নীল ধ্রুবতারা (প্রথম পর্ব)

নীল ধ্রুবতারা (প্রথম পর্ব)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে।]

সময়কাল: অক্টোবর ২০০৬ থেকে বর্তমান।

আজ সকাল থেকেই ফাহিমের মধ্যে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। কেন জানি এক অজানা ভালোলাগা গ্রাস করে রাখল তাকে সারাক্ষণ। সারাদিন ভীষণ উত্তেজনায় কাটল তার।

হঠাৎ করে এই ভালোলাগার কারণ একটা টেক্সট মেসেজ। সকালে ঘুম ভাঙার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলসেমি করছিল ফাহিম- মেসেজের নোটিফিকেশন এল তখন। সে ফোনটা সামনে নিয়ে দেখল সিমির মেসেজ। সে লিখেছে, ‘হাই, তুমি কি ডালাসে আমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবা?’

ফাহিম বেশ কিছুক্ষণ মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে উত্তর দিল, ‘চেষ্টা করে দেখতে পারি। কী ধরনের কাজ তুমি খুঁজছো?’

‘জানি না। যে কোনো কাজ- আমার পক্ষে করা সম্ভব এমন কোনো কাজ।’

‘তুমি ডালাসে আসছ? তোমার না আসার কথা ছিল?’

‘আগামীকালই আসছি। দুপুর সাড়ে বারোটায় আমার অ্যারাইভাল।’

‘তাহলে তো ভালোই হলো। আমাদের কি দেখা হতে পারে?’

‘বুঝতে পারছি না। আমি মাত্র একদিনের জন্যে আসতেছি। পরের দিনই ফিরে যাচ্ছি।’

‘উফ!’

‘তুমি ফ্রি থাকলে আগামীকাল দেখা হতে পারে। তুমি কখন ফ্রি হবা?’

‘পাঁচটা পর্যন্ত আমার কাজ। তারপরেই ফ্রি।’

‘দেখি পাঁচটার পরে আমি দেখা করতে পারি কি-না। আমি তোমাকে জানাব।’

ওকে লিখে ফাহিম ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু সিমি আর কিছু লিখল না। ফাহিম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। সে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই ‘টিং’ করে নোটিফিকেশনের শব্দ শুনতে পেল। সে চকিতে ফোন তুলে নিল। সিমি লিখেছে, ‘তুমি কি পরশুদিন দেখা করতে পারবা? আমি তিনটার মধ্যেই ফ্রি হয়ে যাব। রাত আটটায় আমার ফ্লাইট।’

ফাহিম কিছু না ভেবেই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘পারব।’

‘আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে পারবা?’

‘হ্যাঁ, পারব।’

সিমি ঠিকানা লিখে পাঠাল। তারপর আর কোনো কথা নেই। অনেকক্ষণ কেটে গেল। ফাহিমের মনে হচ্ছে সিমি আরও কিছু লিখবে। অন্তত একটা সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ নিশ্চয়ই দেবে। সে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে রইল।

আরও কিছুক্ষণ ফোনের দিকের তাকিয়ে থেকে ফাহিম বাথরুমে ঢুকে পড়ল। প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে ফিরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল সিমি লিখেছে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, ফাহিম। ইট রিয়েলি মিনস এ লট।’

ফাহিম লিখল, ‘আমার যে কী ভালো লাগছে তোমাকে বোঝাতে পারব না সিমি। কতদিন পর তোমাকে দেখতে পাব, ভাবতে পারো?’

সিমি কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর সে অফলাইন হয়ে গেল।

সিমির সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল ফাহিম মনে করার চেষ্টা করল। সম্ভবত ২০০৯ সালের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে যখন সে দেশে গিয়েছিল। সিমি তখন কাজ করত একটা এয়ারলাইন্সে। সম্ভবত সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। ঢাকার গুলশানস্থ সিমির অফিসে দেখা করতে গিয়েছিল ফাহিম। মাত্র কয়েক মিনিটের দেখা। রিসেপশনে বলতেই সিমিকে ডেকে দিল রিসেপশনিস্ট। সিমি এল, এসে একটা এনভেলপ ধরিয়ে দিল ফাহিমের হাতে। আর কোনো কথা নেই। ফাহিমের সাথে তার এক বন্ধু ছিল। বাংলাদেশের জনপ্রিয় একজন সংগীতশিল্পী। তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক পরিচয়টুকুও করাতে পারে নি ফাহিম। সিমি এনভেলপটি ফাহিমের হাতে দিয়েই চলে গিয়েছিল ভিতরে। একবারের জন্যেও ফিরে তাকায় নি। ফাহিম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এসেছিল। সেই শেষ দেখা।

ফাহিম গত নয় বছরে অনেকবার ভেবেছে, কী এমন হয়েছিল- বা ঘটেছিল যে সিমি তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিল? ফাহিম ফোনে চেষ্টা করেছে অনেকবার- সিমি কোনো উত্তর দেয় নি। ফেসবুক-মেসেঞ্জারেও ফাহিমকে ব্লক করে দিয়েছে সিমি। অথচ সিমির অনুরোধেই ফাহিম ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছিল। সিমিই তাকে কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করতে হয় শিখিয়েছিল।

যোগাযোগের সব মাধ্যমগুলিই বন্ধ করে দিল সিমি, এমনকি ইমেইলও। অথচ একটা অনাকাঙ্খিত ইমেইলের কারণেই সিমির সঙ্গে ফাহিমের পরিচয় হয়েছিল। অনেকটা নাটক-সিনেমার কাহিনির মতো। ভুল থেকে পরিচয় তারপর বন্ধুত্ব তারপর বিচ্ছেদ। সময়টা খুব মনে আছে ফাহিমের। ২০০৬ সনের অক্টোবর মাসের ১৬ কী ১৭ তারিখ।

