চলচ্চিত্র জগতের মানুষরা একদা আকাশের তারার মতোই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ছিলেন। এখনকার মতো প্রকাশ্যে তাদের তেমন দেখা যেত না। তারা ছিলেন অধরা। রহস্যময়তার পরিমণ্ডলে বন্দি। কী হলিউড কী বলিউড, টালিউড অথবা ঢালিউড- সর্বত্রই এই চিত্র দেখা যেত। এর মধ্যেও কোনো কোনো তারকা-অভিনয়শিল্পীদের সাধারণ মানুষ কাছের জন মনে করত। অবশ্য সেইসব তারকার অবস্থান ছিল মাটির কাছাকাছি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাক তেমনই একজন তারকা-ব্যক্তিত্ব। তিনি সাধারণ অবস্থা থেকেই অসাধারণ হয়েছেন; জিরো থেকে হয়েছেন হিরো। অত্যন্ত কষ্টের দিন পেরিয়ে, কঠিন জীবনসংগ্রামের পরই তিনি চলচ্চিত্র জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই জগতে বিচরণ করেন সম্রাটের মতো। এই নায়করাজের জীবনের নানা বাঁকের ওপর আলো ফেলা হলো এখানে।
টালিগঞ্জের সেই ছেলেটি
রাজ্জাকের জন্ম হয়েছিল কলকাতার টালিগঞ্জে, সেখানকার ৮ নম্বর নাকতলা রোডে। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাকের জন্ম হয় ওই পাড়াতে। বাবা আকবর হোসেন। মা নেসারুন্নেসা। দাদার নাম চিমাই মোল্লা। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। রাজ্জাকের বাবা আকবর হোসেন ছিলেন আধা জমিদার। নাকতলায় তাঁর অনেক জমি ছিল। এখনো সেই এলাকার প্রবীণ মানুষরা রাজ্জাকদের পরিবারকে জমিদার পরিবার বলেই স্মরণ করে।
ছোটবেলায় রাজ্জাক প্রথম ছবি দেখেছিলেন মা-বাবার সঙ্গে। কী ছবি ছিল, সেটি পরে আর স্মরণ করতে পারেন নি তিনি। তবে হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার দেখা ছবিটির কথা তার স্মরণে ছিল। ‘মানে না মানা’ নামের সেই ছবির একটি গানও স্মৃতিপটে উঁকি দিত তার। গানটি হলো ‘ভুল করে তুই ঝাঁপ দিলিরে প্রেম যমুনায়’। যখন স্কুলে পড়ার বয়স হয় তখন রাজ্জাক ভর্তি হন খানপুর হাইস্কুলে। এর আগে বাড়িতেই শিক্ষকের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় তার। তৎসঙ্গে নামাজ পড়াও শেখেন। কিন্তু পড়াশোনা তার মোটেও ভালো লাগত না। তখন ফুটবল ছাড়া আর কিছুতেই রাজ্জাকের মন বসত না। তিনি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন তখন থেকেই এলাকায় ভালো গোলকিপার হিসেবে তার একটা সুনাম ছিল। উল্লেখ্য, কলকাতায় বিশেষ করে টালিগঞ্জে তখন পাড়ায় পাড়ায় নাটক হতো। তখন বন্ধু-বান্ধব মিলে রাজ্জাক প্রচুর নাটক দেখতেন। সত্যি কথা বলতে কী, রাজ্জাক কোনো নাটকই বাদ দিতেন না। এভাবে ফুটবলের পাশাপাশি নাটকও রাজ্জাকের নেশায় পরিণত হয়। দুটো ক্ষেত্রেই তিনি সমান আগ্রহ বোধ করতেন। ফলে প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিতেন। আর বাড়ি থেকে স্কুল সামান্য দূরে ছিল বলে সহজে ধরাও পড়ে যেতেন।
অভিনয়ে হাতেখড়ি
রাজ্জাক যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন তখনকার ঘটনা। তাদের স্কুলের বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে নাটক করা হবে। তখন মহিলা চরিত্র ছাড়া স্ক্রিপ্ট পাওয়া যেত। তেমনই একটা স্ক্রিপ্ট জোগাড় করে শরীরচর্চার শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি তাদের ডাকলেন। নাটকের মূল চরিত্র ছিল একজন কিশোরের। গ্রামের এক সমাজকর্মী। রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি শিক্ষক ওই চরিত্রটি করার জন্য রাজ্জাককে বললেন। স্যারের কথায় রাজ্জাক তো হতবাক। তিনি প্রথমে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলেন। রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি তাকে ধমক দিলেন। তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে ওই নাটকে অভিনয় করতে হলো। নাটকটির নাম ছিল ‘বিদ্রোহী’।
