নীল ধ্রুবতারা (তৃতীয় পর্ব)

নীল ধ্রুবতারা (তৃতীয় পর্ব)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।]

রাতে ঘুমানোর আগে ফাহিম মেইলের উত্তর লিখতে বসল। অনেক ভেবে নিয়ে সে লিখল—

‘প্রিয়তমা সিমি,
এটা ঠিক, আমরা একে অপরকে চিনি না। তুমি আমাকে চেনো না, একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কয়েকটি মেইল আদান-প্রদান হয়েছে, শুধু এটুকু পরিচয়ের সুত্র ধরেই কারো সঙ্গে তার একান্ত অনুভূতির কথা ভাগ করে নেওয়া হয়তো যায় না— তবুও তুমি বলেছ। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তোমার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে। রাত দশটার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার মেইলটি আমি আবারও পড়লাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর লিখতে বসলাম। কিন্তু কী যে হলো, কেন যেন কিছুই লিখতে পারলাম না। রাত বারোটা নাগাদ বিছানায় গিয়ে এপাশ-ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম এল না। এখন বাজে রাত দুটোর মতো। তোমার জন্যে কয়েকটি লাইন না লিখে যেন কিছুতেই ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা মিসিং। অবশেষে বুঝলাম, তোমার জন্য অন্তত একটি লাইন হলেও আমাকে লিখতে হবে।

আমার শুধু তোমাকে একটা কথাই বলার আছে। আমরা যতই একজন আরেকজনকে চিনি আর না চিনি কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তুমি আমার অনেকদিনের চেনা-কাছের একজন মানুষ। দূরের কেউ নও। তুমি মুনারও বন্ধু। আর মুনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব দশ বছরের ওপরে। আমাকে অবিশ্বাস করার কোনোই কারণ নেই। এবং চাইলে ভরসা রাখতেও পারো- নিশ্চিন্তে। অভয় দিয়ে বলছি।

তোমার মনের ভেতরে যত কষ্ট জমে আছে, তা দ্রুত বের হয়ে যাক। আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারো। অযাযিতভাবে কাউকে বিরক্ত করার মানুষ আমি নই। ভালো থেকো। শুভেচ্ছা।

ফাহিম।’

রাত দু’টায় মেইল পাঠিয়ে ফাহিম যখন ঘুমাতে গেল, নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল তার।

সকালে অফিসে গিয়ে প্রাত্যাহিক টিম মিটিং শেষ করে ফাহিম তার বসের সঙ্গে দেখা করতে গেল একটা প্রজেক্টের আপডেট দিতে। ফাহিমের বস জ্যানিস প্যাসিলিও, ষাটোর্ধ্ব আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ প্রৌঢ়া। ফাহিমকে সাথে নিয়ে জ্যানিস চলে গেল স্মোকিংয়ের জন্য নির্ধারিত অফিস বিল্ডিংয়ের বাইরের জায়গাটাতে। কিছুদিন আগে তার প্রথম ধাপের ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়েছে, তারপরেও এই মহিলা সিগারেট ছাড়তে পারছেন না। কী আছে এই সিগারেটে যা ছাড়তে এত অনীহা? সিগারেটে ৬৫ রকমের বেশি ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। নিকোটিন ছাড়াও তিন হাজারেরও বেশি রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধূমপায়ীর শরীরে। এমন কোনো রোগ নেই যার কারণের মধ্যে ধূমপান নেই। আর এই ধূমপানের কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগটিই হলো ক্যানসার।

জ্যানিস বিভিন্ন কথা বলছে কিন্তু ফাহিমের কানে যেন কিছুই ঢুকছে না।

‘কোনো সমস্যা?’ ব্যাপারটা লক্ষ করে জ্যানিস জানতে চাইল।

‘না না কোনো সমস্যা না। তুমি কেমন আছ?’ ফাহিম সপ্রতিভভঙ্গিতে জানতে চাইল।

জ্যানিস সিগারেটে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? মনটা তো এখানে নেই। আমাকে বলতে পারো যদি পারসোনাল ইস্যু না হয়ে থাকে।’

ফাহিম কী বলবে ভেবে পেল না। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত সে তার পারসোনাল মেইলগুলো খুলে দেখার সুযোগ পায় নি। অফিসের ইমেইল দেখে আর উত্তর দিতেই সময় চলে যায় অনেক। তারপর টিম মিটিং, এখন বসের সাথে কথা বলতে এসেছে এখানে। ভেতরে ভেতরে যে সে অস্থির হয়ে আছে এবং তার বসের চোখে সেই অস্থিরতা ধরাও পড়ে গেছে। সে দ্রুত উত্তর দিল, ‘না না তেমন কিছু না।’ বলেই সে দ্রুত প্রজেক্টের আপডেট দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

জ্যানিস ওকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য কিছু পরামর্শ দিল। কথা শেষ করে চলে যেতে উদ্যত হতেই জ্যানিস ডাকল, ‘ফাহিম!’

