আঙ্কারার আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা। ভোররাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মেঘের মুখ ভার। মাঝ কার্তিকে হেমন্তঋতুর আগমন আমাদের দেশে হিমেল আমেজের বার্তা দেয়। ভোরে ঘাসের ওপর ছেয়ে থাকে শিশির। এখানে তো দেখি, আষাঢ়ে আমেজ! ভাগ্যিস, গরম নেই। টিপ টিপ বৃষ্টির সঙ্গে থেকে থেকে হিমেল হাওয়া।
‘বাইরে না গিয়ে আজ হোটেলে মোটা গদির বিছানায় অলস ঘুমানোর দিন।’ বলে বিছানায় আড়মোড়া ভাঙতেই ভ্রমণসঙ্গী জলি বলল—
তোমার সময় কোথায় যে ঘুমাবা? ইবনে বতুতার মতো কি অবসর আছে যে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াবা? তুমি না গৃহী, না মুসাফির, তোমার সময় তো মাপা।
পূর্বদিন রাত খানিকটা বয়সী হলে আঙ্কারার বিরিলিকে ৪৫৭ সড়কের হোটেল নাম্বার নাইনটিনে চেক ইন করেছি। রিসেপশন লবি থেকে লিফটে সোজা চারতলার কক্ষে। গাট্টি বোচকা ফেলে ভ্রমণক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়। হোটেলের চারপাশ দেখার সুযোগ মেলে নি। রাত আরও গভীর হলে বিছানা থেকেই শুনেছি ঘেউ ঘেউ কুকুরের ডাক। ঘুমজড়ানো চোখে ধরা গলায় জলিকে বলি—
পিরালী পাড়ায় চোর এসেছে।
জলি হাসি দিয়ে বলে, ধুর, যত আজগুবি কথা তোমার!
কেন, আমাদের গ্রামে মধ্যরাতে এরকম কুকুরের ডাক শোন নি? ইউরেশিয়ার দেশ তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় সে ডাকের একটুও হেরফের নেই। মানুষের ভাষা আর রংই কেবল আলাদা।
এত বাজে প্যাচাল না পেরে ঘুমাও। সকাল সকাল উঠতে হবে।
দীর্ঘ দূতিয়ালি অভিজ্ঞ মান্যবর মসয়ূদ মান্নান এখানকার রাষ্ট্রীয় দূত। মুসাফিরের দুনিয়ানামায় নতুন একটি দেশ যুক্ত করতে বন্ধুর জন্য ভ্রমণসূচি সাজিয়েছেন সুবিবেচকের মতো। এমন সূচি যে, কয়েকদিনেই পুরো দেশ ভ্রমণ শেষ! সূচির ধারাবাহিকতায় আঙ্কারায় বেশি সময় নেয়ার সুযোগ নেই। পূর্বরাতে এখানে পৌঁছলেও আজ সকালেই বেরুতে হবে। যে-কোনো সময় নাম্বার নাইনটিনের নিচে নামার ডাক পড়তে পারে। স্বয়ং মান্যবর বন্ধুকে নিতে আসবেন। রাষ্ট্রাচারের শিষ্টাচারঅভিজ্ঞ মানুষ তিনি, সময় মেপে চলেন। মনে মনে বলি, মস্তিষ্কের নিউরণে স্রোতের মতো চলতে থাকা বহুবিধ কল্পকথা থেকে বেরিয়ে এসো মাহমুদ হাফিজ, ঝটপট তৈরি হয়ে নাও। দরজায় যেমতি দরদি হাজির, তেমতি নামতে হবে তোমায় নিচে!
