আমাকে একটি ফুল দাও

আমাকে একটি ফুল দাও

এগিয়ে চলেছে সে দ্রুত পায়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে, কখনো গাছের ছায়ায় একটু থেমে, কখনো কোনাকুনি রাস্তা পার হয়ে। প্রথম বৈশাখের ঠাঠা দুপুর। প্রখর রৌদ্রতাপে সমস্ত সবুজ ম্রিয়মাণ, কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার সারি রক্তিম পুষ্পসম্ভারে হালকা হাওয়ায় হেলছে-দুলছে। আশপাশে সামনে পেছনে চলাফেরা করছে ব্যস্তসমস্ত লোকজন, পথচারী। গাড়ির গোলমাল, রিকশার ক্রিং ক্রিং। 

দু’ একবার ছোট হোঁচটও খেয়েছে; কিন্তু কোনোদিকে যেন খেয়াল নেই। দেখতে প্রায় অদ্ভুত। যেন বাবরি চুল ঘাড় ইস্তক নেমেছে। প্রশস্ত ললাট, খাড়া নাক। গোঁফদাড়িতে ভরা মুখমণ্ডল, অল্পসল্প খালি জায়গার মধ্যে চামড়াতে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম দেখা দিয়েছে। ঘামে ভিজে লেপটে আছে পিঠে ডোরাকাটা শার্টের পেছনটা। পরনে চেক লুঙ্গি এবং পায়ে ময়লা ক্যাম্বিসের জুতো, যার ওপরে শক্ত লোমশ গোছা, মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে, অবিরাম চলার ছন্দে।
কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে ফেলে খাকি কাপড়ে তৈরি ঝোলার প্রান্তটা মুঠো করে ধরেছে বুকের কাছে।

কিছুদূর থেকে দেখলে বোঝা যায়, ঠিক কুঁজো সে নয়, কিন্তু বাঁ কাঁধের দিকটা স্পষ্টতই বাঁকা হয়ে ঝুঁকে আছে; এবং তাল সামলে চলার সচেতন চেষ্টা থাকায় মনে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছনে ফট করে একটা আওয়াজ হতেই থমকে দাঁড়াল, কিন্তু তাকিয়ে দেখে একটা রিকশার টায়ার ফেটে গেছে। মরদ হাতির মতো বিশালকায় প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিয়ে হ্যান্ডেল ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তার ধারে তালপাতার সেপাই চ্যাংড়া রিকশাওয়ালা। ভাব, দোষটা ওরই। এমন একটা জিনিসকে সে তার দুর্বল ত্রিচক্রযানে তুলে নিয়েছিল, সেটাই ছিল ভুল। ভুলের মাসুল দিতে হয়েছে। কাংস্যস্বরে বকবক করছেন ভদ্রলোক, আরেকটা ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডানধারে তলপেটের কাছে হাতটা নিয়েছিল, হ্যাঁ এখনো ঠিকই আছে তার ছোট অস্ত্রটা। কালো চকচকে ধাতব গড়ন, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত; কিন্তু কী মারাত্মক! ঠিকমতো তাক করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে কাত। এখন এক বছর সাড়ে তিন মাস, স্বাধীনতার; অস্ত্র জমা দিয়েছে অনেকেই কিন্তু অস্ত্রের খেলা বন্ধ হয় নি  না রাজধানীতে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তারও একটা অস্ত্র আছে, এটা সান্ত¡না। হয়তো ব্যবহারও করতে হবে; হয়তো সে রক্ত ঝরাবে আবার, হয়তো। যেন ভুরুর নিচে তার কালো চোখের পুতুলি ধকধক করে জ্বলে উঠল।

আজব এক এবেড়োখেবড়ো গতিতে চলেছে জীবনটা, একটু তলিয়ে দেখলেই, বুঝতে পারে। সবচেয়ে, হঠাৎ করে শেষ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ হয় না, এটাও অদ্ভুত। একেবারে শিশু অবস্থায় মাস আষ্টেক বয়েসের সময়ে শুরু। শীতকাল ছিল। ওকে কোলে নিয়ে বসে আগুন তাপাতে তাপাতে নানি বিপদে পড়েছিলেন। চোখে কম দেখতেন। কখন তার কাপড়ের কোণটা আলিয়ার ভেতরে গিয়ে পড়েছিল, খেয়াল করেন নি। ক্রমে বড় হয়ে যায় আগুন। এবং ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াবার সময় কয়েকটা গনগনে জ্বলন্ত আংরা পেটে এসে পড়েছিল। নিদারুণ চিৎকার। জলদি করে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেই ছোবলে গোলাকার ছাপ মেরে দিয়েছিল দুরন্ত আগুন, সেসব দাগ এখনো পেটের ডানপাশে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল হলো, ইস্পাহানি কলোনির গেট পেরিয়ে যাচ্ছে; হ্যাঁ, এখন সাবধান হওয়া দরকার। ভালোই ছদ্মবেশ; কিন্তু তবু যদি, কেউ চিনে ফেলে ? দুনিয়াতে চালাক লোকের সংখ্যা তো বেড়েই চলেছে।
চলার গতি মন্থর করে মগবাজার চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক।

