১০০ বছর আগে ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা। যদিও তাঁর গন্তব্য আর্জেন্টিনা ছিল না। কেন তিনি হঠাৎই আর্জেন্টিনায় যাত্রা বিরতি নিলেন? তিনি সেখানে কোথায় উঠলেন, কত দিন ছিলেন আর্জেন্টিনায়, কার সান্নিধ্যে আর্জেন্টিনায় সময় পার করেছিলেন, তখন তিনি কী লিখতেন, কী ভাবতেন!
ঘটনার ১০০ বছর পর, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক ভিন্ন রবীন্দ্রনাথের দেখা পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত আবেগে তিনি ভাসছেন, মধুর সময় কাটাচ্ছেন, সুখের মতো অসুখে জর্জরিত হয়ে আছেন। তিনি দেশে ফিরতে চাইছেন, কিন্তু ফেরা হচ্ছে না। অদ্ভুত এক পিছুটান তাঁকে আটকে ধরেছে অথবা ধরেনি, তিনি সেইসব উপেক্ষা করে সমুদ্র পাড়ি দিলেন। হে সমুদ্র, চাহিলাম আপন গহন চিত্ত পানে; কোথায় সঞ্চয় তার, অন্ততার কোথায় কে জানে।
দু’ মাসের অনির্দিষ্ট অনির্ধারিত ভ্রমণ শেষে তিনি বাড়ি ফিরলেন। এই ভ্রমণ থেকে তিনি কী নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, এই ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের মনে কী রকম ছাপ ফেলেছিল, দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের স্মৃতি-ছবি কি তিনি মুছতে পেরেছিলেন মন থেকে, এইসব প্রশ্নের প্রসঙ্গ ধরে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের চেষ্টায় ম্যাড টোরের ২য় প্রযোজনা ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া’।
২৫ জুন, সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হবে ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া’ নাটকের ৮ম প্রদর্শনী। নাটকটি রচনা, নির্দেশনা ও পরিকল্পনা করেছেন ম্যাড থেটারের প্রধান পরিচালক আসাদুল ইসলাম। নাটকটির চরিত্র সংখ্যা দুটি। রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুল ইসলাম ও ভিক্টোরিয়া চরিত্রে সোনিয়া হাসান।
রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর শতাব্দী প্রাচীন প্রেমের নতুন উদ্বোধন ঘটেছে ম্যাড থেটারের ২য় প্রযোজনা ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া’ নাটকটির মধ্য দিয়ে।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পেরু সরকার দাওয়াত দিয়েছিলেন স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। সেখানে যওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর থেকে জাহাজে চড়ে বসেন। দীর্ঘ দু’মাসের সমুদ্র যাত্রার ক্লান্তিতে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। দেহের মধ্যে বাসা বাঁধে ইনফ্লুয়েঞ্জা। পেরুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেও তিনি পেরু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন না। জাহাজে করে কোনো রকম আর্জেন্টিনা পর্যন্ত পৌঁছাতেই শরীর রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় ও ডাক্তারের পরামর্শে বাধ্য হয়ে তাঁকে বিশ্রাম নিতে হয়। প্লাজা হোটেলে অসুস্থতার দিনগুলোতে একদিন হঠাৎ তাঁর এক পাঠিকা এসে উপস্থিত হন। পাঠিকার আমন্ত্রণ রক্ষার্থে তিনি হোটেল ছেড়ে শহরের বাইরে সান ইসিদ্রোতে এক ভাড়াবাড়িতে অবসর কাটাতে লাগলেন। বাড়ির নাম ছিল মিরালরিও ভিলা, রিও ডেলাপ্লাটা নদীর পাড়ে। বাড়ির ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে বসে তিনি নদী দেখতেন, আপন মনে ভাবতেন, কবিতা লিখতেন। মিরালরিও ভিলাতে রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর পাঠিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সখ্য গড়ে ওঠে। সেখানে ওকাম্পোর সান্নিধ্যে একটা সুখকর সময় তিনি কাটাতে থাকেন। ওকাম্পোর সেবা শুশ্রূষায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। মিরালরিও ভিলায় তিনি এক সপ্তাহের জন্য যান, কিন্তু কীভাবে সপ্তাহ ঘুরে মাস পেরিয়ে যায়, তিনি টের পাননি। ১৯২৪ সালের নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাস, মিরালরিও ভিলায় কাটিয়ে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার সময় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো স্মৃতির স্মারক হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন একটা চেয়ার, যে চেয়ারে বসে তিনি লিখতেন কিংবা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ওকাম্পোর দেওয়া উপহার নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে আসলেন। মিরালরিও ভিলায় অজানা ভাষার দেশে কাটানো দিনগুলোতে লেখা কবিতাগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পূরবী’, বইখানা রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। আর জীবনের বাকি দিনগুলোতে যক্ষের ধনের মতো তিনি ওকাম্পোর দেওয়া উপহারটি আগলে রাখেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও চেয়ারটির কথা ভোলেন নি, ভোলেননি স্মৃতিকাতর সান ইসিদ্রোর কথা। শান্তিনিকেতনের বারান্দায় পাতা চেয়ারটিতে বসে তিনি নিজের মনে পাঠ করতেন- আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন দেশ। শেষ দিনগুলোতে যখন তিনি অবলুপ্ত চেতনা থেকে ক্ষণিকের জন্য ফিরে আসতেন, সেই ক্ষণিক চেতন-অবচেতনের মাঝখানে হানা দিত প্রিয় চেয়ারটির প্রতিকৃতি যার কোলে রয়েছে বিছানো বিদেশের আদরের বাণী। সান ইসিদ্রো থেকে শান্তিনিকেতন, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সান্নিধ্যে থাকা না-থাকা রবীন্দ্রনাথের সেই সময়কে অন্য একটি সময়ে এসে ফিরে দেখার অসামান্য উদ্ভাবন ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া’।
Leave a Reply
Your identity will not be published.