ইস্তাম্বুলের ওল্ডটাউন সুলতান আহমেতে একরাত গুজরান শেষে আমাদের আঙ্কারা যাওয়ার পূর্বকথা। সেমতে, কাল বিকালে সোউতলুচেশমে স্টেশন থেকে ওয়াইএচটি হাইস্পিড ট্রেনে উঠে বসি। সোউতলুচেশমে’র ইংরেজি বানানে সো-এর পরে জি হরফ। এর উপরে দুটো ফোঁটা। তুর্কিবন্ধু ডেনিস বুলকারকে জিজ্ঞেস করে দ্রুত উত্তর না পেয়ে গুগলের উচ্চারণরীতি দেখে বুঝি দুইফোঁটাওলা জি-এর উচ্চারণ উ’র মতো। যেমন স্প্যানিশভাষায় ইংরেজি জে হরফের উচ্চারণ জ না হয়ে হ’ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নামকরা শহর সানহোজের নাম কতদিন সানজোসে উচ্চারণ করে এসেছি তার ঠিক নেই। স্প্যানিশঅভিজ্ঞ বন্ধু ভুল শুধরে দেওয়ার পর মুখে মুখে লফ্জটি বেরোয়—সানহোজে।
দ্রুতগামী ট্রেন সোউতলুচেমশে থেকে আঙ্কার গার (স্টেশন) পর্যন্ত ৫৩০ কিলোমিটার দূরত্বকে এক মনোরম জার্নির মাধ্যমে সাড়ে চার ঘণ্টা সময়ের ফ্রেমে বেঁধে রেখেছে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে ডোমেস্টিক বিমান ধরার জন্য দু’ঘণ্টা খরচের পর আরও ঘণ্টাকাল উড়াল প্রক্রিয়ায় খরচ করার সময়েই আঙ্কারা পৌঁছে যাওয়া যায়। ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারাগামী অফিসিয়াল লোকজন, পর্যটক আর স্থানীয়রা ট্রেনজার্নিই প্রেফার করেন। এরওপর যাত্রীদের চোখের আরামের রয়েছে মারামারা সমুদ্রের নীলজল ছুঁয়ে চলার অবিরাম গতি। বলাবাহুল্য, রোমান কনস্টান্টিনোপল তথা ওসমানী খেলাফতের ইস্তাম্বুল থেকে আমাদের ট্রেনই ধরতে বলা হয়েছে।
আধকিলোমিটার আগে থেকে শাঁই শাঁই গতি কমে ব্রেকের ক্ষীয়মাণ চিঁইইইই আওয়াজটি যখন বন্ধ হয়ে ট্রেন তেতলা প্লাটফর্মের প্রান্ত ছুঁলো, তখন পর্যটকরা চোখ কপালে তুলে দেখল স্টেশন তো নয়, ব্যস্তসমস্ত বিমানবন্দর। ঝকঝকে আলো ঝলমলে বিশাল বন্দর। লাগেজ কার্টে বোচকা তুলে নানা দেশের নানা চেহারার আদমসন্তানসমূহ ব্যস্ততায় ছুটে চলেছে। কেউ ট্রেনের অপেক্ষায়, কেউ নেমে গন্তব্যের পথ ধরছে, স্থানীয়দের কেউ পুস্পহাতে ভুবনরাঙানো হাসিতে চারপাশ মোহিত করে স্বাগত জানাচ্ছে প্রিয়জনকে, কারও মুখ প্রিয়জন বিদায়ের বিষণ্নতার আর্তিমাখা। এসব দুনিয়াবি ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই প্লাটফর্মের নম্বরের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের কামরাটি নির্ধারিত স্থানে এলে দরজাটি আপনাআপনি খুলে যায়। জলি আর আমি নেমে আসি। দরজামুখেই পুষ্পমঞ্জুরি হাতে বাড়িয়ে দেওয়া তিনটি তিনটি হাত। সামনের জন বলে ওঠেন—
আই্ এ্যাম কেমাল দুগকান। ওয়েলকাম টু আঙ্কারা।
বেঁটে খাটো মধ্যবয়স্ক। স্যুটকোটে কেতাদুরস্ত। ফর্সা মুখমণ্ডল ক্লিনসেভড। মাথার পক্ককেশ পরিপাটি করে আঁচড়ানো। অভিজ্ঞতাময়, ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্যে অটল। তার সঙ্গে হোয়াটসআপে কয়েকবার কথা হয়েছিল মাত্র। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল আমার। কুশল বিনিময়ের পর্যায়ে জানলাম, বাকি দুজনের একজন স্টেশন ম্যানেজার, আরেকজন রাজদূত অফিসের গাড়িচালক। বুঝি, ভদ্রলোকের নাম কামাল। তুর্কি দেশের নামগুলোই এরকমই। মাহমুদ হয়েছে মেহমুত, আহমেদ হয়েছে আহমেত। এরকমভাবে কামাল হয়তো হয়েছে কেমাল, দুগকান তার ফ্যামিলি নেম হতে পারে। দূতিয়াল অফিসের রাজ কর্মকর্তা কেমাল দুগকান এলেমদার মানুষ। বসের বন্ধুকে স্বাগত জানাতে লটবহরসহ অফিসসময়ের পর রাতে হাজির হয়েছেন আঙ্কারা গার-য়ে (গার অর্থ স্টেশন)।
