মেঘে মেঘে অনেক আগেই বেলা হয়েছে। বসন্ত গত। এখন শীতের হাতছানি। বলছি প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার কথা। কাল তিনি ৭০-এ পা দিতে যাচ্ছেন। আজ (১৭ নভেম্বর) তাঁর ৬৯তম জন্মদিন।
ব্যক্তি রুনা লায়লার জীবন থেকে বসন্ত বিদায় নিলেও কণ্ঠশিল্পী রুনা এখনো বসন্তের মাঝে বসবাস করছেন। কণ্ঠমাধুর্য এখনো অটুট। ৫৭ বছরের বর্ণাঢ্য কেরিয়ার গতি হারিয়ে ফেলে নি।
১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর রুনা লায়লা সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মা আনিতা সেন ওরফে আমিনা লায়লা ছিলেন সংগীতশিল্পী। তার মামা সুবীর সেন ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী।
রুনা লায়লার বয়স যখন আড়াই বছর, তার বাবা রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে যান। ফলে রুনা লায়লার শৈশব কেটেছে লাহোরে।
রুনা লায়লার কেরিয়ার শুরু হয় সাড়ে এগারো বছর বয়সে, ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ ছবিতে প্লেব্যাকের মাধ্যমে। গানটি ছিল ‘গুড়িয়াসি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি’। এই গানটি কণ্ঠে তোলার জন্য তখন রুনা লায়লা একটানা দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
পাকিস্তানে থাকা অবস্থায় রুনা লায়লা অজ¯্র চলচ্চিত্রে গান গেয়েছিলেন। ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বলা যায়, সেই সময় পাকিস্তানের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নুরজাহানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অপরিহার্য শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন টিভি ও বেতারেরও। গানের সূত্রে রুনা লায়লা পান নিগার ফিল্ম ক্রিটিক পুরস্কার, ‘কমান্ডো’ ছবিতে কণ্ঠদানের জন্য। ওই সময় তিনি এদেশের ‘স্বরলিপি’ ছবিতেও কণ্ঠদান করেছিলেন।
১৯৭৪ সালে রুনা লায়লা দেশে ফিরে আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গান করেন ‘জীবন সাথী’ ছবিতে, কিংবদন্তি সুরকার সত্য সাহার সুরে। গানটি ছিল ‘ও জীবন সাথী তুমি আমার’। তার সঙ্গে গেয়েছিলেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। রুনা লায়লার কণ্ঠ দেওয়া এদেশের উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে প্রতিনিধি, দি রেইন, যাদুর বাঁশি, মিন্টু আমার নাম, ফকির মজনু শাহ, সওদাগর, দেবদাস, পদ্মাবতী, আবে হায়াত, শহর থেকে দূরে, প্রিয় বান্ধবী, এতিম, যদি জানতেম, রঙ্গিন রূপবান।
শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে নয়, ভারতের বহু চলচ্চিত্রেও কণ্ঠদান করেছেন রুনা লায়লা। নব্বইয়ের দশকে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সুরকার নিসার বাজমির সুরে একদিনে ১০টি করে তিন দিনে ৩০টি গানে কণ্ঠ দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও তিনি নাম লিখিয়েছিলেন।
গানের জন্য রুনা লায়লা দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ৭ বার।
রুনা লায়লা ১৭টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক—” সব ধরনের গানই রুনা লায়লা করে থাকেন।
তবে রুনা লায়লা সম্পর্কে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, তার হওয়ার কথা ছিল নৃত্যশিল্পী। তিনি ষাটের দশকের প্রথমার্ধে টানা চার বছর করাচির বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভরত নাট্যম, কত্থক, কত্থকলি শেখেন। তবে শেষ পর্যন্ত পায়ে পায়ে নূপুরের প্রতিধ্বনি নয়, গানকেই বেছে নিয়েছেন। গানের কোকিল হয়েই এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছেন। সত্তর দশকে তার জনপ্রিয়তা যেন আকাশ স্পর্শ করেছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক সাংবাদিক পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘তোমরা যত খুশি গঙ্গার পানি নাও, শুধু রুনা লায়লাকে আমাদের দিয়ে দাও।’
ভারত থেকে একাধিকবার রুনা লায়লা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। বলাই বাহুল্য, নায়িকার চরিত্রে। এর মধ্যে বলিউডের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার-অভিনেতা রাজ কাপুরের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু রুনা কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেন নি। অবশ্য বাংলাদেশের চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন, আলমগীরের বিপরীতে। এই ছবিতে তার জীবনের ছায়া রয়েছে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.