গাড়িঘোড়া, লোকজন, দারুণ ব্যস্ততা মাত্র এক নজর সেদিকে তাকিয়ে পাশ ফিরল, এবং পরক্ষণেই উপস্থিত কারুর দিকে দৃকপাত না করে মাথা গুঁজে ঢুকে পড়ল পূর্বকোণের টিনশেড রেস্তোরাঁটার ভেতরে। ঘরের মাঝামাঝি বেড়াতে লটকানো একটা আয়না ছিল। নিজের চেহারাটা দেখে, দাঁড়িয়ে। না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। সে অচেনা হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ অচেনা। পরিচয় না দিলে কেউ তাকে চিনবে না; পরিচয় দিলে, সন্দেহের চোখে তাকাবে। এই তো যথেষ্ট। আজ সে যে আত্মপরীক্ষার সম্মুখীন, ছদ্মবেশই তার আসল পরিচ্ছদ। সামনের দিকে উঁচু চৌকিতে গদি; তার ওপরে ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে আছেন ম্যানেজার। অসহযোগের সময় এখানে নিত্য যাওয়া-আসা ছিল, এমন কি রাত বারোটায় থাকেন এবং কাউকে ঘাঁটান না। এত পরিচয় ছিল অথচ এখন তিনি একবার দেখলেন মাত্র; হয়তো ভাবলেন, নতুন একজন কাস্টমার। এই তো বয়, হোসেনটা; টেবিলে গেলাস ঠুকছে এবং চেঁচিয়ে অর্ডার পৌঁছে দিচ্ছে ওধারে কিচেনে। সে সিনেমায় নামতে চায়; কত ঠাট্টাতামাশা করত। কিন্তু সেও, এখন শুধু কাছে এল এবং জিজ্ঞেস করল, চা না শরবত, স্যার ? গরম গরম লাঞ্চও আছে।
থলেটা কাঁধের থেকে নামিয়ে বেঞ্চিতে রাখল ওমর, দেখে স্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি হয়েছে হোসেনের, নাকের নিচে উঠি-উঠি গোঁফের রেখা। সে বলল, এককাপ চা দে আগে।
সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে চাপড়, আবার হাঁক—একটা চা। মালাই বাহায়ে দেবে, সাব ?
না, না। শুধু লিকার। ওমর বলল, দুধ চিনিও লাগবে না।

এবার সে মনোযোগ দিল, চেহারায় বনমানুষ এবং কাপড়চোপড়ে উলাঝুলা হলেও হয়তো কোনো সম্মানিত বুদ্ধিজীবী। শুধু সাহেব নয়, কিঞ্চিৎ তারও ওপরে। হোসেন হেসে ফেলল এবং বলল, বুঝেছি স্যার  লেমন টি! আমাদের লেমন টি ভেরি গুড!
আস্তে ধীরে, চিকন চুমুকে লেবুর চা খাওয়া শেষ করার পর পেছনের খুঁটিটাতে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বেশ ক্লান্ত, তবু ভেতরের আলোড়ন কমছে না। এখান থেকে বেশি দূরে নয় তাঁদের বাড়িটা; চৌরাস্তার ওপারে ওই কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে এগোতে থাকলে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগে না, বড়জোর দশ মিনিট। কৈশোর-যৌবনের লীলাক্ষেত্র এখানকার সব জায়গা। মুহূর্তে ভিড় করে আসে মনে কত ছবি, কত রং, কত স্মৃতি। নিজের চোখেই দেখেছে ঝোপঝাপ গাছগাছড়া ধূলিমাটি থেকে আড়মোড়া ভেঙে কেমন করে গড়ে উঠছে শহরটা, এখানেও প্রতিদিনই তার ঢেউ লাগত। চল্লিশ দশকের শেষের দিকে অতি অল্প টাকায় বাবা কিনেছিলেন দুটো টিনের ঘরসমেত আধাবিঘা জমি  আর এখন তা কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি, যদিও দালান তুলতে পারে নি এখনো। কোনোক্রমে পেছনের বড় ঘরটা দেয়াল দিয়েছে। সামনের ঘরটা ভেঙে বাংলো প্যাটার্নের করা হয়েছিল টব বারান্দা দিয়ে এবং ভিটির চারদিকটা পাকা করে। এ ঘরটাতেই সে থাকত। গেটের কাছে কৃষ্ণচূড়া গাছটা হয়তো তেমনি আছে, এবং এখন ফুলে ফুলময়। বাড়ির পেছনে কাঁচা দেয়াল, আর তিনদিকে মেহেদির বেড়া, যার মধ্যে পেঁচিয়ে থাকে অনেক স্বর্ণলতা। কিছু দূরে দূরে লাগানো, এক সারি নিমগাছও আছে। ভেতরের দিকে একটা পেয়ারাগাছ। ডোমরা ঝোপে টুনটুনির বাসা। হয়তো আছে এখনো। থাকবে না কেন ? সে আর কতদিনের ব্যাপার! পঁচিশে মার্চের রাতেই শেষবারের মতো ফিরেছিল; আর আজকে তিয়াত্তরের সতেরই এপ্রিল। গোনাগুনতি দুবছর বাইশ দিন। এখনো বাড়িতে গিয়ে উঠলে, পরিচয় দিলে প্রথমে হয়তো হইচই গোলমালই হবে, কিন্তু সব ঠিকঠাক হতেও বেশি সময় লাগবে না। কালের প্রলেপে সব জখমই শুকায়ে যায়। কিন্তু না, ওভাবে যাবে না; সে যেতে পারে না। সোজা হয়ে বসল, আঙুলে টোকা মেরে ছাই ফেলল। কেমন একটা অদ্ভুত বিষণ্নতা তাকে তন্ময় করে রেখেছে।