আমাদের ট্রলিব্যাগগুলো তারাই ট্রেনে আগে আগে চলতে লাগলেন। অন্য যাত্রীরা যে সিঁড়ি দিয়ে তেতলা থেকে নিচে নেমে স্টেশন ত্যাগ করছে, আমরা চললাম ভিন্নপথে। অভ্যর্থনাকারীসহ আমাদের নিয়ে স্টেশনের ছোট দলটি বিশেষ পথে ভিআইপি লিফটের গোড়ায় পৌঁছাল। নিচে নামার পথে স্টেশনম্যানেজার তাঁর কক্ষে চা পানের আহ্বান জানালেও রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা দ্রুতই স্টেশন ত্যাগ করতে চাইলাম। আঙ্কারা গার থেকে কঙ্কায়া এলাকার দিকে গাড়ি চলতে শুরু করলে আলাপচারিতায় কেমাল দুগকান দ্রুত সহজ হয়ে উঠলেন এবং কয়েক মিনিটে ষাটোর্ধ্ব জীবনের বৃত্তান্ত শোনালেন। জানলাম, জনাব কেমাল সংগ্রামী, মফস্বল থেকে রাজধানীতে জায়গা করে নেয়া সফল মানুষ। একদা ভাগ্যানুসন্ধানে এসে বহু সংগ্রাম করেছেন, এখন এ নগরে মাথাগোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত করে ফেলেছেন। দুই ছেলের জনক কেমালের সন্তানরাও জবমার্কেটে। অবসরে বাড়িতে তৃতীয় প্রজন্মের সঙ্গে আনন্দে মেতে থাকেন তিনি। বললেন, গৃহী জীবনের চেয়ে মজার ও আয়েশময় আর কিছু নেই।
কিছুক্ষণ নীরবতার মধ্যে গাড়ি চলল। নীরবতার চেয়ে ভালো ভাষা বোধ হয় আর পৃথিবীতে নেই। শিল্প তাই নীরবতার মধ্য থেকে আনন্দের শাঁসটুকু বের করে আনেত চায়। একসময় কেমাল দুগকান বললেন—
হোটেল নাম্বার নাইনটিন ডিপ্লোম্যাটিক জোনের কাছে। চেক ইন করতে করতে ডিনার টাইম অতিক্রম করবে। পথে ডিনার সেরে নেয়া ভালো।
আমরা নীরব পূর্ববৎ। কেমাল বুঝলেন, নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।
ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারা সাড়ে চার ঘণ্টার জার্নিতে খাওয়া হয় নি। আমরা এখন ক্ষুধার্ত। জনাব কেমাল ডিনারের আমন্ত্রণ জানালে আর না করতে পারি না। তাঁর ইশারায় এক বড় এভিনিউয়ের পাশে ব্যস্ত রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামলে তাঁকে অনুসরণ করে নেমে যাই। দেখি আসপাভা কেবাপ। ওজলিক আসপাভা রেস্তোরাঁটি টোয়েন্টফোর সেভেন খোলা। বিলিউন এভিনিউয়ে। রেস্তোরাঁটিতে বেজায় ভিড়। কেমাল বললেন—
আসপাভা কেবাপ (কাবাব) গোটা তুরস্কে জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর চেইন।
পরিচ্ছন্ন হয়ে টেবিলে বসেই অর্ডার দেওয়া হলো। শুরুতে সবার জন্য বড় প্লেটারে গ্রীন সালাদ ও রায়তার মতো একটা জিনিস এল। পরে যার যার পছন্দের অর্ডারের খাবার। জলি বিফের সঙ্গে রাইস। আমি নান চিকেন কাবাব আর কেমাল দুগকান তার পছন্দের পোলাও আর কাবাব অর্ডার করলেন। সালাদ আর এ্যাপিটাইজার খাওয়ার পর মেইনকোর্সের প্লেট দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া আর মনে মনে ‘ওয়াও’। খাবারগুলো ফ্রেশ, সদ্য তৈরি ও গরম, তবে পরিমাণে বেশি। আমার ভ্রমণসঙ্গী জলির মন বেজার। সে মনে করেছিল বিফ রাইসে ভাতের সঙ্গে গরুর গোশতের মসলাদার ঝোল আসবে। সে রন্ধনপ্রিয় ও ঘরকন্নায় এক্সপেরিমেন্টাল হলেও ভাতের ওপর হলুদ মসলাহীন সেদ্ধ বিফের চিকন স্লাইসের পরত দেখে তার বুঝতে বাকি নেই, নতুন এই রেসিপি গলা দিয়ে নামবে না। লজ্জা শরমে কষ্ট করে কয়েকবার মুখে দিয়ে খাওয়া শেষ বলে সে প্লেট সামনে ঠেলল। আমার পাতে চিকেন আদানা কাবাব আর নান, খেতে খারাপ না। জলির অবস্থা দেখে আমি বারবার সাধছি, কিন্তু টেবিলের উল্টোদিকে কেমাল দুগকান বসা বলে লজ্জায় সে খেতে চাচ্ছে না। ডেজার্ট হিসাবে এসেছে আইসক্রিমের সঙ্গে শামোলিনা হালভা ও চা। আইসক্রিম সব দেশেই একই রকম। পরিবেশন ভিন্ন। আসপাভা রেস্তোরাঁ আইসক্রিমের সঙ্গে হালভা পরিবেশন করে। আমাদের সুজির হালুয়ার মতো। আইসক্রিমের সঙ্গে খেতে বেশ। সঙ্গে কাচের গ্লাসভর্তি লেমন টি।
সব আইটেমই সিকি পরিমাণের বেশি প্লেটে রেখে দেওয়া দেখে কেমাল বললেন—তুর্কি জাতি একটু বেশিই ভোজনপ্রিয়!
