হাওয়া রাতে।। মাহরীন ফেরদৌস

হাওয়া রাতে।।          মাহরীন ফেরদৌস

তুহিনের যেদিন ওর স্ত্রীর সাথে পুরোপুরি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, সেদিন ছিল আট অক্টোবর। আমরা কাছের সব বন্ধুরা মিলে একটা নামকরা রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় তুহিনের ফোনে একটা মেসেজ এল। ও পকেট থেকে ফোন বের করে মেসেজটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ থেকে আমি অফিশিয়ালি ডিভোর্সড। 

কথাটা শুনে আমার ধাক্কার মতো লাগল। আমি বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালাম। চারপাশে তাকালাম। আর কেউ তুহিনের বলা কথাটা শুনতে পায় নি। ওরা ওদের মতোই শব্দের তুবড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। তুহিন নিজেও আর আমার দিকে তাকিয়ে নেই, ওর সমস্ত মনোযোগ তখন নাচোসের প্লেটে। চিজভর্তি মাংসের কিমা কায়দা করে চিপসে নিতে সে এতই ব্যস্ত যেন এরচেয়ে জরুরি কাজ আর এই পৃথিবীতে নেই; যেন পৃথিবীর বাকি সব কাজই তুচ্ছ। আমি অবশ্য ওর মতো পৃথিবীর সবকিছু মুহূর্তে তুচ্ছ করে দিতে পারলাম না। আমার বুকের ভেতরটুকু শিরশির করে উঠল। আমি দেখতে পেলাম,  তুহিন, তুহিনের গালে বেড়ে ওঠা দাড়ির  জঙ্গল, ওর হাতে ধরা নাচোসের প্লেট, রেস্তোরাঁর শোরগোল, বাকি বন্ধুদের গল্প, মাথার ওপরের নীল-সাদা আকাশ সবকিছু হঠাৎই যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠছে।

একদিন তুহিনের সম্পর্কের পরিণতি এমন কিছু হবে তা আমরা অনেকেই আন্দাজ করতে পারছিলাম। কিন্তু, যেভাবে বাস দুর্ঘটনা হলে খবরে বলা হয় তদন্ত করা হবে, যেভাবে দুর্নীতির খবর ছড়িয়ে গেলে বলা হয় তা দমন করা হবে। একইভাবে তুহিন বলত তিরার সাথে ওর সব ঝামেলা খুব দ্রুতই মিটে যাবে। তবে পৃথিবীর কোনো দুর্ঘটনা বা বিচ্ছেদ মিটে যাওয়া কোনো সহজ অঙ্ক নয়। যেখানে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষ ফিরে আসে না, দুর্নীতিতে গায়েব করে দেওয়া অর্থের হিসাব পাওয়া যায় না, সেখানে তুহিন আর তিরার মাঝে সবকিছু তাহলে ঠিক হয়ে যাবে কীভাবে? 

তিরা চলে যাওয়ার পর তুহিনের মাঝে অনেক ধরনের পরিবর্তন আসা শুরু করল। কলাবাগানের যে ডুপ্লেক্স বাসায় ও আর ওর ছোটভাই পৈতৃকসূত্রে থাকত, সে বাসার নিচের গেস্টরুমকে সে পরের মাসেই একটা ওপেন বাথরুম বানিয়ে ফেলল। ঘরের বামপাশে ডিম্বাকৃতির বিশাল বাথটব। সেখানে গরম ও ঠান্ডা পানি  আসার কল। দেয়ালের সাথে আটকানো আলমারিতে কিছু গল্পের বই, একটা বড় সাউন্ড বক্সের পাশাপাশি অনেকগুলো ছোট-বড় স্পিকার। ওয়াল মাউন্টে একটা সত্তর ইঞ্চি স্ক্রিনের টিভি। ছোট একটা টেবিলে কিছু সুগন্ধি ছড়ানো ক্যান্ডেলসহ কী নেই সেই ঘরে ? বাড়ির অন্য কোনো ঘরের সাথে এই ঘরের কোনো সামঞ্জস্য কেউ খুঁজে পাবে না। বরং হঠাৎ এ ঘরে ঢুকলে যে কারও বিস্মিত হতে হবে। মনে হবে কলাবাগানে না, সিনেমার শুটিং স্পটে বুঝি সে চলে এসেছে।