হুঁ, ঘা খেয়ে খেয়ে কিছুটা মনে হয় বদলেছে হায়দার; কিন্তু ওর চরিত্রের মহৎ গুণটি, মনে অতিরঞ্জনপ্রিয়তা, পুরো শুধরে গেছে বলা যায় না। মাঝে মাঝে মিথ্যেও বলত, হয়তো মুহূর্তের দুর্বলতায়। ইউনিভার্সিটি জীবনে এইসবের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত  জমা আছে। তেমনি একটা এই তো। প্রতিষ্ঠিত চিরকুমার অধ্যাপক রায়হান সাহেব গ্রাম থেকে ছুকরি বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন, সেবার গ্রীষ্মের ছুটির পরে ক্লাসে এমন কথাও প্রচার করেছিল। বেশ জোর দাবি বাজিও ধরে; খবর ঠিক না হলে, তিনজনকে চাইনিজ। বাঘা আদমি, কটু মন্তব্য ও ব্যঙ্গবিদ্রƒপ জিবে লেগেই আছে, যার জন্যে ছাত্ররা পারতপক্ষে তাঁর ছায়া মাড়ায় না। তবু গেল ওরা তিনজন, টিউটরিয়্যাল জটিল সমস্যা আলোচনার অছিলা ধরে। এবং সর্বনাশ! সত্যিই তো! সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে উঠতেই দেখল লাল পাড় এবং সবুজের ওপরে ডোরাকাটা শাড়ি পরা ডাগর ডাগর একটি মেয়ে কাপড় মেলছে রেলিঙের রোদে! গায়ের রং দুধ-আলতা এবং ভোমরা কালো চোখের তারা! কানে ইয়ারিং এবং গলায় সোনার হার। তিনজনের চোখই ছানাবড়া ভেবাচেকা খেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু পাশের ড্রয়িংরুমে গুড়ুর গুড়ুর আওয়াজের পরে পরিচিত গলা খাঁকারি শুনতেই সাবধান। এ বছরেই অবসর গ্রহণ করবেন এবং বলতে গেলে, গোরের দিকে পা বাড়িয়েই আছেন,  অথচ এ সময়েও এমন একটা খাসা মাল যোগাড় করে ফেলেছেন। বাহাদুর বটে! না, গ্রামবাংলা এখনো রত্নপ্রসবিনী, সেই জন্য? কিংবা হতে পারে, সারাজীবন নারীসঙ্গ বর্জনের অন্তিম পুরস্কার? মুখ চূর্ণ, কিছুক্ষণ অনেক জল্পনা-কল্পনা ওদের মাথায় জেগেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, রসভঙ্গ। জানতে পারে অধ্যাপক সাহেবের আপন ভাগ্নি তাঁর বাসায় বেড়াতে এসেছে।
তবু এটা তো সামান্য, ম্লানমুখে আরও কত গুল ছাড়ত হায়দার, ওকে বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। এবারেও, এমন সংকট মুহূর্তে যা সে বলেছে সে কি সত্য না মিথ্যা?


মনে পড়ে, ফেরবার সময় বিশেষ কোনো বাধা পায় নি, বরং পেয়েছে সীমান্তরক্ষীদের উৎসাহ ও সহযোগিতা; তবে বাস থেকে নামার পরও অনেক দূর হেঁটে আসতে বেশ কষ্ট লাগছিল। কিন্তু আশ্চর্য, বর্ডারের সীমারেখা পেরিয়ে দেশের মাটিতে পা দিতেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল; সে বুকভরে শ্বাস টানল। আহ কী আরাম, শান্তি! সে বেঁচে আছে এবং স্বাধীনতার উজ্জ্বল রৌদ্রে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে এ তো পরম সৌভাগ্য। একমুঠো মাটি তুলে ঝরঝর করে ফেলল নিচে, তারপর মাটিমাখা হাতের পাতাটা গলার কাছে ঘষে দিল। হয়তো ছেলেমানুষি কিংবা পাগলামি। কিন্তু ভালো লাগে। মুহূর্তে কী একটা শক্তি যেন সঞ্চারিত হয়ে গেল দেহের মধ্যে, তার রক্তধারায়, সব দুর্বলতা কেটে গেল। হাত তুলে সীমান্তরক্ষীদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে বলেছিল : হ্যাঁ পরিবর্তনটা রীতিমতো বৈপ্লবিক। অল্প সময়ের মধ্যে কত ওলটপালট হয়ে গেল; সেইজন্য মনের ভেতর এত  ভাবাবেগ, এত ব্যাকুলতা।

স্বপ্না আর সোনিয়া তো আপনসত্তা, সারাক্ষণ জেগে থাকত স্মৃতিলোকে। কিন্তু ওপারের পাহাড়ি অঞ্চলের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ফেরার কথা ভাবতেই প্রথম যার কথা মনে হয়েছিল সে আজমল হায়দার। তার কারণও ছিল; সে সহপাঠী, উপরন্তু সংগ্রামের সাথি। পঁচিশের রাতে ইকবাল হলে সংগ্রামে দুজনে পাশাপাশি থেকে বন্দুক ছুড়েছে; প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে পিছুও হটে এসেছে একই সঙ্গে। আগুন এবং গোলাগুলির মধ্যে কোনোরকম গা বাঁচিয়ে বাসায় এসে পৌঁছেছিল কয়েক মিনিটের জন্য, বিদায় নিতে; তখনো সে সঙ্গে ছিল। তারপর দীর্ঘ রাত, দীর্ঘ পথযাত্রা। শ্রান্ত ক্লান্ত, সীমান্ত পেরিয়ে প্রথম গিয়ে উঠেছিল আগরতলা এবং কিছুদিন পরে গেরিলা ট্রেনিঙে যোগ দিয়েছে বাসে চড়ে গিয়ে একটা নতুন শিবিরে। বাঁশের ঘর, তরজার বেড়া। বাঁশের মাচানে দুজন শুয়েছে পাশাপাশি।