ভরপেটে আসপাভা রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসি। হোটেলে পৌঁছে দিয়ে কেমাল দুগকান বাড়ির পথ ধরেন। সেখানে অপেক্ষায় তার স্ত্রী, পুত্র ও নাতিগণ।
এদিকে সকাল সকাল তৈরি হওয়ার পর জলিকে তৈরি হতে বলে যতক্ষণ না ডাক পড়ছে, ততক্ষণে আমি কক্ষের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। চারদিক তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে যাই। বর্গাকৃতির ভবনটির মাঝখানের ভয়েডের ওপরের দিকে ট্রান্সপারেন্ট শীটে ঢাকা। ভেতরদিকের বারান্দা ও ভয়েডের গ্রাউন্ড পর্যন্ত প্রাকৃতিক আলোর বিচ্ছুরণে কোনো বাধা নেই। বর্গাকৃতি স্থাপনাটির চারদিকই প্রায় বারান্দা। যে পাশে সিঁড়িঘর ও লিফট তার বিপরীতদিকের দেয়ালজুড়ে বিশালকায় তুর্কি শিল্পকর্ম, নান্দনিকতায় নিপুণ। ভয়েডের মাঝ বরাবর চারতলার ওপরের ছাদ থেকে নেমে এসেছে শক্তরজ্জু। এর সঙ্গে শিল্পিতবন্ধনে সন্ধি করেছে প্রাচীন সংগ্রহের সাক্সোফোন। বিভিন্ন ফ্লোরের বারান্দা নিচের ভয়েডে স্থাপিত মিনি সংগ্রহশালা। শতাব্দী প্রাচীন সামগ্রীতে ঠাসা। যুৎসই কাঠের পাটাতন, কিংবা পরিচ্ছন্ন ফ্লোরে সযত্নে সংরক্ষিত। বেতার ও সংগীতযন্ত্রপ্রধান ইলেকট্রনিক সামগ্রী, দূরালাপনী ও লেখনযন্ত্র টাইপরাইটারও আছে। সবকিছু যেন অতীতের জয়গানমুখর। এদের নেতৃত্বে ভয়েডে ঝুলন্ত সাক্সোফোন। পুরো হোটেলজুড়ে এক মায়াবী প্রাচীনগন্ধী বাতাস মনকে উতল করে। আমার মনে নেচে ওঠে। মনে হয়, আমি মাঘী অমাবস্যার জাঁকালো শীতের রাতে উদোম পায়ে, প্রায় খালি গায়ে খোকসার মেলায় দাঁড়িয়ে আছি। যাত্রা প্যান্ডেলের গেটমুখে উঁচু বাঁশের মাচানে বসে বড় মোছওয়ালা লালচক্ষু লোক গাল ফুলিয়ে বাজাচ্ছে বড় পিতলের বাঁশি—‘দ্বীন দুনিয়ার মালিক খোদা, দিল কি দয়া হয় না, তোমার দিল কি দিয়া হয় না।’
আমি সুরের ঘোরে তরতর করে নিচে নেমে যাই। ভূতলস্তরে বহুবিধ সংগ্রহ মুগ্ধ হয়ে দেখি। ভূতল শেষ করে উপরতিলের ঝুলবারান্দার স্থানে স্থানে রাখা সংগ্রহও দেখা শেষ করি। সকালে বেরুনোর মুখে বিনা পয়সার জাদুঘর দর্শনে আমার মন চাঙা হয়ে ওঠে। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করি নাম্বার নাইনটিন-এর স্বত্বাধিকারী আর্টিস্ট না সংগীতশিল্পী? না হলে কালের করালগ্রাসে বিলীন ও বিলীয়মান এমন সমৃদ্ধ সংগ্রহ গড়ে তোলা হবে কেন?
