চির অমলিন

চির অমলিন

নায়করাজ বলে যিনি অভিহিত হয়েছিলেন, অর্জন করেছিলেন অভাবনীয় তুমুল জনপ্রিয়তা, মানুষের মনে প্রসন্নতার এবং আনন্দময় ভুবন সৃষ্টির গভীর দাগ কাটতে পেরেছিলেন, সেই রাজ্জাককে আমি চিনি তার অভিনয়জীবনের সূচনালগ্ন থেকে। তার ব্যাপ্তিকে ক্রমশ বিস্তারিত হতে দেখে অনুভব করতে পেরেছি জিরো থেকে হিরো উপমাটির সার্থকতা। স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় প্রতিভার সঙ্গে অকল্পনীয় পরিশ্রম করার দুর্লভ ক্ষমতার অপূর্ব এক মেলবন্ধন তিনি ঘটাতে পেরেছিলেন। তার প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল নিজেকে অবিরাম অতিক্রমণের, যেন তাকে যেতে হবে অনেকদূর পর্যন্ত। পেশাগত জীবনে শীর্ষদেশে পৌঁছানোর স্পৃহাকে তিল তিল পরিশ্রম করে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বুঝিবা তার বিশ্বাস সমর্পিত ছিল মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের সেই পঙক্তিনিচয়। আমাকে যেতে হবে অনেক দূর, ঘুমিয়ে পড়ার আগে।

প্রবল নিষ্ঠা আর একাগ্র চিত্তে তিনি শিল্পের সেই কঠিন পথ ধরে ছুটে গেছেন এবং সফলতা অর্জন করেছেন। আমি তাকে নিঃস্ব অবস্থা থেকে বিশ্বসভায়  উত্তীর্ণ হতে দেখেছি। তার সেই নিঃস্ব অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করছি।

 

টেলিভিশনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ১৯৬৬ সাল থেকে। সেখানেই রাজ্জাককে আমি প্রথম দেখি। আমি তখন ১৬ বছরের কিশোর। আমার। কৈশোরকালে টেলিভিশন ছিল সোনালি জাদুর কাব্য। খুব চাইতাম টেলিভিশনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। আমার এই তুমুল আগ্রহের কথা  অবহিত হয়ে কবি জসীমউদ্দীন আমাকে টেলিভিশনের তত্ত্বালীন কর্মকর্তা শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি চুক্তিভিত্তিক স্ক্রিপ্ট রচয়িতা হিসেবে যোগদান করি। সেই সময় টেলিভিশনে 'ঘরোয়া' নামে একটি প্রামাণ্য নাট্যানুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানটির বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের গুণাগুণ কীর্তন করা। অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করতেন মেধাবী। প্রযোজক জামান আলী খান, যার স্ত্রী ছিলেন সুঅভিনেত্রী আজমেরী জামান রেশমা। সেই অনুষ্ঠানটির সহ-প্রযােজক ছিলেন মুসা আহমেদ। তিনি ‘ঘরোয়া’তে অভিনয়ও করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। মুসা আহমদ একদিন রাজ্জাককে নিয়ে এলেন ‘ঘরোয়া’তে অভিনয় করানোর জন্য। সুদর্শন চেহারার রাজ্জাক সম্পর্কে জানলাম, কলকাতার অভিনয় জগৎ বলে খ্যাত টালিগঞ্জের বাসিন্দা উনি। তার খুব শখ অভিনয়ের প্রতি। চৌষট্টি সালে কলকাতায় দাঙ্গা বেধে যাওয়াতে তিনি আট  মাসের পুত্র বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকায় নিঃসম্বল অবস্থায় চলে এসেছিলেন। থাকেন ঢাকার কমলাপুরের ঠাকুরপাড়ার একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে। আমার আত্মীয়  জহিরুল হক তার অভিনয়প্রীতি দেখে মুসা আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই তার টেলিভিশনে আগমন। ঘরোয়া' নাটকে চমৎকার, স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে রাজ্জাক সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তার অভিনয়ের মাঝে সজীবতা ছিল। আমি তখন মুসা আহমদের সহকারী হিসেবে রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। ঘরোয়ার মহড়াতে তার সঙ্গে কথা কথা  বলতাম। টালিগঞ্জে থাকার সুবাদে রাজ্জাক বড় হয়েছিলেন কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস, বসন্ত চৌধুরীর অভিনয় দেখে। স্মৃতিকথায় রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, তাদের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে একদিন তাদের মতো হওয়ার সংকল্প করেছিলেন। একদিন একটি ঘটনায় আমি বুঝতে পারলাম, কতটা দৈন্যদশায় কাটছে তার জীবন। ঘরোয়া’ নাটকের আরেকজন অভিনেতা ছিল এ এফ এম আবদুল আলী (লালু)। টেলিভিশনে ‘কইনচেন দেহি' বলে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেই লালু কি এক দাপ্তরিক কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ায় একবার মহড়ায় আসতে পারলেন না। স্বাভাবিকভাবেই প্রযোজক নাটকের ওই পর্বের প্রচার বাতিল করলেন। বিষয়টা জেনে রাজ্জাক বিমর্ষ হয়ে বললেন, তাহলে তো আমার বাজার করাই হবে না। |

কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম। সেই সময় একটি পর্বে অভিনয়ের জন্য পাওয়া যেত ৬৫ টাকা। ওই টাকার অভাবে রাজ্জাকের বাজার হবে না জানতে পেরে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। যে লোকটি টেলিভিশনে বিভিন্ন পণ্যের গুণাগুণ প্রচার করছেন তার সেগুলো ক্রয় করার ক্ষমতা নেই। রাজ্জাক তার স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, তখন আমার খুব দুর্দিন ছিল। যত দিন যায় ততই অভাব-অনটনে পড়তে থাকি। দারুণ অর্থকষ্টের মাঝে দিনাতিপাত করতে থাকি। |

 আমি তার সেই দুঃসময়ের কথা বলেছিলাম চ্যানেল আই আয়োজিত রূপসী বাংলা হোটেলের এক অনুষ্ঠানে। সামনের সারিতেই বসেছিলেন রাজ্জাক। আমি চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, তারা যেন দুস্থ শিল্পীদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা যখন রানী সরকার-মেজবাহকে সহযোগিতা করেছিলেন, রাজ্জাক তখন বিত্ত-বৈভবে সমুজ্জ্বল। উত্তরার সুবিশাল বাণিজ্যিক প্রকল্প রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী হিসেবে আর্থিকভাবে নিরাপদ। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্জাক বলেছিলেন, আলী ইমাম সাহেব আজকে আমার দুঃসময়ের কথা বলে আমার স্মৃতিতে নাড়া দিয়েছেন। এই হচ্ছে জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠার উপাখ্যানের সূত্রপাত। কমলাপুরে থাকার সুবাদে এদেশের প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আবদুল জব্বার খান টালিগঞ্জে বেড়ে ওঠার কারণে রাজ্জাককে গ্রহণ করলেন। তাকে তার প্রোডাকশনের চার নম্বর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। সেই সময় জব্বার খান তৈরি করছিলেন উর্দু ছবি ‘উজালা'। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি দুর্মর বাসনা রাজ্জাকের। সে কারণে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার কাছাকাছি ফার্মগেটে বাসা ভাড়া নিলেন। চলাচল করতেন গণপরিবহনে। চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য কোথাও ঠিকমতো সুযোগ না পেয়ে দারুণ মনোকষ্টে ভুগছিলেন রাজ্জাক। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই হতোদ্যম হন নি। তিনি জানতেন, এই পথটি অত্যন্ত বন্ধুর। সুঅভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'যখন নায়ক  ছিলাম’-এর শেষ দিকে মন্তব্য ছিল, “হে নব্যযুগের নায়কেরা, তোমরা আজ যে মসৃণ রাস্তাটির উপর দিয়ে সাই সাই করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ, ওই রাস্তাটিকে তৈরি করে দিতে আমাদের বুকের পাঁজরের হাড় গুড়ো গুড়ো করে দিতে হয়েছে। রাজ্জাক বিশ্বাস করতেন, এই রাস্তা নির্মাণের জন্যে তাকেও বুকের পাঁজরের হাড় গুড়ো গুড়ো করে দিতে হবে। রাজ্জাক তখন চূড়ান্তভাবে সংগ্রাম করছেন। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় কলকাতা ফিরে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। তার স্ত্রী লক্ষী তখন সাহস জুগিয়ে বলেছিলেন, এখানে এসেছ যখন তখন শেষ পর্যন্ত দেখ। সেসময় এমনও তিক্ত দিন গিয়েছে রাজ্জাকের, যার কথা স্মরণ করে রাজ্জাক স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ‘দুটি বাচ্চাই শিশুসন্তান। আমি-স্ত্রী একবেলা উপোসই থাকি।'