নতুন ইহুদি এবং ছবি বিশ্বাসের তালিম
রাজ্জাক যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন সর্বপ্রথম পাড়ার একটি নাটকে অভিনয় করেন। ‘নতুন ইহুদি’ নামের এই নাটকে তিনি একটি কিশোর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন—যে পড়াশোনার পাশাপাশি হকারি করে নিজের সংসার চালায়। এটা ছিল রাজ্জাকের জন্য একটি পরীক্ষা। কারণ এই চরিত্রটি তিনি পেয়েছিলেন অনেক ছেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ...এই নাটকে রাজ্জাকের একটা মজার স্মৃতি আছে। নাটকের শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক তার মৃত বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। সেদিন দর্শক সারিতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। নাটক শেষে তিনি রাজ্জাকের কাছে এসে ধমকের সুরে বললেন—‘গাধা কোথাকার! মঞ্চনাটকে অভিনয়ের সময় কখনো দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে অভিনয় করতে নেই।’ রাজ্জাক তাঁর কথার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেন এবং মঞ্চে অভিনয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবগত হন।
রঙ্গসভা, ঝংকার এবং...
রাজ্জাকের বয়স তখন সতেরো-আঠারো হবে। সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছেন, চারুচন্দ্র কলেজে। এ সময় অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর তৎকালীন সময়ের প্রথিতযশা পরিচালক পীযূষ বসুর নাট্যদল ‘রঙ্গসভা’-য় যোগ দিলেন। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, অভিনয় তার সমগ্র সত্তায় মিশে যাচ্ছে। তখন তার সকল চিন্তা-ভাবনা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, ব্যস্ততা সবটাই আবর্তিত হতো নাটককে ঘিরে।
‘রঙ্গসভা’র হয়ে বেশ কয়েকটি নাটক করার পর পীযূষ বসুর সঙ্গে রাজ্জাকের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। তার অভিনয়জীবনের দিকনির্দেশনা তখন পীযূষ বসুই দিতেন। তাকে রাজ্জাক অন্ধের মতো ভক্তি করতেন। ...রঙ্গসভার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যা রায়, বলাই সেন, দিলীপ চক্রবর্তী, রসরাজ চক্রবর্তী প্রমুখ। এই নাট্যদলের নাটক ‘মৌচোর’ (সলিল সেন রচিত এই নাটকটি পরে বাংলাদেশ থেকে চলচ্চিত্র রূপ দেন রাজ্জাক এবং ছোট মেয়ে ময়নাসহ অভিনয় করেন)। মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত এই নাটকে রাজ্জাকের অভিনয় সবার প্রশংসা অর্জন করে।
১৯৬২ সালে রঙ্গসভার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে নিজের পাড়াতে রাজ্জাক ‘ঝংকার’ নামে আরেকটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। এই দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন রাজ্জাকের পাঁচ বন্ধু— টি দাস ওরফে হিটলার, লালজি, রণেন, পিলু ও প্রদীপ। রণজিৎ কুমার চৌধুরী (খুলনার শিমুলিয়া গ্রামের জমিদার পুত্র) পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এ অমল এবং শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ নাটকে আমিনার চরিত্রে অভিনয় করার পর পাড়াতে রাজ্জাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পীযূষ বসু পরিচালিত ‘রূপকথা’ নাটকেও রাজ্জাক চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। শুধু পাড়াতেই নয়, বাইরে থেকেও বিভিন্ন নাটকের অফার আসতে শুরু করে। বলা যায়, নাট্যাঙ্গনে তখন ‘রাজা’ নামটি বেশ পরিচিতি পায়। রাজা ছিল রাজ্জাকের ডাকনাম।
