সময় রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিনকে বলেছিলাম একটি গান গাওয়ার জন্য। তখন তারা দুজনে মিলে আমাদের মঞ্চে একটি গান গেয়েছিলেন। এরকম অনেক কিছু ঘটেছে। তখন তিন বছরে অন্যদিন-ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড যা দেখিয়েছে আর কোনো পুরস্কার অনুষ্ঠান তা দেখাতে পারে নি।
এই অনুষ্ঠানের যে বৈচিত্র্য ছিল, তিন বছর যেভাবে অন্যদিন-ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে; তাতে সেই অনুষ্ঠানের টেপ দেখে আজ অনেকেই বিস্মিত হবেন। কী পরিমাণ আধুনিকতার ছোঁয়া সেই সময় ছিল। এটা হলো অন্যদিন-এর পুরো টিমের বড় গুণ। এদের প্রত্যেকেরই আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমি দেখেছি। আমি নিজে যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করেছি তখনো এটা বুঝতে পেরেছিলাম। তখন বিটিভিতে আজকের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। কিন্তু সেই সময় টেলিভিশনে আমরা যেসব নাটক করেছি বা আমাদের অগ্রজরা যেসমস্ত নাটক করেছেন, সেগুলি চিরায়ত শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। এর কারণ হলো, সেইসব নাটকের মানুষদের আন্তরিকতা ছিল, নাটকের প্রতি ভালোবাসা ছিল এবং সেই জিনিসটা তৈরির পেছনে চমৎকার মনের একটা ছোঁয়া ছিল। অন্যদিন সেভাবে বড় হয়েছে। অন্যদিন-এর সবাই তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে ছোট একটা জিনিসকে অনেক বড় করার চেষ্টা করেছে। তাই যখন অন্যদিন ঈদসংখ্যা বের হলো সেটি চমকে দিল সবাইকে। আর অন্যদিন ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ বরাবর করেছেন এবং করছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন।
অন্যদিন-এর একটা বড় আকর্ষণ ছিল সব বয়সের মানুষের কথা সে ভেবেছে। ভেবেছে একটা বাড়িতে গেলে পরিবারের সবাই ম্যাগাজিনটা উল্টিয়ে দেখবে। এটা একটা পারিবারিক ম্যাগাজিন। সেজন্য সেখানে যোগ করা হলো ছোটদের একটা উপন্যাস। সেই ছোটদের উপন্যাস এখনো অন্যদিন প্রত্যেক ঈদে অব্যাহত রেখেছে। কারণ অন্যদিন-এর ভাবনার কোনো রকম পরিবর্তন হয় নি। আর সেটি হলো এই যে অন্যদিন সবার পত্রিকা।
ঈদসংখ্যার মতোই অন্যদিন-এর আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, বৈশাখী সংখ্যা। ব্যাপক কলেবরে এধরনের সংখ্যা অন্যদিন-ই প্রথম বের করে। বলাই বাহুল্য, সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতির নানা কিছু ঠাঁই পেত এই সংখ্যায়। দুঃখের বিষয় হলো, চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর এটি আর প্রকাশিত হচ্ছে না।
বিভিন্ন সময় অন্যদিন স্বনামধন্য নানা ব্যক্তিকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তাঁরা হলেন ড. মুহম্মদ ইউনূস, হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কাইয়ুম চৌধুরী, সুচিত্রা সেন, আনিস্জ্জুামান, রাজ্জাক, শাহাবুদ্দিন প্রমুখ। এছাড়া বিশ্বক্লাব ফুটবল এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে নানা সময়ে বিশেষ অ্যালবাম প্রকাশ করেছে, কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে।
অন্যদিন-এর সঙ্গে কে যোগ দেয় নি? বাংলাদেশের যারা বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হক থেকে শুরু করে আমি এমন কারও নাম বলতে পারব না যিনি অন্যদিন-এর সঙ্গে যুক্ত হন নি। এবং সর্বোপরি হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদকে অন্যদিন যেভাবে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছে; সেটা যদি না হতো তাহলে বাংলা সাহিত্য অনেক বড় বড় জিনিস থেকে বঞ্চিত হতো। কারণ অন্যদিন-এর উৎসাহে হুমায়ূন আহমেদ অনেককিছু রচনা করেছেন— যে রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছে, প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
এদেশে প্রথম ঈদ ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা শুরু করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা। পরে তা বন্ধ হয়ে গেলে অন্যদিন সেটি চালু করে। অন্যদিন ভাবল ঈদের সময় এত দোকানে এত কাপড় তৈরি হয় এগুলিকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেটা অন্যদিন করে দেখাল। অন্যদিন কোনো কিছু ছোট আকারে করতে চায় না, বড় আকারে করে। তাই চ্যানেল আই প্রেজেন্স ‘বেক্সিফেব্রিক্স-অন্যদিন ফ্যাশন’ অনুষ্ঠানও বড় করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। ফারজানা ব্রাউনিয়ার উপস্থাপনায় রেকর্ড করে টেলিভিশনে দেখানো হলো। টেলিভিশনে দেখানো মানে ছড়িয়ে দেওয়া হলো সব জায়গায়।
অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন অনুষ্ঠানে একটা লাইফ টাইম পুরস্কার দেওয়া হতো। যাদের দেওয়া হতো সেইসব মানুষের ব্যক্তি পরিচয় আমরা কোনোদিনই পাই নি। কিন্তু তাদের বুনন, তাদের কাজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে; বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। এইসব বুননশিল্পীকে ঢাকায় নিয়ে এসে পুরস্কৃত করা, সম্মানিত করা, এই কাজটি অন্যদিন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করেছে।
বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় দেখা যায় অন্যপ্রকাশের স্টলটি সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। সেখানে অন্যদিন-এর একটি স্টলও থাকে। সেটাও কিন্তু অন্যদিন পত্রিকাটিকে পাঠকদের কাছে নিয়ে যেতে অনেক বেশি সাহায্য করে। আরেকটি কথা, অন্যদিন কিন্তু তরুণ লেখকদের চমৎকার একটি প্লাটফর্ম। গত ২৫ বছরে অন্যদিন-এ বহু নবীন গল্পকার ও কবির লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আজ তাদের মধ্যে অনেকেই স্বনামে খ্যাত।
২০১৫ সালে থেকে এক্সিম ব্যাংকের সহায়তায় অন্যদিন প্রবর্তন করেছে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার। যা অন্যদিন-এর আরেকটি চমৎকার উদ্যোগ।
অন্যদিন-এর এই ২৫ বছরে আমরা যদি মনে করি এটা শুধু একটি পত্রিকা, তাহলে ভুল করা হবে। অন্যদিন আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার একটা হাতিয়ার। এই অন্যদিন নামের গাড়িটাকে যে সকল কর্মীরা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সবাইকে অনেক অভিনন্দন। কারণ ২৫ বছর যথেষ্ট সময় নয় একটা পত্রিকার জন্য। আশা করি, আগামী বছরগুলোতে আরও অনেক চমক ও বিস্ময় নিয়ে অন্যদিন আমাদের সামনে আসবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.