দেয়ার ইজ এ নাট অন দ্য রুফ

দেয়ার ইজ এ নাট অন দ্য রুফ

[আজিজ নেসিন। একাধারে লেখক, রাজনৈতিক এবং সমাজসেবক। সম্রাট অটোমানের রাজত্বকালে ইস্তাম্বুলের নয়াভিরাম দ্বীপ হাইবেলিডাসে ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। চাকরি শেষে অবসরকালীন জীবনে তিনি একটি ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন। ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য বহুবার কারাবরণকারী এই প্রথিতযশা লেখক দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কারেও ভূষিত হন। ইটালি, বুলগেরিয়া, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তুরস্ক তাকে সম্মানজনক বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করে। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিগুলো ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়।

আকাবা ম্যাগাজিনে কর্মরত থাকাকালে ১৯৫৬ সালের ৬ জুন মিরাল সিলেন নামক এক সহকর্মীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন আজিজ নেসিন। ১৯৭২ সালে দুঃস্থদের সাহায্যার্থে নেসিন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।  

নব্বই দশকের শুরুতে সালমান রুশদির বিতর্কিত উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ অনুবাদ করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন আজিজ নেসিন। দেয়ার ইজ এ নাট অন দ্য রুফ' তার একটি অন্যতম ছোটগল্প।  ১৯১৫ সালের ৬ জুলাই একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টানেন এই লেখক।]

পুরো পাড়াটাই উত্তেজিত। সচরাচর ঘটে না আজ তাই ঘটেছে। রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। সবাই পাগলটাকে দেখতে এসেছে। গাড়ি ভর্তি পুলিশ এসেছে। তারা এসেছে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি থেকে। সদর দপ্তর থেকে আরও কিছু পুলিশ এসেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের লোকজনও এসেছে। সঙ্গে রয়েছে পাগলের মা, ছেলেকে নেমে আসার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিল-বাবা আমার নেমে আয়। মার কথা শোন, বাবা...।

তাকে শহরের কোতোয়াল বানানো না হলে সে ছাদ থেকে লাফ দিবে বলে হুমকি দিচ্ছিল।

পাগল যদি লাফিয়ে পড়ে সেই ভয়ে সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা জাল পেতে রাখল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা চারপাশে জাল মেলে ধরতে গিয়ে গলদঘর্ম। পুলিশ সার্জেন্ট কিছুটা মিনতি ও ভয় দেখিয়ে পাগলটিকে নিচে নেমে আসতে প্রলুব্ধ করতে লাগল।

আমাকে নগর কোতোয়াল বানানো হোক, আমি নেমে আসব, নচেত আমি লাফিয়ে পড়ব।

অনুরোধ ভয়-ভীতি দেখানো সবই ভেস্তে গেল। কোনো কাজেই এলই না।

পুলিশ সার্জেন্টের সবিনয় অনুরোধ, নেমে এসো বন্ধু আমার। নেমে আসছ না কেন?পাগল জানায়, আমাকে নামতে না বলে তোমরাই আমার কাছে চলে আসো

না কেন?

ভিড়ের মাঝ থেকে একজন বলল, তাকে কোতোয়াল বানানো হয়েছে বলা হোক।

অন্যরা তার প্রতিবাদ জানায়। কেমন করে সম্ভব? পাগলকে দিয়ে শহর কোতোয়ালের কাজ হবে?

আমরা সত্যি সত্যি তো পাগলটাকে শহর কোতোয়াল বানাচ্ছি না, লাঠির  উপর ভর করে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বললেন, অসম্ভব। মস্করা করেই হোক বা অন্য কারণেই হোক তা অবাস্তব।

সে নেমে আসতেও তো পারে।

একবার যদি তাকে নামানো যায়, তবে পরের কাজগুলো সহজ হবে।

সে নেমে আসবে না।

বেশ দূর থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, তোমাকে শহর কোতোয়াল বানানো হয়েছে। নেমে এসো।

শুনে পাগল আরও উত্তেজিত। নেচে নেচে বলতে লাগল, আমি নামব না। আমাকে পৌরসভার সভ্য না বানানো পর্যন্ত আমি নামব না। বৃদ্ধ বলে, এখন দেখ, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

