বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় নারী (প্রথম পর্ব)

বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় নারী (প্রথম পর্ব)

[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধÑসব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]

প্রাচীনকালে (বৈদিক যুগের প্রারম্ভে) এই অঞ্চলে কিছু বিদগ্ধ নারীর কথা শোনা যায়, যাঁরা পুরুষের পাশাপাশি নিজেরাও মৌলিক স্লোক বা স্তব রচনা করেছেন এবং যাঁরা নিজেরাই পুরুষদের মতো মন্দিরের অধিষ্ঠাতা এবং গুরু হয়ে (শুধু গুরুপত্নী নয়) শিষ্যদের জ্ঞান বিতরণ করতেন। সোহম বলে যে আদি স্লোকটি এখনো বিদ্যমান তা নারী-লিখিত বলে দাবি করা হয়। সেই সময় প্রকাশ্য সভায় বসে পুরুষ ও নারী পণ্ডিতরা তাদের সৃষ্ট সাহিত্য বা শাস্ত্রীয় রচনাবলি নিয়ে এবং জীবন-জগৎ, সৃষ্টির রহস্য নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলোচনা, তর্কবিতর্ক করতেন। তখনকার দিনের কিছু বিখ্যাত নারী স্লোক রচয়িতা হলেন লোপামুদ্রা, গার্গি, অপালা, মৈত্রেয়ী, বাক, ঘোষা, সুলভা, শাশ্বতী। তবে খ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে যেহেতু এদেশে এই শাস্ত্রীয় গাথা কিংবা মন্ত্র রচিত হয়েছে এবং তখন যেহেতু দেবদেবীদের নিয়ে সকল রচনা-ই সংস্কৃতে লিখতে হতো, ওপরে উল্লিখিত বিদগ্ধজনেরা যে কেউ আমাদের পরিচিত ভাষা বাংলায় কথা বলতেন না, সেটা প্রায় নিশ্চিত।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সারা বাংলায় প্রথম যে নারী বাংলা ভাষায় কবিতা লেখেন, তিনি খনা। কিন্তু খনার (এবং তাঁর স্বামী মিহিরেরও) জন্মস্থান, জন্মের কাল, পিতামাতা, তাঁর বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, সাফল্য, জ্ঞানচর্চা, মৃত্যু, তাঁর বচন, প্রতিটি বিষয়ে—জীবনের প্রতিটি স্তরে এত বেশি রূপকথার মতো কাহিনি জড়িয়ে আছে যে এই বিভিন্ন কিংবদন্তি-ঘেরা খনা প্রকৃতই একজন ঐতিহাসিক চরিত্র, নাকি পল্লী জনগণের মিলিত কণ্ঠস্বর এই সন্দেহ উঁকি দিলে কেউ কেউ খনাকে রক্ত-মাংসের একজন নারী না ভেবে একটি সমষ্টির কণ্ঠস্বর ভাবতে শুরু করেছেন। প্রকৃতপক্ষে খনা ছাড়াও মধ্যযুগে আরও তিনজন উল্লেখযোগ্য নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভেতর মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী ছাড়া অপর দুজন হলেন চণ্ডিদাসের প্রণয়িনী ও সাধনসঙ্গী রামী বা রামতারা (চতুর্দশ শতাব্দী) আর শ্রীচৈতন্যের ভাবশিষ্যা মাধবী (পঞ্চদশ শতাব্দী)। বাংলা সাহিত্যে চন্দ্রাবতীর উদ্ভব হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। ফলে, কিংবদন্তির খনাকে বাদ দিলে বাংলা ভাষায় প্রথম নারী কবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকে। তিনি লোকশ্রুতির রজকিনী রামী। পুরো নাম খুব সম্ভবত রামমনি। পদাবলির বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর অসম এবং চাঞ্চল্যকর প্রণয় সম্পর্কের কথা এখনো লোকমুখে প্রচারিত। শোনা যায় এই রামী ছিলেন নিরক্ষর। তখনকার দিনের লোককবির মতো তিনি মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন। কিন্তু সময়ের পরম্পরায় লোকমুখে মুখে রামীর ভাষা এতই পরিবর্তিত হয় যে এখন রামীর কবিতা বলে আমরা যে মাত্র দুটি পূর্ণ কবিতার নমুনা পাই, তার ভাষা আঠারো শতকের শেষ ভাগের ভাষার সঙ্গে তুলনীয়। ইতিহাসে চতুর্দশ শতকের কবি বলে ব্যক্তি রামীর সন্ধান পাওয়া গেলেও তাঁর কবিতায় সেই সময়কার ভাষার রূপ বা শব্দভাণ্ডার পাওয়া যায় না। পঞ্চদশ শতকের কবি মাধবী দাসী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তা ছাড়া এই মাধবী নারী নাকি পুরুষ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক আগে সুকুমার সেনও তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে সে সংশয়ের কথা বলেছেন। জানা যায় মাধবী ১৫০৯ সালে পুরীর মন্দিরে শ্রীচৈতন্যের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের জন্য ১৮ বছরের জন্যে পুরীতে যান ১৫১০ সালের ফাগ্লুনে (১৫১০-এর একেবারে শেষ দিকে)। সময়ের এই বিচ্যুতি মাধবীর ব্যাপারে আমাদের নতুন করে ভাবার সুযোগ দেয়। সন্দেহাতীতভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি ষোড়শ শতকের সূচনাপর্বের চন্দ্রাবতী, কিশোরগঞ্জ-নিবাসী মনসামঙ্গল কাব্যধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা, যাঁর নিজের হাতে লেখা কবিতাগুচ্ছ আজও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে সংগ্রহশালায়। চন্দ্রাবতী নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি।