কিন্তু এসবও নয়, সবচেয়ে বড় কথা, সে তার গ্র“পেই ছিল সহকারী কমান্ডার হিসেবে। জুলাইয়ের সে রাতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ছিল। সীমান্তের কাছাকাছি তাঁদের প্রথম লড়াইয়ে কাঁধের মধ্যে একঝাঁক গুলি খেয়ে জঙ্গলের ধারে পড়ে গেলে, মনে হয়, সে-ই দ্রুত এসে ধাক্কা দিয়ে দেখেছিল। তখন জ্ঞান ছিল না; এবং শত্র“রাও ছিল, আশপাশে নিশ্চয়ই। সঙ্গীরা যে ফেলে চলে গেল, পরে স্থির মাথায় ভেবে দেখেছে, তাতে বিশেষ দোষ ছিল না। অতর্কিত আক্রমণ, এবং শক্তিক্ষয় হতে থাকলে, ক্ষিপ্র পশ্চাদপসরণও গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম রণকৌশল। অনেকটা উড়োখবর হলেও, ওর ভাঙাদলটি কিছুকাল পরে দেশের ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল।
মনে পড়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়ার পরে নতুন বন্ধুত্বের অবস্থায় কুমিল্লায় হায়দারদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল গ্রীষ্মের ছুটিতে। তিনদিকে সুপারি গাছের সারি। ওদের বাসাটা কান্দিরপাড়ে, কাঁচা রাস্তার ওপরে।
এমন জানের জান ছিল। তবু প্রথম চিনতে পারবে না, জানত। কিন্তু অচেনা হলেও, সে কারুর প্রতি এমন অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করবে, তা প্রত্যাশিত ছিল না।
গেটের কাছে পেছন থেকে একটু ডাক দিতেই সে ঘুরে দাঁড়াল এবং বিরক্তিভরা মুখটা তুলে তেতোস্বরে বলল, দেখুন আমাকে মাফ করবেন। আমি কিছু শুনতে পারব না।
তখন সে নিশ্চয় ভেবেছে অভাবী লোক, সাহায্য চাইতে এসেছে। মেজাজটা হঠাৎ ভীষণ চড়ে গেল। ওমর বজ্রধ্বনির মতো উচ্চারণ করল, স্টপ, হায়দার।
হকচকিত হায়দার। বিভ্রান্ত, স্তম্ভিত। পিঠে বর্শার ঘা যেন লাগল, সে দাঁড়িয়ে পড়ল। খুব চেনা কণ্ঠস্বর। সে প্রায় কাঁপতে লাগল এবং কোনোক্রমে উচ্চারণ করল, তুই! তুই! 
হ্যাঁ আমি ওমর।
অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি না। মাত্র এক পা এগিয়ে হায়দার বলল, মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক শহিদ হয়ে গেছে। সে পেয়েছে মরণোত্তর খেতাব বীরপ্রতীক। তার পরিবারে নির্ধারিত সাহায্য পৌঁছে— 
থাম হায়দার, আর লাগবে না। ওমর যেন নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে, হাতটা বাড়িয়ে দিল, বলল, একটু ধর আমাকে। এই দ্যাখ আমি বেঁচে আছি।
এই পর্যন্ত মন্দ ছিল না। কিছু রহস্য, কিছু উত্তেজনা। অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলনে, উচ্ছ্বসিত আলিঙ্গনের সময় দুজনেরই চোখের কোণে চিকচিক অশ্রুরেখাও দেখা দিল।
কিন্তু কী একটা তখনো ছিল অপ্রকাশিত যার ছায়া পড়ছিল, মাঝে মাঝে, বন্ধুর বিবর্ণ চেহারায়।