সে যা করতে বলে তাই করা হোক।

তোমরা যাই করো না কেন সে নামবেই না। একবার যদি কোনো লোক পাগলামির এমন স্তরে পৌছে ছাদের উপরে উঠে যায় সে কখনোই সেখান থেকে নেমে আসে না।

সার্জেন্টের চিঙ্কার, তাই হবে। তোমাকে পৌরসভার সভ্য বানানো হলো। অথবা আমাদেরকে এখানে দাঁড় করিয়া রেখো না, নেমে এসো।

পাগল নেচে যেতে লাগল, আমি নামব না...আমাকে শহরের মেয়র বানানো হোক, তাহলে আমি নেমে আসব।

বৃদ্ধকে বলতে শোনা গেল, অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন সে আর নেমে আসবে না।

ফায়ার সার্ভিস প্রধান বলছে, যদি তাকে বলি যে বানানো হয়েছে, তাতে অসুবিধা কোথায়?মাইকের মতো হাত দুটি মুখের সামনে এনে চিল্কার করে সে বলল, তাই হবে। বাবাধন নেমে এসো। আমরা তোমাকে এ শহরের মেয়র বানালাম। নেমে এসে মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করো।

পাগলের উন্মাদনা আরও বেড়ে যায়। নাচতে নাচতে উত্তর দেয়, আমি নিচে নামব না। যারা আমার মতো পাগলকে শহরের মেয়র পদে বসায় তাদের জন্য আমার কিছুই করার নেই।...আমি নামব না।

ঠিক আছে, তাহলে তুমি কী চাও?

আমাকে মন্ত্রীসভার সদস্য বানানো হলেই আমি নেমে আসব।

নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ শলাপরামর্শের পর উপস্থিত কর্তাব্যক্তিদের চিৎকার শোনা যায়, তাই হবে। তোমাকে মন্ত্রীসভার সদস্য বানানো হলো, এখন নেমে এসো। চেয়ে দেখ এখানে উপস্থিত সবাইকে তুমি আটকে রেখেছ।

সমবেত মানুষের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে পাগলের চিৎকার-যারা এক পাগলকে মন্ত্রী বানায়, তাদের মাঝে আমি নেমে আসছি না।

চলে এসো ভাইটি। অযথা ঝামেলা বাড়িও না, তোমাকে সত্যিই মন্ত্রী বানানো হয়েছে, বাকি সব মন্ত্রী তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। এখন তুমি নেমে এসো।

আমাকে বোকা বানাচ্ছ? আমি নেমে আসি আর তোমরা আমাকে পাগলাগারদে ঢুকিয়ে দাও! আমি নামব না।

বৃদ্ধ বলে, তোমরা অযথাই চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছ। আমি পাগলকে ভালোভাবেই চিনি। তোমাদের যদি মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়ার শখ হয়, তাহলে তোমরাও সেখান থেকে কখনো বের হয়ে আসবে না।

এতক্ষণে পাগল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, আমাকে যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ না দেওয়া হয় তাহলে আমি লাফিয়ে পড়ব।

তাই হবে। তোমাকে প্রধানমন্ত্রীও বানানো হলো।

সে নেমে আসছে না।

পাগল আবার নৃত্য শুরু করে। কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে বলে, আমাকে রাজা বানাও। নচেৎ আমি লাফিয়ে পড়লাম।

সবার কাছে এখন বৃদ্ধের কথাই সত্যি মনে হলো। সবাই তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে বসল, আপনার মত কী? আমরা কি তাকে রাজা বানাব?

বৃদ্ধ জানায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে যা বলবে, তোমাকে তাই করতে হবে। তাকে তোমরা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছ।

তাই হলো। সমবেত কণ্ঠে সবাই বলল, আমরা তোমাকে রাজা বানালাম। এবার নেমে এসো।

উদ্দাম নৃত্যরত পাগল বলল, না আমি নামব না।

তাহলে আর কী চাও? তোমাকে তো রাজা পর্যন্ত বানানো হয়েছে।

আমি নেমে আসব না। আমাকে রাজাধিরাজ না বানালে আমি এখনই লাফিয়ে পড়ব।

অনেকেই বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইল, সত্যি সত্যি কি সে লাফিয়ে পড়বে? বৃদ্ধের জবাব, হ্যাঁ, সে লাফ দিবে।