মাথাটা পুরাই গেছে ওর। বিশাল বাথটবটা ঘুরে ঘুরে দেখার পর আমার কানের কাছে প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল রবি। উত্তরে আমি কড়া দৃষ্টিতে তাকালাম ওকে দিকে। তারপর ঠান্ডা স্বরে বললাম, এত জাজমেন্টাল হওয়ার কী আছে? আমার ধারণা এই ঘরটায় ওর আর তিরার সবচেয়ে বেশি স্মৃতি ছিল। ও সেগুলো মুছে ফেলতে চাইছে। 

ঘর থেকে স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য মিউজিক, টিভি দিয়ে গোসলখানা বানিয়েছে? যাতে করে সেই ঘরে আরও বেশি থেকে স্মৃতিকাতর হতে পারে ? এই তোর লজিক ? কণ্ঠে বিরক্তি ঝরিয়ে বলল রবি।

এবার আমি চুপ করে গেলাম। রবির কথায় যুক্তি আছে। তুহিনের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল, এই বাথরুমই আসলে ওর থাকার ঘর। ওর ছোটভাই রবিন এমনিতেই দেশের বাইরে পড়তে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই এই বাড়িটায় যে শেষ পর্যন্ত তুহিন একাই থাকবে তা নিয়ে তুহিনের বা আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। রবি পর্যন্ত একদিন ওর মুখের ওপর বলে বসেছিল, বাবা-মা প্রচুর সম্পত্তি রেখে মারা যাওয়ার একটা সুবিধা আছে। স্বাধীনভাবে সহায়সম্পত্তি ভোগ করা যায়। কথাটা শুনে আমার এত বিচ্ছিরি অনুভূতি হয়েছিল যা বলার বাইরে। অথচ তুহিন কিছুই মনে করে নি। এক গাল হেসে শুধু বলেছিল, এই তোরা স্কচ খাবি?   
 
তবে তুহিনের এই বাথটব প্রীতি খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। বড় জোর মাস ছয়েক। প্রথম দিকে আমাদের সন্ধ্যার আড্ডাটা এই ঘরেই হতো। তুহিন ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে, হালকা মিউজিক ছেড়ে বাথটবে ইপসাম সল্ট, বাথ বাবল দিয়ে এমনভাবে গা ডুবিয়ে বসে থাকত যেন ধ্যান করছে। আমি বিশাল বড় পিৎজা অর্ডার করে একেকটা স্লাইস দীর্ঘসময় নিয়ে খেতাম। আর রবি সারা ঘরজুড়ে পায়চারি করত আর গজগজ করত, কেন এই ঘরে তুহিন সিগারেট খেতে দেয় না? কেন রাস্তায় এত জ্যাম? ঘনঘন ভূমিকম্প ঘটছে কেন ? বা এখানে আসার সময় ওর পকেটে থাকা একমাত্র এক শ টাকার নোটটা একটু ছেঁড়া ছিল বলে বদমাশ রিকশাওয়ালা কত কাহিনি করেছে এইসব আর কী। ছয় মাসের মধ্যে এগুলো সব থেমে গেল। আর হঠাৎ করেই তুহিন আমাদের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। তুহিনের ফোন অন থাকলেও ও কল ধরত না, মেসেজের রিপ্লাই দিত না। দুদিন ওর বাসার সামনে গিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। রবিন ততদিনে আমেরিকায় পড়তে চলে গিয়েছে। তুহিনকে মেসেঞ্জারে কল দিয়েও তেমন কোনো খবর পেলাম না। শুধু জানলাম ও বেশ টাকাপয়সা খরচ করে একটা বাইক কিনেছে। খবরের মতো খবর আসলে এটাই ছিল। কারণ, এর দুদিন পরেই রবি জানাল ফেসবুকের খুব জনপ্রিয় বাইকার গ্রুপের সাথে নাকি তুহিনকে দেখা যাচ্ছে। ওরা বাইকে করে দলবেঁধে সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ করবে।
তার মানে সারা দিন বাসায় থাকা বা বাথটব প্রীতি এরমাঝেই শেষ? হতভম্ব হয়ে বললাম আমি।
সে আর বলতে? বাসা, বাথটব প্রীতি বাদ হয়েছে। এখন সেইখানে এসেছে বাইক। দিন দুয়েক বাদে বাইকও ভালো লাগবে না, তখন ও বসে বসে... রিকশা ভাড়া দেওয়ার জন্য টাকা বের করতে মুখ খারাপ করল রবি। কিছুক্ষণের মাঝে দেখলাম এক শ’ টাকার ছেঁড়া নোট নিয়ে এই রিকশাওয়ালার সাথেও ঝগড়া করছে ও। ওর কাছে ঠিক কতগুলো ছেঁড়া নোট আছে? 

