১১ অক্টোবর বেইলী রোডের বাসায় দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে চেয়ারে বসেছিলেন তিনি। সেই অবস্থায়ই তিনি না-ফেরার দেশে যাত্রা করেন। তাই স্ত্রী লাকী ইনামের ডাকে তিনি সাড়া দেন নি। চিকিৎসক এসে তাঁর পালস খুঁজে পান নি। তাঁর চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জানান
ইসলামিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা.যখন সেখানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বলছি ড. ইনামুল হকের কথা। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে ফেনী সদরের মটবী এলাকায় জন্ম হয় তাঁর। বাবার নাম ওবায়দুল হক ও মা রাজিয়া খাতুন। ড. ইনামুল হকের পুরো পরিবারই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তাঁর স্ত্রী লাকী ইনাম বরেণ্য নাট্যজন। তাঁদের সংসারে দুই মেয়ে হৃদি হক (স্বামী লিটু আনাম) আর প্রৈতি হক (স্বামী সাজু খাদেম)।
ফেনী পাইলট হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ও এমএসসি সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভ করেন ড. ইনামুল হক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘ ৪৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার সময় ১৫ বছর রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নটরডেম কলেজে পড়াশোনাকালীন তিনি প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। ফাদার গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় সেই নাটকের নাম ছিল ‘ভাড়াটে চাই’। তাঁর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক মুস্তাফা মনোয়ার পরিচালিত ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। এটি ছিল শেক্সপিয়রের নাটকের মুনীর চৌধুরী কর্তৃক অনুবাদ। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য অন্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’ এবং ‘বৃহন্নলা’। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’।
১৯৬২ সালে নাটক করার মধ্য দিয়ে ড. ইনামুল হক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিটি সময়েই তিনি লড়াকু সৈনিকের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। নাটকই ছিল তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সৃজনীর ব্যানারে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পথনাটক করেছিলেন। এভাবেই স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন ড. ইনামুল হক।
ষাট দশকে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রনাটকেও অভিনয় করেন ড. ইনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সৃজনীর হয়ে। পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রসংগীত, নাটক-সাহিত্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন তিনি আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাটক করার মধ্য দিয়ে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
ড. ইনামুল হক বহু নাটক লিখেছেন। তাঁর লেখা প্রথম নাটক ‘অনেক দিনের একদিন’ নির্মাণ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। পূর্ব পাকিস্তানের শেষ টিভি নাটক ‘আবার আসিব ফিরে’, স্বাধীন বাংলাদেশে বিটিভির প্রথম টিভি নাটক ‘বাংলা আমার’ এবং একুশের প্রথম টিভি নাটক ‘মালা একশত মালঞ্চের’ তাঁরই লেখা ছিল। তাঁর ১৮টি নাটক বিভিন্ন নাট্যপত্র, বিশেষ ম্যাগাজিন এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নির্জন সৈকতে, সেইসব দিনগুলো, কেবা আপন কেবা পর, বিবাহ উৎসব, গৃহবাসী, মুক্তিযুদ্ধ নাটকসমগ্র, স্ট্রিন্ডবার্গ-এর দুটো নাটক, মহাকালের ঘোড়সওয়ার, বাংলা আমার বাংলা ইত্যাদি।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। দলটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ড. ইনামুল হক। এই দলের হয়ে প্রথম তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে। এরপর এই দলের হয়ে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘নূরল দীনের সারা জীবন’সহ আরও বহু নাটকে অভিনয় করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। তিনি এই দলটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। নাট্যাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক (২০১২)।
এখন তিনি বনানী কবরস্থানে শুয়ে আছেন। তবে তাঁর চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। ভক্ত-অনুরাগীদের হৃদয় আর তাঁর সৃষ্টির মাঝে তিনি বিরাজ করবেন চিরকাল।
Leave a Reply
Your identity will not be published.