এ দেশের একটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘ঘুড্ডি’। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ছবিটি এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাজা বাতাস বয়ে এনেছিল। প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফার প্রথম চলচ্চিত্র এটিই। পুনা প্রত্যাগত চিত্রগ্রাহক শফিকুল ইসলাম স্বপনেরও এটি প্রথম ছবি। আর চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দীন জাকীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘ঘুড্ডি’। এমনকি এ ছবিতেই প্রথম সংগীত পরিচালনা করেছিলেন লাকি আখন্দ। তার ভাই হ্যাপি আখন্দের প্রথম প্লেব্যাকও এ চলচ্চিত্রে। তবে চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটিই এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র যে চলচ্চিত্রটি কোনো তৈরি স্ক্রিপ্ট ছিল না। চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দীন জাকী ইম্প্রোভাইজ করেছিলেন; তাৎক্ষণিকভাবে সংলাপ, দৃশ্য তৈরি করেছিলেন। আরেকটি কথা, এ চলচ্চিত্রটির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্যামেরা ছিল হ্যান্ড হেল্ড যা দেশীয় চলচ্চিত্রে প্রথম। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের নেপথ্য গল্প এখানে তুলে ধরা হলো।
'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...
গত শতকের সত্তর দশকের শেষপর্যায়। ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে সদ্য ফিরেছেন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। দুজন এ দেশে প্রথম একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হলেন যথাক্রমে পরিচালক এবং সম্পাদক হিসেবে। প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন নিজের লেখা পথনাটক ‘চরকাকড়ার ডকুমেন্টারি’অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রোডাকশন অফিস থেকে সেই চিত্রনাট্য উধাও হয়ে গেল। তৎসঙ্গে শিশু একাডেমির নির্মাণাধীন ছবি ‘গল্প দাদু’র সমগ্র ড্রেস এবং প্রপ্স্। অন্যকিছু, মূল্যবান, সবই ছিল। সন্দেহ নেই, উদ্দেশ্যমূলক চুরি।
এই দুর্ঘটনায় কিন্তু চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দীন জাকী ভেঙে পড়েন নি বরং তার মধ্যে জেদ চেপেছিল যে নির্ধারিত দিনেই শুটিং শুরু করবেন। কিন্তু গল্প, স্ক্রিপ্ট? কলাকুশলীরা জানতে চেয়েছিল। জাকী জানিয়েছিলেন, সব মাথায় আছে। ইম্প্রোভাইজ করবেন, তাৎক্ষণিকভাবে সংলাপ লিখবেন, সিকোয়েন্স তৈরি করবেন। বলাই বাহুল্য, চলচ্চিত্রটির তখন নাম ঠিক হয় নি। পরে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ঘুড্ডি’।
স্ক্রিপ্ট চুরি যাওয়ার পর দিন সকালে সময়মতো সবাই প্রোডাকশন অফিসে হাজির হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং সুবর্ণা মুস্তাফাও। কী ব্যাপার? ইউনিট ছবির শুটিং করতে যাবে। এই সময় সহকারী পরিচালক বিকাশ দত্ত, চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের ছোটভাই, তিনি টিপ্পনি কেটেছিলেন, কোথায় লোকেশন? নাকি সেটাও ইম্প্রোভাইজড হবে? বিকাশ দত্তকে পাত্তা না দিয়ে সালাহউদ্দীন জাকী সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলেছিলেন।
দুটি গাড়িতে চড়ে সবাই রওনা দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গের উদ্দেশে। একটি গাড়িতে ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম স্বপন, চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দীন জাকী, নায়ক-নায়িকা রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা। অন্য গাড়িতে বাকিরা।
পথের মাঝে গাড়িতে নানা কথা হয়েছিল জাকী, স্বপন, আসাদ ও সুবর্ণার মধ্যে। একপর্যায়ে আসাদ সুরেলা গম্ভীর গলায় ফোক জাতীয় গান ধরেছিল। সুবর্ণা সুরেলা গলায় রবীন্দ্রসংগীত। একসময় দুটি গাড়িই শীতলক্ষ্যার পাড়ে পৌঁছেছিল। ওখান থেকে নদী পার হয়ে সোনাকান্দা দুর্গে।