ঝগড়া থামাতে আমি নিজেই ভাড়া দিয়ে দিলাম। তারপর ধানমন্ডির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওর কাছ থেকে বাইকারদের গ্রুপের নাম জেনে নিয়ে ফেসবুকে সার্চ দিলাম। আসলেই ঠিক বলেছে ও। গ্রুপের পিনড পোস্টে আট জন বাইকার ছেলে হেলমেট হাতে হাসিমুখে দাঁড়ানো। এদের একজন তুহিন। আমাদের বন্ধু তুহিন। দাড়িগোঁফের জঙ্গল দুপাশে সরিয়ে সে দাঁত বের করে হাসছে। খুব দ্রুতই ওদের গ্রুপ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ট্যুর দিবে। এরপর যাবে ভারত, নেপাল ও ভুটান। এরপর ওরা বাইকে করেই বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা করবে। ওদের সবার গায়েই গেরুয়া রঙের লেদার জ্যাকেট। সবারই বাইকের একই ব্র্যান্ড। রবিকে ছবিটা দেখালাম। ও মুখ খারাপ করে একটা গালি দিল।

এমন সময় আকাশে গম্ভীর সুরে মেঘ ডেকে উঠল। পরপর দুটা বিদ্যুৎ চমকালো। বৃষ্টির ভয়ে আমরা দ্রুত রাস্তা পার হয়ে একটা টঙের দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি এল না, কিন্তু আকাশ মেঘদের মিছিল দিয়ে চারপাশ অন্ধকার করে ফেলল। বাতাস এসে রাস্তায় ধুলা উড়াতে থাকল। ধুলা আটকাতে গায়ে জড়ানো ওড়নাটা নাকের ওপরে তুলে মাথার পেছনে গিঁট মারলাম। প্রবল বাতাসে মাথার ওপরের বড় বড় গাছগুলো ডানে বামে কাঁপছে। ডাকতে ডাকতে কিছু পাখি উড়ে গেল দূরে। টঙের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পাখিদের চলে যাওয়া দেখে কেন যেন আনমনা হয়ে গেলাম। কোর্টনি ম্যারি এন্ড্রুসের একটা অখ্যাত অথচ বিষণœ গান গুনগুন করে উঠলাম। টেবল ফর ওয়ান, আই হ্যাভ গট নো ওয়ান, আই অ্যাম ওয়েটিং অন...
কার গান এটা ? মাঝপথে বিড়বিড় করল রবি।
কজ আই অ্যাম লিটল বিট লোনলি, আ লিটল বিট স্টোনড। অ্যান্ড আই অ্যাম রেডি টু গো হোম—আবার গুনগুন করলাম আমি।
রবি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আজকে প্রচণ্ড ঝড় হবে। 
তবে সেদিন প্রচণ্ড ঝড় হলো না। ঝড় হলো ঠিক তার মাস তিনেক পর। আর হুট করে তুহিন আমাকে আর রবিকে পুরোনো দিনের মতো ওর বাসায় ডাকল। গত তিন মাসে ওর কাছ থেকে আমরা কোনো মেসেজ পাই নি। মাঝে মধ্যে শুধু বাইকার গ্রুপ থেকে ওদের গ্রুপটার ছবি আর আপডেট পেতাম। খাগড়াছড়ির রিসাং ঝরনা কিংবা হিরণ পয়েন্টের পাশে ওদের রোদে পোড়া চেহারার হাস্যজ্জ্বল মুখ। আর চকচকে চোখের মণিতে বিশ্ব জয়ের উত্তেজনা দেখে আমার প্রায়ই মনে হতো, আমার আর রবির জীবন এত পানসে কেন ? আমরা চাইলেই এমন করে কোথাও উদ্দেশ্যহীন কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বের হয়ে যেতে পারি না কেন?