পরিচয় পাওয়ার পরে যন্ত্রচালিতের মতো সে কাজ করে গেছে, বেশ দ্রুত এবং কখনো কখনো, অন্যমনস্ক; তোশক বিছাতে গিয়েছিল, বাধা দিলে কাঠের চৌকিতে সে বিছানা পেতেছে, একটা পালা-মুরগি, জবাই করে পোলাও কোরমা খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছে। কথাবার্তা ছিল প্রায়ই অসংলগ্ন; এবং মাঝে মাঝে উচ্চহাস্যও যে করে উঠেছে তাও কোনো একটা সাংঘাতিক ব্যাপারকেই গোপন করার চেষ্টাও হতে পারে। ভেতরে ভেতরে প্রমাদ গুনছিল। ধূমপান করতে করতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে স্থিরদৃষ্টিতে, সঠিক আন্দাজের চেষ্টা করেছে। ওর বাবা, মা, হয়তো ওরই পরামর্শে, কুশল জিজ্ঞাসা করে গেলেন। সন্ধ্যার পরে সাজগোজ করিয়ে নিয়ে এল নবপরিণীতা বধূ কাজলকে, যার সঙ্গে ভালোবাসার কথা ও সবসময় বলত নিচু গলায়। ওদের পাড়ারই, উপেন মাস্টারের মেজো কন্যা। এই পরিবারের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনাচরণ সর্বজনবিদিত, তবু মিলনটা সহজ ছিল না। এবং বিয়েটা তো ছিল অসম্ভব, যদি না দেশ স্বাধীন হতো। বউকে নিয়ে আসার আগে সে ওসব গল্প করছিল। সংগ্রামের সময় আগরতলা হয়ে ওরা কলকাতায় যায়, যেখানে বড়দা ব্যবসা করতেন। তিনি ওকে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠিত একজন পাত্রও যোগাড় করেছিলেন। কিন্তু বোনটা বেশ একগুঁয়েমি করল, যার জন্য কথাবার্তা পাকা করতে পারেন নি। ওর ফাইনাল পরীক্ষা সত্যই বাকি। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ত, ভালো ছাত্রী হিসেবে নাম ছিল।
কান পেতে সব শুনছিল ওমর, কিন্তু তার হৃদয়জুড়ে তখন স্বপ্না। বেনারসি ঘেরা ঘোমটার নিচে গভীর চাউনি কাজলকে ছাপিয়ে জাগছিল বারবার। দুই সম্প্রদায়ের, বন্ধুর রোমান্সের মধ্যে বিপত্তির অর্থ বোঝা যায়; কিন্তু আপন মামাত বোনের সঙ্গে তার ভাব করাটা যে ছিল আরও কঠিন, তাই আশ্চর্য। বেদৌরা বিনতে আজিজ, নামটা বিদঘুটে বৈকি; কিন্তু যৌবনে সে দিল নিজের নাম, স্বপ্না, যেন কবিতার একটি শব্দ। কেউ জানত না, কেবল নিজেই ডাকত ওই নাম ধরে  গোপন চিঠিতে, চিরকুটে লিখত। প্রেমের খাতিরে, বাংলা অনার্সের ইয়ার কাইউমের কাছ থেকে বৈষ্ণব পদাবলির একটা পুরোনো বই যোগাড় করেছিল; কিন্তু বেশি ব্যবহার করত রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্তবক। বিশেষত, যেগুলোতে হৃদয়ের আওয়াজ বেশি। সেসব তীক্ষè কাঁটার মতো, বিঁধলে নীরবে রক্ত ঝরবে; নায়িকা ব্যথা পাবে কিন্তু ভেঙে পড়বে না। আর নজরুলের যে গানটি ছিল সবচেয়ে প্রিয় তা হলো, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় কে যেন আমাকে ডাকে। সে কি সে কি তুমি সে কি তুমি...  
এখন, কাজল বিদায় নিয়ে চলে গেলে, কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে ওমর, ঘনঘন সিগারেট টানে; তারপর হঠাৎ খাট থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল এবং হায়দারের ডান হাত ধরে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, কী লুকোচ্ছিস তুই বল  আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না।
নিজেকে ছাড়াল না হায়দার, বরং ওর বাঁ হাতটা আলগোছে তার কাঁধে রাখল, জড়ানো স্বরে বলল, কী আর লুকাব, আমি—  
না, না। তোকে বলতে হবে, সব বলতে হবে। চোখজুড়ে অগ্নিদৃষ্টি, ওমর বলল, মনে রাখিস তুই আমার কমান্ডে ছিলি। আমি অর্ডার করছি।
বেশ, যদি অর্ডারই তবে আমি মানতে বাধ্য। কিন্তু হঠাৎ আবার হায়দার যেন বিচলিত, থেমে থেমে বলল, আমি জানি তুই সশস্ত্র ওমর। আমি যা বলব, তা শুনলে গুলি করবি। গুলি করবি তুই আমাকে, তাতে আপত্তি ছিল না। আমি যে পাপ করেছি। পাপের শাস্তি আমি চাই। কিন্তু ভাবছি শুধু একজনের কথা, সে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। আশা-ভরসা করেছে। তবু তবু তুই আমাকে মার। চল যাই দুজনে ওই দূরে, সড়কের ওধারে। 
ওর গলা বন্ধ হয়ে গেল হাউমাউ কান্নার দমকে, দমকে দু হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে হুহু শব্দ করতে লাগল।
এরপর নীরবতা। অনেকক্ষণে সে সুস্থির হয় এবং দুজনে এসে বসে চৌকির ধারে, পাশাপাশি। কথাবার্তাও বলতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ছোকরাটাকে দিয়ে খাবার পাঠাল কাজল এবং শেষে, নিজে পরিবেশন করতে এল। খিদে ছিল, কিন্তু খাওয়ার মুড মোটেই ছিল না।
কিন্তু বন্ধুপত্নীর সৌজন্য অনেক মূল্যবান, কোনোক্রমেই তার অবহেলা চলে না। সাময়িকভাবে ভুলে গেল দুঃখশোক। দীর্ঘকাল পরে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভুঁড়িভোজন করল।
এবং তখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে যে যার ঘরে, কিন্তু ঘুমায় নি হয়তো। দুই বন্ধু একান্ত এখন। খিল এঁটে দিল। এবং বাতিটা অফ করে দিয়ে বালিশে কাত হলো, দুজনের আঙুলের ফাঁকেই জ্বলন্ত সিগারেট।
ঝড় এসেছিল। চলে গেছে। এখন যেন প্রশান্ত চাউনিতে প্রকৃতিকে চেয়ে দেখার সময়। ওমরের ডান হাতের আঙুলগুলো ধরে রেখেছে, আস্তে আস্তে বলল হায়দার, তুই বিশ্বাস কর, আমি বুঝতে পারি নি। কাছে গিয়েও পালস দেখেছিলাম। কিন্তু মনে হয়েছিল, খতম। তুই মরে গেছিস। অবশ্য আমাদের বিশেষ করে আমার কর্তব্য ছিল তোকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, জীবিতই হোক মৃতই হোক। কিন্তু পারলাম না। কাছেই ছিল দুশমনের এলএমজির মুখ। আমরা হন্তদন্ত, জান নিয়ে পালিয়ে এলাম। এটা আমাদের বিশেষ করে আমার ঘৃণ্য অপরাধ।
ওমর বলল, কী আর অপরাধ! যুদ্ধের সময়ে অমন ঘটেই থাকে, সেজন্যই আমি ভাবি না।
তুই যাই বলিস, কিন্তু যখন আমার সব মনে পড়ে, একটু থেমে হায়দার বলল, নিজেকে ধিক্কার না দিয়ে পারি না।
ওমর বলল, আমি যে বেঁচে গেছি তা নেহাত অস্বাভাবিক। তুই তো জানিস অমন বহুবার ঘটেছে আমার জীবনে, অল্পের জন্য মরি নি। আমার নানা পীর ছিলেন, মা বলেন তাঁর দোয়া আছে। তখনো, ঘটনাচক্রে আমি গড়িয়ে গিয়েছিলাম লতাপাতার আড়ালে, আমি সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম। শেষরাতের দিকে, মনে হলো, কাছে জিপের আওয়াজ। কারা যেন আমাকে ধরাধরি করে ওঠাল, তারপর নিয়ে গেল। কাঁধের জখমটা আমার মারাত্মকই ছিল 
হায়দার বলল, লিবারেশনের পরে অনেকবারই আমাকে ঢাকা যেতে হয়েছে। যতবার গেছি একমাত্র একবার ছাড়া প্রত্যেকবারই গেছি তোদের বাসায়। সবাইকে দেখে এসেছি। আমাকে দেখলেই কান্নাকাটি করত। তবু যেতাম। আমার কথাতেই ওরা তোর মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করেছিলেন। নইলে হয়তো, এমন কাণ্ডটি ঘটত না ।
তুই কী বলতে চাস ? মুহূর্তে আঘাত খাওয়া গোখরা সাপের মতো ফুঁসে উঠল ওমর, কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল, কী? কী? 
হায়দার তবু শান্ত। সে বলল, বিয়ে হয়ে গেছে স্বপ্নার ।