চলচ্চিত্রে অভিনয়
অনেক আগে থেকেই রাজ্জাকের চলচ্চিত্র স্টুডিওগুলোতে যাতায়াত ছিল। এর প্রধান কারণ হলো—কাছেই ছিল টালিগঞ্জের একটি স্টুডিও। আর রাজ্জাকদের বাড়ির পাশে তখন এ জগতের স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক থাকতেন। যেমন ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে, পীযূষ বসু, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তাদের সঙ্গে রাজ্জাকের আলাপও ছিল। উল্লেখ্য, পীযূষ বসুর সঙ্গে প্রায়ই স্টুডিওগুলোতে যেতেন রাজ্জাক। সিনেমার শুটিং দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগত। সেই সময় উত্তমকুমারের দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি। যখন তিনি শুটিং করতেন রাজ্জাক সারাদিন বসে তাঁর শুটিং দেখতেন।
সেই সময় উত্তমকুমারকে দেখে রাজ্জাক প্রচণ্ড আলোড়িত হয়েছিলেন। তখন তার মনেও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বাসনা জাগে। কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও পান। ছবিগুলো হলো—পংকতিলক (পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী), রতনলাল বাঙালি (পরিচালক অজিত ব্যানার্জি), শিলালিপি...।
বোম্বেতে পাড়ি
১৯৬১ সালের শেষ পর্যায়ের কথা। তখন রাজ্জাকের বয়স আঠারো-উনিশ। চলচ্চিত্রাভিনয়ের আশায় তিনি পাড়ি জমান বোম্বেতে। বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) তখন একটিই ফিল্ম ইন্সটিটিউট। পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট তখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ...ইন্সটিটিউটে রাজ্জাক নয় মাসের একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মাস দুয়েকের মধ্যে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। সেখানে ক্লাস নিতেন দিলীপ কুমার, শশধর মুখার্জি। বোম্বেতে সেই সময় রাজ্জাকের প্রচুর খরচ হয়। তারা কয়েকজন বাঙালি মিলে একটি মেসে থাকতেন। আর যাবতীয় খরচ কলকাতা থেকে পাঠাতেন তার ভাইবোনরা। যাই হোক বোম্বেতে রাজ্জাকের বেশিদিন থাকা হয় নি। কারণ চলচ্চিত্রাভিনয়ের ওপর পদ্ধতিগত শিক্ষা শেষে তিনি যখন বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন, কেউই তাকে ব্রেক দিতে চায় নি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এই শিক্ষা তার দারুণ কাজে লেগেছিল।
কলকাতায় প্রত্যাবর্তন এবং বিয়ে
বোম্বে থেকে কলকাতায় ফিরে রাজ্জাক আবার পীযূষ বসুর নাটকের দলে যোগ দেন। বলা যায়, ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি মঞ্চের একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এ সময় অজিত চ্যাটার্জি পরিচালিত ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে রাজ্জাক অভিনয় করেন একস্ট্রা হিসেবে।
