পিঠ সাদা বিছানা স্পর্শ করলেই একটু ভাবনার সুযোগ পেতেন তিনি। কত দায়িত্ব, কত দায় থেকে তিনি নিজের কাছাকাছি আসতেন, কেবল ডায়ালাইসিসের সময় হলে! মিতা হকের তখন মনে পড়ত, জীবনসংগ্রামের উল্টো পিঠে তিনি একজন শিল্পী। মনটা ভার করে শিল্পস্বজন লাইসা আহমদ লিসাকে বলেছিলেন, ‘আমার খুব গাইতে ইচ্ছে করে রে!’
গান করা আর হবে না মিতার। মঞ্চেও তাঁকে দেখা যাবে না আর। রোববার (১১ এপ্রিল) গানের ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে নিয়েছেন অবসর। বেলা ১১টায় প্রিয় সংগঠন, সাংস্কৃতিক বিদ্যাপীঠ ছায়ানটে নেওয়া হয়েছিল তাঁর মরদেহ। ছায়ানট ভবনের উঠানে শীতল গাড়ির ভেতর থেকে শেষবারের মতো তিনি গ্রহণ করেছেন শিল্পস্বজনদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধার শেষ ফুল। বিদায়বেলায় স্বজন, সহযাত্রী, ছাত্রছাত্রী সমস্বরে তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে শুনিয়েছেন গান—‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, তারপর ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘পথে চলে যেতে যেতে।’ সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি কেরানীগঞ্জের বড় মনোহারিয়ায় ফিরে গেছেন বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক। বাদ জোহর জানাজার পর মা–বাবার কবরের পাশে শেষ ঘুমে যান তিনি, সব দায়িত্ব থেকে, গান থেকে যান চির অবসরে।
বাংলা বছরকে বিদায় ও স্বাগত জানানোর আয়োজনে গাইতেন মিতা হক। চৈত্রসংক্রান্তি বা বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক আয়োজন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বা প্রয়াণের দিনেও মিতা গাইতেন রবীন্দ্রনাথেরই গান। বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে গিয়ে সেই গান শিখিয়েছেন বহু ছেলেমেয়েকে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক রবীন্দ্র গবেষক চাচা ওয়াহিদুল হকের কাছে গান শিখেছিলেন মিতা। পরে শিখেছেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজীদা খাতুনের কাছে। সহযাত্রীরা বলেন, মিতা ছিলেন শ্রুতিধরের মতো। একটা গান কেবল একবার শুনলেই তুলে নিতে পারতেন কণ্ঠে, নির্ভুল। কোনো স্বরলিপি একবার দেখলে কখনোই ভুল হতো না। ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত মিতা গাইতে শুরু করেন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে। বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের শিল্পী ছিলেন তিনি।
মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালে। ১৯৮৫ সালে তিনি বিয়ে করেন অভিনেতা খালেদ খান যুবরাজকে। দারুণ গোছানো এক সংসার ছিল তাঁদের। তারপর হঠাৎ সেটা এলোমেলো হতে শুরু করে। একে একে হারান মা–বাবাকে। ২০১৩ সালে মারা যান স্বামী যুবরাজ। মানসিকভাবে অবিকশিত ছোট ভাইটিকে সন্তানের মতো লালন করেছেন মিতা, মেয়ে ফারহিন খান জয়িতাকে বানিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। শাশুড়ি তাঁকে ছেড়ে থাকতেন না কখনোই। চেনাজনেরা বলতেন, মিতা এত মানবিক ছিলেন যে বাড়ির দরজাটা খোলা রাখতেন সবার জন্য। আতিথেয়তা করতেন পরমাত্মীয়র মতো। মনের দরজাটাও থাকত সদা উন্মুক্ত। মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন মুহূর্তেই, ঠিক ওয়াহিদুল হকের মতো। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘মিতা ছিল এক বলিষ্ঠ সংস্কৃতিসংগ্রামী শিল্পী। মানুষের মঙ্গল দেখে যে ভীষণ আনন্দও পাওয়া যায়, সেটা আমরা তাঁকে দেখে শিখেছি।’ মিতার আরেক স্বজন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, ‘যারা তাঁকে কাছে পেয়েছেন, তাঁরাই জানেন, মিতা আপা কেমন মানুষ ছিলেন। আমরা যে কী হারালাম, আমরা জানি না।’
গানটাই ছিল মিতা হকের জীবন। সংসারের দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁকে পালন করতে হয়েছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব। পরিচালনা করতেন গানের স্কুল সুরতীর্থ। ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকও ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় মিতা হকের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না।’ প্রায় দুই শতাধিক রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তাঁর ২৪টি একক অ্যালবামের ১৪টি ভারত ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। সংগীতে অবদানের জন্য ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। ২০১৬ সালে তিনি লাভ করেন শিল্পকলা পদক। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মিতা হককে রবীন্দ্র পুরস্কার দেয় বাংলা একাডেমি। তবে বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ মনে করেন, মিতা হকের যথেষ্ট মূল্যায়ন হয়নি। তিনি বলেন, ‘যাঁরা সংগীত বোঝেন, তাঁরা নিশ্চয়ই চিনবেন মিতা কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি, ভাগ্যও তাঁর সুপ্রসন্ন ছিল না। তবে মিতার মনোবল ছিল প্রকট। এ কারণে তিনি এত কষ্টকে পাত্তা দেননি।’
গত পাঁচ বছর কিডনি রোগে ভুগছিলেন মিতা হক। দুটো কিডনি প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল। সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হতো। ডায়ালাইসিস করাতে গিয়েই করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসায় তিন-চার দিন আগে করোনামুক্ত হন। বুলবুল ইসলাম জানান, গত শনিবার ডায়ালাইসিস করিয়ে মিতাকে বাসায় নেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার ভোরে তিনি চলে যান। করোনা–উত্তর ধকল সইতে পারেননি তিনি।
Leave a Reply
Your identity will not be published.