আমি যেদিন বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম

আমি যেদিন বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম

ঘুমের মধ্যে আমি লিলি খালার চাপা হাসি শুনতে পেলাম। আমার প্রথমে মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু এ রকম মনে হওয়া আমার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমি বুঝতে পারলাম আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আর, যে-হাসি আমি শুনেছি একটু আগে, সেটা স্বপ্নে নয়, বাস্তবে। এমনও হতে পারে ওই হাসির শব্দেই আমার ঘুম ভেঙেছে।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমার আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করল না। আর, লিলি খালার হাসির কথা আমার যখন মনে হলো, তখন আমার এ বাসায়ই আর থাকতে ইচ্ছে করল না। আচ্ছা, আমি যদি এ বাসা ছেড়ে চলেই যাই, চিরদিনের জন্য; তা হলে কেমন হয়? একা-একা আমার জন্য কোথাও চলে যাওয়া অবশ্য কঠিন। একটা মেয়ে ইচ্ছে করলেই একা-একা কোথাও চলে যেতে পারে না। ছেলেরা পারে। আমি ছেলে হয়ে জন্মালাম না কেন?

আমি যদি ছেলে হয়ে জন্মাতাম, বাবা আর লিলি খালার ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাতাম না। কারণ সে-সময়ই আমি পেতাম না। তার বহু আগেই একা-একা হাঁটতে-হাঁটতে আমি সেই কোথায় চলে যেতাম।

আমি মৃদু পায়ে বিছানা ছেড়ে নামলাম। বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে আমি ক্যাসেট প্লেয়ারটা ছাড়লাম। মান্না দে’র গান আমার খুবই প্রিয়, বিশেষ করে আমার যখন মন খারাপ থাকে। এখন আমার মন খারাপ, খুবই খারাপ। লিলি নামের এই মহিলা খুবই বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছেন। আগে আসতেন সপ্তাহে একদিন কি দুদিন। এখন প্রতিদিন আসতে আরম্ভ করেছেন। পারলে এ-বেলা ও-বেলা দু’বেলা আসেন।

মান্না দে’র গান শুনতে শুনতে আমার মন আরো একটু বিষণ্ণ হলো। এ রকম হয়- বিষণ্ণ থেকে আরো বিষণ্ণ হতে-হতে আমার মন একসময় ভালো হয়ে যায়। আমি আমার বিষণ্ণতাকে গুরুত্ব না-দিয়ে অন্য কথা ভাবলাম। আচ্ছা, আমি তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেই পারি। মা মারা যাওয়ার পর থেকে মামারা আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কতবার তারা বলেছে এ কথা। বাবা রাজি হয় নি আর আমিও ঠিক বুঝতে পারি নি বাবাকে ছেড়ে আমার যাওয়া উচিত হবে কি হবে না। এই তো দিন বিশেক আগেও আমার বড় মামা এসেছিলেন। বড় মামা একটু গম্ভীর ধরনের মানুষ। গম্ভীর গলায় বাবাকে বললেন, শফিক, কিছু কি ঠিক করলে?

বাবাও খুব গম্ভীর গলায় বলল, কী ঠিক করার কথা বলছেন?

টুম্পাকে আমরা সেই কবে থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।

কেন? ওর কি এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে?

না, অসুবিধা কিসের! তবে তুমি যদি বিয়ে টিয়ে করো, তাহলে টুম্পার আমাদের ওখানেই থাকা উচিত।

আমি আবার বিয়ে করব, এ কথা কে বলল আপনাদের?

না, করতেও তো পার।

তখন বলবেন।... তবে টুম্পা যদি নিজে থেকে যেতে চায় আমি না করব না।... টুম্পা মা মণি...।

বাবা যখন ‘টুম্পা মা মণি’ করে ডাকে তখন আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। আমার মনে হয় পৃথিবীতে এত সুন্দর করে আর কেউ ডাকতে পারে না। আমি বাবার মুখে ‘টুম্পা মা মণি’ শুনে তখনই তার দিকে তাকালাম। বাবা বলল, টুম্পা মা মণি, তুমি কি যাবেই তোমার মামার সঙ্গে?