ও, না না। একটা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে নিচে গিয়ে পড়ল ওমর, ডান হাতটা শূন্যে নিক্ষেপ করতে করতে বলতে থাকে, আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না। হায়দার মিথ্যে বলায় তুই সুখ পাস, আমি জানি।
সমবেদনায় হতবাক, হায়দার ওকে ধরে আদর করে সান্ত¡না দিতে চায় কিন্তু সেও কি সম্ভব ? ক্রমে রাত নিঝঝুম, সে উঠে ভেতর বাড়িতে চলে গেল।
স্বপ্নার বিয়ে হয়ে গেছে, এই শব্দগুলো চারদিকে, ওর কানের কাছেও ভনভন করে ফিরছিল মাছির মতো, এবং একসময় কুঁকড়ে গিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে দেখল ওরা একটা ঝলমলে আগুনের চাকা হয়ে বনবন ঘুরছে। এমন যন্ত্রণা! অসহ্য ঠেকে কিছুক্ষণেই। মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে। বিজয়ের আগ পর্যন্ত কোনো খবর ছিল না, এবং বিজয়ের পরে গোনাগুনতি সাড়ে সাত মাসের বেশি অপেক্ষা করতে পারল না ? জানে, চার মাসেরই নিয়ম, কিন্তু অনেকে তো বছরের পর বছর, এমন কি সারা জীবনটাই কাটিয়ে দেয়। এমনই ঠুনকো ছিল ওদের ভালোবাসা ? ভাবতে ভাবতে চোখ ছাপিয়ে পানি এল, একসময় বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ, চাদর ভিজিয়ে দিল। মাথার ভেতরটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবু সব শুনেছে সে, সব শুনেছে। ঘরেই রেখেছে ওকে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে। ছোটভাই ফয়সল, সে-ই বর। ভাবির চাইতে সে স্পষ্ট দু বছরের ছোট, তবু নাজায়েজ নয়। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। গভীর পানির মাছ শ্বশুর সাহেব, সে যুগের লীগ নেতা, শেষদিকে ঘনঘন ঢাকা-পিন্ডি করতেন, তিনি এবারেও বেঁকে দাঁড়ালেন। আগেই আপন ভাগ্নের কাছে মেয়ে দেবার ঘোর বিরোধী ছিলেন। আপন পছন্দমতো ঠিকই করেছিলেন উচ্চ সম্বন্ধ, কিন্তু ওমরের দলবলকে এঁটে উঠতে পারেন নি, বিশেষ করে যখন বেদৌরা নিজে গিয়ে ওদের কাছে ধরা দিল। মুসলিম হলের ইমাম নিকা পড়িয়েছিলেন। বেশ অপছন্দ হয়েছিল, বলা যায়। ভাগ্নে হলে কী হবে, সমুচিত শিক্ষা দিতেন। শিক্ষা দিতেন মামলা দায়ের করে। কিন্তু আপন রক্ত, মায়ের পেটের বোনটির কান্নাকাটি উপেক্ষা করতে পারলেন না। তবু ক্ষোভটা ছিল। পারতপক্ষে, আসতেন না। মেয়েও সুবিধা বুঝে যেত ধানমণ্ডির বাপের বাড়িতে। সেই দুষ্ট ভাগ্নেটার করুণ পরিণতিতে মোটেই দুঃখিত হন নি তিনি, বরং যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।
হায়দার যদি এমন কিছু বলে থাকে যা অতিরঞ্জিত কিংবা মিথ্যা, তাকে এবার ক্ষমা করবে না। কিন্তু এখন ঢাকা, শুধু ঢাকা। ঢাকায় না গিয়ে শান্তি পাবে না। ঢাকা এখন টানছে, চুম্বকের মতো। একফোঁটা ঘুমও আসে নি চোখে, শেষরাতের দিকে উঠে পড়ল।
বাতি জ্বালাল না, হাতড়ে হাতড়ে থলেটা খুঁজে নিয়ে কপাট খুলে বেরিয়ে পড়েছিল রেলওয়ে স্টেশনের দিকে।
অনেক ভেবেচিন্তেই ঠিক করেছে, আত্মপ্রকাশ করবে না, এবং রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া বেশ দেরিতে খেয়ে, ম্যানেজারের অনুমতিক্রমে পেছনে একপাশের বেঞ্চিটায় বিশ্রাম নেয়ার সময়েও সে সংকল্পে স্থির। অবাক লাগছে, নিজের কাছেই। সাদামাটা একজন যুবক বৈ তো ছিল না, গোঁয়ার প্রকৃতির বলা যায়। সে নিশেন উড়িয়ে হৈচৈ করতে করতে গিয়ে বাসায় উঠবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন? এ যেন অন্য কেউ। কিংবা নিজে হলেও, তার সম্পূর্ণ অচেনা অস্তিত্ব। শামুকের মতো সে গুটিয়ে আছে, কঠিন এক আচ্ছাদনে, কিন্তু একটানা ঢিবঢিব করে চলেছে হৃৎপিণ্ড, একটা স্পন্দনকে উপলব্ধি করছে।
না-না, সে আর চিৎকার করবে না, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়বে না। এখন, প্রতারক এই জীবনের মনোরম প্রসাধন, সমস্ত সাজপোশাক দেখবার জন্য সে প্রস্তুত।
বেড়ায় হেলান দিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজে থাকতে থাকতে ফোয়ারার মতো স্বতঃউৎসারিত ভাবনার এই পর্যন্ত সহজেই চলে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই একটা বিস্ফোরণ। একটা নৃশংস, জিঘাংসার হাতছানি। প্রাগৈতিহাসিক হিংস্র। বুনো জন্তুর মতো সে ফুঁসছে, ছুটছে প্রচণ্ড ঢুস মেরে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে শিকারের ওপরে, রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন করছে।
কিন্তু এও অদ্ভুত, বেলা পড়ে এলে হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালে তার বুকের ভেতরটা আশা-নিরাশায় দুলতে লাগল। যদি সত্যই মিথ্যা হয় যা শুনেছে তার সমস্তটা ? যদি যদি যদি....
হ্যাঁ, এখানে কৃষ্ণচূড়া গাছটা এখন অজস্র ফুলে ফুলময়, তাদের যেন অনেক বেশি গাঢ় রং। ওমর মুখ উঁচিয়ে একনজর মাত্র দেখল।

