ভালোবাসার দরজা
হাত ছোঁয়াতেই হাতে আমার জাগলো ভোরের আলো,
বুকের ভেতর আকাশ-মাটির পূর্ণতা চমকালো।
বন্ধ শরীর খুলল দুয়ার, পিঠের ওপর ডানা,
দেরাজজুড়ে হাজার চিঠি পড়তে তো নেই মানা।
বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কালের পাখি,
পালিয়ে থাকা প্রহরগুলো করল ডাকাডাকি।
চোখের ভেতর স্মৃতির ছবি ছুটছে ট্রেনের বেগে,
অনেক বেলা পেরিয়ে গেছে অমল-ধবল মেঘে।
মরচে পড়া হাতের আঙুল খুঁজছে ইতিউতি,
নতুন পথে হাঁটতে আমার ঘটছে পদচ্যুতি।
এই ভূ-ভাগে যা আছে সব হৃদয় দিয়ে কেনা,
জমার খাতা শূন্য তবু, বাকির খাতায় দেনা।
পুড়িয়ে দিলাম বাকির খাতা, উপরওয়ালা হাসে,
ভালোবাসার দরজা খুলে দিলাম অনায়াসে।
রবীন্দ্রনাথ হবো
কাঁধের ওপর কাব্যভাষা, বুকের ভেতর বই,
মন উড়ে যায় তেপান্তরে,
এলোমেলো পঙ্ক্তি ঘোরে,
বাঁধবো তেমন বাঁধন কোথায়? হৃদয়-সুতো কই?
কেমন করে আমি তবে রবীন্দ্রনাথ হই?
পাশের ঘরে ব্যস্ত তিনি, আকুল করা গান,
চাঁদ ডুবে যায় অন্ধকারে,
সোনার তরী নদীর ধারে,
বোশেখ মাসে এক হাঁটু জল, পোড়া মাটির ঘ্রাণ,
আমি খুঁজি ঠাকুরবাড়ির নতুন অভিধান।
উড়ছে ধুলো রৌদ্রতাপে, ঘূর্ণি অভিনব,
উদাস হয়ে ফুলতলাতে,
পঙ্ক্তি খুঁজি পথ চলাতে,
আমের বোলে মৌ তুলেছে ছন্দ নব নব,
এবার ঠিকই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হবো।
একদা একটা বাঘ ছিল
তোমাদের দল থেকে আমি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি,
বাঘের শরীর প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে কচ্ছপে,
পায়ের তীব্র গতির ভেতর জমা হচ্ছে হামাগুড়ি, পালাচ্ছি,
সরে যাচ্ছি গভীর জঙ্গল থেকে সমুদ্রের দিকে, মচ্ছবে
আনন্দ করো, সূর্যের খরতাপ ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার গুহায়,
আমাকে চিনতে কষ্টই হবে তোমাদের, যেমন পলাতক শেয়াল,
যে হাতের মুষ্ঠিবদ্ধ শক্তির কাছে নত হতো পাথর-দেয়াল
সে এখন নিজেই পাথর হয়ে গড়িয়ে পড়ছে নর্দমায়।
আমার ভেতর কাঠঠোক্রা কুরে খাচ্ছে হৎপিণ্ড, ফুসফুসে
জমা হচ্ছে কোকিলের ডিম, অদ্ভুত শব্দ কেড়ে নিচ্ছে সুর,
মুখে শব্দ নেই, আতঙ্ক গিলে খায় জিহ্বা, জল নেয় চুষে,
ধূর্ত সঙ্গীর হাত দু’ঠোঁটে আটকে দিয়েছে তালা, যাব কতোদূর
আমার ট্রাউজারে জ্বলছে আগুন, জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার
আগে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলতে ইচ্ছে করলেও শক্তি নেই,
আমি মোমের মতো গড়িয়ে পড়ছি চারপাশে, মরার