আমি বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মামার দিকে ফিরলাম। মামা একটু হাসলেন। যা-বোঝার বুঝে নিলেন। গম্ভীর গলা যতদূর সম্ভব নরম করে বললেন, মা, তোমার যখনই যেতে ইচ্ছে করবে আমাকে খবর পাঠাবে। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

হ্যাঁ, মামা বাড়ি আমার যেতে ইচ্ছে করে। এর মধ্যে আমি বার ৩/৪ গেছিও। কিন্তু আমার যাওয়ার ইচ্ছা ও যাওয়া অল্প সময়ের জন্য। চিরদিনের জন্য মামাবাড়ি কেন, সত্যি কথা বলতে কী, বাবাকে ছেড়ে কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে করে না। নতুন কোনো জায়গায় চিরদিনের জন্য আমার যদি যেতেই হয়, বাবাকে থাকতে হবে আমার সঙ্গে। আমার এই ইচ্ছাটাই ইদানীং বেশি-বেশি করে- বাবাকে নিয়ে একদম নতুন কোনো জায়গায় চলে যাওয়ার। নতুন জায়গায় সবই অপরিচিত, তবু লিলি খালাতো সেখানে থাকবে না।

আমি বিছানা থেকে নেমে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করলাম। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পাউডার বুলোতে-বুলোতে নিজেকে একটু দেখে নিলাম। এখন আমি ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকব। ছাদে যে আমার যেতেই হবে, রোজ বিকালেই যে আমি ছাদে যাই, এমন নয়। কিন্তু লিলি নামের মেয়েটা যখন বাবার সামনে বা পাশে বসে বেহায়ার মতো হি হি করে হাসছে, তখন সেই হাসি শোনার জন্য ঘরের ভেতর বসে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এই বিকালে আমার ইচ্ছা আসলে ছিল অন্যরকম। আমি ভেবে রেখেছিলাম, বাবাকে বলব, কোনো এক জায়গা থেকে ঘুরে আসার জন্য। কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় না-গেলেও অসুবিধা নেই, বাবার সঙ্গে এমনি-এমনি রিকশায় ঘুরতেও আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বেহায়া এক মহিলা এসে আমার সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছে। এই মহিলা কেন আসে আমার বাবার কাছে! আর বাবাই-বা কেন এই মহিলা এলেই অন্যরকম হয়ে যায়, হেসে-হেসে খাতির করে গল্প করে! আমি অবশ্য জানি এই মহিলা কেন আসে, জানি আমার বাবা কেন এই মহিলা এলে খুশি হয়। আমি জানি, কিন্তু এসব আমার মেনে নিতে ইচ্ছে করে না, এসব আমি মেনে নিতে চাই না। কিন্তু মেনে না নিয়ে আমার কি অন্য কিছু করার আছে?

ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে সরে এসে দরোজার কাছে আমি একটু দাঁড়ালাম। দু’পা হাঁটলেই আমি বাবা আর লিলি খালার সামনে হাজির হবো। কিন্তু হাজির হওয়া বলতে ঠিক যা-বোঝায়, তা হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমার ইচ্ছে ওই ঘরটা এমনভাবে পার হয়ে যাওয়ার, যেন ওই ঘরে কেউ যে আছে, তা-ই আমার জানা নেই। আমি সেরকমই করলাম। আমার ঘরের দরোজার সামনে একটু দাঁড়ালাম, তারপর হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। এভাবে হেঁটে গিয়ে বাইরে বেরোবার দরোজা খুলব, ছাদে চলে যাব। কিন্তু আমার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটনা ঘটল না। আমি হেঁটে যেতে-যেতে আড়চোখে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা হাসিমুখে তার ডান পাশের সোফায় বসা লিলি খালাকে কিছু বলতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে। আর লিলি খালাতো সরাসরি আমার দিকেই তাকিয়ে। দু’পা এগোলাম দরোজার দিকে। বাবা বলল, টুম্পা।

আমি এমন ভান করলাম যেন বাবার কথা আমি শুনতে পাই নি।

বাবা এবার একটু জোর গলায় বললেন, টুম্পা মা মণি।

আমি থামলাম। বাবার দিকে এমনভাবে তাকালাম যেন জানতে চাচ্ছি বাবা কী কিছু বলল!

বাবা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ মা?

ছাদে। আমি ছোট করে বললাম। বলেই এমনভাবে দরোজার দিকে এগোলাম যেন নিশ্চিত করেই জানি এর পরে আর কোনো কথা নেই। কিন্তু বাবা আবার আমাকে থামাল, তোমার খালাকে সালাম দিলে না!

আমি ওই লিলি খালার দিকে না-তাকিয়েই বললাম,  স্লামালেকুম। (মনে মনে বললাম, দোয়া করছি তুই যেন আজ রাতেই বোবা আর কালা হয়ে যাস।)

বাবা বললেন, তুমি খালাকে জিজ্ঞেস করলে না ও কেমন আছে!

