[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১১ তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব
সিমিকে উত্তর দেওয়ার আগে, আগের মেইলের পুনশ্চতে লেখা সিমির কথাগুলো ফাহিম বেশ কয়েকবার পড়ল। সিমি কেন বলল যে সে ফাহিমের কাছে কোনো মায়া, দয়া, অনুকম্পা, কিংবা সহানুভূতি এসব কিছুই চায় না। শুধু চিঠির এই সম্পর্কটাই থাকুক, ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হয়ে। ফাহিমের কোনো কথায় কি সে ভুল বুঝেছে? ফাহিমও তো এমনই চায়।
সিমির মনটা কি তাহলে খারাপ? ফাহিম চাইল এমন কিছু কথা লিখবে যা পড়ে সিমির মনটা ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক ভেবেও সিমির জন্য কোনো কিছুই লিখতে পারল না সে। হঠাৎ মনে হলো, একটা কবিতা লিখলে কেমন হয়? কলেজ জীবনে মাঝে মাঝেই সে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছে। সেসব পাগলামি করার বয়স কি আর এখন আছে? তখন যে কোনো মেয়েকে দেখলে কবিতা লেখায় রাত পার হয়ে যেত। সেই কবিতা অবশ্য আর কাউকেই দেওয়া হতো না।
সিমির জন্য ফাহিমের মন কেমন কেমন করে। মেয়েটাকে কেন জানি অন্যরকম মনে হয়। খুবই বিশ্বাসের একটা মানুষ, যার কাছে নির্দ্বিধায় সব কথা বলা যায়। এত মায়াময় একটা মেয়ে! সেই মেয়েটিকে কী লিখবে তাই ভাবছিল ফাহিম। আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফাহিম লিখল-
I'm not a poet
capable of writing lovely sonnets.
I'm not a musician
able to compose magnificent symphonies
or a sculptor who could create
a monument
that would endure forever.
I'm just one man...
এই কবিতা পড়ে তোমার মন ভালো হবে কি-না জানি না। তবুও একটু চেষ্টা করে দেখা। তোমার মনের ওপর এর খানিকটা রেশ থেকে গেলেই আমার ভালো লাগবে।
ভালো থেকো। খুব ভালো।
কবিতাটি পেয়ে অসম্ভব এক ভালোলাগায় ভরে গেল সিমির সমস্ত মন। হারিয়ে গেল কথামালার ভেতরে। এমন সাধারণ অথচ কত আন্তরিক।সে কালক্ষেপণ না করেই লিখতে বসে গেল।
ফাহিম, প্রিয় বন্ধু আমার,
তোমার কবিতাটা ভালো লেগেছে। ভীষণ। তোমার লেখার মতোই। তোমার লেখা আমি যত মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তেমন করে অন্য কারও লেখা আমি কখনো পড়ি নি। মাঝে মাঝে ভাবি, আচ্ছা, মানুষ কি তার লেখার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় বেশি, নাকি কথার ভেতর দিয়ে? নাকি দু’টোই!
তোমার প্রতিটা লেখাই আমি সেভ করে রাখছি। ইমেইল হওয়াতে অবশ্য একটা সুবিধে হয়েছে- লেখা হারিয়ে যাওয়ার কোনো ফুসরৎ নেই। ফোনের বাটন চেপে না পাওয়ার বেদনা নেই। কণ্ঠ না শুনেও লেখা দেখে কল্পনায় তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, বেশ। কিন্তু এই দেখাটা কি সত্যি হতে পারে না?
তুমি কবে আসবে দেশে? কবে দেখা হবে? কথা বলব সামনাসামনি বসে।
আচ্ছা, তোমার কি নদী ভালো লাগে, নাকি নদীর ওপর পালতোলা নৌকা?
নীল আকাশ, নাকি আকাশের ওপর মেঘ?
বিস্তৃর্ণ খোলা মাঠ, নাকি মাঠের ওপর বৃষ্টি?
চাঁদ ভালো লাগে, নাকি জোছনা রাত?
গহিন রাত নাকি সেই রাতে ঝিঁ ঝি পোকার ডাক?
পড়ন্ত বিকেল নাকি সেই বিকেলের চটুল হাওয়া?
খোলা চুল নাকি চুলের ঘ্রাণ?
উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকব। অফুরান শুভেচ্ছা তোমার জন্য।
সিমি লেখাটি শেষ করে একটা কবিতা লিখে দিল নিচে।
‘Call me’ by Robert J. Lavery.
If one day you feel like crying...
Call me.
I don't promise that I will make you laugh,
But I can cry with you.
If one day you want to run away
Don't be afraid to call me.
I don't promise to ask you to stop,
But I can run with you.
If one day you don't want to listen to anyone...
Call me.
I promise to be there for you.
And I promise to remain quiet.
But if one day you call...
And there is no answer...
Come fast to see me.
Perhaps I need you.
