মা আমার মা

মা আমার মা

মানুষের হৃদয়ে রণিত সবচেয়ে প্রিয় শব্দটি হলো ‘মা’। মা যে কী, যার মা নেই সে-ই বোঝে। তার সবকিছু আছে অথচ কিছুই নেই। অদ্ভুত এক শূন্যতার মাঝে তার বসবাস। অন্ধকারে ডুবে থাকে তার পৃথিবী।

মানুষের জীবনে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মা-ই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। তাকে বহু কষ্টে বড় করে তোলেন। জগৎ-সংসারের নানা বিষয়ে অবহিত করে যোগ্য করে তোলেন এই কঠিন পৃথিবীর। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার ভাবনা ঘুরপাক খায় সন্তানকে ঘিরে।

৮ মে ছিল বিশ্ব মা দিবস। এ উপলক্ষে এই বিশেষ রচনা।

সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান

দশমাস দশদিন সন্তানকে গর্ভে ধারণের মধ্যেমে একজন নারী মা হয়। সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় তাকে অসহ্য যন্ত্রণা সইতে হয়। এ সময় তার নানারকম শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। নানা কষ্ট ভোগের পর অবশেষে একজন নারী মা হন। তার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে। তারপরও সন্তানকে বড় করতে গিয়ে নানা কষ্ট সহ্য করেন। সন্তান যখন একটু বড় হয়ে হামাগুড়ি দেয়, হাঁটতে শেখে, তখন তার প্রতি মায়ের থাকে সজাগ দৃষ্টি। বলা যায়, সন্তানের শারীরিক, মানসিক গঠনে মায়ের ভূমিকা থাকে অপরিসীম। শিশু সন্তান মায়ের কাছ থেকেই চলাফেরা, আদব-কায়দা শেখে। মায়ের কাছেই সন্তানের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। মা-ই সন্তানের প্রথম শিক্ষক। সন্তান যখন স্কুল-কলেজে পড়ে, তখন মাকে তার প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। আসলে সন্তানের প্রতিষ্ঠিত হওয়া না পর্যন্ত মা’র চিন্তার শেষ থাকে না। সন্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মা কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। তারপর তাকে বিয়ে দিয়ে অথবা পাত্রস্থ করে শান্তি পান। এমনকি সন্তানের সংসার জীবনেও মা চেষ্টা করেন তার সুখী সংসার গড়ে দিতে। কেননা সন্তানের সুখেই মায়ের সুখ।

মা দিবসের কথা

১৮৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মা দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন আমেরিকায় সিভিল ওয়ার চলছিল। সেখানকার সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট জুনিয়া ওয়ার্ড হাউই তার একটি লেখার মাধ্যমে প্রস্তাব করেন মা দিবস পালনের। তার উদ্দেশ্য ছিল, মায়ের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করা। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অতঃপর এ ধরনের আরও একটি উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন আনা জারভিস। তিনি ১৮৫৮ সালে তার মা আনা রিভজারভিসের ‘মাদার’স ওয়ার্ক ডে পালনের ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা পান। ১৯০৮ সালে তিনি তার মায়ের কর্মস্থল ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের একটি মেথডিস্ট চার্চে প্রথম মা দিবস পালনের উদ্যোগ নেন। তখন থেকে বেসরকারি অর্থাৎ আনা রিজভারভিসের মৃত্যুর দিন ১০ মে-কে মা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত করা হতো। তারপর ১৯১৪ সালের ৯ মে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যাশনাল মাদার ডে ঘোষণা করেন এবং সেদিন বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ব্রিটেনের ইতিহাসে দেখা যায়, ষোড়শ শতকে গির্জাকেন্দ্রিক মা দিবস উদ্যাপনের রেওয়াজ চলে। পরে প্রতি বছর মে মাসের চতুর্থ রোববারকে ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে পালন করা হতো।