আমি ওই মহিলার দিকে তাকালাম, কেমন আছেন খালা? (মনে-মনে বললাম, তুই আবার আমার খালা হলি কোত্থেকে! মা মারা গেল আর তুই কোত্থেকে এসে জুড়ে বসলি!)

লিলি খালা বললেন, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ টুম্পা?

আমি কিছু বললাম না। (মনে-মনে বললাম, তা দিয়ে তোর কী দরকার কুত্তি।)

লিলি খালা বললেন, তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

আমি মুখে কিছু না-বলে মনে-মনে বললাম, এই প্রশ্ন তুই কেন করবি হারামজাদি?

বাবা একটু গম্ভীর গলায় বলল, কী ব্যাপার, তুমি যে তোমার খালার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছ না!

লিলি খালা তখনই বললেন, না না, ঠিক আছে। ওর মনটা বোধহয় খারাপ। যাও টুম্পা, তুমি ছাদে যাও।

আমি ছাদে চলে এলাম। এসে ছাদের একদিককার রেলিং-এর ওপর বসলাম। রেলিংটা বেশ চওড়া। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। আর, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, পড়ে যদি যাই তো যাব। মাঝে-মাঝে তো আমার পড়ে যেতেই ইচ্ছে করে। বিশেষ করে আমার বন্ধুরা যখন আমাকে ক্ষ্যাপায়। খুব ভালো মানুষের মতো ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ওই মহিলা তোর কেমন খালারে?... তুই কি তোর ওই খালাকে মা ডাকিস?... তোর বাবা ওনাকে কী বলে ডাকে?... রাতে কি তোর খালা তোদের বাসায় থাকে, কোন ঘরে? এসব হোল বন্ধুদের কথা। কিন্তু শুধু বন্ধুরা নয়, বয়স্করাও আমাকে অনেক বাজে-বাজে কথা শোনায়। এমনভাবে বলে যেন সব দোষ আমার। তখন আমার চোখ ফেটে কান্না আসে, আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বাবাকে বলি, বাবা, পেয়েছ কী? বলি তোমরা পেয়েছটা কী? তোমাদের জন্য কথা শুনতে-শুনতে আমি যে হয়রান হয়ে গেলাম। আমার সত্যি, মাঝে-মাঝে এরকম বলার ইচ্ছে হয়। না, গলা ফাটিয়ে বলব না আমি, ঠাণ্ডা গলায় ধীর-স্থিরভাবে বলব। বলব- শোনো বাবা, তুমি কাজটা খুব খারাপ করছ।

এমন হতে পারে বাবা তখন খুব অবাক হয়ে যাবে কিংবা অবাক হওয়ার ভান করবে, কোন কাজটা খারাপ করছি?

এই যে লিলি খালা...।

হ্যাঁ লিলি...কী হয়েছে লিলির?

আমি জানি এরপর আমি তার কিছু বলতে পারব না। আমি মাত্র ক্লাস এইটে পড়া একটা মেয়ে। আমার পক্ষে বাবাকে কি ওর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব? ওটুকু বলাই অবশ্য যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও বাবা যদি না-বোঝার ভান করে তাহলে আমার আর কিছু করার থাকে না।

ছাদে আমার বেশিক্ষণ বসা হলো না। কারণ একটুপরই উঠে এলো স্বপন। স্বপন এবার ম্যাট্রিক দেবে, আমাদের এই বিল্ডিং-এরই এক ফ্ল্যাটে থাকে। ওর চেয়ে নোংরা স্বভাবের ছেলে আমি আর একটাও দেখি নি। সুযোগ পেলেই ও নোংরা-নোংরা কথা বলে আর গায়ে হাত দিতে চায়। দু’ একবার আমাকে সিঁড়ির মধ্যে ধরেছেও, আমি কোনো মতে নিজেকে ছাড়িয়েছি।

স্বপন আমাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল। কাছে এসে বলল, তুই নিজে-নিজেই ছাদে এলি, না তোর বাবা তোকে ঠেলে পাঠাল?

স্বপনের কথা বুঝতে না পেরে আমি অবাক গলায় বললাম, বাবা কেন ঠেলে পাঠাবে, আমি নিজেই এলাম।

বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস।

আমি স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

স্বপন বলল, ভালোই করেছিস, তোর বাবাকে আর খালাকে চান্স দিয়ে এসেছিস।

একই সঙ্গে আমার রাগ হলো আর কান্না পেল। আমি স্বপনকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম। স্বপন কি আর এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র, ও বলল, টুম্পা।

আমি অন্যদিকেই তাকিয়ে থাকলাম।

শোন, তোর বাবা আর খালা যা করছে, আয় না আমরাও তাই করি। বলে স্বপন আমার হাত ধরল।

আমি এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে নিলাম।

রাগ করিস কেন? তোর ভালো লাগবে। একবার অন্তত ট্রাই করে দ্যাখ।

আপনি যাদের সঙ্গে এসব করেন, সেখানে যান। প্লিজ, আমার কাছে আসবেন না।

আমি কারও সঙ্গে এসব করি না। আমি শুধু তোর সঙ্গে করতে চাই। আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি।

আজেবাজে কথা বলবেন না। আজেবাজে কথা শুনতে আমার একটুও ইচ্ছা করছে না।

বিশ্বাস কর, আমি তোকে ভালোবাসি। কী করলে তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি?