যে রাতে তুহিন আমাদের ডেকেছিল সেদিন ওর বাসায় গিয়ে দেখলাম, সারা বাড়ি অন্ধকার। শুধু নিচতলার অতিকায় বাথরুমে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। আর সেই ডিম্বাকৃতির বাথটবের দেয়ালে ও হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর আগের চেয়ে মেদহীন আর টানটান। মাথার চুল রুক্ষ, এলোমেলো। চোখের দৃষ্টিতে অনেকটা ধারালো ভাব। সব মিলিয়ে ওর বসার ভঙ্গিটাও যেন বলে দেয় শহর নয়, বন-জঙ্গল, নদীনালার বাতাসে ডুবে এসেছে আমাদের এই তুহিন। এসিতে বসে মিউজিক শোনা কিংবা বাথটবে বাবল তুলে গা ডুবিয়ে দেওয়ার জীবনের সাথে ওর এখনকার জীবনের কোনোই মিল নেই। রবি আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। ওকে দেখলাম ঘরের আরেক পাশে নাক কুঁচকে কিছুটা চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। আমি আসার পর তুহিনকে বলল, কী জন্য ডেকেছিস বল। 
তুহিন অবশ্য সাথে সাথেই ঘটনা বলার জন্য কোনো তাড়া দেখাল না। আগের মতো স্কচ বা বাদাম খাওয়ানোর মতো কোনো আমন্ত্রণও জানাল না। নিজের জন্য ব্ল্যাক কফি বানাতে গেল আর আমাদের জন্য ক্যাপাচিনো। এরই মাঝে আমি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া মনোযোগী পাঠকের মতো ওকে পড়ার চেষ্টা করতে থাকলাম।
তিরার সাথে আমি বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, আমাদের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলা শুরু করল তুহিন। কিন্তু ওর দিক থেকে সবসময়ই খুব রুক্ষ ব্যবহার পাচ্ছিলাম। আমার মনের কোথাও একটা অস্থিরতা ছিল। মনে হতো পেটের ভেতরে এসিডের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাথার পাশাপাশি সারা শরীর গরম হয়ে উঠত। মনে হতো গায়ে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে, আমি ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। সারা দিন এ জন্যই বাথটবে শরীর ডুবিয়ে রাখতাম। দারোয়ানকে বলা ছিল, ও ব্যাগভর্তি বরফ এনে আমার বাথটবে ফেলে রাখত। তাও আমার শরীর, গায়ের চামড়া ঠান্ডা হতো না। আমার সবকিছুই অসহ্য লাগা শুরু করেছিল। কিন্তু ভান করতাম যে ভেতরে ভেতরে খুব ভালো আছি। তোদেরও তাই দেখাতাম। তিরার চলে যাওয়া নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই মনে হতো জ্বলন্ত আগুনে নিজেকে নিজেই পুড়িয়ে দিচ্ছি। আবার নিজেই বেঁচে উঠছি।

