মরমী কবি ও সাধক হাসন রাজা জন্মেছিলেন ৭ পৌষ ১২৬১ বঙ্গাব্দে আর মৃত্যুবরণ করেন ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ। গত ৭ ডিসেম্বর ছিল ১৪২৮-এর ২২ অক্টোবর। অর্থাৎ ওই দিন ছিল হাসন রাজার ৯৯তম প্রয়াণ দিবস। এই উপলক্ষে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরা হলো এখানে।
‘লোকে বলে, বলেরে’, ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে’, ‘কানাই তুমি খেইল খেলাও কেনে’, ‘বাউলা কে বানাইলো রে’— এইসব গানের রচয়িতা হাসন রাজা। তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রীর সন্তান। জমিদার। তাঁর পূর্বপুরুষ অযোধ্যার অধিবাসী। তাঁরা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সুনামগঞ্জে আসেন ও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
হাসন রাজার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ হয় নি। পনেরো বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি মহাজন কর্তৃক নিলামে তুলতে আরম্ভ করলে মাকে রাজি করিয়ে নিজস্ব সম্পত্তি বিক্রি করে বনেদি পৈতৃক সম্পত্তি ‘রামপাশা’ অঞ্চল রক্ষা করতে সক্ষম হন।
জীবনের শুরুতে প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদারদের কারসাজিতে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। এক মিথ্যা মামলায় দায়রা আদালত কর্তৃক দেড় বছর কারাদণ্ড প্রদান। কিন্তু হাইকোর্টে আপিল করায় নিষ্কৃতিলাভ করেন।
শীতের মৌসুমে হাসন রাজা গাজীর গীতের মেলা বসাতেন এবং সমস্ত খরচ বহন করতেন। তাঁর সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি মিঃ নিটল নামে এক ইংরেজকে ম্যানেজার নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই ম্যানেজার পদত্যাগ করেন এবং হাসন রাজার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় হাসন দশ হাজার টাকা খেসারত দেন।
১৯১৭ কিংবা ১৯১৮ সালে আসামের তদানীন্তন চিফ কমিশনার বাটসন বেল সুনামগঞ্জ পরিদর্শনে যান এবং হাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯২০-এ ভারতের তদানীন্তন বড়লাট চেমস ফোর্ট সিলেট এলে দুই পুত্রসহ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সুনামগঞ্জের এম. ই. স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাসন রাজা। এ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া ও বৃত্তির ব্যবস্থা করেন হাসন। পরে এই স্কুল জুবলি হাই স্কুলে পরিণত হয়।
কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানা ধরনের লীলায় অভিনয় করেন হাসন রাজা। যৌবনে ছিলেন আর দশটি জমিদারের মতো ভোগী। পরিণত বয়সে ভোগের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আসে। ষাট বছর বয়সে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি বিলি-বণ্টন করে দরবেশি জীবনযাপন শুরু করেন। অনেক দেবালয় ও আখড়া তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একজন উচ্চ শ্রেণির হেকিম ও চিকিৎসকও ছিলেন হাসন রাজা। কেয়াফকা শাস্ত্রেও বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বহু আধ্যাত্মিক গানের রচয়িতা তিনি। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই গানগুলি তাঁর ‘হাসান উদাস’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে। তাঁর গানে প্রেম, বৈরাগ্যময় মরমি চেতনার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এইসব গানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলো পাশাপাশি বিদ্যমান।
Leave a Reply
Your identity will not be published.