 

ওভাবে না খেয়ে, অভুক্ত থেকে, অনমনীয় চিত্তে রাজ্জাক তার স্বপ্নকে চরিতার্থ করার জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। আসামের রাজকুমার প্রমথেশ  বড়ুয়া তার স্বপ্ন দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করা প্রমথেশের অভিনয়শৈলী তাকে আকৃষ্ট করে। কীভাবে অভিনয়শিল্পের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে উদ্বেলিত করা যায়, দর্শকচিত্তকে স্পর্শ করা যায়, তা নিখুঁতভাবে জানতেন জমিদার তনয় প্রমথেশ বড়ুয়া। আর ঢাকায় উপবাসে থেকে রাজ্জাক সুকঠিনভাবে সে অভিনয়শৈলীর চর্চা করতেন। তার একটাই স্বপ্ন, অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের আলোড়িত করতে হবে, স্পন্দিত করতে হবে। উত্তমকুমার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র সাড়ে চুয়াত্তর থেকেই রাজ্জাক অভিনয়শিল্পের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন উত্তমকুমারকে। তার আগে বাংলা ছবিতে অন্য কেউ এমন রোমান্টিক আবহ তৈরি করতে পারেন নি। চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে ওই  ভাবটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারতেন ওরল ফিল্ম, মন্টখোমারি ক্লিভড। ওরা সবাই ছিল রাজ্জাকের আদর্শ। বসন্ত চৌধুরীর বলার ভঙ্গি তাকে আকর্ষণ করেছিল। সব মিলিয়ে অবিরাম শ্রম করে রাজ্জাক নিজের ধারাটিকে তৈরি করলেন। | জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মুসা আহমেদ। ‘ঘরোয়া’তে অভিনয় করার সুবাদে মুসা আহমদের সঙ্গে রাজ্জাকের দারুণ সখ্যতা হয়ে যায়। রাজ্জাকের অভিনয়শৈলীর প্রশংসা করতেন মুসা আহমদ। জহির রায়হান তখন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’র কাহিনি নিয়ে। ছবি তৈরির কথা ভাবছেন। মুসা আহমদের ধারণা হলো, মন্তু চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক উপযুক্ত। বিল থেকে শাপলা তোলা দৃশ্যে তাকে অপূর্ব লাগবে। রাজ্জাক জহির রায়হানের দুটি আকর্ষণ করলেন। তাকে বললেন, আমি আপনাকে নায়ক করব। জহির রায়হান তখন এদেশে প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। ‘বাহানা তৈরি করছিলেন। জহির রায়হান রাজ্জাককে ‘বেহুলা' ছবিতে নায়ক হিসেবে নিলেন সেখানে চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর হিসেবে তার আবির্ভাব। প্রথম দিন চুক্তি স্বাক্ষরের অর্থ হিসেবে পাঁচশত টাকা দিলেন। নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। ছবিটি দারুণ ব্যবসা সফল হয়েছিল। রাজ্জাক জানিয়েছেন, 'আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। জহির রায়হানের মতো মেধাবী নির্মাতার হাতে গড়ে উঠেছিলাম বলে আমি আজকের রাজ্জাক হতে পেরেছি। পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কলকাতার ছবি এখানে প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন উত্তম-সুচিত্রা জুটি তুমুলভাবে জনপ্রিয়। এতটাই জনপ্রিয় যে, তারা যেন প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। উত্তমের কথা প্রক্ষেপণের ভঙ্গিটি দর্শকদের একান্তভাবে মুগ্ধ করে রাখত। রাজ্জাক তার অভিনয় কুশলতা দিয়ে তখন যেন উত্তমের স্থানটিকে দখল করে নিলেন। সেই মিষ্টি করে ভুবনভোলানো হাসি, গাঢ় দৃষ্টিতে তাকানো, মুখাবয়বে রোমান্টিকতার আভাসও যেন এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিনি ভিডি ভিসি। তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। এ তো শুধু জয় নয়, দর্শক চিত্তে তোলপাড় তোলা। আমাদের অভিনয়শিল্পে নায়কোচিত ক্ষেত্রে নতুন এক মাত্রা সংযোজন করলেন রাজ্জাক।