এরপর একদিন যখন খবর পেলাম তিরা ওর জীবন নতুন কারও সাথে শুরু করা নিয়ে ভাবছে। সেদিন আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারি নি। মাঝরাতে রাস্তায় বের হয়ে গিয়েছিলাম উদ্ভ্রান্তের মতো। একসময় আবিষ্কার করলাম রাজপথে দাঁড়িয়ে আছি। হইচই, চিৎকার হচ্ছে আমার চারপাশে। গাড়ি থেমে গেছে। গালি দিচ্ছে লোকে। অথচ কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করছিল না। মনে হচ্ছিল কেন বেঁচে আছি আমি ? সেদিনই আমার স্কুলজীবনের বন্ধু মাসুম আমাকে চিনতে পেরে সামনে এগিয়ে এসেছিল। মাসুমকে তোরা চিনবি না। দুর্দান্ত বাইক চালায়। দেশবিদেশ ঘুরে। হাইকিং করে। ওর ডাকেই আসলে বাইকার গ্রুপে জয়েন করি। আর টের পাই ওদের সাথে ব্যস্ত থাকলে আর গনগনে আগুনের মধ্যে আছি বলে মনে হয় না। 
তোর একবারও মনে হয় নি আমাদের অন্তত জানানো উচিত ছিল তুই কোথায় আছিস—বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
তোদের কথা মনে হয় নি তা না। তবে জানাতে ইচ্ছে করে নি। তোরা অনেক প্রশ্ন করবি তা আমি জানতাম। আমি কোনো প্রশ্ন নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বাইকার গ্রুপের সাথে দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। মাসুম খুব ভালো ট্রেইনার। ওর কারণেই আমি এমন ট্যুরগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। আমার আগের জীবনের সাথে তুলনা করলে এই জীবন এত ভিন্ন ছিল যে তিরার কথা আমার মনেই পড়ত না। বা এমন কিছু আমার সামনেও আসত না যা তিরাকে মনে করিয়ে দিবে। আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম বাংলাদেশ ট্যুর শেষ হবার পর বাসা বিক্রি করে, রবিনকে ওর ভাগ দিয়ে, বাকি টাকা-পয়সা নিয়ে পৃথিবী দেখতে বের হয়ে যাব।
তোর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুই বাস্তবতা থেকে ক্রমশ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিলি, রবি তুহিনের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল।
তোর কাছে এমন কিছু মনে হতেই পারে। তবে আমার মানসিক পরিবর্তন বা ট্যুরগুলো নিয়ে আমার পরিকল্পনা নিয়ে কতটা দৃঢ় হয়ে উঠেছিল তা তোরা আমার এটুকু কথায় বুঝতে পারবি না। আমি আমাদের পারিবারিক উকিলকে মেসেজ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলাম। যা যা করব ভেবেছিলাম সবই করতাম কিন্তু এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল। 
কী ঘটনা? 
কিছুদিন আগে আমরা সিলেট ছিলাম। একটা বাংলোয়। একদিন গভীর রাতে আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো কেউ আমাকে ডাকছে। সাহায্য চাইছে। কারও কোনো বিপদ হয়েছে। ভয়ে, আতঙ্কে গা হাত-পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সবার আগে মনে হলো তিরার কিছু হয় নি তো? 
হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছিস, তাই এমন মনে হয়েছে। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, স্লিপ প্যারালিসিসের মতো ডিজঅর্ডারে ভুগলে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক। চাপা স্বরে বললাম আমি।
তুই কি মাত্র এগুলো গুগল করে বের করলি? কণ্ঠে উষ্মা ছড়িয়ে বলল তুহিন।
না। আমি আগে থেকেই জানি। আমি নিজে এক সময় ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দূর করতে আইআরটি থেরাপি নিতাম। 
হুম। এ কথা শোনার পর আর কথা থাকে না তাই ছোট্ট করে উত্তর দিল তুহিন। তারপর কণ্ঠে কিছুটা ক্লান্তি ছড়িয়ে বলল, আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক দুঃস্বপ্ন দেখি। তবে সেই রাতের মতো এত ভয়াবহ বাস্তব অনুভূতি আমার কোনোদিন কাজ করে নি। মনে হচ্ছিল কোন অশরীরীর ডাক পাচ্ছি আমি। আর আমাকে যেতেই হবে। না গেলে খুব খারাপ কিছু ঘটবে। তাই আমি কাউকেই কিছু না জানিয়ে দ্রুত বাইক নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দিয়ে ছিলাম। 

