[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব।]
সিমির আগের মেইলটা পেয়ে ফাহিমের মনটা ফুরফুরা ছিল।
তার মনের সমস্ত আশঙ্কা মুহূর্তেই কেটে গেছে। সে ফুরফুরে মেজাজ থাকতে থাকতেই আর দেরি না করে উত্তর লিখতে বসে গেল।
সিমি প্রিয় বন্ধু আমার,
তোমার মেইল পেয়ে আমার যে কী ভালো লেগেছে, তখনকার সে অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না। বুকের উপর থেকে যেন বড্ড ভারী একটা পাথর নেমে গেল!
তুমি মেয়েটা সত্যিই অন্যরকম। তোমার মধ্যে কোনো ন্যাকামি নেই। তারচেয়েও বড় কথা, কোনোরকম সংকোচ বা দ্বিধাও নেই। একদিনে তোমাকে যতটুকু চিনেছি তাতে এটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি।
এ কথা ঠিক, অনেককে দীর্ঘদিন কাছ থেকে জেনেও জানা হয়ে ওঠে না আবার কারও কারও সঙ্গে স্বল্পকটি চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে তা অতি নিবিড়। সম্পর্কের নানারকম যেমন হয়। জানার ধরনও হয় তেমনি।
তুমি যখন বললে আমার মেইলগুলো তোমাকে শক্তি দেয় কোনোভাবে, আমি জেনে তৃপ্ত হয়েছি। ভীষণ। তোমাকে নিয়মিত লেখার আগ্রহটা পাকাপোক্ত হলো। অবশ্যই যতদিন তুমি চাইবে, আমি লিখব।
আমার একটা ইয়াহু মেসেঞ্জার আইডি আছে। একটা অনলাইন ম্যাগাজিনে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য খুলেছিলাম। খুব একটা ব্যবহার করা হয় না। এবার মনে হচ্ছে এটার একটা সুষ্ঠু ব্যবহার হবে।
আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে যদি এই মেইল তুমি পড়, তাহলে আমাকে তোমার বাডি লিস্টে অ্যাড করে নিও। তাহলেই এখনই হয়তো তোমার সাথে মেসেঞ্জারে কথা হতে পারে। নাহলে অন্য যে-কোনো সময়ে।
আজ এ পর্যন্তই।
ভালো থেকো। খুবই ভালো থেকো সব সময়। তুমি ভালো না থাকলে আমার যে ভালো থাকা হয় না।
ফাহিম।
লাঞ্চব্রেক থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরেই সিমিকে মেইলটি পাঠিয়ে দিল ফাহিম।
আজ সারাদিন অনেকগুলো মিটিং ছিল- একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে। মোটামুটি ব্যস্ততায় দিন শেষ করে অফিস থেকে বের হবার ঠিক আগের মুহূর্তে ফাহিম তার পারসোনাল মেইলে লগইন করল এবং যথারীতি দেখতে পেল সিমির মেইল এসে বসে আছে। মুহূর্তেই ফাহিমের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সুপ্রিয় ফাহিম,
তোমার মেইলটা পেয়েই উত্তর দিতে বসে গেলাম। একটু তাড়াহুড়োও করছি। আজ একটু আর্লি ঘুমিয়ে পড়তে চাই। কাল সকালে আমার নতুন কাজের জয়েনিং। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, আমার অখণ্ডসময়গুলো কত দ্রুত শেষ হয়ে গেল।কী আর করা!
এখন বলো কেমন আছো তুমি?
আচ্ছা তোমার কি আর কোনো নাম আছে? তোমাকে ফাহিম নামে ডাকতে আমার কোনো সমস্যা অবশ্য নেই, তবে যখনই তোমার নাম ধরে ডাকি, সবসময় শুধুই মনে হয় কেউ আমাকে বলছে ‘জি ভাবী!’ আমার খালাত দেবরের নাম ফাহিম!
আমি তোমাকে দেখতে পেলাম তুমি অনলাইনে আছো, হাই দিলাম, তুমি সাড়া দিলে না। মনে হয় মেসেঞ্জার অন রেখে চলে গেছো। অসুবিধা নেই, আমি তোমাকে এই ছোট মেইলটি পাঠিয়ে দিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছি। তুমি সুযোগ পেলেই উত্তর দেবে। আজকের মতো এটুকুই।
ফাহিম বন্ধু আমার, তোমার মতো সরল, স্বাভাবিক, সুরুচিপূর্ণ মানসিকতার একজন মানুষকে বন্ধু হিসেবে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যিই বলছি।
নিজের যত্ন নিও। ভালো থেকো তুমিও। খুবই ভালো থেকো সবসময়। তুমি ভালো না থাকলে আমারও যে ভালো থাকা হয় না। তোমার লাইন চুরি করে লিখে দিলাম। এত সুন্দর কথা কোথায় পাও তুমি?