উত্তর পাই না। কিন্তু যা পাই, তা হচ্ছে ড্রাইভার ইউসুফের দেখা। স্যুট-টাই পরিহিত কেতাদুরস্ত তুর্কি যুবক রিসেপশনে তুর্কিশ ভাষায় কিছু একটা বললে ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দেওয়া হয়। তুর্কিযুবক নিজের নাম ইউসুফ উল্লেখ করে বলে, ‘স্যার, আমি এক্সেলেন্সির ড্রাইভার, হিজ এক্সেলেন্সি বাইরে গাড়িতে বসা।’
বুঝে যাই দরজায় দরদি হাজির। ইউসুফকে ‘আসছি’ বলে বিদায় দিয়ে দ্রুতই লিফটে ওপরে উঠি আমি। জলি ততক্ষণে তৈরি হয়ে অপেক্ষমাণ। তাকে ডেকে নিচে নেমে একদম গাড়িতে উঠে বসি। বৃষ্টি তখনো ধরে নি। যেতে হবে আঙ্কারা থেকে কাপাদোকিয়া।
দুই
কাপাদোকিয়া ড্রাইভে ছুটন্ত গাড়ি পাহাড়ি সড়কে উঠে গেলে চারদিকে ইতিউতি তাকিয়ে দেখতে থাকি। আমাকে যা মুগ্ধ রাখে তা হচ্ছে, অনুচ্চ ক্যাসকেডের ঢেউখেলানো প্রকৃতি। সবুজ বৃক্ষহীন মরুময় মাঠ প্রান্তর। কোথাও কোথাও ছোট ছোট জনপদ-গ্রাম। সেই গ্রাম জনপদের ধূসর রেখা ভেদ করে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে উর্ধ্বপানে উঠেছে মসজিদের মিনার। কোথায় যেন, সম্ভবত মনীষী সৈয়দ আলী আহসানের কোনো বক্তৃতায় শুনেছিলাম, মসজিদের মিনারসহ ধর্মশালাগুলোর স্থাপত্য সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে আকাশঅভিসারী হয়ে কোন পরম বিন্দুতে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।
দূরান্ত থেকে দেখি রাস্তাকে অতিক্রম করে পাহাড়ি দিগন্তে মিশে গেছে সবুজ রেখা। কাছে গেলে বোঝা যায় শুষ্ক মাঠের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে চিকন স্রোতস্বিনী। দুপার দিয়েই জন্মেছে সবুজ লতাগুল্ম, অনুচ্চ বৃক্ষরাজি। বুঝতে পারি, বৃক্ষ জলাকাঙ্ক্ষী, পানিকে সঙ্গী করেই সে জন্মে, বেড়ে ওঠে, টিকে থাকে। চারদিকে ডানে বামে যেখানে ধূসর-খয়েরি খেত, গম ভুট্টো কেটে তোলার পর পরিত্যক্ত মুড়ো-নাড়া। সেখানে স্রোতস্বিনীটির দুধারে সবুজবৃক্ষের ডানা মেলা। আশ্চর্য হই, যখন দেখি কোথাও বিরানপ্রান্তরে চড়ে বেড়াচ্ছে সহস্র ভেড়ার পালের খামার। গম-ভুট্টা তোলার পর পরিত্যক্ত খয়েরি খোসা হয়তো ভেড়ার খাদ্য নয়, তাদের আরাধ্য বিস্তীর্ণ সবুজ। কিন্তু যেখানে সবুজতৃণের দেখা নেই, সেখানে কী করে চরে বেড়ায় মেষভেড়ার পাল? পেছনে পেছনে লাঠি হাতে ফেরে ভিনদেশি ভাড়াটে মেষপালক? হতে পারে এই খয়েরি উচ্ছিষ্টের মধ্যেই কোথাও মৃত্তিকালগ্ন হয়ে আছে এই প্রাণীর টিকে থাকার তৃণ। কিন্তু তার তৃষ্ণার পানি? সে বড় আশ্চর্যের!
পানিপ্রসঙ্গ মনে উঠতেই বড় তেষ্টা পায়। গাড়ির সিটপকেটে বোতলে বোতলে পানি। বোতল বের করি পান করি। শোকর আলহামদুলিল্লাহ! মানুষ কত শ্রেষ্ঠ!
গাড়ি ছুটে চলে হুসহাস। পাহাড়-পর্বত বিদীর্ণ করে তৈরি সুপ্রশস্ত মসৃণপথ দিগন্তে মিশে গেছে। আমাদের ড্রাইভ করে যেতে হবে তিন শ’ কিলোমিটার। গুগল বলছে, সময় লাগবে তিন ঘণ্টার মতো। তিন ঘণ্টা মানে তিন ঘণ্টাই। আমাদের মতো তিন ঘণ্টার পরিকল্পিত পথ ছয় ঘণ্টায় পাড়ি নয়। সকালের বৃষ্টিবিঘ্ন মেঘলা আকাশ নেই, ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস কেটে গেছে, উঠেছে ঝলমলে রোদ্দুর। মানে, মেঘের মুখভারে আমাদের কাপাদোকিয়া দিনটি মাটি না হয়ে সফলভ্রমণে খাঁটি হবে।