আনা জারভিসই মাদারডে’-র প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

সৃষ্টির ইতিহাসে মা

পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ স্বভাবতই পরকালে বেহেশত চায়। প্রত্যেক নর-নারীই মায়ের গর্ভজাত। সুতরাং মায়ের অবস্থান যে কতটা ঊর্ধ্বে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ সমাজ বাস্তবতায় নারী যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রজাতি। পুরুষ ব্যতীত নারীসত্তা যেন মূল্যহীন। অবশ্য এর স্বীকৃতি রয়েছে ধর্মগ্রন্থগুলোতে। যেমন-  বাইবেল থেকে জানা যায়, পৃথিবীর আদি নারী হচ্ছে ঈভ। প্রথম মানব অ্যাডামের স্ত্রী। অ্যাডামের বাম পাঁজর থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় ঈশ্বর ঈভকে তৈরি করেন। এই ঈভ বা হাওয়ার কথা ‘বুখারী শরীফ’-এ-ও উল্লেখ আছে।

এদিকে মানব ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকালে পাওয়া যায় ভিন্ন এক চিত্র। সমাজবিজ্ঞানী মর্গান তার ‘আদিম সমাজ’ গ্রন্থে বলেন, সম্পত্তি বেশ বেড়ে উঠলে স্ত্রী ধারা থেকে পুরুষ ধারার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। উল্লেখ্য, মানব সভ্যতার এই বাঁক পরিবর্তন ঘটে বর্বর যুগের উঁচু পর্যায়ে। কিন্তু এর আগে ৮০ হাজার বছর মানব সমাজের কর্তৃত্ব ছিল মেয়েদের হাতে। অর্থাৎ তখন ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। সেই সমাজে মেয়েরাই ছিল দলের প্রধান। মাকে মনে করা হতো দলের আদি পুরুষ। উল্লেখ্য, আদি পুরুষ কিন্তু পুরুষকে বোঝায় না, বরং সামাজিক এক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করে। বাস্তবতা হলো- আদি পুরুষ যে কোনো মেয়ে হতে পারে এমনটি আমরা ভাবতে পারি না। কেননা মাতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষের সঙ্গে একজন মেয়ের বিয়ে হতো না। একদল পুরুষের সঙ্গে একদল মেয়ের বিয়ে হতো। সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বিয়েকে যৌথ বিয়ে বলে অভিহিত করেন। যৌথ স্বামী-স্ত্রীর মিলিত প্রয়াসে যে সন্তান, সে তার মায়ের নামেই পরিচিত হতো। কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবলুপ্তির পর নারীর সব অধিকারই কেড়ে নেয় পুরুষতান্ত্রিকতা। প্রকৃতপক্ষে সেখান থেকেই নারী অবমাননার শুরু। আর নারী অবমাননাকে বৈধতা দিতে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয় নানা অনুশাসন। সেই অনুশাসনের কঠোরতার ভেতরে আজও নারী বন্দি। এরপরও নারী আপনগর্ভে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণ করে মানব প্রজাতির বংশ বিস্তারকে অব্যাহত রেখেছে। শুধু কি তাই, মানব প্রজাতির অনন্যতা ও ভিন্নতা যে ভাষা নিয়ে, সেই ভাষা শেখানোর দায়িত্বও নারীর। বায়োলজিক্যালি নারী যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভাষা শেখানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত। বস্তুত মায়ের ভাষাই মানুষের ভাব প্রকাশের অকৃত্রিম ও যথাযথ মাধ্যম।