ফলে দেখাই যাচ্ছে, প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বাংলা কবিদের বিশেষ করে নারী কবির প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই খনার নাম উঠে এলেও খনার জীবন ও কর্ম নিয়ে এত বেশি কিংবদন্তি চালু রয়েছে যে খনার জন্ম, কবি প্রতিভা ও কৃষি এবং জ্যোতির্বিদ্যার পারদর্শিতা, তাঁর বিবাহ, সংসারজীবন, খনার জিহ্বা কর্তন, রক্তক্ষরণ, মৃত্যু—সবকিছুই আবছা-অন্ধকারে ঘেরা-কিংবদন্তি-মোড়া—প্রতিটির রয়েছে একাধিক ভাষ্য। খনা সিংহলে এবং উজ্জয়িনীতে থাকলেও বাংলায় তাঁর বসবাসের সময় বা পরিবেশের কথা স্পষ্ট করে কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। এই অবস্থায় পল্লীবাংলার প্রাত্যহিক জীবন ও প্রকৃতির কথা এমন করে কীভাবে লিখে গেলেন তিনি সেটা সত্যি বিস্ময়কর।


ফলে আনুমানিক ৮০০-১২০০ সালের মধ্যে খনা নাম্নী কোনো প্রাজ্ঞ ছড়াকার যদি সত্যি সত্যি থেকেও থাকেন, কিংবদন্তিঠাসা তাঁর জীবন ও খনার বচন বলে পরিচিত সকল ছড়াকে আজ কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক মানবীর কণ্ঠস্বরের বদলে পল্লীর মিলিত জনগণের বা সমষ্টির কণ্ঠ বলে যদি অভিহিত করা হয়, আমরা প্রত্যেকেই চমকে উঠি না, বরং এর শব্দচয়ন ও বয়ান পদ্ধতি দেখে এসব বচনকে আরও সমসাময়িক বলেই মনে করি। খনার সময় সাহিত্য মুখে মুখেই রচিত হতো, এবং অনেক পরে এগুলো লিখিত রূপ নিয়েছে, এই যুক্তিও খনার বর্তমানে প্রচলিত অগুনতি বচনকে অন্তত আংশিকভাবে প্রক্ষিপ্ত, পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত বা পরিমার্জিত বলে কল্পনা করার সুযোগ সৃষ্টি করে।  


যেহেতু এই গ্রন্থের একশত স্মরণীয় নারীর জীবনপঞ্জিতে কেবল ইতিহাস-আশ্রিত চরিত্রদের-ই জায়গা দেওয়া হয়েছে যাঁদের অবদান সর্বস্বীকৃত ও প্রমাণ সাপেক্ষ, এবং কোনো চরিত্রই অলৌকিকতা বা পৌরাণিক কাহিনিসমৃদ্ধ নয়— বাংলার প্রথম দিকের, জানামতে সর্ব-প্রাচীন, এই চার নারী-কবির মধ্যে কেবল চন্দ্রাবতীই নানা বিষয়ে চরম উৎকর্ষ সাধনের জন্যে মনোনীত একশতজন নারীর নামের তালিকায় এবং তাঁদের জীবনপঞ্জিতে স্থান পেয়েছেন। কেননা, এই গ্রন্থে পরাবাস্তবতা বা কিংবদন্তি-মাখা, মুখে মুখে গল্পাকারে প্রচলিত অলীক কাহিনিসমৃদ্ধ কোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে যাচাই-বাছাই না করে আমরা স্মরণীয় বলে গ্রহণ করি নি। তারপরেও পাঠকের আগ্রহ আর কৌতূহল মেটাবার জন্যে এই অধ্যায়ে খনা, রামী ও মাধবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য দেওয়া হলো নিচে।


