এই পথ চলে গেছে বহুদূর সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্ত রেখা ফেলে অনন্তের পথে। চলে গেলেন কবি হেলাল হাফিজ। কী রেখে গেলেন কবি? গুটিকয়েক কথার বীজ ছড়িয়ে দিলেন বাতাসে, সময়ের স্রোতে।
১৩ ডিসেম্বর, রাতে নিঃশব্দে একা একা ফিরে গেলেন। এক যুগান্তর কবি, যাঁর ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিতে বাতাস কেঁপে ওঠে। প্রবহমান জীবন তরঙ্গের বুদ্বুদ ফেলে চলে গেলেন একজন সাহসী ও সাধক কবি।
আমার সাথে হেলাল হাফিজের সরাসরি কোনো পরিচয় ছিল না। পরিচয় ছিল তাঁর ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিতে এবং উচ্চারণে। ১৯৮৭-এর মাঝামাঝি আমি তখন মিজানুর রহমান মিজান সম্পাদিত দৈনিক খবর পত্রিকার সাথে জড়িত। এবং সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় টুকিটাকি লেখালেখি করি। আমাদের সিনিয়র বড় ভাই সুবিখ্যাত ছড়াকার-কবি এবং দৈনিক খবরের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আবু সালেহ। যাঁর হাতে আমার লেখা প্রকাশনার হাতেখড়ি।
আবু সালেহ ভাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, স্বাধীনতা উত্তর কালের ১৫ জন কবির সাক্ষাৎকারসহ সাহিত্য আলোচনা-সমালোচনার। আমি যেহেতু সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিয়োজিত, সেহেতু বিষয়টি আমার ভীষণ মনঃপুত হয়েছিল। নেমে পড়লাম কাজে। কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি হেলাল হাফিজ, কবি হাসান হাফিজের লেখার উপরে এবং তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও সাক্ষাৎকারের প্রতিলিপি দৈনিক খবরের পাতায় পাক্ষিক প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব পেলাম। আনন্দের সাথে কাজটা লুফে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করলাম। প্রত্যেকের সাক্ষাৎকারসহ কাব্যিক আলোচনার পথ ধরে লিখতে লিখতে ফিরে গেলাম হেলাল হাফিজ ভাইয়ের মনের কাছাকাছি। কথার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে একজন দুরন্ত মনের মানুষকে আবিষ্কার করলাম। তাঁর জীবন ভাবনার গভীরতা তার স্পষ্ট সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মোহিত করেছে। শুধু তাই নয়, আমি আমার সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ও চাঁদ মিথ্যে বলো না’-এর ভূমিকায় কবি হেলাল হাফিজের লেখা (১৯৬৯-এ লেখা ১৯৮৬-তে প্রকাশিত) উল্লেখ করেছি ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এবং জীবন উচ্চারণের পথে নোঙর ফেলে কান পেতে শুনে নিয়েছি তাঁর এই দিকনির্দেশনা এবং সময়ের আহ্বান। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সারাদেশব্যাপী আলোড়নের মধ্যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ সেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের কবিতা।
কিংবা ‘মানব জন্মের নামে কলঙ্ক হবে /এ রকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই’ সময়ের দেয়ালে এবং মিছিলে এঁকে দিলেন আগামী দিনের যাত্রা পথ। শব্দের ভেতর সময়ের গম্বুজ আর যুদ্ধক্ষেত্রে বুলেট ডিনামাইট বসিয়ে রেখে দিলেন! ‘কবিতার কসম খেলাম/ কবিতায় আমি আর আহত হবো না/ কোনো কিছুতেই আমি আর আহত হবো না/ কবিতার কসম খেলাম/ আমি শোধ নেবো সুদে আসলে /এবার নিহত হবো/ ওসবের কোন কিছুতেই তবু আর আহত হবো না।’ আবার একটা সুন্দর ধ্বনি ও শব্দ নিরীক্ষার উদাহরণ রয়েছে এখানে, ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতায় ‘নিউট্রন বোমা বোঝো/ মানুষ বোঝো না!’
সব কথা থেমে যায়, সব দর্শন এসে মিলে যায় এই একটি শব্দের ভেতর। ১৯৮৬-এ প্রকাশিত ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের মাত্র ৬৪টি কবিতায় দেশ, ঔপনিবেশিক সময় এবং আমাদের প্রজন্মের কর্তব্য চিহ্নিত করে গেছেন কবি হেলাল হাফিজ। প্রত্যেকটি কবিতার শব্দ যেন পাথর কেটে কেটে খোদাই করে রেখে গেলেন, আমাদের পথের দু’ধারে মাইলফলক বানিয়ে!
একজন নিঃসঙ্গ ভালোবাসাহীন, প্রেমাহত কবি তাঁর ‘ফেরিওয়ালা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কষ্ট নেবে কষ্ট? হরেক রকম কষ্ট আছে/ কষ্ট নেবে কষ্ট।’ উৎসর্গ কবিতায়, ‘আমার কবিতা আমি দিয়ে যাব/ আপনাকে তোমাকে তাকে।’ এই অসম্ভব ভাবনা ও চেতনার কবি তাঁর কাব্যচর্চা শুধু দু’খানা কাব্যগ্রন্থেই সমাপ্ত।
যৌবনের শুরুতে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ অসহযোগ যুদ্ধের যাত্রা, আর প্রায় জীবন সায়াহ্নের কাছাকাছি রেখে গেলেন কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ জীবন নদীর মোহনায়।
কবিতার ভেতরে কখনো তাঁকে বাড়তি কথা বলতে শুনি নি। এমনকি ধ্বনি বর্ণ শব্দের শরীরে কেটে কুঁদে সৃষ্টি করেছেন, বিজ্ঞান ও শিল্পসম্মতভাবে নির্মাণে অসাধারণ শিল্প।
Leave a Reply
Your identity will not be published.