কলঙ্ক মোছার জন্য হাতের কাছে একটা ন্যাপকিনও নেই।
ডিনার টেবিল
আঙুরগুচ্ছের মতো ঝুলে থাকা ঝাড়বাতিটা জ্বলে উঠল,
ভরসন্ধ্যায় সাজানো হচ্ছে ডিনার টেবিল, প্লেট-চামচের
টুংটাং শব্দ অর্কেস্ট্রার মতো বেজে উঠল, চেয়ারে শুভ্র-
সাদা নরম মেঘের গদি, ওভেন থেকে টেবিলে এনে রাখা
হয়েছে তারার কাবাব, এক টুকরো চাঁদ ফ্রাই করে প্লেটে
রাখতেই গর্ভবতী নারীর নিতম্বের মতো দুলে উঠল
জোছনা, তরমুজের জুসের বদলে মহিষের লাল উষ্ণ রক্তে
গ্লাসের শরীর বেয়ে ঝরতে থাকল ঘাম, সসপ্যানে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র স্মৃতির ঝরঝরে পোলাও আর দুঃখবোধের বোনলেস
মাটন টেবিলে আসতেই আমরা বসে পড়লাম
নৈশভোজে। অথচ কিচেনে বাবুর্চি নেই, দরোজায় পড়ে
আছে দেশি-বিদেশি রেসিপির সুমুদ্রিত বই, আর মদের
বোতলগুলো ন্যাংটো পাগলির মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে
টয়লেটের ফ্লোরে। আমরা সমস্ত খাবার ছুঁড়ে মারলাম
ঝাড়বাতির দিকে। কাঁপল না বাতিটা, ঝরে পড়ল না
আলোর কুণ্ডুলি, স্টোররুমের ভাঙা কলস থেকে বেরিয়ে
এলো জোড়া সাপ, আমরা লাফ দিয়ে ডিনার টেবিলে উঠে
বসতেই জাদুকরের মখমলের কার্পেটের মতো টেবিলটা
বাতাস ভেঙে উড়তে থাকল পাখি হয়ে। সম্ভাব্য দংশনের
আশঙ্কায় আমরা কয়েকটা লণ্ঠন ঝুলিয়ে দিলাম অন্ধকার
আকাশে। আরেকটা টেবিল সাজাতে শুরু করল বিষণ্ন নাগিনী।
রূপান্তর
মরচে পড়া ছুরির মতো মনটা পড়ে ছিল বুকের দেরাজে,
ঝলমলে রোদের তীক্ষ্ণ রশ্মির জমাট পাথরে ওটাকে শান্
দিয়েছি, আমি এখন কাটতে পারি গুদামবন্দি ময়দায়
বানানো অবিশ্বাসের কেক, কাটতে পারি আকাশ ও উদ্ধত
বাতাস, অভিমানের চোখ থেকে তুলে নিতে পারি বিষাক্ত
জল। যে হাত মিথ্যে হলফনামায় স্বাক্ষর দেয় সে হাত
বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারি শরীর থেকে আণবিক ছুরিতে,
কাটতে পারি রাজনৈতিক ভাষণ আর প্রতিশ্রুতির ফর্দ,
চলন্ত ট্রেন দু’ভাগ করে দিতে পারি রুই মাছের মতো,
পূর্ণিমার চাঁদকে নামিয়ে এনে কেটে কেটে পিস করে
বিলিয়ে দিতে পারি জোছনার টুকরো, মনে হবে সোনার
মোহর, বিরুদ্ধবাদীদের লেখালেখি খাবলে-খুবলে তাবৎ
অক্ষর তুলে ফেলতে পারি পত্রিকার বিমর্ষ পাতা থেকে,
যেন যোনিপথ থেকে উপড়ে ফেলছি কলঙ্কের দাগ,
নোংরা স্থবির বন্ধ্যা নদীর তলপেটে শানানো ছুরি বিদ্ধ
করে নামিয়ে আনতে পারি উজানের গঙ্গার স্রোত।
আমি কখনো কখনো মানুষ, কখনো কখনো ছুরি হয়ে যাই।
Leave a Reply
Your identity will not be published.