আমি স্বপনের দিকে তাকালাম। দেখলাম স্বপন আমার দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে আছে। আমার একবার মনে হলো বলি, কী করলে বিশ্বাস করব? আপনি যদি এখন এই ছ’তলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েন, তাহলে বিশ্বাস করব। আমি অবশ্য বললাম না এ কথা। আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম। স্বপনও আমাকে আর বিরক্ত করার সুযোগ পেল না। কে যেন ডাকল ওকে। ও নিচে নেমে গেল। আমি ছাদের ওপর বসে থাকলাম। বসে থাকলাম, আর, একটু ঝুঁকে পড়ে মাঝে-মাঝেই আমি নিচে তাকালাম। আমার ইচ্ছা- নিচে তাকিয়ে আমি দেখব লিলি খালা চলে যাচ্ছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার নিচে তাকিয়েও আমি সে রকম কিছু দেখলাম না। এমন হতে পারে, আমি যখন অন্য কোনো দিকে তাকিয়ে আছি, তখন লিলি খালা চলে গেছে। এ রকম ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও বারবার আমার মনে হতে লাগল- লিলি খালা চলে যায় নি, আমাদের বাসায়ই আছে, বাবার সঙ্গে ড্রইংরুমে বসে গল্প করছে, কিংবা ড্রইংরুমে না, অন্য কোনো ঘরে... কে জানে।

যতবারই আমার এ রকম মনে হলো, ততবারই আমার কান্না পেল। আচ্ছা, লিলি নামের এই মহিলা কেন এলো আমাদের বাসায়! এ মহিলা ছিল মা’র বান্ধবী। মা বেঁচে থাকতে বেশ কয়েকবার এসেছে আমাদের বাসায়। মা’র সঙ্গে বসে অনেক-অনেক গল্প করত। হাসতও অনেক, আবার দুঃখও করত। তখন তো তেমন করে বুঝতাম না, এখন বুঝি তার দুঃখের কারণ- তার স্বামী তাকে ছেড়ে এক মহিলাকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।

মা মারা যাওয়ার পর এই মহিলা ঘনঘন কয়েকবার এলো। তখন আমাকে খুবই আদর করত। বলত, আমি মা নই তোমার, কিন্তু টুম্পা তুমি আমাকেই মা মনে করবে। লিলি তখন আমার পাশে বসেই সময় কাটাত। আমার সঙ্গে অনেক গল্প করত। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইত। অথচ এই মহিলাই একটু-একটু করে বদলে গেল। আমি দেখলাম লিলি খালা আমার সঙ্গে ১/২টা কথা বলে বাবার সঙ্গে কথা বলতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর, বাবাকেও দেখতাম এই লিলি খালার অপেক্ষায় থাকতে। মাঝে-মাঝে আমাকে জিজ্ঞেসও করে ফেলত- মা টুম্পা, তোমার লিলি খালা কি বলে গেছে তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য আবার কবে আসবে?

আমি ভেতরে-ভেতরে হাসতাম আর কাঁদতাম। যে-মহিলাকে আমি এক সময় খুব ভালোবাসতাম, সে-মহিলাকে আমি ঘৃণা করতে আরম্ভ করলাম। এই ঘৃণা বাড়তে-বাড়তে একসময় এমন হলো, আমার মনে হলো- এই মহিলাকে খুন করে ফেললে কেমন হয়!

আচ্ছা, সত্যিই তো, লিলি খালাকে খুন করলে কেমন হয়? পারা যাবে না?

দুই

খুনের এই চিন্তাটা আমার মাথার ভেতর তীব্রভাবে থেকে গেল। কিন্তু খুনটা করব কীভাবে? শরবত বা চা’র সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেব! বিষ পাব কোথায়?

