৭০-এ ৮ অভ্যাস

৭০-এ ৮ অভ্যাস

আপনার আশপাশে এমন কাউকে নিশ্চয়ই দেখেন, সত্তর পেরিয়েও যাদের টনটনে জ্ঞান, ধারালো মানসিক শক্তি। বিষয়টি কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার নয়, প্রতিদিন লালন করা কিছু অভ্যাসের ফল। এটা তো সত্যি কথা যে, মানুষ জন্মগতভাবে যেমন জিন লাভ করে তেমনি কিছু অভ্যাসও যাপিত জীবনে চর্চা করে। এইসব অভ্যাস তাকে মানসিকভাবে এমন শক্তিশালী করে যে, বুড়ো বয়সেও তার মস্তিষ্ক থাকে সতেজ ও তীক্ষ্ণ।

মানসিকভাবে শক্তিশালী যেসব মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তারা জানে যে কীভাবে মন-মানসিকতার যত্ন নিতে হয়, যেভাবে আমরা প্রতিদিন আমাদের শরীরের যত্ন নিই। তাই এইসব স্মার্ট মানুষ যাপিত জীবনে এমন কিছু অভ্যাস নির্বাচিত করে ফেলে— যা তাদের মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ করে, করে শাণিত।

এই রচনায় আমরা এমনই ৮টি অভ্যাস তুলে ধরছি, এগুলো প্রতিদিনের জীবনে চর্চা করলে যে-কোনো মানুষ মানসিকভাবে শক্তিশালী হবে।

শেখার কোনো শেষ নেই

অধিক বয়সেও তীক্ষ্ণধার, শাণিত মস্তিষ্ক কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং তা মানুষের লাইফস্টাইলেরই ফল, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে যে প্রাত্যহিক জীবনে কিছু অভ্যাস চর্চা করার ফলেই তা সম্ভব। এমনই একটি অভ্যাস হচ্ছে, অন্তহীন শেখার আগ্রহ।

আমরা কখনো-সখনো এমন বয়সী মানুষকে দেখি, যাদের যে-কোনো বিষয়ে জানার আগ্রহ সীমাহীন। অফুরন্ত। বিরামহীন। বোধসম্পন্ন হওয়ার পর থেকেই এইসব মানুষ ধারাবাহিকভাবে নানা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছে। নতুন নতুন জ্ঞান আর আইডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরিচিত হওয়ার ফলে তারা মানসিকভাবে শাণিত এবং জীবনের চলার পথে আগুয়ান।

এই বিষয়ে আপনিও ভাবুন। মনে রাখবেন, আজীবন শেখার বিষয়টি হলো আপনার মনের ব্যায়ামাগার। শারীরিক ব্যায়াম যেমন আমাদের শরীরকে শক্তিশালী করে, যেমনি মানসিক ব্যায়াম শক্তিশালী করে আমাদের মনকে।

কীভাবে আমরা মনকে শক্তিশালী করে পারি? উত্তর তো খুবই সহজ। যেমন বইপড়া, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, নতুন কোনো ভাষা শেখা। আর এতে আমাদের শেখার বিষয়টির কখনো সমাপ্তি ঘটবে না।

আজীবন শেখা, এই অভ্যাস ধরে রাখার বিষয়টি কঠিন। চ্যালেঞ্জিংও বটে। কিন্তু এ থেকে আমরা যা লাভ করি তা অমূল্য। যা বৃদ্ধকালেও আমাদের মস্তিষ্ককে শাণিত ও সতেজ করে।

শারীরিকভাবে সচল থাকা

আপনাদের একটি গল্প বলি। আমার দাদির গল্প। তাঁর বয়স ৮৫। কিন্তু তাকে দেখলে কে তা বলবে? তিনি এই বয়সেও তার অর্ধেক বয়সী মানুষের চেয়েও প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তেমনি টনটনে জ্ঞান আর শাণিত মগজ। এর রহস্য কী? কারণ তিনি কখনো সকালে হাঁটাহাঁটি মিস করেন না।

শারীরিকভাবে সফল থাকার বিষয়টি যেমন মানুষকে স্বাস্থ্যবান করে তেমনি তা মস্তিষ্ককেও ধারালো করে। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের নানা অংশে রক্ত প্রবাহকে বৃদ্ধি করে, তেমনি মাথাতেও। এটা স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং চেতনার সামর্থ্যকেও।

আমার দাদি প্রতিদিন সকালে আধ ঘণ্টা হাঁটেন, যতটা আমি মনে করতে পারি, বৃষ্টি বা রোদেলা দিনেও। তিনি বলেন এটি তার মন পরিষ্কার করতে এবং দিনের জন্য একটি ইতিবাচক সুর সেট করতে সাহায্য করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে শারীরিক কার্যকলাপ জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

আপনি যা দিয়ে আপনার শরীরকে জ্বালানি দেন তা সরাসরি আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। যারা তাদের ৭০ বছর এবং তার পরেও মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ থাকে, তারা সাধারণত স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করে।