কেন সোনাকান্দা দুর্গেই প্রথম দিনের শুটিং করলেন জাকী? তার ভাষ্য হচ্ছে, আগের দিন রাতে সোনাকান্দা দুর্গের ছবি তার মনের ভেতর আনাগোনা করছিল। মাস ছয়েক আগে স্টিল তুলতে এসেছিলেন টিভি প্রযোজক শফিককে সঙ্গে নিয়ে। সম্ভবত ওটারই আফটার ইমেজ বা হ্যাংওভার।
সোনাকান্দা দুর্গে সালাহউদ্দিন জাকী ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম স্বপনকে একটি জায়গা দেখিয়ে সেখানে ক্যামেরা বসাতে বললেন। প্রথম শট কম্পোজিশনের কথা জানালেন। বললেন, এই হলো ফ্রেম। প্রথমে কেউ নেই। শুধু দুর্গের সিঁড়ি। ক্যামেরার ডানদিক দিয়ে ইন করবে সুবর্ণা। আসাদ ইন করবে বাম দিক দিয়ে। তারপর ব্যাক টু ক্যামেরা হেঁটে ওরা দুজন উঠে যাবে চত্বরে।
এক টেকে ‘ঘুড্ডি’র এই শট ওকে হয়েছিল। অতঃপর পরিচালক জাকী নাস্তার ব্রেক দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন এখন তিনি সংলাপ লিখবেন, প্রথম সিকোয়েন্সের। তৈরি চিত্রনাট্য ও সংলাপ ছাড়া এই যে চলচ্চিত্র নির্মাণ এমনটি এ দেশে প্রথম। ভারতের বিকল্পধারায় এভাবে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। ফ্রান্স, ইতালিসহ আরও কয়েকটি দেশে তো বটেই। এভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে সাহস লাগে। সেই সাহস সালাহউদ্দীন জাকীর ছিল, তবে তিনি এর কৃতিত্ব ‘ঘুড্ডি’র অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের দিতে চান। তাদের অনুপ্রেরণাতেই তিনি ভিন্নপথে হেঁটেছিলেন।
নতুন পদ্ধতিতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণে কোনো সমস্যা হয় নি পরিচালকের। যখন যা আইডিয়া মাথায় এসেছে, সেটির প্রয়োগ তিনি ঠিকই করতে পেরেছেন। কলাকুশলীরা তাকে সাহায্য করেছেন। অনেক সময় তারা না খেয়েও থেকেছেন। কিন্তু কোনো অভিযোগ করেন নি।
এখানে অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নায়লা আজাদ নূপুর। পোড় খাওয়া একটি মেয়ের চরিত্র, একাত্তরে যে হারিয়েছে তার প্রেমিককে। এই চরিত্রটিসহ আরও কয়েকটি চরিত্রের সূত্রে একাত্তরের প্রচ্ছন্ন ছায়া রয়েছে এ চলচ্চিত্রে। মোট তিনটি জায়গায়। এর মধ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শুটিং হয়েছিল। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, সেই জায়গাটিও তুলে ধরা হয়েছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে একটি প্রশ্ন তোলে। যদিও তা সেন্সর বোর্ড কেটে দিয়েছিল। অবশ্য সিকোয়েন্সের বাকি অংশটুকু রয়েছে। এরও গুরুত্ব রয়েছে। তখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেমন ছিল তা বোঝা যাবে।
বাম রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন- এমন এক ব্যক্তির মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। বুয়েটের আর্কিটেকচারে পড়ে। জীবনবোধ তেমন গভীর নয়। কিছুটা হালকা হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এক মেয়ে।
আসাদ এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রত্যাগত এক তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সুতো কাটা ঘুড্ডির মতো ঘুরে বেড়ায় বাংলাদেশের আকাশে। গোলাম মুস্তাফা এ ছবিতে দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নৌকার মাঝি এবং বুট পালিশওয়ালা। এমন এক বুট পালিশওয়ালা যার চেহারা অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মতো। তার আফসোস সারা জীবন জুতা পালিশ করে গেল কিন্তু অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মতো হতে পারল না। উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রটির ব্যাপ্তি বেশি হয়ে যাচ্ছে, এটি অনুধাবন করে বুট পালিশওয়ালার অংশটি ফেলে দেন সালাহউদ্দীন জাকী।
