সকালবেলায় মাজহারুল ইসলামের সাথে কথা হয়েছিল। মাজহার ‘অন্যদিন’ পত্রিকার সম্পাদক। ওর একটি এসএমএস এল। পড়ে আমি চমকে গেলাম। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের অবস্থা সংকটাপন্ন। স্যারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ল্যাবএইড হাসপাতালে। সাথে সাথে মাজহারকে ফোন করলাম কিন্তু পেলাম না, ফোনে সে ব্যস্ত ছিল।
মাজহারকে না পেয়ে খ্যাতিমান চিকিৎসক বরেন চক্রবর্তীকে ফোন করলাম। তিনি ল্যাব এইডে আছেন। বড় মাপের একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাহিত্যিকও বটে। বরেনদাকে জিজ্ঞেস করলাম মনজুরুল ইসলাম স্যারের ব্যাপারে। তিনি জানালেন, মাজহারুল ইসলাম এবং সাথে আরও দু-একজন মিলে স্যারকে এখানে নিয়ে এসেছে, আমি ব্যাপারটা দেখছি। পরে জানলাম স্যারের বুকে রিং পরানো হবে দুটো।... অপারেশনের পর স্যার ভালোই ছিলেন। দুদিন পর হঠাৎ মাজহার জানাল যে স্যারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হচ্ছে। দেশ-বিদেশে স্যারের অনেক ছাত্র রয়েছে। আমি যদিও স্যারের সরাসরি ছাত্র নই। আমার পরিচিত অনেকেই স্যারের সরাসরি ছাত্র যাদের সঙ্গে আমার জানাশোনা রয়েছে। তাদের আমি স্যারের কথা জানালাম। সবাই বলল তাদের প্রিয় শিক্ষক তিনি। অনেকে বললেন, আমি যেন স্যারের আপডেটটা তাদের জানাই। শুনতে পেলাম স্যার কিছুটা সুস্থ। আমিও তাদের এ কথা জানিয়ে দিলাম। পরদিন ডাক্তার বরেন চক্রবর্তী জানালেন, স্যারের অবস্থা অবনতি হওয়ায় আবারও লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। প্রথমবার যখন স্যারকে লাইফ সাপোর্টে দিয়েছিলেন তখন বরেন চক্রবর্তী আমাকে জানিয়েছিলেন, স্যার বলেছিলেন তিনি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেন না। সুতরাং তাকে লাইফ সাপোর্টে দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু পরেরবার লাইফ সাপোর্টে যে কী হবে সেটা কারও জানা ছিল না।
স্যারের অসম্ভব মনের শক্তি ছিল। তাঁর সঙ্গে যতদিন আমার মেশার সৌভাগ্য হয়েছে বা কথা বলার সুযোগ হয়েছে দেখেছি তিনি অসম্ভব রকম মানসিক শক্তির অধিকারী।
একটি কথা মনে পড়ছে। একবার আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য স্যারকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু স্যার হাসিমুখে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আরেকবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)-র চেয়ারম্যান হওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাতেও রাজি হন নি। একদিন আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—‘স্যার আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিজীবন শেষ করেছেন। এখন এই বড় বড় পদের প্রস্তাব আসছে, আপনি গ্রহণ করছেন না কেন ? অনেকেই তো এই সমস্ত পদে থেকে কর্মজীবন শেষ করেন।’ স্যার আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কর্মজীবন কি শেষ হয় ?’ তারপর তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শোনো, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে চাই। এই যে শিক্ষার্থীদের বিরাট ভুবন, এখান থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চাই না। আমি এদের ভেতরেই সময় কাটাতে চাই। আরও একটি কথা, আমার অনেক কাজ করার বাকি আছে। আমি যদি এসব প্রশাসনিক দায়িত্বে যাই, তাহলে এসব কাজ করতে পারব না। আমি তো চিন্তা করেই পাই না যে এত কাজ আমি কখন করব, কীভাবে করব!’