ফল, শাকসবজি, জলপাই তেল এবং চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটি কারণ রয়েছে। এই খাবারগুলি প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, যা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি জানেন যে ব্লুবেরিগুলিকে প্রায়শই ‘ব্রেনবেরি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়? কারণ এই ধরনের খাবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ যা মস্তিষ্কের বার্ধক্যকে বিলম্বিত করে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।

নিয়মিত সামাজিক মিথস্ক্রিয়া

সামাজিক হওয়া শুধু মজাই নয়, আপনার মস্তিষ্ককে তীক্ষ্ণ রাখার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে নিয়মিত মিথস্ক্রিয়া জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে।

যারা ৭০ এবং তার পরেও মানসিক তীক্ষ্ণতা বজায় রাখে, তাদের একটি প্রাণবন্ত সামাজিক জীবন থাকে। তারা অর্থপূর্ণ কথোপকথনে জড়িত এবং তাদের প্রিয়জনের সাথে প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি জীবনযাপন করে।

অন্যদের সাথে জড়িত হওয়া আমাদের মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে, আমাদের নানা বিষয়ে অবগত রাখে এবং আমাদের সুখের অনুভূতি দেয়। এটা মস্তিষ্কের জন্য বিশ্রামও বটে।

বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সাথে ভালো চ্যাটের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করবেন না। এটি শুধু সাম্প্রতিক গসিপ সম্পর্কে নয়, আপনার মস্তিষ্কের পেশিগুলির ব্যায়ামেও ফলপ্রসূ।

পরিবর্তনের আলিঙ্গন

জীবন পরিবর্তনে পূর্ণ, যা ছোট কিংবা বড়। এবং তা নির্ভর করছে আমরা কীভাবে বিষয়টি পরিচালনা করি—যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

যারা তাদের ৭০ বছর বয়স এবং তারপরও মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ থাকে, তারা প্রায়শই একটি সাধারণ অভ্যাসকে রপ্ত করে নেয়- সেটি হলো, তারা পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করে।

নতুন পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা প্রতিরোধ করার পরিবর্তে তারা সেটিকে স্বাগত জানায়। তারা পরিবর্তনকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখে, চাপ বা অস্বস্তির উৎস হিসেবে নয়। এই মানসিকতা তাদের মস্তিষ্ককে সক্রিয় এবং প্রাণবন্ত রাখে, তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।

পর্যাপ্ত ঘুম

ঘুমের গুরুত্বও অবহেলা করা যাবে না। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে ঘুমের অভাব সত্যিই আপনার মানসিক তীক্ষ্ণতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

আমি আমার চাবিগুলি কোথায় রেখেছি তা ভুলে যাওয়া হোক বা কাজে ফোকাস করার জন্য লড়াই করার বিষয় হোক না কেন, দুর্বল ঘুম সব সময় আমার জ্ঞানের ভান্ডারের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

যারা ৭০ বছর এবং তার পরেও মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ থাকেন, তারা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের মূল্য বোঝেন। একটি ভালো রাতের ঘুম স্মৃতিকে একীভূত করতে, একাগ্রতা উন্নত করতে এবং পরের দিনের জন্য মনকে সতেজ করতে সাহায্য করে।

নিয়মিত মানসিক ব্যায়াম

শারীরিক ক্রিয়াকলাপ যেমন আপনার শরীরকে সবল রাখে, তেমনি মানসিক ব্যায়াম মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

যারা ৭০ এবং তার পরেও মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ থাকে, তারা প্রায়শই তাদের মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করে এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকে। এটি পাজল এবং ক্রসওয়ার্ড থেকে শুরু করে একটি নতুন দক্ষতা বা ভাষা শেখার মতো আরও জটিল কাজ হতে পারে।

এইসব মানসিক কার্যকলাপ মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে, স্মৃতিশক্তি এবং জ্ঞানীয় ফাংশনগুলিকে উন্নত করে। এটি মনকে সক্রিয় এবং নিযুক্ত রাখে, মানসিক তৎপরতা প্রদান করে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জে রাখুন, এমন ক্রিয়াকলাপগুলিতে জড়িত হন যা আপনাকে চিন্তা করতে সাহায্য এবং আপনার মনকে উদ্দীপিত করবে। আপনার ভবিষ্যৎ এটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে।

জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

মন একটি শক্তিশালী জিনিস। আর ইতিবাচক মনোভাব মানসিক তীক্ষ্ণতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত কার্যকর একটি উপায়।

যারা তাদের ৭০ বছর এবং তার পরেও মানসিকভাবে সতর্ক থাকেন, তারা প্রায়শই জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। তারা ভালোর দিকে মনোনিবেশ করেন। বেছে নেন এমন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি, যা চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মনকে পরিষ্কার রাখে।

এর মানে এই নয় যে তারা জীবনের নেতিবাচক দিক উপেক্ষা করেন। বরং তারা সেগুলিকে স্বীকার করে কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনায় তার প্রভাব ফেলতে দেন না।

আপনার জীবনে ইতিবাচকতা লালন করুন। কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করুন এবং ইতিবাচকতাকে আপনার গাইড হতে দিন। এটি আপনার মন ও মস্তিষ্ককে তীক্ষ্ণ রাখার জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.