১৯৬২ সালের শুরুতে রাজ্জাক বিয়ে করেন। ৩ মার্চ তার ঘরে আসেন লক্ষ্মী ওরফে খায়রুন্নেসা। এ কোনো হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের বিয়ে নয়। এ সম্পর্কে লক্ষ্মীর ভাষ্য হলো: ‘টালিগঞ্জে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, ঠিক সেই বাড়ির পাশে ওর এক আত্মীয় থাকতেন। একদিন বাড়ির গেটের সামনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, তখন নাকি তাদের কেউ আমাকে দেখে ফেলে। তারপরই ও বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব আসে। এরপর তারা আমাকে দেখতে আসে এবং সেদিনই আংটি বদল হয়ে যায়। তখন আমার বয়স ১২ বছর। এর দুই বছর পর আমাদের বিয়ে হয়।’ তারপর ১৯৬৪ সালে তাদের প্রথম সন্তান বাপ্পার জন্ম হয়।
এপার বাংলায় আগমন এবং জীবনসংগ্রাম
এ সময় শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যদিও ছেলেবেলায় মুসলমান হিসেবে রাজ্জাককে কখনো আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে হয় নি, তবুও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কলকাতার প্রতি তাকে বিরূপ করে তোলে। তখন তিনি কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন আবার বোম্বে চলে যাবেন। কিন্তু বাদ সাধেন পীযূষ বসু। তিনি বলেন— ‘চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি তোর যখন এতই দুর্বলতা, তুই বোম্বে না গিয়ে বরং পাকিস্তানে চলে যা। তাছাড়া বোম্বেতে প্রতিযোগিতা অনেক।’ রাজ্জাকও ভাবলেন, বোম্বেতে তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া তখন এখানে সবে মাত্র নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। ভেবে দেখলেন, সুবিধাটা ওপার বাংলায় হবে বেশি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আর বিলম্ব করলেন না। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে লক্ষ্মী ও বাপ্পাকে নিয়ে তিনি ঢাকায় চলে আসেন।
ঢাকায় আসার পর তখন ভীষণ কষ্টে রাজ্জাকের দিন কেটেছে। আর রাজ্জাকের স্ত্রীও অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। শেষ পর্যন্ত সংসার চালানোর তাগিদে তিনি ইকবাল ফিল্মে এসিস্টেন্ট হিসেবে চাকরি নিলেন। সেটাও ছিল অবৈতনিক। শুধু খাওয়া এবং শুটিং থাকলে যাতায়াত ভাতা পেতেন।
পরিচালক কামাল আহমেদের ‘উজালা’য় রাজ্জাক কাজ করেন পাঁচদিন। শেষের দিন কাউকে না বলে শুটিং স্পট থেকে তিনি ফিরে আসেন। বাসায় এসে স্ত্রী লক্ষীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। লক্ষ্মী বলেন, ‘এভাবে ভেঙে পড়বেন না। নিশ্চয় আপনার ভালো কিছু হবে। ধৈর্য ধরেন।’
সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাক কাজ করেন ‘পরওয়ানা’ ছবিতেও। কিন্তু ছবির কাজ আশি ভাগ হওয়ার পরই সেই কাজ তিনি ছেড়ে দেন। কারণ রাজ্জাক নায়ক হতে ঢাকায় এসেছিলেন। সহকারী পরিচালক হতে নয়। অবশ্য যোগাযোগটা তখনো চালিয়ে যেতে থাকেন। ছুটে যেতেন কাজী জহির, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্তদের কাছে। জানান তিনি বম্বের শশধর মুখার্জির ফিল্মালয় থেকে নয় মাসের কোর্স করেছেন, কলকাতার ছবিতেও কাজ করেছেন। কিন্তু কেউই পাত্তা দিতেন না তাকে। দিন দিন আর্থিক কষ্ট তাকে কোণঠাসা করে ফেলছিল। এই কষ্টের দিনে অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানসহ না খেয়েও থেকেছেন। নায়ক হওয়ার আশা তো অনেক আগেই তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন যে-কোনো একটা চরিত্র পেলেই বেঁচে যান। কারণ সংসারই তার কাছে ছিল মুখ্য। জীবনের এই সময়ে এদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে রাজ্জাকের যোগাযোগ হয়। তিনি তার সঙ্গে দেখা করেন। রাজ্জাকের স্টিল ছবি দেখে জহির রায়হান বলেন, ‘তুমি এক সপ্তাহ পরে আমার সাথে দেখা করো, তবে দাড়ি কাটবে না।’ দ্বিতীয়বার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে জহির রায়হান জানালেন—তার নিজের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’-র চলচ্চিত্ররূপে তিনি নায়ক হিসেবে রাজ্জাককে নেবেন। এ বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়। কিন্তু ‘বাহানা’ ফ্লপ করায় জহির ওই প্রজেক্ট থেকে সরে আসেন। ততদিনে রাজ্জাকের সংসারের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। বিশেষত ১৯৬৫ সালের শুরুতে তার চলার মতো অবস্থাও ছিল না। উপায় না দেখে টিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে অডিশন দেন। পাশও করেন। কিন্তু তখন টিভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জামান আলী খান সব কথা শুনে রাজ্জাককে একটি ধারাবাহিক নাটকের জন্য নির্বাচন করেন। ‘ঘরোয়া’ নামের এ নাটকটি ছিল একটি বিজ্ঞাপন নাটক। এখানে রাজ্জাক একজন পিতার চরিত্রে অভিনয় করতেন। এই নাটকই রাজ্জাককে সাময়িকভাবে সংসার চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। নাটকের পারিশ্রমিক হিসেবে পেতেন পর্ব পিছু ৬৫ টাকা।
স্টেশনমাস্টার থেকে মাতাল মক্কেল
এই সংগ্রামী জীবনে রাজ্জাক বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেন—‘আখেরি স্টেশন’-এ স্টেশনমাস্টার, ‘কার বউ’-এ বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার, ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ পাড়ার ছেলে মিন্টু, ‘ডাকবাবু’-তে কোর্টের কর্মচারী এবং ‘কাগজের নৌকা’-য় বাইজি পাড়ার মাতাল মক্কেল। তখন রাজ্জাক মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেছেন। প্রথম অভিনয় করেছিলেন আবদুস সাত্তার নির্দেশিত ‘পাত্রীহরণ’-এ, ১৯৬৫ সালে। বলা যায়, এই সময় ঢাকা-কুমিল্লার প্রায় পঞ্চাশটি নাটকে অভিনয় করেন রাজ্জাক।
বেহুলার লখিন্দর
অন্ধকার কেটে গিয়ে একসময় নতুন প্রভাত রাজ্জাকে স্বাগত জানায়। জহির রায়হান খবর পাঠান। শুনে রাজ্জাক আর দেরি করলেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। জহির রায়হান জানালেন, ‘হাজার বছর ধরে’ আপাতত তিনি করছেন না। নতুন ছবির কাজে হাত দিয়েছেন। এই নতুন ছবি ‘বেহুলা’তে তিনি রাজ্জাককে নায়ক তথা লখিন্দর চরিত্রে নির্বাচন করেছেন।
১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি রাজ্জাক ‘বেহুলা’য় চুক্তিবদ্ধ হন। ‘বেহুলা’ মুক্তি পেল ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর। ছবিটি সুপারহিট হয়। বলা যায়, বেহুলাই নায়ক রাজ্জাকের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। তাকে আর থমকে দাঁড়াতে হয় নি।
‘আনোয়ারা’ থেকে ‘জীবন থেকে নেওয়া’
রাজ্জাকের দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘আনোয়ারা’। কিন্তু আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘আগুন নিয়ে খেলা’। আসলে ‘বেহুলা’ হিট হওয়ার পরও নির্মাতারা তখনো রাজ্জাকের প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করেন নি। কারণ ‘বেহুলা’ ছিল লোককাহিনিভিত্তিক ছবি। পরে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ যখন হিট করল, তখন থেকে পটপরিবর্তন হলো। এই ছবিটি ছিল রাজ্জাকের জীবনের একটি মাইলস্টোন। সেই সময় ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিটি পুরোনো ঢাকার তৎকালীন স্টার সিনেমাহলে এক নাগাড়ে আটাশ সপ্তাহ চলেছিল। দীর্ঘ কষ্টের পর রাজ্জাকের জীবনে স্বচ্ছলতা এসেছিল তখন থেকে। এটা ১৯৬৭ সালের শেষের দিকের কথা।