মাতৃভক্তি

বায়েজিদ বোস্তামীকে নিয়ে লেখা কবিতা আমরা অনেকেই পড়েছি। সেখানে মাতৃভক্তির নিদর্শন ফুটে উঠেছে। সন্ধ্যা রাতে ছেলের কাছে মা পানি চাইল। যুবক দেখল, ঘরে কোথাও পানি নেই। রাতের আঁধারে দূর থেকে পানি এনে ছেলে দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। মাকে জাগালে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। আবার পানি রেখে যদি ঘুমিয়ে পড়ে, তবে ঘুম থেকে জেগে তো মা আবার পানি চাইতে পারে! দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছেলে সারারাত কাটিয়ে দেয় বিনিদ্র রজনী। ভোরে মা জেগে দেখে, ছেলে তার পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিয়রে। তিনি অবাক হয়ে যান। তারপর তিনি মনে করেন, সন্ধ্যা রাতে ছেলের কাছে পানি চেয়েছিলেন। ভালবাসা ও গর্বে তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। এই সুবোধ ছেলেটিই মাতৃভক্তির সেরা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। বায়েজিদ বোস্তামী (রহঃ)।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন অবিভক্ত বাংলার স্কুল পরিদর্শক। হঠাৎ খবর এলো তার মা অসুস্থ। তিনি ছুটি চাইলেন। কিন্তু ইংরেজি ডিপিআই ছুটি দেবেন না। বিদ্যাসাগর বললেন, আমার মা’র অসুখ, তুমি ছুটি দেবে না? তবে আমি চাকরিই ছেড়ে দেব। চাকরি ছাড়ার হুমকিতে বিদ্যাসাগরের ছুটি মঞ্জুর হলো। কিন্তু অসময়ে রওনা দেওয়ার কারণে তিনি নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার কিছুই পেলেন না। তখন তিনি দামোদর নদী পার হলেন সাঁতরিয়ে। একেই বলে মা জননীর প্রতি ভক্তি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেমন মায়ের গর্ভে এমন সন্তান জন্মায়? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গরিবের সন্তান ছিলেন। তাই বাড়িতে লেপ ছিল না। চাকরি পেয়ে বিদ্যাসাগর মা’র জন্য লেপ কিনে নিয়ে আসেন। কিন্তু পরের বছর বাড়িতে এসে দেখেন, মা লেপ গায়ে দেয় নি। বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করল, মা তুমি লেপ গায়ে দাও নি কেন? তার মা বললেন, বাবা গ্রামে কত মানুষের লেপ নেই। তারা শীতে কষ্ট করে। আমি কী করে লেপ গায়ে দিই? বিদ্যাসাগর বললেন, গ্রামের মানুষের জন্য কতগুলো লেপ লাগবে? তার মা কতগুলো লেপ লাগবে বললেন। এরপর বিদ্যাসাগর সবার জন্য লেপের ব্যবস্থা করলেন। তখনই বিদ্যাসাগরের মা লেপ গায়ে দেন। মায়ের প্রতি শুধু শ্রদ্ধাশীলতাই নয়, মা ও সন্তানের আদর্শের মধ্যে যে কতটা একাত্মতা তারই উদাহরণ হলো বিদ্যাসাগর ও তার মাতা।

তৈমুর লং বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন। একদা তিনি যুদ্ধ জয় করে বন্দিদের তার বাড়ির পাশে তাঁবুতে রাখছেন সৈন্যবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে। হঠাৎ তিনি এক মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এক মহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি মহিলাকে তার কাছে আসার অনুমতি দিলেন। মহিলা এসে বললেন, আমার একমাত্র ছেলেকে আপনি নিয়ে এসে বন্দি করে রেখেছেন। তার বয়স ১৮ বছর। সে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমরা মেয়েমানুষ। সে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তৈমুর লং জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, এই মা দেড়শ’ মাইল হেঁটে এসে তার ছেলের মুক্তি চাচ্ছেন। তার বিমর্ষ চেহারা ও ছেঁড়া পোশাক দেখে তৈমুর লংয়ের আত্মা কেঁপে উঠল। তিনি মহিলাার ছেলের মুক্তির নির্দেশ দিলেন। একজন যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেও মায়ের করুণ আকুতির কাছে মাথা নত করে- সে তো শুধু মাতৃস্নেহকেই অনুভব করে।