খনা : (৮০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) শোনা যায়, কৃষি ও জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী খনার জন্ম অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কোনো একসময়ে। সঠিক সময় জানা যায় না। উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের সভা আলো-করা পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদ বরাহ ছিলেন খনার স্বামী মিহিরের পিতা। কথিত আছে মিহিরের জন্মের পরে বরাহ তিথি ইত্যাদি গণনা করে দেখেন যে তাঁর পুত্র এক বছরের বেশি বাঁচবেন না। তখন তিনি সদ্যোজাত পুত্রকে একটি হাঁড়িতে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ভাসতে ভাসতে সেই হাঁড়ি এসে ভেড়ে সিংহল দ্বীপের কিনারায়। সিংহলের রাজা ও রানী মিহিরকে পেয়ে নিজেদের কন্যা লীলাবতী (পরবর্তীকালে খনা)-র সঙ্গে তাকেও পরম আদরে বড় করেন। মিহির ও লীলাবতী দুজনেই গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অতঃপর মিহির ও লীলাবতীর বিয়ে হয় এবং তাঁরা বরাহের কথা জানতে পারেন। একদিন বরাহের উজ্জয়িনীর বাড়িতে স্ত্রী লীলাবতীকে নিয়ে উপস্থিত হন মিহির। এই কাহিনি বা কিংবদন্তি হলো প্রচলিত অনেকগুলোর কিংবদন্তির ভেতর অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় একটি। মিহিরের জন্মস্থান, তাঁর সিংহলযাত্রা, মানুষ বা রাক্ষস দ্বারা তাঁর উদ্ধার ও লালনপালন, লীলাবতীসহ তাঁর ভারত প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নানা ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে এবং এগুলোর কোনটা ঠিক, অথবা আদৌ কোনটি ঠিক কি না বলা শক্ত। খনার গল্প ও খনার বচন শুধু বাংলায় নয়, অন্যান্য রাজ্যে বিশেষ করে উড়িষ্যায় ও আসামে খুব জনপ্রিয় ও পূজিত। উড়িয়া ভাষায় খনা মানে বোবা। স্বামী ও শ্বশুর কর্তৃক খনার জিহ্বা কর্তনের মধ্য দিয়ে খনার কথা বলা বা মুখে মুখে কাব্যরচনা বন্ধ করে তাঁকে বোবা বা খনা কি খোনা করা হয়েছিল। বরাহ কিংবা তাঁর পুত্র মিহির অথবা দুজনে মিলেই এই ভয়ংকর কাজটি করেছিলেন বলে কথিত আছে। যার জন্যে উড়িয়া ভাষ্যমতে, লীলাবতী এভাবেই খনা নামে পরিচিতি পান। খনার বুদ্ধিমত্তা ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁর অকল্পনীয় পাণ্ডিত্যকে কেন্দ্র করে খনার সঙ্গে তার পুরুষতান্ত্রিক স্বামী ও শ্বশুরের গোল বাধে। জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সাধারণ জানাশোনা-অভিজ্ঞতা থেকে খনা গ্রামের কৃষকদের চাষবাস ও ফলন সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে উপকৃত করতেন। ওদিকে একদিন বিক্রমাদিত্য রাজসভায় তাঁর নবরত্নকে জিজ্ঞেস করেন আকাশে কত তারা আছে। বরাহ ও মিহিরসহ নবরত্ন সভার কেউ তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। কিন্তু খনা সঙ্গে সঙ্গেই তার সঠিক উত্তর দেন। দেখা যায় জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি, আবহাওয়া, সাধারণ জ্ঞান, ইত্যাকার বিষয়সমূহে বিক্রমাদিত্যের যত জিজ্ঞাস্য, যত কৌতূহল, তা তার নবরত্নের সভার বড় বড় পণ্ডিতের চাইতে লীলাবতীই আরও ভালো করে উত্তর দিতেন, তার কৌতূহলী মনকে পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম হতেন। বিক্রমাদিত্য তখন স্বভাবতই অন্যদের তুলনায় লীলাবতীর কথাতেই বেশি প্রভাবিত হন, তাঁর কথাকেই প্রাধান্য দেন। তিনি বরাহের পুত্রবধূকে রাজদরবারে তাঁর পণ্ডিতসভায় আমন্ত্রণ জানান। এসব দেখে হিংসায় তাঁর স্বামী ও শ্বশুর মিলে লীলাবতীকে খনা অর্থাৎ বোবা বানিয়ে দেন তাঁর জিহ্বা কেটে দিয়ে। যাতে তিনি আর কথা বলতে না পারেন। যাতে তাঁর জ্ঞানচর্চা, সৃজনশীলতা ও পাণ্ডিত্য প্রকাশিত না হতে পারে। কেননা তখন ছিল শ্রুতির সময়। লিখিত নয়, সমস্ত জ্ঞানচর্চাই হতো মুখে মুখে কথায়, গানে, কবিতায়। কর্তিত জিহ্বা থেকে রক্তক্ষরণেই খনার মৃত্যু হয়।