ভালো থেকো সুন্দর মনের মানুষ।
সিমি।
তখন শিকাগোতে সকাল আটটার একটু বেশি।
সিমি হয়তো ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে তার সাথে— রাত জেগেছে। সিমি বলেছিল সকালে ফোন করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে। আজ তো ওর কাজ নেই। থাক না, ঘুমাক না আর একটু।
হঠাৎ করেই ফাহিমের মাথায় একটা খেয়াল চেপে বসল। সিমি ওকে যে কবিতাটা পাঠিয়েছে— সেটির বাংলা অনুবাদ ওকে পাঠালে কেমন হয়? আরও ভালো হয় কবিতাটির আবৃত্তি রেকর্ড করে পাঠাতে পারলে। সিমি যেমন ওকে মাঝে মাঝে ওর গাওয়া গানের কয়েকটি লাইন রেকর্ড করে পাঠায়। সিমির গানের গলাও সুন্দর। কিন্তু ফাহিম তো আবৃত্তিকার নয়, তবুও তার কেন এমন ইচ্ছে হলো কে জানে! মনের কিছু ইচ্ছাকে তাৎক্ষনিকভাবে প্রাধান্য দেওয়া যেতেই পারে- ফাহিম আবৃত্তি করল।
যদি কোনো দিন
অঝোরে কাঁদতে চাও তুমি,
তবে আমায় ডেকো।
আমি কথা দিচ্ছি না
তোমায় হাসিয়ে দেব,
তবে, তোমার সাথে কাঁদতে তো পারব।
যদি একদিন দূরে কোথাও
চলে যেতে চাও তুমি,
আমায় ডাকতে ভয় পেয়ো না।
আমি কথা দিচ্ছি না
তোমায় বাধা দেব।
তবে তোমার সাথে যেতে তো পারব।
যদি একদিন কারও
কথাই শুনতে ইচ্ছে না করে,
তবে আমায় ডেকো।
আমি কথা দিচ্ছি,
নীরবে তোমার কথা শুনব।
কিন্তু কখনো একদিন
তোমার ডাকে যদি না আসি,
তবে তুমি আমায় দেখতে যেও।
হয়তো সেদিন খুব দরকার
তোমাকেই আমার।
কবিতাটির সঙ্গে ফাহিম আরো লিখল-
সিমি, তোমার পাঠানো কবিতাটির বাংলা ভার্সন পাঠালাম রেকর্ড করে। আমি আবৃত্তিশিল্পী নই তবুও একবার চেষ্টা করলাম। এক কাপ চা হাতে, সকালের মিষ্টি রোদ খানিকটা গায়ে মেখে শুনে দেখো একবার। ভালো না লাগলে ডিলিট করে দিও।
প্রিয় মানুষটির জন্যে ছন্দে-আনন্দে সকালের শুভেচ্ছা।
আঁধারের পর সূর্যের আলো,
দিনটা তোমার কাটুক ভালো।
ফাহিম।
সিমি ঘুম থেকে উঠে ফাহিমের কবিতা পেয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল।
আজ অফিস নেই। সারাদিন তেমন কিছু করারও নেই। তবে সে জানে আজ ফাহিমের একটা মেইল আসবে। মেইল না আসা পর্যন্ত সে কবিতাটিই শুনতে থাকল। সিমি চট করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসে বসল বারান্দায়। গাছের ফাঁক দিয়ে সকালের রোদের অনেকখানিই এসে পড়েছে। সিমি রোদে গা ভিজিয়ে, গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুনল কবিতাখানি আবার। বেশ কয়েকবার শুনে তার মনে হলো— বাহ, বেশ তো!