স্বপনকে বললে বিষ এনে দেবে না? বিষ আনার বিনিময়ে ও যদি কিছু চায়? আচ্ছা, চাইলে দেবক্ষণ, আমার তো কাজ উদ্ধার করা নিয়ে কথা। বিস্তারিত ভাবতে গিয়ে দেখলাম, শরবত বা চা’র সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানোর মধ্যে ছোট একটা সমস্যা আছে। ধরা যাক, আমি তিন গ্লাস শরবত বানালাম। আমার, বাবার আর লিলি খালার। কিন্তু কোনো কারণে গ্লাস যদি বদলে যায়! সুতরাং এতটা রিস্ক না-নিয়ে আমাকে অন্য কোনো সহজ উপায়ের কথা ভাবতে হবে। আমি সেই সহজ উপায়ের কথা ভাবতে আরম্ভ করলাম।

খুনের কথা যখন ভাবছি, তখন এক রাতে মা এলো আমার স্বপ্নে। মাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। আমার মা কখনোই এত রোগা ছিল না। এখনো সেই চমৎকার হাসিটা আছে তার কিন্তু মা শুকিয়ে যেন আরো ছোট হয়ে গেছে। আমি কান্না-কান্না গলায় বললাম, তোমার এটা কী অবস্থা হয়েছে বলো তো?

মা একটু হাসল, কেন রে, ঠিকই তো আছি।

কোথায় ঠিক আছ! শুকিয়ে তুমি কী হয়ে গেছ।

তাই? কী করব বল! তোদের ছেড়ে এসে কতরকম চিন্তা।

আমি কিছু না-বলে মা’র দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

মা বলল, টুম্পা তুই আছিস কেমন বলতো?

আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম, কেমন আর আছি। তুমি তো জানোই সবকিছু।

হুঁ। মা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। লিলি যে এমন একটা কাজ করবে, আর শুধু লিলির কথাই-বা বলি কেন...।

মা কথা শেষ না-করে চুপ করে গেল।

আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললাম, মা, তোমাকে একটা গোপন কথা বলি।

কী কথা রে?

আমি ঠিক করেছি লিলি খালাকে খুন করে ফেলব।

কী?

লিলি খালাকে খুন করে ফেলব।

মাকে একটু চিন্তিত মনে হলো- কাজটা কি উচিত হবে? তা ছাড়া তুই অত বড় একটা মানুষকে খুন করবিই-বা কীভাবে?

ধরো খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিলাম। কিংবা গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেললাম।

গাড়ি পাবি কোথায়? আর, তুই তো গাড়ি চালাতেও জানিস না।

তা-ও বটে। এবার আমিও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তা হলে কী করব মা? আমার যে আর ভালো লাগে না। আমার সব সময় শুধু কান্না পায়। আমি কি তোমার কাছে চলে যাব?

ধ্যাৎ পাগল, কী যে বলিস না! আমার কাছে আসা অতই সহজ নাকি?

তাহলে কী করব আমি? মামাদের ওখানে চলে যাই? বড় মামা বারবার বলছে।

মা আমার চিন্তিত হয়ে পড়ল- যাবি?

আসলে যেতে আমার ইচ্ছে করে না। বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে আমার ইচ্ছে করে না। এমনিতে তুমি নেই, তারপর বাবাকে ছেড়েও আমাকে যদি দূরে গিয়ে থাকতে হয়...।

হুঁ। বুঝতে পারছি।

বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি, মা। খুব। বাবাকে ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে থাকতে পারব না। কিন্তু তোমার ওই বান্ধবী কেন আমার আর বাবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে?

তুই এক কাজ কর টুম্পা।

কী কাজ মা?

তোর বাবার সঙ্গে তোর তো খুব ভালো বন্ধুত্বই ছিল।

এখনো বাবা মাঝে-মাঝে খুব ভালো বন্ধুর মতো কথা বলে।

তা হলে তুই তোর বাবাকে বলে ফেল। তুই লিলির কথাটা বাবাকে বলে ফেল।

আমি একটুক্ষণ ভেবে বললাম, সেটা আমি পারব না, মা। বাবা তাহলে বুঝে ফেলবে লিলি খালার ব্যাপারটা আমি জানি।

বুঝলই-বা। তুই তো সত্যিই জানিস।

জানি। কিন্তু বাবাকে সেটা আমি বুঝতে দিতে চাই না। বাবা তাহলে খুব লজ্জা পাবে।

পাক। মা একটু কঠিন গলায় বলল।

না মা। বাবা যদি কখনো লজ্জা পায় আমার সামনে, সেই বাবার সঙ্গে আমি কি আর থাকতে পারব!