বাংলা চলচ্চিত্রে মা

বাংলা চলচ্চিত্রে মা ও সন্তানের সম্পর্কের অসংখ্য দৃষ্টান্ত লক্ষ করি। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে দেখা যায়, অপুর পৃথিবী একান্তই মা-কেন্দ্রিক। কেননা ছোট্ট অপুর মায়ের প্রতি নির্ভরতাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, কৈশোর উত্তীর্ণ একটি ছেলের জগৎ আগেকার মাতৃকেন্দ্রিক জগৎ থেকে কীভাবে ক্রমশ আলাদা হয়ে যায় এবং মায়ের সঙ্গে পুত্রের কীরকম এক আত্মিক বিচ্ছেদ ঘনিয়ে ওঠে, নীরবে নিঃশব্দে, মা বিধবা ও পুত্র একমাত্র সন্তান হলে-  এটি কী রকম ট্র্যাজিক হতে পারে, মা ও ছেলে দুজনের মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণিক ডিটেলের মধ্যে অসামান্য চলচ্চিত্রের ভাষায় ‘অপরাজিত’-এ সত্যজিৎ তা দেখিয়েছেন। এ চলচ্চিত্রে অপু তার সমস্ত মানবিক বোধ সত্ত্বেও প্রচণ্ড অগ্রগতির টানে ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে চলে, সর্বজয়া পড়ে থাকে পিছনে স্মৃতিভারাক্রান্ত নিঃসঙ্গ জগতে- এ এক ধরনের ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তো বটেই, আরও অনেক কিছু। কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচক রবিন উড তাঁর ‘অপু ট্রিলজি’ গ্রন্থে যে লিখেছেন- সর্বজয়ার মৃত্যু অপুর বন্ধনমুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, এমনটি না হলে সৃষ্টি হয় না- এটি ঠিক নয়। এ সম্পর্কে অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “মাতা-পুত্রের এই সম্পর্কের ট্রাজেডির মূল কারণ হচ্ছে ছেলের ওপর মায়ের মানসিক পরাধীনতা, যা আত্যন্তিক পুত্রকেন্দ্রিকতা- তা যদি না থাকত তাহলেও ‘জেনারেশন গ্যাপ’ জনিত বিচ্ছেদ অবশ্যই হতো কিন্তু তা এমন ট্র্যাজিক হতো না- যা এ ক্ষেত্রে হয়েছে। এই আত্যন্তিক পুত্রতান্ত্রিকতা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতার নামান্তর, যে সমাজে মানুষ শুধু নিজের কথা ভাবে এবং নিজের একমাত্র আপনজনের কথা এবং তারই নিরিখে বা ‘টার্মে’ তার সমস্ত জীবনবীক্ষা স্থির হয়ে থাকে- সেখানে এই ট্রাজেডি অবশ্যম্ভাবী। কেননা একটা বয়সের পর পুত্রের একটি অন্য নিজস্ব জগৎ গড়ে ওঠেই- পুত্রের সেই জগতের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র স্থাপন না করে সেখানে সম্ভব শুধু পুত্রের ব্যক্তিসত্তার প্রতি আত্যন্তিক আগ্রহ- যে ধরনের আগ্রহ পুত্রের শৈশবকালে পুত্রের প্রতি সব মায়ের থাকে- তাকে আত্মকেন্দ্রিকতারই আর এক নামান্তর বলা ভুল নয়। এবং এক্ষেত্রে ট্র্যাজেডি অনিবার্য। সেসব সমাজ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক হতে শেখায়, মানুষ তার নিজের ‘ডেসটিনির’ সঙ্গে সমগ্র সমাজের ‘ডেসটিনি’-কে একাত্ম করতে চায় না, শুধুমাত্র নিজের আপনজনের ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে আষ্টেপৃষ্টে বিজড়িত করে রাখে (কিন্তু তার ক্রমবিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে নয়) সেসব সমাজে এই মাতা-পুত্রের আন্তঃসম্পর্কের ট্রাজেডি অনিবার্য।”

তরুণ মজুমদারের ‘আলোর পিপাসা’তে এক বাঈজী সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখে এ জন্য যে, যেন তার ক্লেদাক্ত জীবনের ছোঁয়া সন্তানের ওপর না পড়ে, সে যেন আলোকিত মানুষ হয়। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে নীতার সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কটি অদ্ভুত। আর্থিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত সংসারটি নীতার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই মা চান না যে, নীতার বিয়ে হোক। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা ও স্নেহ সংসারের যাঁতাকলে এভাবেই চাপা পড়ে থাকে।

তপন সিংহের ‘অতিথি’র তারাপদ অন্য ধরনের। সংসারের বন্ধন তাকে বাঁধতে পারে না, এমনকি মায়ের অপরিসীম স্নেহও। তাই সে ঘুরে বেড়ায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।