স্যারের কথা আমি উপলব্ধি করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আমি আর কখনোই এরকম প্রস্তাব দেই নি।
মাজহার আর বরেনদার সাথে কথা বলার পরও ভেবেছি, অসম্ভব মনোবলের কারণেই স্যার ফিরে আসবেন এবং তাঁর যে অসমাপ্ত কাজ রয়েছে, সেগুলি তিনি সম্পন্ন করবেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। মহাকালের অনন্ত যাত্রায় তিনি শামিল হলেন। স্যার চলে গেলেন, তবে আমাদের জন্য তিনি যে কাজ রেখে গেলেন তার পরিমাণও কম নয়। মনজুরুল ইসলাম স্যার অনেক ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর ভাষাশৈলী আমাদের মুগ্ধ করে। স্যারের গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে—‘স্ব^নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাঁচ ভাঙ্গা রাতের গল্প’, ‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘সুখদুঃখের গল্প’, ‘বেলা অবেলার গল্প’—আমি পড়েছি। উপন্যাসের ভেতর—‘কানাগলির মানুষেরা’, ‘দিনরাত্রিগুলি’, ‘আজগুবি রাত’, ‘তিন পর্বের জীবন’ আমার পড়া গ্রন্থের অন্যতম।
সব সময় তিনি কিছু না কিছুর মধ্যে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। আমার মনে আছে একবার আমাদের পক্ষ থেকে স্যারের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের তখনকার মহাপরিচালক মেনোকা হাসান। তিনি স্যারকে বলেছিলেন একটি নাটক লিখে দিতে। স্যার জানিয়েছিলেন, তিনি নাটক লিখবেন, তবে কোনো মৌলিক নাটক নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গল্পের নাট্যরূপ দিবেন। অসাধারণ নাটক হয়েছিল সেটি। তবে আমি অন্য কথা বলতে চাই। তখন একটি টেলিভিশন নাটকের জন্য তিন থেকে চার দিন মহড়া হতো। তারপর নাটকের শুটিং হতো। এই নাটকটির শুটিং একদিন সারা রাত হয়েছিল। নাটকের মূল দুজন শিল্পী ছিলেন হুমায়ূন ফরীদি ও সুবর্ণা মুস্তাফা। নাটকের রিহার্সেলের সময় স্যারের আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কেননা এই নাটকের প্রযোজক ছিলেন মেনোকা হাসান। কিন্তু স্যার প্রতিদিনই আসতেন এবং নাটকের বিভিন্ন পর্বে যোগ-বিয়োগ করতেন। নাটকটি কীভাবে আরও ভালো হবে সেই চিন্তা করতেন। যেদিন সারা রাত শুটিং হলো ঢাকার রোজ ভ্যালিতে, সেদিনও স্যার সেখানে উপস্থিত থেকেছেন। নাটক শেষে স্যার বলেছিলেন, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। নাটকটি খুব ভালো হয়েছে।’ আমরাও খুশি হয়েছিলাম, নাটকটি সুন্দরভাবে শেষ করতে পেরে।
স্যার বলেছিলেন, তিনি একটি ‘সিটকম’ লিখবেন ধারাবাহিকভাবে। সিটকম-এর বাংলা আভিধানিক শব্দ হচ্ছে হাস্যরসাত্মক বা কমেডি যেটাই বলি। এই নাটকে হাসিও থাকবে, বিদ্রƒপ থাকবে, আবার মেসেজও থাকবে। সেরকম একটি ধারাবাহিক নাটক স্যার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর করা হয় নি। তারপর অনেক দিন পর স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুবাই এয়ারপোর্টে। ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি, আমিও ফিরছিলাম। দেখা হতেই স্যার বললেন, ‘তোমার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলো, তাই না ?’
আমি বললাম, ‘জি স্যার।’
স্যার তখন বললেন, ‘তোমার সঙ্গে সেই সিটকমটি নিয়ে কাজ করা হলো না।’
আমি অবাক হলাম। সেই কবে ধারাবাহিক নাটকের কথা বলেছিলেন, এখনো মনে রেখেছেন। আমিই হয়তো আর যোগাযোগ করি নি বা উৎসাহ দেই নি। আমার টিমকেও বলি নি। সেই অভিমানে হয়তো স্যার নাটকটি লেখেন নি। কিন্তু স্যার ঠিকই মনে রেখেছেন যে আমার সঙ্গে তাঁর একটা কথা হয়েছিল।
আমি বললাম, ‘স্যার হবে।’
স্যারও বললেন, ‘নিশ্চয়ই হবে। এত কাজ করতে হয়! কখন যে সময় পাব তাও জানি না।’
আসলেই স্যার যে পরিমাণ কাজ করে গেছেন কিংবা যে বিশাল ছাত্রছাত্রী তৈরি করে গেছেন তা বিস্ময়কর!