ছবিতে দেখা যায়, আসাদ প্রেমে পড়ে সুবর্ণার। প্রেমিকার কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে নানা মিথ্যে কথা বলে। সেলুন থেকে ধার করা দামি শার্ট পরে সুবর্ণার সঙ্গে দেখা করে। বন্ধুর গাড়িকে নিজের গাড়ি বলে অভিহিত করে। কিন্তু আসাদের এই মিথ্যাচার একপর্যায়ে ধরা পড়ে যায় সুবর্ণার কাছে। সম্পর্কে ভাঙন ধরে। শেষপর্যন্ত অবশ্য আসাদের কাছেই ফিরে যায় সুবর্ণা।
‘ঘুড্ডি’র শুটিংয়ে নানা ঘটনা ঘটেছে। যেমন, একটি দৃশ্য রয়েছে আসাদকে খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে তার দেখা পায় সুবর্ণা। তখন এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। এই দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে দেখা গেল যে, সুবর্ণা নদীতে পড়ে গেছে। প্রথিতযশা এই অভিনেত্রী তখন সাঁতার জানতেন না। তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে সুবর্ণাকে উদ্ধার করেন সালাহউদ্দীন জাকী, রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং সহকারী পরিচালক মাহবুব আলী। কিন্তু নদীতে পড়ার ফলে সুবর্ণার শাড়ি ভিজে গিয়েছিল। ভেজা শাড়ি অথবা অন্য শাড়ি পরে সুবর্ণা অভিনয় করতে পারবেন না। এতে কন্টিনিউটি থাকবে না। তাই পুরো ইউনিটকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নদীর বাতাসে অবশ্য আধ ঘণ্টার মধ্যেই সুবর্ণার শাড়ি শুকিয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আবার শুটিং হয়েছিল এবং শটটি ওকে হয়েছিল। সুবর্ণা এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় ঠিক মতোই ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন।
রাইসুল ইসলাম আসাদও ‘ঘুড্ডি’র একটি দৃশ্যে নারায়ণগঞ্জের পাগলার ম্যারি অ্যান্ডারসন রেস্টুরেন্ট থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি অবশ্য সাঁতার জানতেন। তাই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নি।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল টেকনাফে। দেশের এই জায়গায় যেতে তখন অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। ওখানকার সমুদ্র সৈকতটি অবশ্য বেশ নির্জন ছিল, এখনকার মতোই আর এখন যেমন এটি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য, তখনো সেটি স্মাগলারদের স্বর্গরাজ্য ছিল। সেখানে শুটিং করতে গিয়ে কয়েকজন লোকের কথাবার্তা কানে এল পরিচালক সালাহউদ্দীন জাকীর। লোকগুলো কথা বলছিল স্থানীয় ভাষায়। ওরা জানতেন না যে জাকী চাঁটগাইয়া অর্থাৎ চট্টগ্রামের আদিবাসী। যা হোক, ওই লোকগুলোর কথা শুনে জাকী শঙ্কিত হলেন। কেননা ওরা সুবর্ণাকে কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করেছিল।... ডিরেকশন দেওয়ার নাম করে সহকারী পরিচালক বিকাশ দত্ত, আসাদ এবং স্ত্রী সাহানাকে বিষয়টি খুলে বললেন সালাহউদ্দীন জাকী। সুবর্ণা ভয় পেতে পারে তাই তাকে বলা হলো না বিপদের কথা। উঁচু গলায় সুবর্ণাকে জাকী বললেন, তোর মেকআপ নষ্ট হয়ে গেছে। যা তো ওই বালিয়াড়ির আড়ালে যেয়ে চুল আর মেকাপ ঠিক করে আয়। বিকাশ, সাহানা ওকে নিয়ে যাও।
সুবর্ণা একটু বিস্মিত হয়ে অস্পষ্ট প্রশ্ন করলেন, মেকআপ? চুল? চুল তো হাওয়ায় উড়ছে বেশ। প্রায় ধমক দিলেন জাকী, তর্ক করিস না। তাড়াতাড়ি উঠে যা।
তারা চলে গেলেন। জাকী খুবই মনোযোগ দিয়ে মিথ্যা শট নিতে শুরু করলেন আসাদকে নিয়ে। তারা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ-এ বললেন, এফ-৪ অর্থাৎ ফিল্ম ছাড়া শুটিং। ফাঁকি। শট নিচ্ছেন আর ক্যামেরা বসাচ্ছেন সৈকত থেকে ক্রমাগত এগোতে এগোতে তীরের দিকে, যেখানে ইউনিটের গাড়ি রাখা হয়েছে। বালিয়াড়ির আড়াল দিয়ে সুবর্ণা এবং অন্যরা পৌঁছে গেছেন এবং গাড়িতে উঠে গেছেন। দুষ্কৃতকারীরা বুঝতে পারে নি।