ছুটে চলার পথে আমরা প্রকৃতির অবারিত সম্ভার দেখি, শস্যখেত ও গ্রাম দেখি। মাঝে মাঝে ঝিমুনিভাব এলে আবার গল্পসল্প করে জেগে থাকার চেষ্টা করি। মান্যবর তুর্কিদেশে দূতিয়ালির নানা গল্প করেন। কীভাবে বাংলাদেশের প্রতি বর্তমান তুরস্ক সরকারের নেতিবাচক মনোভাব এ্যাবাউট টার্ন হয়ে ইতিবাচক হলো। শুনি নেতিবাচককে ইতিবাচক করার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার কথা। নেতিবাচককে ইতিবাচকে রূপান্তর করতে ক্যারিশমাটিক গুণের প্রয়োজন। তা বন্ধু মান্যবরের আছে বলে আগে থেকেই জানি।
কথায় কথায় আমরা বৃক্ষ ও বসতিহীন রুক্ষ পর্বতাঞ্চল পেরিয়ে পৌঁছে যাই একটি নবস্থাপিত শহরমুখে। প্রশস্ত রাস্তার দুদিকে বহুতল ভবন। মূল রাস্তার থেকে শহুরে পাড়ায় ঢুকেছে ছোট সড়ক। শহরের নাম নেভেশেহির। আন্দাজেই ভেবে নিই, নেভেশেহির অর্থ হতে পারে নতুন শহর। তুরস্কের কেন্দ্রীয় আনাতোলিয়া অঞ্চলের নেভেশেহির দেশটির একাশি প্রদেশের একটি এবং প্রদেশের রাজধানী। আমাদের গন্তব্য ঐতিহ্যিক পর্যটন কেন্দ্র কাপাদোকিয়া অঞ্চল নতুন শহর নেভেশেহির সংলগ্ন ও প্রশাসনিক আওতাভুক্ত। শহরের প্রবেশমুখে যা নজর কাড়ে তা হলো ঘোড়ার প্রেক্ষণনন্দন ভাস্কর্য। তা একটি নয়, একাধিক। ঘোড়ার ভাস্কর্যের দোর্দ- প্রভাব দেখে বিস্মিত হই। এক্সেলেন্সির গাইড কাম ড্রাইভার ইউসুফ জানান, পার্সিয়ান ভাষা কাপাদোকিয়ার অর্থ ‘ল্যান্ড অব হর্স’, এ জন্য ঘোড়ার ভাস্কর্যের এই চোখধাঁধানো অবস্থান। অবশ্য একে ল্যান্ড অব ফেইরি টেলস, ল্যান্ড অব হট বেলুন, ল্যান্ড অব পিজিওনও বলা হয়।
কথা শেষ না হতেই দেখি শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর। উড়ে যায় আবার দূরান্ত থেকে ফিরে আসে। এখানে পিজিওন ভ্যালি নামে আলাদা কবুতরের একটা উপত্যকাও আছে। আমাদের পর্যটকচোখে আরাম দেয় ঘোড়ার ভাস্কর্য আর কবুতর। কিছুক্ষণ পরই আমাদের চোখকে অবিশ্বাস্য করে দেয় আঁকাবাঁকা উপত্যকা। বাঁকে বাঁকে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা আগ্নেয়শিলা আর পাথরে গড়ে ওঠা অনুচ্চ টিলা, চিমনি। মজার ব্যাপার, প্রতিটির গাত্রে ও ঢালে জানালা, দরজার মতো খোপ। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এরকম ভূপ্রকৃতি আর গুহাগৃহ আছে কি না আমার জানা নেই। দূরের কোনো পাহাড়ি বিন্দু থেকে মিনিয়েচার শিল্প কল্পনা করলে মনে হয় উইঢিবির উইঢিবিতে ভরা ও ঘেরা এই প্রাচীন জনপদ। আসলে কাপাদোকিয়া জনপদটির ইতিহাসই এমন, পাহাড়-টিলার গায়ে কেভহাউজ বা গুহাগৃহ বানিয়ে প্রাচীন মানুষের বসবাস ছিল। পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠায় এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় পর্বতগাত্রে কেভ হোটেল, কেভ রেস্তোরাঁ এসব চালু হয়েছে।
আমি গাড়ির ভিতর থেকে আকাশের দিকে উঁকিঝুঁকি মারি। দুয়েকটি গরম বাতাসভরা বেলুন উড়তে দেখি। এখন দুপুর। সকাল হলে মরুময় তামাটে পাহাড়ি অঞ্চলের ওপর শত শত উষ্ণবেলুনের নয়নাভিরাম উড়াল দেখতে পেতাম। বেলুনউড়ালের দৃশ্যই কাপাদোকিয়ার প্রতীক। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভ্রামণিকদের কাছে এ জনপদ হটবেলুনের হটস্পট। চারদিকে পাহাড়টিলার রুক্ষতা আর রং দেখে ধারণা করতে কষ্ট হয় না, আগ্নেয়গিরির উদ্গত লাভার শীতলতা আর মহাকালের প্রভাবে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তামাটে রঙের এই অনবদ্য ভূমিরূপ। স্থানে স্থানে কোণ, পিলার ও মাশুরুম আকৃতির ঊর্ধ্বমুখি শিলার চিমনির সঙ্গে মিশে আছে মহাকালিক মিথ। সব মিলে পর্যটক আকর্ষণের যেমন