সিমির সঙ্গে ফাহিমের পরিচয়পর্বটা বেশ অদ্ভুত।

তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার এখনকার মতো এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠে নি। এখন যেমন যে-কোনো মজার ঘটনা, কৌতুক, ছবি ও অন্যান্য তথ্য বন্ধুদের ট্যাগ করে টাইমলাইনে শেয়ার করার প্রচলন- তখন ইমেইলই ছিল অনলাইন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এবং এ ধরনের মজার বিষয়গুলো শেয়ার করার প্রচলিত মাধ্যম।

তো এমনই একটি মজার ঘটনা, সম্ভবত একটা কৌতুক ফাহিমের ইমেইলে এল। মজার ঘটনা বা বিষয়টি কী সে কথা ফাহিমের মনে নেই এখন আর। তবে যা মনে আছে তা হলো, সে আবার সেই কৌতুকটি শেয়ার করল আরেকটি ইমেইল গ্রুপে যেখানে তার অন্য বন্ধুরা আছে।

এবং সেই ইমেইলটির একটি উত্তর এল ফাহিমের ইনবক্সে- একজনের কাছ থেকে। যে লিখেছে তাকে ফাহিম চিনতে পারল না। এবং সে এই ইমেইল গ্রুপেই-বা কী করে এল তাও ফাহিম মনে করতে পারল না। খুব কড়া ভাষায় সে লিখেছে- ফাহিম না চিনে একজন অপরিচিত মানুষকে এ ধরনের ইমেইল কেন পাঠিয়েছে? সে যদি ফাহিমের পরিচিত হয়েই থাকে, তবে কীভাবে তাকে চেনে? আর ফাহিমের পরিচয়ই-বা কী?

‘আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না- ক্ষমা করবেন। আপনি কি বলবেন, আপনি কে?’

ফাহিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মেলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারল না। সে তার ইমেইল লিস্টের সব ইমেইলগুলোকে এক এক করে দেখল এবং সব শেষ ইমেইলটি যে পাঠিয়েছে সেই লিস্ট দেখে বুঝতে পারল সে ফাহিমের দীর্ঘদিনের বন্ধু মুনার পরিচিত কেউ।

ফাহিম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে লিখে পাঠাল- এটা আসলে অনিচ্ছাকৃত ভুল। ভীষণ দুঃখিত। সে আরও লিখল, ‘আমাকে চেনার অবশ্য কোনো কারণও নেই। আমার নাম ফাহিম। শিকাগোতে থাকি। আপনার ইমেইল লিস্টে মুনা নামের যে মেয়েটি আছে, সে আমারও বন্ধু। আমরা একই শহরে থাকি। আপনার আর কিছু জানার থাকলে দয়া করে বলবেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যে আবারও দুঃখিত।’

এরপরে এই বিষয় নিয়ে আর কোনো ইমেইল আদান-প্রদান হয় নি। ফাহিম মাঝে মাঝে ইমেইল খুলে দেখেছে- কিন্তু না কোনো উত্তর আর আসে নি। একসময় বিষয়টা সে ভুলেও গেল।

বেশ কিছুদিনের ব্যবধানে হঠাৎ করেই ফাহিম একটা ইমেইল পেল। সিমি লিখেছে, ‘হ্যালো ফাহিম, কেমন আছো? উত্তর দিতে দেরি হলো বলে দুঃখিত। ব্যক্তিগত কিছু কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ইমেইল নিয়ে আর ভাবতে হবে না- এসব ইমেইল পেতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ভালো থেকো। সিমি।’

ফাহিমের ভালো লাগল ইমেইলটা পেয়ে। এমন নয় যে সে একটা উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। তবুও সিমির এমন সৌজন্যতায় খানিকটা মুগ্ধ হলো সে। এবং একটা ধন্যবাদ দিয়ে দু’লাইন মেসেজ লিখে পাঠাল সে। ‘রিপ্লাই দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ, সিমি। আমি আমার ইমেইল লিস্টটি আপডেট করে নিয়েছি। এরপর থেকে তোমার কাছে আর অপ্রয়োজনীয় ইমেইল যাবে না- অন্তত আমার কাছ থেকে না।’ এটুকু লিখে ফাহিম একটু ভাবল। তারপর লিখল, ‘জাস্ট কিউরিয়াস- তুমি কি ইউএসএ-তে থাকো না বাংলাদেশে? ভালো থেকো। ফাহিম।’

ফাহিম ইমেইল পাঠিয়ে দিয়ে লগ আউট করে অফিসের কাজে মন দিল।

পরের দিন সকালে লগ-ইন করেই সিমির ইমেইল পেল ফাহিম। সিমি লিখেছে, ‘আমি বাংলাদেশের মেয়ে। ঢাকায় থাকি। মুনা আমার স্বামীর এক বন্ধুর প্রেমিকা (এক্স)। এত তাড়াতাড়ি তোমার উত্তর পেয়ে খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ। টেক কেয়ার। সিমি।’

ফাহিম রিপ্লাই বাটনে চাপ দিয়ে চুপ করে বসে রইল। সে ভেবে পেল না, কী লিখবে। কী-ই বা লেখা উচিত। ফাহিম যা জানতে চেয়েছিল তার উত্তর সিমি দিয়েছে। এখন কি আর কিছু জানতে চেয়ে মেসেজ পাঠাবে নাকি শুধু একটা ধন্যবাদ দিয়ে রিপ্লাই করবে? কিছুক্ষণ ভেবে কোনো উত্তর না দিয়েই ইমেইল বন্ধ করে দিল সে।

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.