[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৪তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব
নিকোলা টেসলার বারান্দায়
ঘটনাটা টেসলার জন্মের সময়ে, ক্রোয়েশিয়ার এক প্রান্তিক গ্রামে স্মিয়ানের এক ছোট্ট বাড়িতে প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছেন ডিউকা। চিন্তিতভাবে পায়চারি করছেন তাঁর খ্রিষ্টান পুরোহিত স্বামী মিলাটিন। ওদিকে বাইরে তখন চলছে তুমুল ঝড়। থেকে থেকে মেঘে ঢাকা কালো আকাশের বুক চিরে দিয়ে যাচ্ছে বজ্রপাত। প্রসবকাজ সবে শেষ হয়েছে। বৃদ্ধা ধাত্রী বজ্রপাতের ঝলকানিতে ভয় পেয়ে গেলেন। শিশুটির জন্মে সে একে অশুভ সংকেত হিসেবে ধরে নিলেও, তা মানতে রাজি হন নি ডিউকা। বরং পরম ভালোবাসায় বললেন, ‘আমার এ সন্তান ছড়িয়ে দেবে আলো!’
নিকোলা টেসলাকে নিয়ে তাঁর বাবার আশাবাদ সত্য হয়েছিল।
এবার আমার গন্তব্য সেই টেসলার জাদুঘর। কিন্তু সার্ব ড্রাইভার আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বলা মুশকিল। এ গলি থেকে ও গলি, এই মোড় থেকে ওই মোড়, সম্মুখে গিয়ে আবার ইউটার্ন, লেগে গেল পাক্কা ২৫ মিনিট। অথচ লাগার কথা মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। মাঝারি ধরনের মেটে রঙের ভবন, যা বেলগ্রেড শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। বেলগ্রেডের অন্যতম প্রধান জাদুঘর, যা ১৯২৯ সালে নির্মাণ করা হয়। ব্যতিক্রমী মূল্যবান সংগ্রহশালা হিসেবে রয়েছে এর বিশেষ খ্যাতি।
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম বিস্ময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার গ্রিড। প্রায় ১০০ বছরে গড়ে ওঠে এই জটিল বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক। এতে যুক্ত অসংখ্য পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ট্রান্সফরমার। এগুলো ছড়িয়ে আছে প্রায় ৪৫০ হাজার মাইল এলাকাজুড়ে। এ অভাবনীয় সংযোগে যুক্ত করে দুনিয়ার বুকে আলো ছড়িয়ে দেওয়া মানুষটির নাম— নিকোলা টেসলা।
হাতে সময় কম। কম সময়ে দেখতে হবে পুরো জাদুঘর। কাজেই, গবেষণার উপায় নেই। দেখতে হবে দ্রুতগতিতে। এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মূল নথি, বই এবং জার্নাল রয়েছে এই জাদুঘরে। ঐতিহাসিক প্রযুক্তিগত পণ্যের সমাহারে যে-কেউ অবাক হবেন। ফটোপ্রেমীদের জন্য রয়েছে সেই সময়ের ফটোগ্রাফ, প্রযুক্তিগত বস্তু, ফটোগ্রাফের যন্ত্রপাতি। বিখ্যাত সব ছবির পরিকল্পনা আর নানা অঙ্কনের ফটো প্লেটও আছে এখানে। বিজ্ঞান-ইতিহাসের গবেষক ও উদ্ভাবকদের জন্য এটি তথ্যভাণ্ডার। তাই বেলগ্রেড ভ্রমণকারীরা নিকোলা টেসলা মিউজিয়াম ঘুরে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
মিউজিয়ামের এই রুম থেকে ওই রুম, এ বারান্দা থেকে ওই বারান্দা ঘুরে বেড়াই। সঙ্গে কেউ থাকলে ভালো হতো? না, একাই যথেষ্ট। একা ঘুরতে গেলে নিজের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারি আমরা। ব্যস্ত জীবনে ক্রমশ নিজের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে আমাদের। যার জন্য একটা সময় গ্রাস করে অবসাদ। এই সমস্যা কাটাতে মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়া উচিত। একা ঘুরতে গেলে কেনাকাটা, খাবারদাবারও সারতে হয় একা একাই। আত্মবিশ্বাসটা বাড়ে। অনুকূল-প্রতিকূল সব পরিস্থিতি একা সামলানোর চেষ্টা থাকে। দল বেঁধে গেলে মনে হয় ঘোড়ার গাড়িকে টেনে সামনে নিতে হয়। সময় খরচ হয় বেশি, বাড়ে ঝক্কিঝামেলাও। এই ট্যুরে বসে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাই।