সালাহউদ্দীন জাকী, আসাদ এবং ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম স্বপনও দ্রুত গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া ছিল। তাই তারা দ্রুত অই স্থান ত্যাগ করতে পারলেন।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম স্বপনের বাড়িতে। তার বাড়ির চিলেকোঠায় দু’দিন দুই রাত্রি সামান্য বিরতি দিয়ে একটানা শুটিং হয়েছিল। কেননা ছবির অন্যতম অভিনেত্রী নায়লা আজাদ নূপুর দেশের বাইরে যাবেন, কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তাই নূপুর ও আসাদের অংশটুকু হঠাৎ শুটিং করতে হয়েছিল ক্যামেরাম্যান স্বপনের বাসায়।...অই শুটিং-এর পর দেখা গেল যে, স্বপনের বাসায়ই আসাদ ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমালেন সারা দিন, রাত, পরদিন দুপুর পর্যন্ত। ইতিমধ্যে অবশ্য সালাহউদ্দীন জাকী এবং শফিকুল ইসলাম স্বপন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কী না কী হলো আসাদের! আসলে অত্যন্ত পরিশ্রমের দরুন আসাদ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাশাপাশি নূপুরের সঙ্গে কাজটি ভালোভাবে শেষ করার পর এক ধরনের আত্মতৃপ্তিও বোধ করেছিলেন। তাই প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলেন।
পরিচালনার পাশাপাশি ‘ঘুড্ডি’ প্রযোজনাও করেছিলেন সালাহউদ্দীন জাকী। অবশ্য অর্থ সঙ্কট তার ছিল। তাই বিভিন্ন বন্ধুর কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছিলেন। আর শেষ পর্যায়ে স্ত্রী সাহানার গহনা বন্ধক দিয়েছিলেন শাখারী বাজারের একটি দোকানে। পরে অর্ধেক গহনা ফেরত এনেছিলেন, কিন্তু বাকি গহনা ওখানেই থেকে গিয়েছিল। বলা যায়, আর্থিক সংকটের দরুন শুটিং-এর ফ্লো ঠিক ছিল না। বিরাট কোনো আয়োজনের ভাবনাও তাই ভাবেন নি জাকী। উল্লেখ্য, অভিনয়শিল্পী ও টেকনিশিয়ানরা কোনো পারিশ্রমিক নেন নি। বরং ছবির অন্যতম অভিনয়শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম দুদিনের খাবার সরবরাহ করেছিলেন।
চলচ্চিত্রটির শেষ শুটিং হয় কক্সবাজারে। সাগর সৈকতে হেঁটে যাচ্ছে আসাদ-সুবর্ণা। সুবর্ণা একলাই কথা বলছে। আসাদ শুনছে। লম্বা শট। তখন ক্যামেরাম্যান স্বপনের কাঁধে ক্যামেরা হ্যান্ডহেল্ড। যা চলচ্চিত্র মাধ্যমে অত্যন্ত কঠিন। পরিচালক সালাহউদ্দীন জাকী সংলাপের স্লিপগুলো হাতে নিয়ে স্বপনের পাশে পাশে পিছিয়ে যাচ্ছেন। একসময় সুর্বণার সংলাপ বলা শেষ হলো আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার শব্দ ‘করাং’ অর্থাৎ বন্ধ। ফিল্ম রান আউট বা কাঁচামাল শেষ। এমনিতেই অর্থ সংকট তার মধ্যে ওই সময় ফিল্মে সরবরাহ কম থাকায় দাম অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় হয়তো শুটিং করাই সম্ভব হতো না। তখন এফডিসিতে ফিল্ম সরবরাহ করতেন প্রথিতযশা চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান। তিনি খুবই স্নেহ করতেন জাকীকে। চলচ্চিত্রকেও খুবই ভালোবাসতেন। তিনিই গোপনে ফিল্ম সরবরাহ করেছিলেন চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দীন জাকীকে। অই ফিল্ম দিয়ে কক্সবাজারে শুটিং করে চলচ্চিত্রটি শেষ করেছিলেন জাকী।...ফিল্ম সংকটের কথা সুবর্ণাকে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন এক টেকেই সাগর সৈকতের শটটি ওকে করতে হবে। সুবর্ণা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
জাকী এফডিসি থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করেন নি। তাকে ক্যামেরা দিয়েছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সাই নেন নি। ক্যামেরা সহকারী ছিলেন শামসুল হক। যিনি তখন বিটিভির চিফ ক্যামেরাম্যান ছিলেন।
চলচ্চিত্রটির সম্পাদক ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল। এটি ছিল তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। তিনি প্রথম সম্পাদনা করেছিলেন ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’।
