তরুণ মজুমদার: মধ্যপথের নন্দিত চলচ্চিত্রকার

তরুণ মজুমদার: মধ্যপথের নন্দিত চলচ্চিত্রকার

[৪ জুলাই, সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদার। তিনি কিডনি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে এ লেখাটি পত্রস্থ হলো]

তরুণ মজুমদারের জন্ম ১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি, বাংলাদেশের বগুড়ায়। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।

মধ্যপথের বাংলা ছবির উল্লেখযোগ্য পরিচালক ছিলেন তরুণ মজুমদার। অবশ্য শিল্প ও বাণিজ্যের সমন্বয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও তরুণ মজুমদার সব সময়ই দর্শকদের চাহিদাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতেন। অর্থাৎ তাঁর ছবির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য। যদিও মূলত বাণিজ্যিক ছবি করতে গিয়েও তরুণ মজুমদার ভাবতেন, গল্প বলার কায়দায়, চরিত্রায়ণে, ছবির সম্পূর্ণ নিমার্ণশৈলীতে কতখানি রুচির পরিচয় রাখা যায়। বলা যায়, তরুণ মজুমদার বাংলা ছবির জন্য ক্রমাগত সাফল্যের সঙ্গে সন্ধান করেছেন এমন এক নির্ভুল বাণিজ্যিক ফর্মুলা যার মধ্যে ছিল সুরুচির স্পষ্ট স্বীকৃতি। উল্লেখ্য, তরুণ মজুমদার পরিচালিত সিংগভাগ ছবি দর্শক আনুকূল্য লাভে সমর্থ হয়েছে।

তরুণ মজুমদার চলচ্চিত্রজীবনের শুরুতে যাত্রিক গোষ্ঠীর (এই গোষ্ঠীর অন্য দুজন সদস্য ছিলেন পরিচালক শচীন মুখার্জী এবং দিলীপ মুখার্জী) একজন সদস্য হিসেবে ‘চাওয়া পাওয়া’ ‘পলাতক’সহ কয়েকটি হিট ছবি পরিচালনা করেন। তারপর স্বনামে এবং স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করেন ‘আলোর পিপাসা’ (১৯৬৫) থেকে।

তরুণ মজুমদার তিন দশক ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। এ পর্যন্ত তাঁর নির্মিত ছবির সংখ্যা ত্রিশ। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে: বালিকা বধূ (১৯৬৭), নিমন্ত্রণ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা (১৯৭৮), দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫), পথ ও প্রাসাদ (১৯৯১), আলো (২০০৩) প্রভৃতি।

তরুণ মজুমদারের বাণিজ্যিক সফল ছবিগুলোতে কাহিনি বিন্যাসের দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। এ প্রসঙ্গে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ (১৯৭৩), ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭) কিংবা ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ (১৯৮৫) ছবিগুলোর কথা বলা যায়। তরুণ মজুমদার পরিচালিত ছবির গল্পের গতি, চরিত্রায়ণের সহজ সরল নির্মেদ পদ্ধতি এবং কাহিনির সার্বিক রূপায়ণ- সবকিছরু মূল উদ্দেশ্য হলো জনমনোরঞ্জন কাহিনি বাছাই এবং বিন্যাস ভঙ্গির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্ভাব্য সমস্ত রকম আপসের বীজ। এসব ছবির কাহিনি এবং চরিত্রের ক্রমিক বিবর্তন চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বাণিজ্যিক ফর্মুলার দ্বারা। যা কিছু চমকপ্রদ, যা কিছু অপ্রত্যাশিত, সবই আসে প্রত্যাশিত ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে। এভাবেই তরুণ মজুমদার তৈরি করেছেন নির্ভার প্রমোদের নির্ভুল উপাদান। বাণিজ্যিক উপাদানের এই স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল বণ্টনের মধ্যেই ছিল তাঁর আর্ট। এবং এই স্বতঃর্স্ফূত, সাবলীল বণ্টনের দাবিই নিয়ে আসে সারিবদ্ধ আপস। পরিত্যক্ত হয় পরিচিত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোয় চরিত্রগুলোর ব্যবহারিক লজিক; ভুলে যাওয়া হয় নানা ঘটনার টানাপোড়েন থেকে উৎসারিত কাহিনির বাস্তবধর্মী অনিবার্যতার কথা। তরুণ মজুমদারের দক্ষ বাণিজ্যমুখী পরিচালনা শুধু বেছে নিয়েছিল ঘটনা ও চরিত্রের সেই নির্যাস, যার মধ্যে রয়েছে প্রমোদের উপাদান।

তরুণ মজুমদারের ছবির বাণিজ্যিক সফলতার পেছনে গানের ভূমিকাও কম নয়। ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ প্রভৃতি ছবি হিট হওয়ার ক্ষেত্রে গান কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত, গানের জন্যে সিচুয়েশন তৈরি কিংবা সঠিক সিচুয়েশনে সঠিক গান প্রয়োগের ব্যাপারে তরুণ মজুমদারের দক্ষতা ছিল অসামান্য। উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের সুপ্রয়োগে তরুণ মজুমদারের কৃতিত্ব সর্বজনস্বীকৃত। উদাহরণ-স্বরূপ ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়’ (শ্রীমান পৃথ্বীরাজ), ‘বধূ কোন আলো লাগল চোখে’, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো’, ‘এই করেছো ভালো নিঠুর’ (দাদার কীর্তি), ‘হার মানা হার’, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি’ (ভালোবাসা ভালোবাসা), ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু’ (পথভোলা) প্রভৃতি গানের কথা বলা যায়।

তরুণ মজুমদার ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন চারটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার; লাভ করেছেন বিএফজেএ সম্মাননা, পাঁচটি ফিল্ম ফেয়ার, পদ্মশ্রী এবং একটি আনন্দলোক পুরস্কার।

উল্লেখ্য, যেখানে তরুণ মজুমদার শিল্প ও বাণিজ্যের মিশ্রণে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন নি (যেমন পথভোলা/ গণদেবতা/অমর গীতি) সেখানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ছবির শিল্পগুণ কখনো এতদূর নিখাঁদ যে, তাঁর বাণিজ্যিক ব্যর্থতাকে শৈল্পিক বিশুদ্ধতার মহৎ অজুহাতে মেনে নেওয়া যাবে। যা হোক, বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রগিতে তরুণ মজুমদারের অবদান চিরস্মরণীয়।

Leave a Reply

Your identity will not be published.