 বাংলার পথঘাট-মাঠ-পুকুর আর শস্য, খেত, বৃষ্টি, ফলফুল নিয়ে খনা যেসব ছড়া তৈরি করে গেছেন, তা এতটাই বাংলাদেশের মাটি-জলের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে এখানে বাস না করলে সেগুলো লেখা সম্ভব নয়। ফলে খনার প্রাথমিক জীবন সিংহলে বা উজ্জয়িনীতে কাটলেও সাবালিকা জীবনের একটি বড় অংশ অর্থাৎ জীবদ্দশার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্ভবত কেটেছে বাংলায় বা তার আশপাশেই। খুব সম্ভবত ২৪ পরগনার বারাসতের দেউলিয়া গ্রামে। অজস্র উপদেশমূলক বা পরামর্শসমেত ছড়া লিখেছেন খনা। বাংলায় আজও সেসব ছড়া অতি জনপ্রিয় এবং লোকের মুখে মুখে অনুরণিত। এইসব ছোট ছোট এবং সহজবোধ্য ও প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য ছড়াসমূহ সামগ্রিকভাবে ‘খনার বচন’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন খনার বচন কোনো বিশেষ ব্যক্তি-প্রতিভার অসাধারণ প্রকাশ না-ও হতে পারে। হয়তো ঐ বচনগুলো ঐ সময়ের সমচিন্তাশীল একদল মনীষার মিলিত কণ্ঠস্বর।  আরও একটি ব্যাপারে খটকা থেকে যায়। খনার সময়কাল-স্থান নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে (উইকিপিডিয়া অনুসারেও) ভারত উপমহাদেশে খনার অবস্থান ৮ থেকে ১২ শতাব্দীর কোনো একসময়ে। অথচ আরেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, তাঁর শ্বশুর বরাহ, যিনি বিক্রমাদিত্যের সভায় ছিলেন, যাঁর অবয়ব আজও ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে শোভা পায়, তাঁর অবস্থান ছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে। যতদূর জানা যায়, বরাহের জন্ম ৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ৫৮৭-তে। তাহলে বরাহ কেমন করে খনার শ্বশুর হতে পারেন ? তাঁর সঙ্গে একত্রে জীবনধারণই বা কী করে সম্ভব তাহলে ? নাকি খনা আসলে ষষ্ঠ শতাব্দীরই কবি ? খনার জন্ম, সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর এবং তাঁর স্বামী বা শ্বশুরের অবস্থান, তাঁর কর্মযোগ ইত্যাদি সম্পর্কে এত বেশি ও এত বিভিন্নমুখী কিংবদন্তি রচিত হয়েছে যে, ইতিহাস ঘেঁটে এসবের স্থিরতা বা অস্তিত্বের প্রমাণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে যে খনা নামে কোনো প্রাজ্ঞ নারী ছড়াকারের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল কিনা। নাকি নানা কিংবদন্তির মতো খনা নামের কথিত নারীটিও এক কিংবদন্তি এবং খনার বচন আসলে লোকজ গ্রামীণ বাংলার সম্মিলিত কণ্ঠ। কৃষি, পশুপালন, গৃহনির্মাণ, ঋতু, আবহাওয়া, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, রোগ-জরা নিয়ে ছোট ছোট ছড়ার মতো বয়ানে খনার উপদেশসমূহ মানে খনার বচন আজও পল্লী অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ও কৃষকের জীবনের পথপ্রদর্শক।