১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’। ছবিটির হিট হয়। এরপর ব্যবসাসফল হয় ‘এতটুকু আশা’ও। তবে ১৯৬৯ ছিল রাজ্জাকের বছর। ওই বছর ‘ময়নামতি’ বক্স অফিসে ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়ে।
১৯৭০ সালে যুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’-য় রাজনীতি সচেন ও প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে রাজ্জাকের অভিনয় অবিস্মরণীয়।
সফল শিল্পী
স্বাধীনতার পরে ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’ ইত্যাদি রাজ্জাকের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করে। সামাজিক ছাড়াও সামাজিক অ্যাকশন ছবিতেও তার সাফল্য আসতে শুরু করে। ফলে স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পের একজন অপরিহার্য শিল্পীতে পরিণত হন। এরই মধ্যে তিনি প্রযোজনা সংস্থাও গড়ে তোলেনÑরাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস। এটা ১৯৭২ সালের ঘটনা। এর আগে গুলশানে নিজের বাসাও হয়েছে তার।
পরিচালনায় অভিষেক
১৯৭৭ সালে রাজ্জাক পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবির প্রথম ‘অনন্ত প্রেম’। প্রেমের এই ছবিটি এখন দর্শকমহলে আলোড়ন তুলেছিল। ছবিতে গল্পের প্রয়োজনে একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল। সেন্সর বোর্ড তা কাটে নি। অবশ্য নায়িকার কবিতার এবং নারী দর্শকদের অনুরোধে রাজ্জাক দৃশ্যটি ছবি থেকে বাদ দেন। সন্তানদের তার আদর্শে মানুষ করেছেন। তার তিন ছেলে দুই মেয়ে। বাপ্পা ১৯৬৪ সালে, শম্পা (রাজ্জাকের যে মেয়ে মারা গেছে) ১৯৬৬ সালে, বাপ্পি ১৯৬৭ সালে, ময়না ১৯৬৯ সালে এবং সম্রাটের ১৯৮০ সালে জন্ম হয়। বাপ্পা ও সম্রাট চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
‘নায়করাজ’ উপাধি প্রাপ্তি
গত শতকের আশির দশকের কথা। তখন অবজার্ভার হাউজ থেকে বের হতো সিনে-পত্রিকা ‘চিত্রালী’। সহকারী সম্পাদক (পরে সম্পাদক) ছিলেন আহমদ জামান চৌধুরী ওরফে আজাচৌ। তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনি-সংলাপ ও গীত রচয়িতাও। এই আহমদ জামান চৌধুরী রাজ্জাককে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন। রাজ্জাক তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন। ‘চিত্রালী’তে আজাচৌ লিখতে লিখতে ‘নায়করাজ’ উপাধিটির প্রচলন হয়ে যায়।
সফল মানুষ
ব্যক্তিগত জীবনে রাজ্জাক একজন সফল মানুষ ছিলেন। তিন ছেলেই বিবাহিত। দু’বার হজ করেছেন রাজ্জাক। তারপর ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবনযাপন করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তার জীবন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেছিলেন: ‘নিজেকে আমি সফল বলব হানড্রেড পার্সেন্ট। না যদি বলি, আল্লাহ নারাজ হবেন। আমি একজন সফল মানুষ। সফল পিতা, সফল পুরুষ, সফল শিল্পী। আমার জীবনে না-পাওয়ার দুঃখ নেই। আমি যা চেয়েছি বরং আল্লাহ তার থেকে বেশি দিয়েছেন। আমি যা চেয়েছি আর আমি যা পেয়েছি এ নিয়ে যেন দুনিয়া থেকে বলে যেতে পারি।’
রাজ্জাকের শেষ ইচ্ছে অপূর্ণ থাকে নি। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু এদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকাল তিনি বেঁচে থাকবেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.