সেটা তুই বুঝবি। মা একটু হাসল। আজ যাই তা হলে। শরীরটা ভালো লাগছে না। এই বলে মা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিলিয়ে গেল।

আমারও ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম এলো না আমার। আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। হ্যাঁ, মাকে ওটা আমি ঠিক কথাই বলেছি, বাবাকে বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাবাকে বললে, বাবা বুঝবে লিলি খালার ব্যাপারটা আমি জানি। অর্থাৎ বাবার ওই চেহারাটা আমি বুঝে ফেলেছি। তখন ব্যাপারটা আমার আর বাবার, দুজনের জন্যই খুব লজ্জার হবে না? ওরকম লজ্জা নিয়ে আমরা কি আর একসঙ্গে থাকতে পারব!

তা হলে কী করব আমি? কিছু তো একটা করাও দরকার। আমার মনে হলো, এক কাজ আমি করতে পারি। বাবাকে না-বলে আমি লিলি খালাকে বলতে পারি যে সে খুবই বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে।

 

তিন

ঘটনাটা ঘটল বিকালের দিকে। আমি লিলি খালাকে অপমান করলাম। তবে দুপুরে স্কুলে একটা ঘটনা না-ঘটলে আমি হয়তো লিলি খালার সঙ্গে ওভাবে কথা বলতে পারতাম না। আজ স্কুল ছিল হাফ। দুটোর সময় ছুটি। এদিন শেষ যে পিরিয়ড হয় সেটার নাম ই.সি.এ। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ। এ ক্লাসে কেউ গান গায়, কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, কখনো আবার আমরা নাটক করি। তবে এ ক্লাসের যে টিচার, সে হচ্ছে বজ্জাত টাইপের মানুষ। অনর্গল পান খায় আর চোখ ছোট করে নোংরা-নোংরা কথা বলে। আজ যেমন, ক্লাসের শেষদিকে হঠাৎ আমাকে ডাকল, টুম্পা।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

তুমার বাপে কি লিলিরে বিয়া করছে?

লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেল, কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল, আমার কান্না পেল। আমি কিছু না বলে না-সূচক মাথা নাড়লাম।

তাইলে লিলি রোজ-রোজ তোগো বাড়ি যায় ক্যান! কেইসটা কী?

ক্লাসের সবাই হাসতে আরম্ভ করল, কেউ মুখ টিপে কেউ হো-হো করে। ক্লাস শেষ হওয়ার পরও আমি রেহাই পেলাম না।

আমার পেছনে-পেছনে অনেকে বলতে লাগল- কেইসটা কী, বলি কেইসটা কী!

বাসায় ফিরে আমি কিছুক্ষণ কাঁদলাম! তারপর লিলি খালার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

লিলি খালার কলিংবেল বাজানোর একটা আলাদা ধরন আছে। বিকালবেলা যখনই কলিংবেল বাজল ওভাবে, আমি একদম ছুটে গেলাম। বাবা তার ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই আমি দরোজা খুলে ফেললাম। হ্যাঁ, আমার সামনে লিলি খালাই। লিলি খালা আমাকে দেখে হাসল, ‘কেমন আছ টুম্পা মণি’ বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চাইল। আমি শক্তভাবে দাঁড়িয়েছি দরোজায়। তাকে আমি ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি না। আমি বললাম, আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো।

লিলি খালা হাসিমুখে আমার দিকে তাকাল, বলো।

আপনি আমাদের বাসায় রোজ-রোজ আসেন কেন? লজ্জা করে না আপনার?

ফোলানো বেলুনের গিঁট খুলে দিলে একটু একটু করে যেভাবে চুপসে যায়, লিলি খালার হাসি হাসি মুখ সেভাবে কালো হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, এ তুমি কী বলছ?

কী বলছি সেটা আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন। আমার বাবার কাছে আপনার কী দরকার?

লিলি খালা বলল, সেটা তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো।

না, আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমার বাবা কিছু জানে না। আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি।

ততক্ষণে বাবা পৌঁছে গেছে আমাদের কাছে। বাবা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? লিলি তুমি ভেতরে ঢুকছ না কেন?

লিলি খালা বিষচোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বাবাকে বলল, কী করে ঢুকব! আপনার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে কেন আমি এ বাসায় রোজ রোজ আসি। বলছে, আমার কি লজ্জা নেই!