জ্যানিসের ডাক শুনে ফাহিম ঘুরে তাকাল।

জ্যানিস বলল, ‘আমি কিছুদিনের জন্যে ছুটি নিচ্ছি- কেমো শুরু হবে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যে কোনো দরকারে তুমি মার্গারেটের কাছে যাবে, ওর সঙ্গে কথা বলবে। সব রিপোর্ট তাকেই দেবে। শী উইল বি ইয়োর বস ইন মাই এবসেন্স।’

ফাহিম মাথা নেড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তার নিজের রুমে গিয়ে বসল। ঘড়ি দেখল, সকাল দশটা বেজে দশ মিনিট। মাথাটা ধরে আছে মনে হচ্ছে। ফাহিম ব্রেকরুমে গেল কফি আনতে। সকালে অফিসে এসে অনেকের মতোই ফাহিম ব্রেকরুম থেকে এক কাপ কফি নিয়ে ঢোকে তার রুমে। আজ কফি নেওয়ার সময় হয় নি। সে কফি বানিয়ে নিয়ে এসে বসল তার অফিস কম্পিউটারের সামনে।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে পারসোনাল ইমেইলে লগইন করা মাত্রই চোখে পড়ল সিমির মেইল। সকাল ৮টায় এসেছে। তার মানে বাংলাদেশে তখন রাত ৮টা। ফাহিম অবাক হয়ে লক্ষ করল, আকারে বেশ বড়ই আজকের মেইলটা। এতদিন যেসব মেইল আদান-প্রদান হয়েছে সেগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বড়। সে আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করল।

‘প্রিয় ফাহিম,
তোমার মেইল পেয়ে আমি অনেকক্ষণ একা একা হেসেছি, কেন জানো? তুমি যা করেছ আমিও ঠিক তাই-ই করেছি। অস্বস্তিবোধ করছি তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমিও তোমার মেইলের অপেক্ষা করছিলাম। এবং সেটা পেয়েই আমি উত্তর লিখতে শুরু করেছি। তোমার মতোই- যদিও তখনো জানি না, কী লিখব।

আর কিছু লেখার আগে প্রথমেই তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই- তোমার সমবেদনা আর সাহস দিয়ে আমাকে লেখার জন্য। আমি কৃতজ্ঞ। আমি ভীষণ খুশি এই ভেবে যে, এখন থেকে তোমার মতো একজন সুন্দর হৃদয়ের মানুষকে আমার বন্ধু হিসেবে পাশে পাবো।

তোমাকে ভয় পাব কেন? আসলে আমি খুব সহজে কাউকে বন্ধু বানাতে পারি না। এমন নয় যে, আমি খুঁতখুঁতে। আমি ঠিক পারি না। পারি না সবার সাথে তাল মেলাতে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমার সাথে আমার যাবে। আমরা হয়তো একে অপরের ভালো বন্ধু হতে পারব।

তোমার বন্ধু মুনা আর তার প্রেমিক প্রবর অনির্বান কদাচিৎ আমাদের বাসায় আসত। তোমাকে কি বলেছি অনির্বান ছিল রাশেদের বন্ধু? সেই সুবাদে মুনাকে আমি চিনতাম। শুনেছি ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। যদিও কারণটা আমার অজানা। ব্রেকআপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে মুনার সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু জানি ও শিকাগোতে ফিরে গেছে এবং সেখানেই আছে কিন্তু কেমন আছে, কী করছে কিছুই জানি না। তোমার সাথে দেখা হলে আমার কথা বোলো- আমার শুভেচ্ছা দিও।

আমার জীবনে প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধু অথবা গার্জিয়ান বলতে একজনই ছিল আর সে হচ্ছে রাশেদ, মানে আমার স্বামী। রাশেদই ছিল আমার সব- সবকিছু। বিয়ের আগে প্রায় তিন বছর প্রেম করেছি আমরা। আমাদের বিবাহিত জীবনটাও ছিল অত্যন্ত সুখের এবং চমকপ্রদ। বেশ সুখেই কাটছিল সময়। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। ওর এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে- খুব। মানিয়ে নিতেও পারছি না। রাশেদ নেই- এই সত্যিটাকে বিশ্বাস করে নিতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। আমি জানি না, কতদিন লাগবে আমার এই সত্যিটাকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হতে!

যা’ হোক, তোমার মতো একজন বন্ধু যখন পেয়েই গেলাম- মনে হচ্ছে আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। অনাগত দিনগুলিতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে জানি না, শুধু এই জানি, রাশেদই আমার জীবনের সব এবং আমার বাকি জীবনেও তাকে ভুলে যাওয়া হবে না।

আমার মনে হচ্ছে আজ আমাকে কথায় পেয়ে বসেছে। কত বড় একটা চিঠি লিখে ফেলেছি ইতোমধ্যেই! তুমি বোর হবে জেনেও লিখলাম এত কথা। তুমি তো বলেইছো, আমার সব অনুভূতির কথা তোমাকে জানাতে। এখন বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। তবুও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি- যদি আমার এই চিঠি তোমাকে কিছুমাত্র বিরক্তির উদ্রেক করে থাকে।

তোমার সাহস জাগানিয়া অসম্ভব সুন্দর চিঠিটির জন্য আরেকবার ধন্যবাদ। আমার খুব ভালো লেগেছে।

আমি অপেক্ষা করব- তোমার পরের মেইলটির জন্য। তোমার নিজের সম্পর্কেও কিছু জানিও। অন্তত বুঝতে যেন পারি আমার নতুন এই বন্ধুটি কেমন!

আজ তবে এইটুকু থাক। বাকি কথা পরে হবে...।

শুভেচ্ছা আর শুভকামনা,

সিমি।’

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.