মা ও সন্তানের আত্মিক সম্পর্ক আমরা লক্ষ করি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও। সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ ছবিতে বন্ধ্যা নারীর সন্তানের হাহাকার লক্ষ করা যায়। অন্যের সন্তানকে তাই অপরিসীম মমতায় সে মানুষ করে। মতিন রহমানের ‘লাল কাজল’-এ আরেক বন্ধ্যা নারী আয়ার কাজ করতে করতে এক ধনীর বালিকাকে ভালোবেসে ফেলে। অবহেলিত ও মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত মেয়েটিও ভালোবাসে ফেলে তাকে। ‘সমাধি’ ছবিতে ছেলে ও মায়ের মধুর সম্পর্ক। সন্তান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে রাজি আছে, কিন্তু মাকে ছাড়তে রাজি নয়। সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’-এ লাড়- মাতৃ অন্তঃপ্রাণ। কিন্তু ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তার জীবন থেকে মাকে ছিনিয়ে নেয়। সে ছিটকে পড়ে নির্দয় পৃথিবীর ফুটপাথে। আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমনি’তে নবজাত ছেলে নয়নকে নিয়ে স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তার মা। এক গায়েনের কাছে আশ্রয় জোটে তার। অনেক দুঃখ-কষ্টে মা মানুষ করে সন্তানকে। সেই মা’র যখন মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে, নয়ন তখন সর্বস্ব হারানোর বেদনায় ভেঙে পড়ে। কবরস্থ করার সময়ও সে মাকে ছাড়তে চায় না। এমনিভাবে ‘সারেং বউ’, ‘নদী ও নারী’, ‘মায়ায় সংসার’, ‘সন্তান’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘চোখের জলে’, ‘আকাঙ্ক্ষা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে মা ও সন্তানের সম্পর্ক মূর্ত হয়ে উঠেছে।

বাংলা গানে মা

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। আর তার আবেগ ও ভালোবাসার অন্যতম উৎস মা। মাকে নিয়ে তাই যুগে যুগে অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। এমনই কিছু গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল সকলই ফুরায়ে যায় মা, মাগো মা ওগো মা আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা, এমন একটা মা দে না, এমন একটা মা দেনা/ যে মায়ের সন্তানেরা কান্দে আবার হাসতে জানে, মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না/দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না, একদিন তো চলে যাব,/পরের ঘরনি হবো/ আঁচল বাঁধতে পারবি না/ ওমা তোর পায়ে পড়ি/ দুষ্টুমি যদি করি/ মা তুই কখনো রাগ করিস না, যেও না, যেও না, যেও না মা, মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে, মধুর আবার মায়ের হাসি, মাগো মা ওগো মা, আমি আমি তোমার কোলে/ মানুষ হবো বলে, তুমি আমার মা আমি তোমার মেয়ে, ও তোতা পাখিরে,/ শেকল খুলে উড়িয়ে দেবো/ মাকে যদি এনে দাও, মায়ের এক ফোঁটা দুধের দাম।

দেশ বা জন্মভূমিকেও ‘মা’ সম্বোধনে গীতিকবিরা অনেক গান লিখেছেন। যেমন- জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী, মাগো ভাবনা কিসের, চাই না মাগো রাজা হতে, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই, ও মা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো, পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব/ মাগো বলো কবে শীতল হব।

লেজার ভিশন থেকে প্রকাশিত ‘মা’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম রয়েছে। এখানে ১০টি গান ঠাঁই পেয়েছে। এর মধ্যে দুটি গান পুরনো। বাকি ৮টি গান হলো- দশ মাস দশ দিন তোমার অংশ ছিলাম মা, ভালোবাসার গভীর সাগর আমার মা, শীতের রাতে তুমি আমার/চেনা উষ্ণতা, একটি ডানপিটে দুপুরে/একটি বখে যাওয়া ছেলে/ স্কুল পালিয়ে ধরা দিতো/ মায়ের কাছে এসে মা আমার মা, মা তোমার এদিনে/অভিবাদন তোমাকে, মাগো তোমার সবুজ চাদরে আদরে আদরে, মাগো ও গো মা/ এই সুন্দর পৃথিবীতে তুমি নেই, পৃথিবীর এক পাশে মাকে রেখে। গানের কথাগুলো লিখেছেন আহমেদ ইউসুফ সাবের, আফরোজা নিজামী, অন্তরা, আবদার রহমান, সৈয়দ মহসীন মুনির, বিজয় কৃষ্ণ পাল এবং ফুয়াদ হাসান। সুর ও সঙ্গীত বাসু, কাজী হাবলু, আলী আকবর রুনু এবং আরেফিন রুমি।