‘ঘুড্ডি’র সংগীত পরিচালক ছিলেন লাকি আখন্দ। একটি গান গেয়েছিলেন তারই ছোটভাই হ্যাপি আখন্দ। এ বিষয়ে অবশ্য একটি মজার ঘটনা আছে। স্বাধীনতার পরে জাকীরা থাকতেন আজিমপুরে। সেখানে প্রায়ই তার উদ্যোগে গানের আসর বসত। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন কিশোর বয়সী লাকী। তবলা বাজাতেন হ্যাপি। একদিন এমনই এক গানের আসরে লাকি আবদার করেছিল জাকীর কাছে, ‘আপনি ফিল্ম বানালে সেখানে আমি সংগীত পরিচালনা করব’। তখনই পাশ থেকে হ্যাপি বলে উঠেছিল, ‘আর আমি সেই ফিল্মে গান গাইব।’সহাস্যে তখন জাকী বলে উঠেছিলেন, ‘ওকে’। সেই কথা রাখতেই লাকি আখন্দকে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া।
মিউজিক রেকর্ডিং নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আছে। লাকি আখন্দ ঘুমকাতুরে ছিল। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী মোটরবাইকে চলে যেতেন খুব সকালে সেই আজিমপুরে। দু-একবার মাথায় পানি ঢেলেও উঠাতে হয়েছে লাকি আখন্দকে। তিনিও কোনো পারিশ্রমিক নেন নি।
‘ঘুড্ডি’র গানগুলো আজও দর্শক-শ্রোতাদের ভালো লাগে। যেমন, আবার এল যে সন্ধ্যা, কে বাশি বাজায় রে (হ্যাপি আখন্দ), সখী চলো না জলসা ঘরে এবার যাই (সৈয়দ আবদুল হাদী), ঘুম ঘুম চোখে দ্যায় চুম’ (শাহনাজ রহমতউল্লাহ), যেমন নদীর জলে নাও ভাইসা চলে (শিমূল ইউসুফ), তা ছাড়া নাসরীন চৌধুরীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের অংশ ছিল। খালি গলায় আসাদ একটি ফোকধর্মী গানের কলি গেয়েছিলেন।
ছবিতে সুবর্ণার লিপে ছিল ‘ঘুম ঘুম ঘুম, চোখে দ্যায় চুম’এই রোমান্টিক গানটি। এটিই স্বাধীনতা উত্তরকালে শাহনাজ রহমতউল্লাহর প্রথম প্লেব্যাক। তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে কী-এক অভিমানে চলচ্চিত্রে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাকে রাজি করান লাকি ও হ্যাপি আখন্দ। কেননা একসময় শাহনাজ রহমতউল্লাহর অনেক গানের সঙ্গে তবলা বাজিয়েছিলেন হ্যাপি। সংগত কারণেই তার একটি অধিকার বোধ ছিল। তা ছাড়া গানটির কথা ও সুর পছন্দ হয়েছিল শাহনাজ রহমতউল্লাহর। ইপ্সা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটি গেয়েছিলেন তিনি। সতেরোটি টেক দিয়েছিলেন। রেকর্ড করেছিলেন এম এ মজিদ। উল্লেখ্য, ‘ঘুম ঘুম ঘুম, চোখে দ্যায় চুম’গানের সূত্রে বাচসাস পুরস্কার পেয়েছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ।
‘ঘুড্ডি’র কোনো শুটিং এফডিসিতে হয় নি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন বাড়িতে চলচ্চিত্রটির শুটিং হয়েছে। চলচ্চিত্রটির আউটডোর শুটিং হয়েছে গুলশান, ধানমন্ডি, বুয়েট, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজারসহ নানা জায়গায়।
চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, নায়লা আজাদ নূপুর, ফরিদ আলী, তারেক আনাম, গোলাম মুস্তাফা, সৈয়দ হাসান ইমাম। এ ছাড়া অভিনয় করেছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাইদুল আনাম টুটুল- যারা পেশাদার অভিনেতা ছিলেন না।
শিল্পনির্দেশক ছিলেন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী স্বয়ং। কস্টিউম ডিজাইনার সাহানা জাকী এবং শিমূল ইউসুফ।
‘ঘুড্ডি’ নির্মাণে দেড় বছর লেগেছিল। বাজেট ছিল পাঁচ লাখ টাকা। মুক্তি দেয়ার পর টাকাটা উঠে আসে নি, অনভিজ্ঞতার দরুন। পেশাদার কোনো পরিবেশককে পরিবেশনার দায়িত্ব দিলে এমনটি হতো না।...এফডিসিতে বাকি ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। ওই টাকা সুদসহ জাকী শোধ করেছিলেন এফডিসিতে চাকরি করার সময়। তার বেতনের টাকা থেকে ওই টাকা কেটে নেওয়া হয়েছিল।
চলচ্চিত্রটি দেশের বাইরে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক এবং নিউজার্সিতে দেখানো হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, তা ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.