ওই তো, নাতিপ্রশস্ত লনের পরে তাদের বাংলোঘরটা, যার একপাশে কামরায় স্মৃতিময় রাত কাটিয়েছে, এখনো দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। এর মধ্যেই ওদের বাসর হয়েছিল, যদিও উৎসবমুখর নয়। ঘরের অর্ধেকটা বৈঠকখানা, ইয়ারদের সঙ্গে আড্ডা দিত, স্বপ্না চা-বিস্কুটের ট্রেন বাড়িয়ে দিত ঝাঁপের ওধার থেকে। কক্ষে একটা পুরাতন পালঙ্ক আছে।
নতুন নতুন সেটাতে শুয়ে পুটুর পুটুর আলাপ করত রাতভর। জ্যোৎস্না রাতে বেড়াতে বেরোত প্রাঙ্গণে। ওই যে শিউলি গাছটা শীতের সকালে উঠে মাটির ওপর মেদুর আস্তরণ হয়ে পড়ে থাকা তার ফুল কুড়িয়ে এনে টেবিলে ছোট্ট স্তূপ করে রাখত স্বপ্না, যার মিঠে গন্ধে আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙত। আসলে স্বপ্না ছিল ফুলের পাগল, খোঁপায় ফুলপরা ওর অভ্যাস ছিল। সুযোগ পেলেই সে ফুল আনত, এবং ওর হাতে তুলে দিত।
ওই তো, বাবা বেরিয়ে আসছেন, সমবায় ব্যাংকের রিটায়ার্ড অডিটর মোহাম্মদ ওসমান গনি। ধবধবে সাদা দাড়িগোঁফ, মাথায় গোলটুপি। কপালের বলিরেখা আরও ঘন হয়েছে, বাঁকা লাঠিটায় ভর দিয়ে আরও ঝুঁকে হাঁটছেন। তাঁর পেছনে কে ? হ্যাঁ, মা-ই তো। সোনিয়াকে কোলে নিয়ে, পিছু নিয়েছেন। সোনিয়া আরেকটু বড় হয়েছে। সে চেঁচিয়ে হাত ছুড়ছে, বলছে দাদু! আমি বাবাল কাতে দাবো। বাবাল কাতে দাবো।
উনি বরাবরই তিরিক্ষি মেজাজের, বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন। পেছন ফিরে বললেন, থাম ছেঁড়ি। আমি মসজিদে যাচ্ছি।
পেছনে পেছনে মা তবু আসছেন, ওর কান্না থামাতে পারছেন না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ওমর, তার চোখজোড়া পানিতে ভরে গেল। ইচ্ছে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু পারল না।
গেটের আংটা খুলে বাবা বার হয়ে যাওয়ার সময় ওকে দেখে একটু থামলেন, চশমার আড়ালে ছানিপড়া চোখ তুলে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে ? এখানে কী চান ?
ওমর বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আপনার ছেলের কাছে এসেছি।
হ্যাঁ, ফয়সালের ফেরার সময় হয়েছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। বলে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে তুড়তুড় হেঁটে চলে গেলেন।
ইতিমধ্যে, কাছাকাছি এসে মা লক্ষ্য করছিলেন, তিনি দেখে ফেলেছেন কান্না। আরও কাছে এসে আর্দ্রস্বরে শুধালেন, কাঁদছ কেন বাবা ? তোমার কী দুঃখ ?
হাতের তালুতে চোখ মুছে ওমর বলল, আপনাকে দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে।
আহা বেচারি! কেঁদো না বাবা কেঁদো না। মা শরিফা খাতুন বললেন, জীবন মানেই তো দুঃখ। আমার দুঃখও কি কম? আমার আরেকটা ছেলে ছিল, তোমার বয়সিই হবে, মুক্তিযুদ্ধে গেল আর ফিরল না।
জি হ্যাঁ, আমি শুনেছি। ওমর বলল, কিন্তু বীরপ্রতীক। উনি তো বেঁচে আছেন।
হ্যাঁ ? বেঁচে আছেন ? কী বলছ তুমি বাবা, কোথায় সে ? কোথায় ?
ওমর ম্লান হেসে বলল, না মা। বলছিলাম, জাতির হৃদয়ে উঁনি বেঁচে আছেন।