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে একসময় ডাকসাইটে সব অধ্যাপক ছিলেন। যেমন, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। তাঁরা যেমন বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি করে গেছেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারও তেমনি—যা আগেই উল্লেখ করেছি। এই শিক্ষার্থীরা স্যারের কাজের ব্যাপারে উৎসাহী। তারা স্যারের কাছ থেকে শুধু ইংরেজি সাহিত্য পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ পায় নি—বাংলা সাহিত্য পড়ারও উৎসাহ পেয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত। যেমন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক, অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার মাসরুর আরেফিন...। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করি। বহু বছর আগে একদিন কথাপ্রসঙ্গে একজন মনজুর স্যারকে বললেন, ‘আপনি কি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে চেনেন ?’ স্যার বললেন, ‘না, আমি চিনি না। তবে সুবর্ণা মুস্তাফা নামে আমার এক ছাত্রী আছে। ভীষণ মেধাবী। কয়েকদিন আগে সেকেন্ড ইয়ারের টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।’ উল্লেখ্য, সুবর্ণা তখন নবীন অভিনেত্রী। বিটিভিতে কয়েকটি নাটক প্রচারিত হয়েছে। সেইসঙ্গে খ্যাতিও কুড়িয়েছে। যা হোক, সেই ভদ্রলোকের কথাতেই স্যার প্রথম সুবর্ণার অভিনয়ের কথা জানতে পারেন। এর বছর দুয়েক পরের কথা। তখন আফজালের সঙ্গে সুবর্ণার জুটি গড়ে উঠেছে এবং সেই জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আবালবৃদ্ধবনিতার অনেকেই সুবর্ণার ফ্যান। তাদের মধ্যে স্যারের ছেলে শাফাকও রয়েছে। সুবর্ণা-আফজালের ভিউকার্ড থেকে কাঁচি দিয়ে আফজালের ছবি কেটে সেখানে নিজের ছবি জুড়ে দিত শাফাক। স্যার ছেলেকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য একদিন বাসায় সুবর্ণাকে আমন্ত্রণ জানালেন। সুবর্ণা কিছুটা অবাক হলেও স্যারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। সেদিন সুবর্ণাকে স্বচক্ষে দেখে শাফাক যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিল।
আরেকটি ঘটনা। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার একদিন নাগরিকের রিহার্সেলে হাজির। তাঁকে দেখে অবশ্য কেউ অবাক হন নি। কেননা তিনি অনিয়মিত হলেও রিহার্সেলে যেতেন। যা হোক, যে নাটকের রিহার্সেল হচ্ছিল সেই নাটকের একজন শিল্পী ছিলেন আফসানা মিমি। তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে স্যার বললেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি কি রিহার্সেলেই ব্যস্ত থাকবে? তুমি তো প্রিলিমিনারি ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছো। তোমার নাম নোটিশ বোর্ডে ঝুলছে। তুমি কি ভর্তি হবে না ? মিতা (প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক) তো ভর্তি হয়ে গেছে।’ এমনই ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার। ছাত্র-ছাত্রীদের শুভাকাক্সক্ষী।
আরেকটি খুব কাকতালীয় ঘটনা। মাজহারুল ইসলাম আমাকে যখন ঢাকা থেকে স্যারের মৃত্যুর ঘটনা জানালেন, তখন আমি দুবাই এয়ারপোর্টে বসে আছি। যে দুবাই এয়ারপোর্টে স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, সেই দুবাই এয়ারপোর্টে বসেই আমি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের শেষ বিদায়ের খবর পেলাম। সেখান থেকেই সবাইকে এসএমএস-এর মাধ্যমে খবরটি পৌঁছে দিলাম। একেকজন একেক রকম জবাব দিলেন। আমি ভাবতে থাকলাম, দুবাই এয়ারপোর্টের কোন জায়গাটায় স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হয়তো আমার সামনের যে খালি চেয়ারটা রয়েছে, সেখানেই বসেছিলেন স্যার।
আমি যতবার এই দুবাই এয়ারপোর্টে আসব ততবারই স্মৃতিতে ভেসে উঠবে স্যারের সেই হাসিমাখা মুখ। স্যার, আপনি ভালো থাকুন চিরকালীন জীবনে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.