সিমির মনটা এতটাই ভালো হয়ে যাবে বা যেতে পারে তা সে কল্পনাও করে নি কখনো। কেমন একটা সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে পাখির মতো আকাশে উড়তে, অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে। সে ফাহিমের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে কবিতাটি আওড়াল শব্দ করে।
দুপুরের দিকে ফাহিমের ইমেইল পেল সিমি। ফাহিম লিখেছে-
সিমি, প্রিয়তমা বন্ধু আমার,
অনেকদিন থেকেই একটা ব্যাপার নিয়ে খুব অস্বস্তি বোধ করছি। ভাবলাম, আজকে তোমাকে জানাই।
আমি ভীষণ অবাক হয়েছি, তুমি আমার স্ত্রীর কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে এনেছ কিন্তু আর একবারও জানতে চাও নি তার ব্যাপারে। আমি কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছি, সেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। তুমি হয়তো ভেবেছ, আমার নীরবতার কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে আর তাই তুমিও নীরবতায় আছো। হয়তো অপেক্ষায় ছিলে কিংবা আছো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তোমার মনে কৌতূহল যে জন্মেছে সেটা কিন্তু আমি বুঝেছি। কাজটা আমি ইচ্ছে করেই করেছি। আমি দেখতে চাইছিলাম, কতটা ধৈর্য তুমি ধরতে পারো। একধরনের পরীক্ষা বলতে পারো।
তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তুমি একজন অসাধারণ ধৈর্যশীল মেয়ে। অন্য কোনো মেয়ে হলে তার কৌতূহল তীব্র হতো— অনেক। তুমি ব্যতিক্রম। তোমার ধৈর্য আর নির্লিপ্ততা আমাকে অভিভূত করেছে।
তবে একেবারেই যে কৌতূহলী ছিলে না, তাই বা বলি কী করে! তুমিই তো তাকে ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করে বলেছিলে, তোমার বউ কিন্তু হট। তুমি মিথ্যে বলো নি, সে সত্যিকার অর্থেই সুন্দরী- শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও। এবং তার সুন্দরের প্রশংসা সে পেয়ে আসছে তার টিনেজ বয়স থেকে। ছোটবেলা থেকেই সে একটু লাজুক ও নরম প্রকৃতির। কথাও বলে কম, যাকে বলে মিতভাষী। সে যখন টিনেজ পার হয়ে কুড়িতে পড়ল তখন আমিই তাকে ইনসিস্ট করেছিলাম মডেলিং ক্যারিয়ার করতে। তোমার মনে আছে কি-না জানি না, তখন ‘আনন্দ বিচিত্রা’ নামে একটা ম্যাগাজিন ছিল, বেশ জনপ্রিয়। সেখানে ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতা হতো। অনেকটা আমার চাপে, একরকম ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এবং প্রথম দশজনের মধ্যে টিকেও যায় সে। কিন্তু ফাইনাল রাউন্ডের আগেই তাকে চলে আসতে হয় আমেরিকায় ইমিগ্রেশন নিয়ে, তার ভাইবোনদের সাথে।
তার সাথে আমার পরিচয়, প্রেম আর বিয়ের ঘটনা নিয়ে লিখলে একটা প্রেমের উপাখ্যান সৃষ্টি হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে বন্ধু যখন হয়েছ, তার সম্পর্কে প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু জানবে। যদি তার সম্পর্কে জানার তোমার আর কোনো আগ্রহ থাকে।
সুন্দরী স্ত্রীদের স্বামীরা সুযোগ পেলেই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, এ কেমন আদিখ্যেতা! স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে শুধু তার সৌন্দর্যের প্রশংসাই করে যাচ্ছি। যে সুন্দর তাকে সুন্দর বলায় কোনো অপরাধ নেই।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তার প্রেমে আমি পড়েছিলাম শুধু তার ব্যক্তিত্ব আর জ্ঞানের সৌন্দর্যে। মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার ব্যক্তিত্বে। সৌন্দর্য দৃষ্টি কাড়ে কিন্তু ব্যক্তিত্ব কাড়ে মন। সেটা যে শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা কিন্তু নয়। ব্যক্তিত্বহীন কিংবা মনের পরিচর্যা করে না এমন মানুষ আমার দৃষ্টিতে একটু কমই সুন্দর।
যাই হোক, সৌন্দর্য নিয়ে এমন বিশেষজ্ঞের মতামত কিংবা বক্তৃতা দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। কেন দিলাম তাও জানি না। আপাতত এই চ্যাপ্টার ক্লোজ।
শেষ করছি একটা গল্প দিয়ে। এই গল্প নিয়েও পরে হয়তো আমাদের কথা হবে। ভালো থেকো সিমি। তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি। অনেক ভালোবাসা।
মেয়েটি একটি চিঠি লিখল, ‘আমি আসছি, বিয়ে করব! বিয়ে করার মতো টাকা আছে তোমার কাছে?’
ছেলেটি সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে, বেতন খুবই কম। এক বছরও হয় নি চাকরি। এর মধ্যে বিয়ে করার মতো টাকা! চেক বইয়ের হিসেব মিলিয়ে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
মেয়েটি আরও লিখেছে, ‘আমার ভাই-বোনেরা কেউ রাজি না। শুধু ছোটো বোন ছাড়া। মা-ও রাজি না। তবে আমার জিদের কাছে হার মেনে আশা ছাড়া দিয়ে বলেছে, তোমার কপাল যদি তুমি পোড়াতে চাও আমাদের আর কী করার আছে? ওই ছেলেকে যদি বিয়ে করো তবে তোমার নিজ দায়িত্বে একা একাই করতে হবে। আমরা কেউ তোমার সাথে থাকব না।’
মেয়েটি স্বপ্নের আমেরিকার নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা না ভেবে একা একাই শুরু করল এক অনিশ্চিত যাত্রা। দেশে ফিরল। ছেলেটির সাথে দেখা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে। বিয়ে হলো, কাজী অফিসে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটি বুঝে গেল ভুল একটা হয়ে গেছে। ছোটো খাটো ভুল না। বেশ বড়ো। মনে পড়ল মায়ের কথা। কিন্তু ফিরে যাওয়ার আর তো পথ খোলা নেই। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে!
মেয়েটি এখন কী করবে?
ফাহিম।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.