প্রাচীন গ্রিস থেকে জাদুঘরের উৎপত্তি, লক্ষ্য ছিল শিল্প ও দর্শনচর্চা। সেই ভাবনা থেকেই উপাসনালয়ের তত্ত্বাবধানে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৮ মে, বিশ্বের সব দেশ মিলে পালন করে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। জাদুঘরবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের তথ্য বলছে, বিশ্বের ২০২টি দেশে ৫৫ হাজারের বেশি জাদুঘর রয়েছে।
বর্তমানে দর্শনার্থী ভ্রমণের সংখ্যায় এক নম্বরে রয়েছে প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘর। প্রতিবছর প্রায় ৯২ লাখ দর্শনার্থী এই জাদুঘর ঘুরতে আসেন। এখানেই রয়েছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’। বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মোমের তৈরি ভাস্কর্য নিয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে রয়েছে মাদাম তুসো জাদুঘর। আর ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে, যার নাম ‘কেরি মিউজিয়াম’। আবার কলকাতায় অবস্থিত ‘চার্লস স্টুয়ার্ট মিউজিয়াম’ হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাদুঘর। বাংলাদেশে প্রথম রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’।
সময় বাঁচাতে দৌড়ে দৌড়ে ঘুরতে থাকি। এ জাদুঘরটি টেসলার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত আইটেমগুলোর বিরাট সংগ্রহশালা। এর মধ্যে রয়েছে হাতে লেখা পেনসিল নোট, টীকা, মুদ্রিত ব্যবসায়িক কার্ড ও বাতিল ডাকটিকিট। টেসলা ভক্তদের মন কাড়বে সস্তার কাগজে অ্যাকাউন্ট বুক, হাতে লেখা চেক আর মুদ্রিত ফর্ম দেখে। ডুপ্লিকেটসহ টাইপ করে লেখা পাঠ্য, সেই সঙ্গে পার্চমেন্টে রঙিন কালিতে লেখা ডিপ্লোমা, একটি ইন্টাগ্লিও স্ট্যাম্পসহ একটি চার্টারও চোখে পড়বে সহজেই। ট্রেসিং পেপারে ভারতের কালিতে আঁকা পরিকল্পনার ব্লুপ্রিন্ট কপি দেখে একটু থামি। ৫৪৮টি বাক্সে করে জিনিসগুলো এখানে প্রদর্শিত হয়। আর এগুলোকে ভাগ করা হয় সাতটি ক্যাটাগরিতে। এসব আর্কাইভাল উপকরণগুলিকে নতুন ফোল্ডার এবং বাক্সে সর্বোচ্চ মানে পুনরায় প্যাক করা হয়েছে। প্রতিটি চেম্বার বিশেষভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ডকুমেন্টারি উপাদানের ডিজিটালাইজেশন পণ্যের গুণমান বজায় রাখে। জাদুঘরকে ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। প্রতিটি উপাদানের মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব উপাদান একেবারে অপরিবর্তিতরূপে দেখতে পারে। বহু যুগ পরেও এসব নিদর্শন আগের মতোই দেখা যাবে।
পুরো জাদুঘর কার্পাস নয়টি সংগ্রহশালা নিয়ে গঠিত। এ সংগ্রহশালায় এক হাজার ২০০টিরও বেশি আইটেম নিবন্ধিত। যার মধ্যে বিভিন্ন যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিক প্রকৌশল প্রযুক্তিগত মূল জিনিসপত্র রয়েছে। সাভা কোসানোভিচ নামের এক ব্যক্তি এসব জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন। শুরুতে এগুলো রাখা হয় বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে। পরে ১৯৫২ সালের জুনে অনুষদ থেকে সরিয়ে ব্রিগাডাতে গেনসিচ ভিলায় নেওয়া হয়। সেই ভিলাই পরে জাদুঘরে রূপ নেয়। ১৯৫৫ সালের ২০ অক্টোবর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় জাদুঘর। ১৯৬৯ সাল থেকে জাদুঘরটিকে বেলগ্রেড শহরের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালে নিকোলা টেসলার জাদুঘরকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ যুক্ত করেছে ইউনেসকো।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.