নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পঞ্চম পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পঞ্চম পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব।]

এরপর আবার শুরু হলো যাত্রী খোঁজা। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করে এক হোটেলের সামনে গেলাম, গিয়ে দেখি সেখানে অনেকগুলো ট্যাক্সি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। হোটেলটির নাম ‘ওয়ালডর্ফ এস্টোরিয়া’। এই হোটেলের নাম আমার স্ত্রী, শাশুড়ির মুখে কতো শুনেছি! কারণ আমার শ্বশুর এই হোটেলে কাজ করেন। যা’ হোক, ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যেসব ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগ ড্রাইভারই বাংলাদেশি। তুমুল আড্ডা হচ্ছে, আড্ডার বিষয় সবই ট্যাক্সিকেন্দ্রিক। কোন প্যাসেঞ্জার ভাড়া না দিয়ে পালাল, কোন প্যাসেঞ্জার টিপস দিল না, মাতাল মেয়ে বমি করে গাড়ি ভাসিয়ে দিলো, পুলিশের যন্ত্রণা, টিএলসির যন্ত্রণাসহ নানান বিষয়। দুই-একজনের সাথে পরিচয় হলো। একেকজন বিশ-পঁচিশ বছর যাবৎ ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। আমি আজ প্রথম কাজে নেমেছি শুনে অভয় দিলেন। বললেন, মোটেও ভয় পাবেন না, ঠিকমতো গাড়ি চালাতে জানেন তো? বললাম, জানি। তবে রাস্তাঘাট তো চিনি না। বয়স্ক ভদ্রলোকটি বললেন, আরে ছোটভাই, মায়ের পেট থেকে তো কেউ রাস্তা শিখে আসে না। চালাতে চালাতে শিখবেন। আমরাও এভাবে শিখেছি।

তাদের কথা শুনে মনে সাহস পেলাম। হোটেলের ডোরম্যান কিছুক্ষণ পর পর ভেতর থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে আসছে। প্রায় সবার সাথেই লাগেজ। বেশিরভাগই এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার। নিউইয়র্ক শহরে দুটো এয়ারপোর্ট আছে। একটি ‘লা গুয়ার্ডিয়া’ (কানাডা ছাড়া প্রায় সব ফ্লাইটই এখানে অভ্যন্তরীণ) অন্য এয়ারপোর্টটি হচ্ছে জে এফ কে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নামে।  আন্তর্জাতিক-অভ্যন্তরীণ— সব ধরনের ফ্লাইটই সেখানে নামে। ম্যানহাটান থেকে এই দুটো এয়ারপোর্টে কীভাবে যেতে হয় তা আমি জানি। তবে নিউইয়র্কে আসা লোকজন আরেকটি এয়ারপোর্ট তাঁদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। সেই এয়ারপোর্টটি নিউ জার্সিতে। নাম ‘নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্ট’। নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টে কীভাবে যেতে হয় তা আমি জানি না, কখনো সেখানে যাওয়া হয় নি। নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার গাড়িতে উঠলে আমি তা অন্য গাড়িতে দিয়ে দেব বলে ভাবছি আর যে কেউ তা লুফে নেবে। কারণ সেই এয়ারপোর্টে যাওয়ার ভাড়া অনেক। একটা একটা করে গাড়ি লাইন ছেড়ে যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। এক সময় আমার পালা এল। প্রায় সাত ফুট লম্বা হিমালয় পর্বত সাইজের এক আমেরিকান লোক আমার গাড়িতে উঠল সাথে তাঁর স্ত্রী। উঠেই বলল, লা গুয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্ট প্লিজ। টার্মিনাল বি। লম্বুকে ঠিক মতনই এয়ারপোর্টে নিয়ে গেলাম কিন্তু ডিপার্চারের বদলে এরাইভাল লাউঞ্জে নামিয়ে দিলাম। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারলেও কিছু বলে নি। আমাকে ত্রিশ ডলার ভাড়া দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।  

নিউইয়র্ক শহরের প্রতিটি এয়ারপোর্টে ‘ট্যাক্সি হল্ড’ আছে, যেখানে এয়ারপোর্টে আসা খালি ট্যাক্সিগুলো প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। আমি ট্যাক্সি হোল্ডে ঢুকলাম না। সাহসে কুলালো না। খালি ট্যাক্সি নিয়ে ম্যানহাটানে ফিরে গেলাম। একটার পর একটা প্যাসেঞ্জার গাড়িতে উঠছে, মিটারে পয়সা উঠছে, দেখে ভালো লাগছে। থার্ড এভিনিউ এইটি ফার্স্ট স্ট্রিট, সেকেন্ড এভিনিউ সেকেন্ড স্ট্রিট, অমুক এভিনিউ তমুক স্ট্রিট মাথার ঘায়ে আমার তখন কুত্তা পাগল অবস্থা। ট্যাক্সিস্কুলে রাস্তাঘাট সম্বন্ধে পড়াশুনা করলেও প্র্যাক্টিকেলি ব্যাপারটা নতুন। আনকোরা ড্রাইভারের জন্য বেশ কঠিন। প্রায়ই ভুলে যাচ্ছি কোন এভিনিউ দক্ষিণে যায় কোনটা যায় উত্তরে!

ডাউন টাউন থেকে কালো এক মহিলা উঠল। উঠেই বলল, ব্রুকলিন যাবে।

ব্রুকলিন নাম শুনে আমার মাইল্ড স্ট্রোক হওয়ার উপক্রম হলো। ব্রুকলিন আমি কখনো যাই নি, কীভাবে যেতে হয় সেটা কাজর আর মানসিক চাপে ভুলে গেছি।

মহিলাকে বললাম, দেখো আমি নতুন ড্রাইভার। রাস্তাঘাট ভালো চিনি না। যদি তুমি দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো, তাহলে আমার সুবিধা হয়। কথাটা বলার পর মনে পড়ল, সিলেট শহরে অন্য শহরের রিকশাওলারা নতুন অবস্থায় প্যসেঞ্জারদের এই একই কথাটা বলত, ‘স্যার আমি নতুন’ রাস্তাঘাট চিনি না চিনায়া নিয়েন।’ আজ আমারও একই অবস্থা।

কালো মহিলা বলল, কোনো সমস্যা নাই। আমি তোমাকে ডাইরেকশান দিচ্ছি। তুমি চালাও।

ব্রুকলিন ব্রিজের উপর গাড়ি চালাচ্ছি। এ ব্রিজটা টিভিতে, ছবিতে হাজারবার দেখলেও কখনো এতে ওঠা হয় নি। বালির রঙে রং করা প্রায় এক শ বছরের পুরোনো এক ব্রিজ। জার্মান এক ইঞ্জিনিয়ারের ডিজাইন করা প্রথম সাসপেন্সন ব্রিজ।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.