কেন্দ্র, তেমনি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই জনপদ। এখানেই শেষ নয়, অধুনা খনন খ্রিষ্টপূর্ব তিনহাজার বছর আগের হিট্টাইট এ্যাসিরিয়ান বাণিজ্যবসতির প্রমাণ পেয়ে একে অতিপ্রাচীন জনপদের তকমা দিয়েছে। নিওলিথিক পটারি আবিষ্কৃত হওয়ায় আর্লি হিউমান বা আদি মানবের উপস্থিতির প্রমাণও রয়েছে। গ্রিক মহাবীর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট এ এলাকার পাশ দিয়ে গিয়েছিলেন। আদিম মানুষ নাকি বন্যপ্রাণী ও শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে নরম শিলা কেটে গুহাবাড়ি বানিয়ে বাস শুরু করেছিল। শিলার ওপর এঁকেছিল নান্দনিক সব শিল্পকর্ম। পার্সিয়ান, গ্রিক, রোমান ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীরাও এসে গুহায় আশ্রয় নিতেন। এখানকার ভূগর্ভস্থ শহর কেইমাকালিতে পরি আগমনের রূপকথা এন্তার লিটারেচারে মেলে। এসবের অনেক কিছু নেটজগতের উইকি এনসাক্লোপেডিয়া নানা সাইটে সবিস্তারে আছে। এমনকি ‘বেস্ট থিংস টু ডু’তে পাওয়া যাবে কাপাদোকিয়ায় আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি, গেরেমে ন্যাশনাল পার্ক, পিজিওন ভ্যালি, রেডরোজ ভ্যালি, ইহলারা ভ্যালি, কাভুসান ভিলেজ, জেলভে ওপেন এয়ার জাদুঘর ইত্যাদি দেখানোর হাতছানি ট্যুর অপারেটরদের কাছে সব সময় পাওয়া যায়।
আমার আগ্রহ সেই ইতিহাসের চর্বিতচর্বণে নয়, বরং নিজ চর্মচক্ষুতে দেখা ও উপভোগের অনুভূতি মনননিষ্ঠতায় প্রকাশ। পুরো অঞ্চলকে তুলে আনতে চাই অন্তত কয়েকদিনের অবস্থান। কিন্তু আমরা দু’দিনের যোগীও নই, ডে ট্রিপের ট্যুরিস্ট মাত্র। কাজে কাজেই আমাদের গন্তব্য হয়ে ওঠে কাপাদোকিয়া পাহাড়শীর্ষ বা ‘উচিসার ক্যাসেল’। ক্যাসেল নামের বিশাল পাহাড়ি গুহা অ্যাপার্টমেন্ট কোনো রাজরাজড়ার ছিল কি না তার ঐতিহাসিক প্রমাণ আমি অন্তত পাই নি। তবে এতে যে হাজারের বেশি মানুষ পাহাড়ি গুহার ঘরগুলোতে বসবাস করে গেছে তা বলা যায়। ভাবি, একবার যদি কষ্টেসৃষ্টে শীর্ষে উঠতে পারি, তাহলে পুরো কাপাদোকিয়া ভ্যালির প্যানোরমিক ভিউ দেখা আর ঠেকায় কে!
চার হাজার ফুটের কিছু বেশি উচ্চতার সামিটে টাঙানো রয়েছে চাঁদতারকা খচিত লালঝান্ডা, তুরস্কের জাতীয় পতাকা। ওপরে উঠতে হলে একটু ছোট গুহার ভিতরে কয়েকটি গুহাগৃহ দর্শনেশেষে একটি প্যাসেজ দিয়ে পাহাড় গাত্রে ওঠা যায়। গুহামুখে বসানো হয়েছে টিকেটঘর। জনপ্রতি ৫০ লিরা। আমরা অতিথি বলে পকেটে হাত দেওয়া ছাড়াই ভিতরে ঢুকতে পারি। সামনেই বড় একটি গুহাঘর। অতীতবাসের কিছু জিনিসপত্র রশির ব্যারিকেড দিয়ে সংরক্ষণ করা। এরপর ওপরের তলায় যাই। দেখি প্রাচীন মানুষের এখানকানকার বসবাসকে মূর্ত করে তোলার জন্য গুহা রেস্তোরাঁ। বৃত্তাকার কাঠের পাটাতনের ওপর এক মধ্যবয়স্কা নারী রুটি বেলছে, আরেকজনের পাশে বড় তাওয়া। রুটি আর ডিমভাজি দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা। কক্ষের ভিতরে অন্ধকারের দিকে একটি বেঞ্চের মতো বসার ব্যবস্থা। সামনে ছোট দুটি বৃত্তাকার অনুচ্চ টেবিল। দুই নারী সহাস্যে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলেও আমরা বসি না। আমার নিশানা এরই পাহাড়শীর্ষে টাঙানো নিশানের দিকে। মিষ্টি আহ্বানকে উপেক্ষা করে আমি বাংলাদেশের ছোট পতাকা পকেটে ভরে ওপরের দিকে উঠে যাই। জলি আমার সঙ্গে সঙ্গে ওঠে। মান্যবর পেছন থেকে বলেন— বয়স হয়েছে না, আমরা কী এত ওপরে উঠতে পারব?