সাহিত্যে মা

সাহিত্যে নানাভাবে নানা রূপে মা মূর্ত হয়ে উঠেছে। মা ও সন্তানের সুন্দর সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসে। পুত্র পাভেলের বামপন্থী রাজনীতি ও আদর্শের অনুরক্ত হয়ে পড়ে এক সময় পাভেলের মা-ও। এমনকি এই ধারার রাজনীতির অনুগত ও আদর্শ কর্মীতে পরিণত হন মা। কাজকর্মে তিনি তার পুত্রকেও টপকে যান।...পাভেল ও তার মা’র সম্পর্কটি ছিল বন্ধুর মতো। ছেলেবেলায় মা’র ওপর শ্রমিক বাবার নানা অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছে পাভেল, তার ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমা হয়েছিল- একদিন তরুণ পাভেলের মনের সেই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়- মাকে বাঁচাতে বাবার গায়ে হাত তোলে সে। মাও ছেলে পাভেলকে ভীষণ ভালোবাসত। শিক্ষিত সন্তানের ওপর তার এক ধরনের শ্রদ্ধাও ছিল। পাভেলও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও চারপাশের বিষয়াদি সম্পর্কে মাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে তাকে সচেতন নারী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

মা ও সন্তানের সম্পর্কের নানারূপ আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, ‘গোঁড়া’, পার্ল এস বাকের ‘গুড আর্থ’, সন্তোষকুমার ঘোষের ‘শেষ নমস্কার’, শওকত ওসমান ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’ উপন্যাসে।

গজেন্দ্র কুমার মিত্রের ‘উপকণ্ঠে’ উপন্যাসে লক্ষ করি মা ও পুত্রের বিচিত্র সম্পর্ক, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম ক্রিয়াকলাপ। এই উপন্যাসের এক মা অল্প বয়সে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। ছেলেকে ঘিরেই ছিল তার পৃথিবী। আদরের এই ছেলেকে বিয়ে করাতে উৎসাহী ছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে পুত্রকে তিনি বিয়ে করাতে বাধ্য হন। তবে তিনি ছেলের সঙ্গে বউ-কে রাত্রিযাপন করতে দেন না। এ নিয়ে এক সময় ছেলের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। নতি স্বীকার করে মা। তারপরও রাতে ছেলের ঘরের বাইরে কান পেতে থাকেন। শোনার চেষ্টা করেন ছেলে ও পুত্রবধূর দাম্পত্য জীবনের ব্যাপার-স্যাপার।

কবিতায়ও ফুটে উঠেছে মা এবং মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন দেখা যায় ‘মাকে আমার পড়ে না মনে।/শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে/ একটা কী সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,/মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।/মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে/ মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।’ ‘মা’, কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-র মতন আহা/একটি কথায় তত সুধা মেশা নাই, /মায়ের মতন এত/ আদার সোহাগ সে তো/ আর অন্য কোনোখানে পাইবে না ভাই।’ শামসুর রাহমান বলছেন : ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনি নি।/ সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/ আমাকে ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’

এমনিভাবে নানা কবিতা-উপন্যাস-গল্পে মায়ের অপরূপ রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে।

চারুকলায় মা

যুগে যুগে বিশ্বের নানা শিল্পী মা’কে নিয়ে এঁকেছেন ছবি; ভাস্কর গড়েছেন ভাস্কর্য। সেইসব শিল্পকর্ম কালের বুকে অক্ষয় হয়ে আছে।

শেষ কথা

মা’র কথা শেষ হবে না। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে মায়ের একই রূপ। সন্তানের সুখ ও কল্যাণে নিবেদিতা। সেই মায়ের প্রতি আমরা যেন যত্নবান হই।

Leave a Reply

Your identity will not be published.