সুতরাং পাগলের উদ্দেশে বলা হলো-তোমার ইচ্ছাই পূরণ হলো। তোমাকে রাজাধিরাজ বানানো হলো, এখন নেমে এসো।

পাগলের তাৎক্ষণিক জবাব, তোমাদের মতো বোকা, বুদ্ধিহীন, নির্বোধদের মহারাজা হিসেবে আমার কিছুই করার নেই।

তাহলে বলো, আর কী করতে হবে?আমরা তাই করব। তুমি নেমে এসো। পাগল জিজ্ঞেস করে, আমি কি এখন রাজাধিরাজ? হ্যা, তুমি রাজধিরাজ। ভিড় থেকে একজন জানিয়ে দেয়।

আমি যদি রাজাধিরাজ হই তাহলে যখন ইচ্ছা তখন নামব, আপাতত নামছি না।

পুলিশ সার্জেন্ট বিরক্ত হয়ে বলে বসল, ওকে লাফিয়ে পড়তে দাও, তাহলে অন্তত পাগলের সংখ্যা একটি কমবে।

ফায়ার সার্ভিস প্রধান বৃদ্ধকে লক্ষ করে বলল, আমরা এখন কী করতে পারি? এ পাগল কি কখনোই নেমে আসবে না?

হ্যা, নেমে আসবে। আমি তাকে নামাচ্ছি দেখ। বললেন বৃদ্ধ লোকটি।

কেমন করে ওই বৃদ্ধ পাগলকে নামিয়ে আনে তা দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে রইল। সাত তলার ছাদে অবস্থানরত পাগলকে উদ্দেশ করে বৃদ্ধ বলল, মহামান্য রাজাধিরাজ আপনি কি ষষ্ঠ তলায় উঠে যাবেন?

পাগল আবেগ তাড়িত হয়ে বলল, ঠিক আছে। সে তখন ষষ্ঠ তলায় নামার জন্য যেই পথটি ছিল, সেই পথে ওই তলায় নেমে এসে জানালা দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষের দিকে উঁকি দিল।

বৃদ্ধ আবার জিজ্ঞেস করলো, মহারাজাধিরাজ আপনি কি পঞ্চম তলায় উঠে যাবেন?

পাগলের ইতিবাচক সাড়া।

উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। ততক্ষণে চতুর্থ তলার জানালা দিয়ে পাগল উঁকি দিয়েছে। বৃদ্ধ জানতে চাইলো, সম্মানিত মহারাজাধিরাজ কি তৃতীয় তলায় উঠবেন?

কিছুক্ষণের মধ্যেই পাগল তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে মুখ বাড়িয়ে তাকাল। খানিক আগে সাততলার ছাদে সে নেচে যাচ্ছিল এখন তার সেই নাচ বন্ধ। এখন সত্যিকারের রাজার মতোই ভাব ধারণ করেছে সে।

মহানুভব এখন কি দ্বিতীয় তলায় উঠে যাবেন?

হ্যা তাই করছি। দ্বিতীয় তলায় পাগল নেমে এল।

মহারাজাধিরাজ কি প্রথম তলায় আসবেন?

অবশেষে পাগল মানুষের ভিড়ে নেমে এল। সে সোজা বৃদ্ধের দিকে হেঁটে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, খোদার কসম আমার বিশ্বাস যে তুমিও একজন পাগল। পুলিশ সার্জেন্টের দিকে ঘুরে সে বলল, আমাকে বেঁধে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দাও।

এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ? কেমন করে পাগলের সাথে তাল রেখে চলতে হয়?বৃদ্ধ বললেন।

পাগলকে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই বৃদ্ধকে ঘিরে ধরল। চাচা, কেমন করে এ কাজটি করলেন?

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে জানায়, চল্লিশটি বছর জুড়ে রাজনীতি করছি। চারটিখানি কথা নয়। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, আমার পায়ে শক্তি থাকলে আমি ওই সাততলার ছাদে উঠে যেতাম। সেখান থেকে কেউ আমাকে নামাতে পারত না।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.