রাজ্জাক-সুচন্দা জুটি উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিকল্প হয়ে গেল। এই জুটির ছবিগুলো হলো, আনোয়ারা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘দুই ভাই’, ‘জীবন সংগীত, ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘প্রতিশোধ', ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘সংসার’, ‘মনের মতো বউ', যে আগুনে পুড়ি’, ‘সখিনা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘জুলেখা’, ‘যোগ বিয়োগ’ | ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মিত জীবন থেকে নেয়া' ছবিতে রাজ্জাকের প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে অভিনয় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন সর্বসেরা হতে, তাই তিনি হয়েছেন। জহির রায়হান ছিলেন তার চলচ্চিত্রজীবনে অন্যতম দিকনির্দেশক। মানসম্মত কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন রাজ্জাক।

১৯৬৯ সালে কাজী জহির পরিচালিত, রাজ্জাক অভিনীত ‘ময়নামতি চলচ্চিত্রটি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। সেই ছবিতে রাজ্জাকের ঠোটে গান ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাধন খুলে যায়’ ও ‘ডেকো না আমারে প্রচণ্ড রকমের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। দর্শকদের মুখে মুখে ফিরত সেই গান। গীতিকার ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। একই বছর নির্মিত নারায়ণ ঘােষ মিতা পরিচালিত জীবনমুখী পারিবারিক চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে' রাজ্জাককে আরও জনপ্রিয় করে তুলল। সেই ছবির গান ‘নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা’ যুব মহলে আলােড়ন তুলেছিল, প্রচণ্ডভাবে স্পন্দিত করেছিল। পাশাপাশি রাজ্জাকের ঠোটে ‘হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায় তুমুল। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭২ সালে কাজী জহির পরিচালিত 'অবুঝ মন' রাজ্জাককে দর্শকদের কাছে নতুনভাবে পরিচিত করেছিল। সেই ছবির একটি গান ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয় জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান দখল করেছিল। ১৯৭৩ সালে জহিরুল হক পরিচালিত ‘রংবাজ’ ছবিতে রাজ্জাকের আগমন ঘটল অ্যাকশন নায়ক হিসেবে। স্থানীয় মাস্তান চরিত্রে রাজ্জাকের অনবদ্য অভিনয়শৈলী দর্শককে মাতিয়ে দিল। দ্বীপ জ্বেলে যাই' ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মাতাল চরিত্রে গাওয়া এমন বন্ধু আর কে আছে যেমন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তেমনি ‘রংবাজ’ ছবিতে মাতাল চরিত্রে গাওয়া ।