 প্রাচীন কালে ভারতবর্ষের অধিকাংশ সাহিত্য বা শাস্ত্রীয় রচনা ধর্ম ও ঈশ্বর দিয়ে যেরকমভাবে আগাগোড়া প্রভাবিত ছিল, খনার বচন তা থেকে প্রায় সম্পূর্ণ মুক্ত। খনার বচনে ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিকতার কিংবা পরকালের কথা, স্বর্গের লোভ বা নরকের ভয় এসব কিছুই স্থান পায় নি বললেই চলে। কৃষকের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সমস্যা নিয়েই এই বচনগুলো রচিত। এছাড়া খনা স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রচুর বচন লিখলেও সেখানে ঝাড়-ফুঁক, ওঝা, তাবিজ, পানিপড়া, ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতার কথা বা অন্য কোনো কুসংস্কারের উল্লেখ নেই। সাদাসিধে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত কিছু উপদেশাবলি রয়েছে। এসব দেখে মনে হয় খনার কালে কোনো বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই খুব বলিষ্ঠভাবে সমাজে গেড়ে বসে নি। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এমন সময় খুব কমই বের করা যাবে, যখন কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম দিয়ে রাজ্যশাসন প্রভাবিত হয় নি।
এছাড়া খনার বচনে বিস্ময়করভাবে নারী-নিন্দা বা নারীর-অধঃস্তনতা, কিংবা নারী নির্যাতন বা অবদমনের ইঙ্গিত অথবা পৌরুষত্বের আস্ফালনের প্রকাশ অনুপস্থিত। প্রচলিত বচনগুলোর মধ্যে কেবল দুটি বচনে আমি নারী-নিন্দার আভাস পাই। এসব দেখে ও বিচার করে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়, খনা নামক কোনো প্রকৃত নারী থাকুক বা না থাকুক, খনার বচন সম্ভবত রচিত হয়েছে চার্বাক বা লোকায়তদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। চার্বাকরা বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী। চার্বাকদের জীবনচর্চা ও ভারত উপমহাদেশে এই লোকায়তদর্শনের ধারণা ও প্রচারের সূচনা অনেক আগেই, প্রায় ঋকবেদের সময়ে। কিন্তু হিন্দু পুনর্জাগরণের জোয়ারে অন্যান্য অনেক লোকজ বিশ্বাসের সঙ্গে চার্বাকদর্শনকেও উৎখাত করা হয়। আর এক-ই কারণে তাদের উচ্ছেদের পর চার্বাকদের কোনো গ্রন্থ, প্রচারপত্র, পরামর্শ বা উপদেশের চিহ্ন রাখা হয় নি পরবর্তী কালের জন্যে। তবে অষ্টম শতকে আবার সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন চার্বাক বা লোকায়ত বিশ্বাসের লোকেরা, যাঁরা মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকার কথা অগ্রাহ্য করেন; যারা প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করেন না, ঈশ্বর বা পরলোক মানেন না, ইত্যাদি। ইহলৌকিক ভোগবাসনায় এবং দৈনন্দিন জাগতিক ব্যাপারে ও বস্তুগত বিষয়ে নিজেদের ও অপরের উন্নতি সাধনে তাঁরা সর্বদা সতর্ক ছিলেন। যেহেতু খনার বচনের রচনাকাল, ও খনার জীবন ৮০০-১১০০ সালের মধ্যে বলে স্বীকৃত, খনার পক্ষে চার্বাকদর্শনের অনুরাগী হওয়া স্বাভাবিক। আর তাই যদি হয়  তাহলে খনার কাল অষ্টম শতাব্দীতে হওয়াই স্বাভাবিক।
খনার বচনের প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে রণদীপম বসু বলেছেন, “খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু ও সপ্তাহের বিভিন্ন বার প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। খনার বচনগুলো তাই বাংলার কৃষিদর্শন”। খনার বচন শুধু কৃষিদর্শনই নয়, কৃষিনির্দেশনাও বটে।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.