বাবা কতক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর যা আরম্ভ হলো তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। বাবা কোনোদিনই আমাকে ও ভাষায় বকাবকি করে নি। বাবা কোনোদিন আমাকে ‘ছোটলোক’ ‘অসভ্য’ ‘বেয়াদব’ এসব বলে বকতে পারে তা-ও আমার ধারণায় ছিল না। প্রাণপণ চেষ্টায় আমি চোখের পানি চেপে রাখলাম। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখ ভালো করে ধুয়ে নিলাম। তারপর হনহন করে হেঁটে এসে আমি বাইরের ঘরের দরোজা খুললাম। জোর শব্দে দরোজা বন্ধ করে ছাদে যাব বলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ি পর্যন্ত আমি পৌঁছাতে পারলাম না। তার আগেই সিঁড়িঘরে স্বপনের সঙ্গে দ্যাখা। ও বোধহয় নেমে আসতে নিয়েছিল। আমাকে দেখে থামল, হাসল। কী রে, লিলি খালা এসেছে বলে উপরে চলে এলি?

আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করল না।

তোকে সেই কবে থেকে বলছি, আয় আমরাও ওদের মতো করি।

আমি চুপ করে থাকলাম।

তুই বোকা একটা। ওরা করলে আমরা করতে পারব না। কেন?... ভালোও তো লাগবে।

ভালো কি মন্দ লাগবে, কাজটা উচিত কি অনুচিত, তা আমি একটুও ভাবলাম না। আমার মনে হলো- হ্যাঁ, বাবা যদি পারে, তবে আমি পারব না কেন! আমি স্বপনের দিকে তাকালাম, এখানে?

স্বপন প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল- এখানে মানে! তারপরই খুশিতে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল- আরে শালা, তুই রাজি! বলতে-বলতে স্বপন এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার মুখটা উঁচু করে নিয়ে আমাকে চুমু খেতে আরম্ভ করল। একটু পর টের পেলাম ওর হাত আমার বুকের ওপর। এমনভাবে চেপে ধরল, আমি একদম কঁকিয়ে উঠলাম। এর ঠিক পরপরই আবার কঁকিয়ে উঠলাম, কে যেন আমার চুল ধরে প্রচণ্ড টানছে।

আমি দেখলাম আমার সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছে, তার একটা হাত আমার চুলে, বাবাকে উন্মাদের মতো মনে হচ্ছে। ততক্ষণে স্বপন আমাকে ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে প্রচণ্ড দ্রুত নেমে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করল, আমি যেন এই মুহূর্তে মরে যাই।

বাবা আমাকে মারতে-মারতে নিচে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল লিলি খালার পায়ের কাছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে বাবা বলল- এই দৃশ্য দেখব বলে আমি ছাদে গিয়েছিলাম! লিলি, তুমি জানো লিলি কী হয়েছে! মেয়ে আমার রাগ করে ছাদে গেল বলে লিলি আমিও তোমার কথা মতো গেলাম ছাদে। তুমি ভয় পেয়েছিলে, মেয়ে আমার রাগের মাথায় কিছু করে বসে কি না।... কী করছিল ও জানো, শুনবে?

চার

যদি এমন হতো আমার আর কোনোদিন বাবার মুখোমুখি হতে হলো না। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। একই বাসায় আমরা থাকি, দ্যাখা আমাদের হবেই। দ্যাখা আমাদের হচ্ছেও, দ্যাখা হওয়া মানে সামনাসামনি হয়ে যাওয়া। তবে বাবা আমার সঙ্গে কথা বলছে না। ওই বিকেলের পর দুদিন হলো বাবা আমার সঙ্গে একটা কথাও বলে নি। আমিও বলি নি, বলার মতো অবস্থা নয় আমার। তবে কিছু কথা আমার বলার আছে। অবশ্য এও আমি জানি, ওসব কথা আমি কোনোদিনও বাবাকে বলতে পারব না।

আচ্ছা, বলতে না-হয় না-ই পারলাম, আমার লজ্জা আমি কাটিয়ে উঠব কী করে? অমন একটা লজ্জা সঙ্গে রেখে একই ছাদের নিচে বাবার সঙ্গে বেশিদিন আমি থাকতে পারব না। কিন্তু কী করে আমি এই লজ্জা কাটাব? আমি কোনো উপায়ই খুঁজে পেলাম না। তা হলে কি বাবাকে ছেড়ে আমাকে মামাবাড়ি চলে যেতে হবে? মামাবাড়িতে একটা সুবিধা- বাবার মুখোমুখি হতে হবে না আমাকে।

মামাবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আসল কথা হচ্ছে বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমি বাবার সঙ্গেই থাকব। শুধু বাবাকে বুঝতে হবে- ওদিনের ওই ঘটনার জন্য আমি একা দায়ী নই। আমি কখনও একটা বাজে মেয়ে নই। আমি কী করলে বাবা এটা বুঝবে? বহু ভাবনা-চিন্তার পর আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমার মনে হলো আমি একটা কাজ করতে পারি- সেটা হলো বাবাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলা। বাবাকে যদি লিলি খালার সঙ্গে ওরকম কোনো অবস্থায় ধরে ফেলতে পারি, তা হলে বাবাও নিশ্চয় আমার কাছে লজ্জা পাবে। তখন আমার লজ্জা আর বাবার লজ্জা কাটাকাটি হয়ে যাবে। আমাদের আর একসঙ্গে থাকতে অসুবিধা হবে না।