ও, তাই বলো। মা মুখ তুলে বললেন, জাতির হৃদয়ে বেঁচে আছে, তাতে আমার কী ? আমার দুঃখ তাতে কমল কিছু? আমি রোজ কাঁদি ওর জন্য। না কেঁদে পারি না। চোখে আমারও ছানি পড়ছে। যদি জলদি অন্ধ হয়ে যেতাম! তাহলে পৃথিবীর মুখ আর দেখতাম না।
না, মা, না। এত বেশি হতাশ হওয়া আপনার সাজে না। দৃঢ়কণ্ঠে বলতে থাকে ওমর, দেশের আরও হাজার হাজার ছেলে প্রাণ দিয়েছে এবং যারা বেঁচে আছে, তারাও আপনার সন্তান।
হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ। ঠিক বলেছ তুমি। চোখের দরদর পানিতে দুই গাল ভেসে গেল, ভাঙা ভাঙা করে বললেন, যারা মরে গেছে, যারা বেঁচে আছে সবাই আমার সন্তান। সবাই আমার ছেলে, আমার ওমর ফারুক। আমি আর কাঁদব না। মাথা উঁচু করে থাকব। এই তো আমার উপযুক্ত কাজ।
স্তব্ধ হয় ওমর ফারুক। ভেতরে চলে এসেছিল। কাছেই গেট, যেখানে শব্দ, সেদিকে তাকাল। হ্যাঁ, ফিরে এসেছে ফয়সল, অফিসের সমস্ত কাজ সেরে। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে এসে ঢুকছে, হাতে একতোড়া মরসুমি ফুল। প্যান্ট শার্ট পরা, কোমরে বেল্ট, হাতঘড়ির রুপালি ব্যান্ড শীর্ণ কব্জির কাছে লেগে আছে। টিকোল নাকের ওপরে সোনালি ফ্রেমের চশমা, হালকাপাতলা গড়নে একটা দৃঢ়তা আছে, যা একনজরেই বোঝা যায়। কাছে এলে মা বললেন, বাবা ফয়সল এই দুঃখী বেচারা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে এসেছি যদি কোনো একটা—
বুঝেছি। ফয়সল মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আপনার একটা কাজের প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার ব্রাঞ্চের সব ভেকেন্সি পূরণ হয়ে গেছে। ঠিক আছে আপনি কাল আমার ওখানে আসুন। আমি টেলিফোন করে দেখব অন্য কোথাও 
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। ওমর বলল, এখন যেমন-তেমন একটা কিছুতে জয়েন করতে পারলেই হতো।
তিনদিন ধরে বেচারা পথে পথে ঘুরছে। শরিফার স্বরে আর্দ্রতা, তিনি বললেন, কিছু সাহায্য করতে পারিস না?
ও হ্যাঁ। হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করল ফয়সল, একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল, কাল অবশ্যই আসবেন আপনি। আমি অপেক্ষা করব। এই নিন আমার কার্ড।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, বাড়ির পেছন থেকে প্রাঙ্গণে এসে পড়েছে এক ঝলক ম্লান রাঙা আলো, কাছাকাছি গাছগাছালিতে শোনা যাচ্ছে পাখিদের কিচিরমিচির। এরই মধ্যে ধীরে হেঁটে কাছে এসেছে স্বপ্না, তার কোলে এখন সোনিয়া। অনবরত জ্বলছে নিভছে ওমরের চোখজোড়া। এ কি স্বপ্ন না বাস্তব ? ভালো দেখা যায়, স্বপ্না পূর্ণগর্ভবতী। আঁচলের নিচে টইটম্বুর বক্ষোভার, পেটের দিকটা স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি সুডৌল। মনে ঝলকা মেরে যায়,  সোনিয়ার সময়েও, এমনি হয়েছিল। ছেলে হবে, ভেবেছিল ওরা। প্রথম সন্তানের আগমন সম্ভাবনায় চাপা আনন্দে ভরপুর ছিল দুজনেই, কিন্তু ভয়ও পাচ্ছিল। সেজন্য পয়সা যোগাড় করে, শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ভর্তি করিয়েছিল হলিফ্যামিলিতে। বেশ কষ্ট হয়, তবু ফাঁড়া কেটে যায়। এখনো চোখের কোণে কালি এবং ঠোঁটে ক্লিষ্ট বিষণ্নতা, নারীত্বের পরম গৌরবের একটা গভীর প্রলেপও রয়েছে চেহারায়। কথা বলছিল না, মাঝে মাঝে কেবল চেয়ে দেখছিল। পরিচয়ের কোনো আভাস কি পেয়েছে কোথাও? না, না সে অসম্ভব। তাছাড়া অনেকের সঙ্গে তো মিলও থাকে, যা একটু ঢেউ তুলতে পারে বিস্মৃতির সরোবরে আর কিছু নয়। অচেনা আদমি, সে এমন একটা পারিবারিক পরিবেশ থেকে চলে যাচ্ছে না, তা নিজের কাছেও বিসদৃশ ঠেকল। কিন্তু হঠাৎ করে নড়তেও পারছে না। কিন্তু যেন টের পাচ্ছে, ওর আবেগ-অনুভূতির সূক্ষ্ম কোমল তন্তুগুলো ক্রমে জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক নয়, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে কেলেঙ্কারি।
সোনিয়ার দাপাদাপিতে অস্থির তবু মাথার কাপড়টা ঠিক রেখেছে স্বপ্না, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে উনি যেই হন, বেগানা পুরুষ। দু হাত বাড়িয়ে কচিকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে সোনিয়া, আমি বাবাল কাতে দাবো। বাবাল কাতে দাবো।
একগাল হেসে ফয়সল আরও দুই পা এগিয়ে গেল, ফুলের তোড়াটা বউকে দিয়ে মেয়েকে দু’ হাতে বুকের কাছে নিল আদরের সঙ্গে। ডান পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বার করল, ওর সামনে ধরে বলল, এই যে, তোমার মিমি!
চকলেটের মোড়কটা ছোট্ট হাতে ধরে ও বলতে লাগল, আমি ফুল নেব।
ফয়সল হেসে বলল, ওটা তো আম্মার।
না, না। আমি ফুল নেব। গাল ফুলিয়ে বলল সোনিয়া, নইলে আমি মিমি থাব না।
এবার একটু হাসে স্বপ্না, স্নিগ্ধ ক্লান্ত, কাছে এসে ফুলের তোড়াটা মেয়ের ছোট্ট হাতের মুঠিতে ধরিয়ে দিল। বলল, হয়েছে?
গর্ভবতী স্ত্রী পাশে, সন্তানকে ধরে আছে, পরম আদরে বাঁ হাতের ওপরে বসিয়ে তরুণ ফয়সলকে দেখাচ্ছে সফলকাম স্বামী, গর্বিত পিতা।
এখন এখানে দাঁড়িয়ে ওমর কি স্তম্ভিত, আলোড়িত? কিছুই উপলব্ধি করতে পারল না। কেবল কীসের খেয়ালে এক পা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে বলল, আমাকে একটা ফুল দাও মা আমাকে একটা ফুল দাও।
এই দেখে, থমকে থাকে সোনিয়া এবং কিছুটা ওরা তিনজনেও। কিন্তু পরক্ষণেই হালকা হয়ে বলল, ফয়সল, দাও না মা, একটা ফুল। উনিও তোমার আঙ্কেল।
এবার সোনিয়া যেন বুঝতে পারল এবং সহজ হয়ে গেল। এবং একটা নয়, গোটা ফুলের তোড়াটাই বাড়িয়ে দিল। সেটা হাতে তুলে নেয় ওমর এবং ধরে রাখে কিছুক্ষণ।
তারপর হঠাৎ স্বপ্নার মুখোমুখি হলো, ফুলের তোড়াটা তার হাতে দিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, একটু খেলা করলাম। ওর মতো আ

Leave a Reply

Your identity will not be published.