সিমি।
সিমি,
আমার যে কী হয়েছে! যখনই আমি মেইলচেক করি, প্রথমেই খুঁজি তোমার নাম। কিন্তু সমস্যা হলো, যখনই দেখি তোমার নাম নেই, আমি ভীষণ অস্থিরতায় কাতর হয়ে পড়ি। হতাশা গ্রাস করে আমাকে। মনে হয় তুমি বোধহয় আর লিখবে না আমাকে! মনে হয়, তুমি হয়তো মন বদলে ফেলেছ। তারপর মেইল খুলে যখনই তোমার নাম দেখি কী যে হয় আমার! হাতে যত কাজই থাকুক, সাথে সাথেই মেইল খুলে পড়তে বসে যাই। আমার মনের সব আশঙ্কা দূর হয়ে যায় মুহূর্তেই। অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।
দুঃখিত আমার অফিস কম্পিউটারে পারসোনাল চ্যাটিং ব্লক করা। সিকিউরিটির কারণেই হয়তো। কাজেই অফিস থেকে তোমার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইমেইল। মেসেঞ্জারে চ্যাট করতে হলে বাসায় যেয়ে করতে হবে।
কাল রাতে তোমার সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য চ্যাট হলো- উফ, কী যে ভালো লাগল! মনে হচ্ছিল আমাদের বুঝি সামনা সামনিই কথা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তোমাকে আমি কতদিন থেকে চিনি। তুমি আমার খুব কাছের কেউ।
তুমি কি জানো কী ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি?
সরি, আমার তো আর কোনো নাম নেই। তবে তুমি চাইলে তোমার পছন্দের একটা নাম তুমি আমায় দিতে পারো। সেটা আমার জন্য একটা বিশেষ কিছু হবে।
আমি জানি এখন তুমি গভীর ঘুমে। ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাবার আগেই যদি তুমি মেইল চেক করো, আশা করি তোমার ভালো লাগবে।
তোমার নতুন চাকরির জন্য অভিনন্দন এবং অনেক অনেক শুভকামনা। খুব শীঘ্রই তোমার সাথে কথা হবে আশা করি।
ফাহিম (যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমায় অন্য কোনো নাম না দিচ্ছ-ততক্ষণ এই নামেই চলুক)।
ফাহিম,
কেমন আছো? আমি নিশ্চিত তুমি এখন ঘুমাচ্ছ। আমি অফিসে তাই বেশি কিছু লিখতে পারছি না। তবে রাতে বাসায় ফিরেই লম্বা মেইল লিখব। শুধু জেনো, তোমার মেইলটি সত্যিই আমার দিনটাকে অন্যরকম করে দিয়েছে। ভীষণ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। ভালো থেকো বন্ধু। সিমি।
সিমি,
আমি জেগেই ছিলাম- তোমার মেইলের অপেক্ষায়। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারব। তবে নতুন করে অপেক্ষায় থাকব তোমার পরের মেইলটির জন্যে। আশা করি, তোমার নতুন কাজের সবকিছু ঠিকঠাক যাচ্ছে। বাকি দিনটা ভালো কাটুক। অনেক শুভকামনা। ফাহিম।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পর হঠাৎ করেই একাকীত্ব পেয়ে বসল সিমিকে। বাসার বারান্দায় অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। তারপর তাকিয়ে রইল আনমনে দূর পানে। নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মানুষ মনে হলো তার। নিঃসঙ্গতা মানুষকে মাঝে মাঝে পেয়ে বসে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। সিমি দেখেছে নিঃসঙ্গতা মানুষকে শুধু অসুখীই করে না, মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দেয়।
মানুষের জীবনটা বড় অদ্ভুত। কেউ সবার মাঝে থেকেও একা। কেউ সবার থেকে দূরে থেকেও একা। কেউ-বা হাজার প্রাপ্তির ভিড়ে একা। দিন শেষে আমরা সবাই একা, তবে কেন এই একাকীত্ববোধ বা নিঃসঙ্গতা?
