না-ফেরার দেশে যাত্রা করেছেন কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ফারুক। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ১৫ মে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। এ হাসপাতালে চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন।
২০১১ সালে সিঙ্গাপুরে রুটিন চেকআপের জন্য গেলে তাঁর রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। তখন তিনি অসুস্থবোধ করেন ও চিকিৎসাধীন থাকেন হাসপাতালে। পরে তাঁর মস্তিষ্কেও সংক্রমণ দেখা দেয়।
ফারুকের নামটি শুনলেই এ দেশের চলচ্চিত্র দর্শকদের মনে তারুণ্য-দীপ্ত এক তেজি যুবকের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। সাত দশকের শেষ দিকে এইচ আকবরের ‘জলছবি’র মাধ্যমে নায়ক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ।
সামাজিক চলচ্চিত্রেই ফারুকের দর্শক গ্রহণযোগ্যতা বেশি ছিল। তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা দুই শতাধিক। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে ফারুক অভিনয় করেছেন। আবেগ বিহ্বল প্রেমিক (সূর্য গ্রহণ), হাবাগোবা গ্রাম্য তরুণ; পরে চালাক-চতুরে পরিণত হয় সে (ঘর জামাই), ডানপিটে বেপরোয়া ও জেদি তরুণ (কথা দিলাম), অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা (আবার তোরা মানুষ হ), উদাসী সারেং (সারেং বউ), পরিবারের প্রতি আত্মউৎসর্গীকৃত তরুণ (সাহেব) ইত্যাদি। তবে গ্রাম্য যুবার চরিত্রে ফারুক সবচেয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। এ প্রসঙ্গে ‘নয়নমণি’র নয়ন, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র মিলন, ‘সুজন সখী’র সুজন, ‘আরশীনগর’-এর বয়াতি, ‘বিরাজ বউ’-এর নীলাম্বরের কথা কি ভোলা যায়? তেমনি ভোলা যায় না ‘লাঠিয়াল’, ‘মাটির মায়া’র তেজি যুবকের কথা।
ফারুক অভিনীত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য চলচ্চিত্র হচ্ছে : নাগরদোলা, সীমার, লাল কাজল, সখী তুমি কার, চিৎকার ইত্যাদি।
ফারুক প্রথম শ্রেণির প্রায় সব নায়িকার বিপরীতেই অভিনয় করেছেন। শুরুতে তিনি কবরীর সাথে জুটি বাঁধেন। কিন্তু এই জুটির আয়ু খুব বেশি দীর্ঘ হতে পারে নি। কেননা কবরী আশির দশকের শুরুতে চলচ্চিত্র মাধ্যমকেই পরিত্যাগ করেন (পরে অবশ্য প্রত্যাবর্তন করেন)। যা হোক, পরবর্তী সময়ে ফারুক অভিনয় করেন ববিতা, সুচরিতা ও রোজিনার সাথে। ছবিগুলোও ব্যবসা সফল হয়। এ ছাড়া শাবানা, অঞ্জনাসহ প্রথম সারির আরো কয়েকজনও ফারুকের নায়িকা ছিলেন।
শুরুতে এক নাগরিক ইমেজের চরিত্রে (জলছবি) অভিনয়ের মাধ্যমে ফারুকের অভিষেক ঘটলেও, অভিনয়শৈলীতে অপরিপক্কতার ছাপ ছিল, সেহেতু তিনি দর্শক-নির্মাতা মহলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হন। পরে ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে গ্রামীণ চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে তিনি পাদপ্রদীপের আলোর সামনে আসেন। সঙ্গত কারণেই এ ধরনের ইমেজে নিজেকে কিছুটা সম্পৃক্ত করে ফেলেন তিনি। অবশ্য একসময় তিনি এ ব্যাপারে সচেতন হন এবং নগর ও গ্রামের পটভূমিতে বিভিন্ন ও বিচিত্র চরিত্রে সফলভাবে অভিনয় করেন। এমনকি সামাজিক অ্যাকশন ছবিতেও (দোস্তী, প্রতিজ্ঞা) চমৎকার পারফরমেন্স দেখান। এটা আশির দশকের কথা।
তারকা হিসেবে ফারুক ক্রমশ নিজেকে বিকশিত করেছেন। নিষ্ঠা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের দরুন তিনি সুপারস্টারে পরিণত হন। পাশাপাশি অভিনয় দক্ষতাও উল্লেখ করার মতো। বস্তুতপক্ষে এ দেশের চলচ্চিত্র মাধ্যমে বহির্মুখী আবেগবাদী অভিনেতাদের মধ্যে ফারুক ছিলেন স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
রোজিনা-ববিতাকে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে ফারুকের নামে গুঞ্জন শোনা গেছে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন ছিল ক্ষণস্থায়ী। পরে তিনি আবার বিয়ে করেন ও সুখের সন্ধান পান। তাঁর স্ত্রীর নাম ফারজানা পাঠান। তিনি দুই সন্তানের গর্বিত পিতা। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম ও পুত্র রওশন হোসেন।
ফারুক জাতীয় পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে তাঁর অভিনয় সত্তার স্বীকৃতি লাভের সক্ষম হয়েছিলেন।
মাঝখানে দীর্ঘ বিরতির পর নব্বই দশকের প্রথমার্ধ্বে আবার অভিনয়ে ঝুঁকে পড়েছিলেন। তবে নায়ক নয়, চরিত্রাভিনয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। মোদ্দা কথা, প্রায় পাঁচ দশক ফারুক দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে অবদান রেখেছেন। শুধু নায়ক নয়, প্রযোজক-পরিবেশক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। পরিবেশক সমিতির কর্মকর্তা হিসেবেও তাঁর অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসময় তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসর গ্রহণ করেন, গার্মেন্টস ব্যবসায় যুক্ত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে অংশগ্রহণ করে ঢাকা-১৭ আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বড় বর্ণাঢ্য ও কর্মমুখর এক জীবন কাটিয়েছেন চলচ্চিত্রের 'মিঞা ভাই'খ্যাত অভিনেতা ফারুক।
Leave a Reply
Your identity will not be published.