 রাজ্জাকের ঠোটে গান ‘এই পথে পথে আমি একা চলি’ দর্শককুলকে আন্দোলিত করেছিল। রাজ্জাকের ঠোঁটে বৃষ্টিভেজা রােমান্টিক গান ‘হই হই হই রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে' অন্যতম সেরা গান বলে বিবেচিত হলো। ১৯৭৭ সালে রাজ্জাক ‘অনন্ত প্রেম' ছবির সফল পরিচালক হিসেবে আবির্ভুত হলেন। এভাবেই অনন্যসাধারণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন রাজ্জাক। ষাটের দশকে রহমান এদেশে রােমান্টিক নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় পা হারানোর পর রহমান এদেশের রুপালি পর্দা থেকে বিদায় নিয়ে ছিলেন। সেই অভাব পূরণের জন্য উত্তমকুমারের ইমেজ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন রাজ্জাক।

 

বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয়শৈলী প্রদর্শন করে রাজ্জাক এমন পর্যায়ে উপনীত হলেন যে, ‘চিত্রালী' পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী তাকে ‘নায়করাজ' উপাধিতে ভূষিত করেন। আসলেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য মুকুটহীন সম্রাট। তিনি গভীর মমতার সঙ্গে উচ্চারণ করতেন, ‘আমার প্রেম আমার ভালোবাসা, আমার সব অভিনয় চলচ্চিত্রকে ঘিরেই। এ ছাড়া আমি আর কিছু জানি না, পারি না। এদেশের চলচ্চিত্রে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয়শিল্পের কুশলতায়, দক্ষতায় বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশের দর্শক এই নায়করাজের ভুবনভােলানাে হাসি, | রোমান্টিক ম্যানারিজম, নিষ্পাপ দৃষ্টি আর অভিনয়ের নেশায় তিন প্রজন্ম পেরিয়ে আজও যেন ঝুঁদ হয়ে আছে। |

২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি এক সাক্ষাঙ্কারে রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, ‘আমি রাজ্জাক হয়তো অন্য কোনো চাকরি করতাম অথবা ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ছোটবেলার অভিনয় প্রচেষ্টাকে আমি হারাতে দিই নি। আমি নাটক থেকে চলচ্চিত্রে এসেছি। সবাই আমাকে চিনেছে। পেয়েছি সাফল্যও। বাংলার মানুষজন আমাকে একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবেই দেখেন ও আমাকে ভালোবাসেন। আজকে আমার যা কিছু হয়েছে, সবাই এই চলচ্চিত্রশিল্পের কল্যাণে।' আরেকটি সাক্ষাঙ্কারে ২০১৬ সালে জানিয়েছিলেন, আমার জগৎ, ধ্যানজ্ঞান সবই ছিল চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়কে কেন্দ্র করে। অভিনয়টাই ছিল রক্তের ভেতর। হ্যা, হয়তো রাজনীতি করতে পারতাম, এমনকি-মিনিস্টার হতে পারতাম। কিন্তু ওটা তো আমার স্বপ্ন বা পেশা নয়। আমি স্বপ্ন দেখেছি নায়ক হব, ভালো অভিনেতা হব। নিজের অন্তরে যা বসাতে পারব না, সেটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করব কেন? আমার তো পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমি কেন রাজনীতি করব?'

চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে তিনি আপামর দর্শক সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তিনি একজন মায়ের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ছেলের মতো বোনের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ভাইয়ের মতো, আর যুবতী নারীর কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রেমিকের মতো এভাবেই | দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্রশিল্পে অর্ধশতাব্দী ধরে বিরাজ করেছিলেন রাজ্জাক। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২১ আগস্ট ৫:২০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি না-ফেরার দেশে চলে যান। কালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেলেন নায়করাজ রাজ্জাক। বিগত ৭৫ বছরের জীবনে ৫৩ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে শাসন করেছেন ম্রাটের মতো। ওই সম্রাটের স্মৃতি আমাদের চিত্তে চির অমলিন হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.