নিঃসঙ্গতা মানেই কি একা হয়ে যাওয়া নাকি এটি মনের এমন একটি উপলব্ধি যা আমাদের মনকে বাইরের সমস্ত যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়? সিমি এলোমেলো ভাবনার জালে জড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
একটা দীর্ঘ সময় পার করে সিমি আগামীকালের অফিসের জন্য সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চিঠি লিখতে বসল ফাহিমকে।
“সময় যেন কাটে না
বড় একা একা লাগে
এই মুখর জনারণ্যে
বিরহী বাতাস বহে
শুধু তোমার জন্যে।”
তুমি কি এই গানটি শুনেছ আগে? সামিনা চৌধুরী গেয়েছেন। অফিস থেকে ফিরে, সন্ধ্যা থেকেই এই গানটি আমি গুনগুন করে গাচ্ছিলাম। আবার ভেবে বসো না তোমার কথা ভেবে কিংবা তোমার বিরহে এই গান গাওয়া। আমার নিঃসঙ্গ আমিকে সঙ্গ দিচ্ছিলাম বলতে পারো।
তুমি কি জানো, আমিও তোমার মেইলের জন্য কেমন করে অপেক্ষা করি। দিস ইজ ক্রেজি বাট ট্রু। যখনই মেইলবক্স খুলি, আমি জানি, তোমার এক লাইনের একটা মেসেজ হলেও সেখানে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। তোমার দীর্ঘ মেইলটি পড়ে আমার দিনটি সত্যিই অন্যরকম ভালোলাগায় পূর্ণ ছিল। অফিসে কিছুক্ষণ পর পরই মেইল চেক করেছি, দেখলাম ইয়াহুতেও অনলাইনে আছো, কিন্তু সাহস পাই নি তোমাকে একটা হ্যালো পর্যন্ত বলার। তুমি নিশ্চয়ই কিছু মনে করো নি।কথা তো হবেই। অফিসের নিয়মকানুনটা আগে একটু ভালো করে জেনে নিই।
আচ্ছা তুমি এমন কেন বলো তো? মেইল পাঠাতে একটু দেরি হলেই বুঝি ধরে নিতে হবে আমি মন বদলে ফেলেছি? এটা কোনো কথা? আচ্ছা আমি কী কোনো টিনেজ মেয়ে যে হুটহাট আমার মন বদলে যাবে? মেইল লিখতে পারি আর না পারি, তুমি যে আমার ভাবনায় থাকো এটা কি কম?
আমি নিজেও জানি না, আমার অফিস থেকে ইয়াহুতে চ্যাট করতে পারব কিনা। না পারলেও ক্ষতি নেই। আমার কি মনে হয় জানো। এই মেসেঞ্জারে চ্যাটিং ব্যাপারটা ক্ষণস্থায়ী, একটা সময় হারিয়েও যায়। কিন্তু একটা ইমেইলের গুরুত্ব কিন্তু অনেক। একটা হাতে লেখা চিঠির মতোই। দেখো একটা চিঠিতে আমরা কত কথা লিখতে পারি, শেয়ার করতে পারি মনের ভাব। চ্যাটিংয়ের সময় অনেক হেজিটেশন কাজ করে, কথা বলতে হয় মেপে অথবা ভেবে এবং দ্রুত। ইচ্ছে হলেই অনেক কিছু বলা যায় না। কিন্তু যখন চিঠি লিখতে বসি, কতকিছু লিখতে পারি। আমার কিন্তু মেইল অপশনটাই বেটার মনে হয়। আমি জানি তুমিও আমার সঙ্গে একমত হবে।
গতকাল একটু সময়ের জন্যে তোমার সঙ্গে চ্যাট করে আমারও ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি চিন্তাই করি নি, এভাবে তোমাকে পেয়ে যাব। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো ছিল ব্যাপারটি। তুমি সত্যিই অমায়িক একটা মানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমি। যদিও এখনো তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয় নি আমার, তবুও মনে হয় তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশ অনেকদূরই গড়াবে। তোমাকেও আমার ভীষণ ভালো লাগে ফাহিম।
তোমাকে ডাকার মতো কোনো ছোট নাম না থাকলে সমস্যা নেই। ফাহিম নামটা কিন্তু খারাপ না। আমি তোমাকে এই নামেই ডাকব।
তোমার মেইল এখন আমার জন্যে ডেইলি ডোজ অফ মিডিসিন-এর মতো। খুব কাজ করে। আমার টেনশন, ডিপ্রেশন এমনকি নার্ভাসনেসও কেটে যায়, আমি যখন তোমার চিঠি পড়ি। তোমার চিঠি আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গ।তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
তুমি চাইলেই আমাকে ভালো রাখতে পারো। না চাইলে না। কাজেই, লক্ষ রেখো মেডিসিনের ডোজ যেন মিস না হয় কিছুতেই।
অনেক ভালোবাসা।
সিমি।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.