আমি গুহা ফ্ল্যাট থেকে প্যাসেজ দিয়ে ওপরে উঠে দেখি, লোহার রেলিং ও খাড়া সিঁড়ি পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ক্যাসেলশীর্ষে। আমি তর করে আরও কয়েকটি কেভ অ্যাপার্টমেন্ট দেখে উঠতে থাকি। জলি আমার সঙ্গে তিন হাজার ফুট পর্যন্ত উঠে শেষে ক্ষ্যান্ত দেয়। মান্যবর মাঝামাঝির একটু বেশি ওঠার পর ভিউপয়েন্টে দাঁড়িয়ে আর রিস্ক নেন নি। একদম সামিটটিতে পতাকা টাঙানোর পাটাতনটিই শুধু আছে। পতাকার জন্যই সেটা করা, মানুষ উঠে সেলফিবাজি করা নিষেধ। আমি সেখানে উঠে যাই কিন্তু বাতাসের তীব্র বেগ আমাকে উড়িয়ে নিচে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করে। আমি শক্তহাতে পতাকাস্ট্যান্ড ধরে কোনোরকম ছবি তোলার সুযোগ নিই। নিষেধ ও অনিরাপদ বিবেচনায় পকেট থেকে নিজদেশের পতাকা বের করে দু’হাতে উঁচিয়ে ধরতে পারি নি। কিন্তু বলা যায়, উচিসার প্রাসাদের পাহাড়শীর্ষ জয় করেছি।
মজাটা হচ্ছে, এভারেস্ট সামিটে ওঠার জন্য দীর্ঘ কিউ থাকে বলে দ্রুতই নেমে আসতে হয়। স্থানীয় এমনকি ট্রেকাররাও এ সামিটে ওঠার আগ্রহ দেখায় না। এটা জনবসতিময় পাহাড়, তাছাড়া প্রায় শীর্ষের কাছাকাছি পর্যন্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা। পাহাড় জয়ের আনন্দ আছে বলে মনে হয় না। আমি পাহাড়জয়ের আনন্দ নিতে উঠি নি। এই শীর্ষে দাঁড়িয়ে পাখিচোখে দেখতে চাই কাপাদোকিয়ার প্যানরমিক ভিউ। আর শীর্ষ থেকে তাকিয়ে আমার চোখে ভেসে ওঠে অসংখ্য ফেইয়ারি চিমনি, গোরেমে ন্যাশনাল পার্ক, পিজিওন ভ্যালি, লাভ ভ্যালি, এরসিয়েস পর্বতসহ কাছে দূরের অপরূপ এক জনপদ। চোখে পড়ে, পৃথিবীতে বিরল আগ্নেয়গিরির লাভাসৃষ্ট তামাটে বর্ণের ঢেউখেলানো বহুবিস্তৃত টিলাশ্রেণি। যা নিজচোখে না দেখলে বর্ণনা করা কঠিন।
বাতাসের বেগে টিকতে না পেরে আমাকে দ্রুতই নেমে আসতে হয়। এরওপর কয়েকধাপ নিচে থেকে জলি বারবার নামার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জায়গাটা লোকজন যাতে না ওঠে কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ আছে বলে তাতে কোনো সুবিধাদিও রাখা হয় নি। আমি ছবি তুলে দ্রুতই নামতে থাকি। কারণ সাতসকালে নাম্বার নাইনটিন থেকে যে নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, লংড্রাইভ আর চার হাজার ফুটের বেশি পাহাড় বাওয়ার ধকলে সেই এনার্জি ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন পেটে দানাপানি পড়া দরকার আবার। আমরা আস্তে আস্তে উচিসার ভিলেজ পেরিয়ে নামতে থাকি। আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা দিয়ে গোরেমে ন্যাশনাল পার্কের ইটিং জোনে যাই। স্বনামখ্যাত সেডেফ রেস্তোরাঁয় গিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বসি। অর্ডারে একটা প্যাকেজ নেয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যই জিহ্বায় জল আনা কাবাবসহ ঐতিহ্যবাহী সব খাবার আসতে থাকে। গ্রীন সালাদ, আদানা কাবাব, সিকান্দার কাবাব, পিডে, বাকলাভাসহ হরেক রকম খাবার ও মিষ্টান্ন। এর পরিমাণ উদরের তুলনায় অনেক বেশি।
সাধু সাবধান, আমাদের মতো দু’ ছটাকি উদর নিয়ে যারা তুরস্কে যাবেন, তাদের কাবাব মে হাড্ডি হওয়া ছাড়া গতি নেই, আর সেডেফ রেস্তোরাঁর চিফ শেফ জুম্মার মতো তার্কিশরা মুখ টিপে হাসবে। কোনো একটি প্যাকেজের আওতায় যে পরিমাণ ও সংখ্যক উপাদেয় রসনাবস্তু সামনে আসতে থাকবে, তা খেতে লাগবে আমাদের সাইজের উদরওলা জনা তিন! সেই খানাপিনার গল্প না হয় আরেকদিন…।
Leave a Reply
Your identity will not be published.