আমি যে কাজটা করব বলে ভাবলাম সেটা মোটেও সহজ নয়। আমি চাইলেই কি বাবা আর লিলি খালাকে হাতে-নাতে ধরতে পারব! কীভাবে সেটা সম্ভব? কিন্তু ততদিনে আমার রোখও চেপে গেছে। আমি একটা দুঃসাহসিক পকিল্পনা নিলাম। প্রথমে আমি আমাদের বাইরের দরোজার ডুপ্লিকেট চাবিটা জোগাড় করলাম। আমাদের বাইরের দরোজার লকটা টেনে দিলেই বন্ধ হয়ে যায়। আমরা ওভাবেই দরোজা বন্ধ রাখি, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছাড়া ছিটকিনি লাগাই না। চাবিটা হাত করে আমি বাবাকে বললাম, আমার আগামীকাল এক বন্ধুর জন্মদিনে যেতে হবে। রাত আটটার আগে ফিরতে পারব না। বাবা গম্ভীর মুখে দু’শ টাকা দিয়ে বলল, কিছু একটা কিনে নিও। আর রাত বেশি হওয়ার আগেই ফিরে এসো। আমি বললাম, সুমনাও যাবে। বলেছে ফেরার পথে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

পরদিন বিকেলে আমি একটু সাজগোজ করলাম। তারপর বাবাকে দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। কোথায় যাব, তার অবশ্য ঠিক নেই। একটা রিকশা নিলাম আমি। ছুটির দিন, স্কুল বন্ধ, তবু ওই স্কুলের মাঠেই কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। তারপর আরেকটা রিকশা নিলাম। মিনিট দশেক এদিক-ওদিক ঘুরলাম, রিকশাঅলাকে বললাম বাড়ির দিকে যেতে। আমাদের ফ্ল্যাট-সিস্টেম বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকতেই স্বপনের সঙ্গে দ্যাখা। ও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি ওকে একটুও গুরুত্ব দিলাম না। আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে। আমার বুকের ভেতর ঢিবঢিব করছে। পরিকল্পনা মতো কাজটা হবে কি না, এই আশঙ্কাও আছে। হয়তো লিলি খালা আসেই নি, হয়তো বাবা বাইরের দরোজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে, হয়তো লিলি খালা আর বাবা দূরে-দূরে বসে গল্প করছে।

আমি দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু সময় নিলাম। ব্যাগ খুলে চাবি বের করলাম। খুব সাবধানে দরোজা খুললাম যেন একটুও শব্দ না হয়। বাইরের ঘরে কেউ নেই। আমিও কিছুটা সময় নিলাম। মৃদু হাসির শব্দ পেয়ে আমি উৎফুল্ল বোধ করলাম। মৃদু পায়ে আমি এগোলাম। আমার মনে হলো এই এখনই আমার সব লজ্জার অবসান হবে। আমি দরোজার কাছে ঘুরলাম, এবং চোখের সামনে যা দেখলাম তাতে আমার মনোবাসনা পূর্ণ হলো। আমি দেখলাম খাটে বসে আছে লিলি খালা। লিলি খালার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে বাবা। লিলি খালা ঝুঁকে পড়ে বাবাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছে। দরোজার কাছে আমাকে দেখে দুজনের যে কী অবস্থা হলো, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। বাবা ধড়মড় করে উঠে বসে পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি স্বস্তি বোধ করলাম, বাবাও আমার কাছে ধরা পড়েছে। আমার লজ্জা আর বাবার লজ্জা তাহলে কাটাকাটি হয়ে গেল। কিন্তু আমার এই অনুভূতি সামান্য সময়ের জন্য। কয়েক মুহূর্ত পরেই আমি বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে একটা। আমি আর বাবা- দু’জন দু’জনকে চিনে ফেলেছি। আমাদের আর একত্রে থাকা সম্ভব না।

আমি হাঁপিয়ে ওঠার মতো গলায় বললাম, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। আমি ঠিক করেছি আমি মামাদের ওখানে গিয়ে থাকব।

বর্ষ ৪ সংখ্যা ৬, ১-১৬ এপ্রিল ১৯৯৯

Leave a Reply

Your identity will not be published.