তারপর? 
বাইরে বের হয়ে দেখি হালকা বাতাস। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সিলেটের আবহাওয়া তো তোরা জানিসই। কিছুদূর যাবার পর এত বেশি বৃষ্টি হচ্ছিল যে খুব বেশি দূর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একবার ভেবেছিলাম বাংলোয় ফিরে যাব নাকি, কিন্তু মন সায় দেয় নি। 
তিরাকে নিয়ে যখন ভাবছিলি এত, ওকে ফোন করে কথা বলতে পারতি। চিন্তা কমে যেত। 

তিরার মোবাইল বন্ধ ছিল। বাইক নিয়ে বের হবার আগে ওর এক কাজিনকে দিয়ে বাসায় কল করিয়ে জেনেছিলাম ও অফিসের ট্যুরে গিয়েছে। সত্যি বলতে শুধু তিরাকে নিয়েই না, আমার মনে হচ্ছিল যেন এক হাজার তিরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে যেমন অস্থিরতা কাজ করতে পারে আমি তেমন কিছুই অনুভব করছি। মাথার ভেতর অনবরত একটা শঙ্কা আর্তনাদ করে যাচ্ছিল। এত ঘন বৃষ্টি হবার পরেও আমি শুধু ঢাকায় ফিরে আসতে চাইছিলাম।  
বাইকারদের গ্রুপে শেখানো সাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম আছে। নিরাপদে বাইক চালানোর জন্য। আমি সবকিছু মেনে চলতাম। সেইরাতে ভেতরে ভেতরে এত অস্থির থাকার পরেও আমি সাবধানে বাইক চালাচ্ছিলাম। বৃষ্টি বাড়লে গতি নিয়ন্ত্রণ করছিলাম, বৃষ্টি কমলে গতি বাড়াচ্ছিলাম। আর মনে মনে নিজের বাইকটাকে বারবার সাহস দিচ্ছিলাম যেন যে-কোনো উপায়েই আমাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে। এভাবে ঠিক কতক্ষণ বাইক চালিয়েছি জানি না। এমন সময় দেখলাম, একটা উজ্জ্বল হলুদ রেইনকোট পরা একটি মেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বুড়ো আঙুল বাঁকা করে দেখাচ্ছে। 
মেয়ে! আমি আর রবি একসাথে বলে উঠলাম।

হ্যাঁ। লম্বাটে গড়নের, চিকনা চাকন একটা মেয়ে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ততক্ষণে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছিল। মেয়েটি জানাল একটা বিপদে পড়ে বের হয়ে এসেছে। আমি যেন ওকে কাছাকাছি কোনো বাসস্টপেজে নামিয়ে দেই। তারপর নিজেই জানতে চাইল আমি কোথায় যাচ্ছি। ঢাকায় যাব শুনে বলল, অসুবিধা না থাকলে যেন আমিই ওকে ঢাকায় পৌঁছে দেই। তাহলে দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে পারবে। 
তুই কী বললি ? রাজি হয়ে গেলি ? 
হ্যাঁ। 
এত রাতে একা একটা মেয়েকে লিফট দেওয়া বিপজনক হতে পারে, তোর মনে হয় নি ? 
আমি তখন কী ভাবছিলাম জানি না আসলে। আবার মনে হচ্ছিল কোনো এক বিচিত্র ডাক শুনে আমি ঢাকা যাচ্ছি। আর কেউ একজন বিপদে পড়ে আমারই সাহায্য চাইচ্ছে—ঢাকা যাবার জন্য এটার কোনো না কোনো বিচিত্র যোগসূত্র থাকতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা, মেয়েটাকে এক নজর দেখে আর কণ্ঠ শুনে খুবই ভদ্র মনে হয়েছিল। সবার আগে ওর অসহায় অবস্থা নিয়েই আসলে আমি ভাবছিলাম, নইলে এত বাজে আবহাওয়াতে কে বের হয় বল? 
তারপর? 
তারপর আমি ওকে বাইকে তুললাম। আমার কাছে কোনো এক্সট্রা হেলমেট ছিল না। ও নিজের হলুদ রেইনকোটটাই ভালো করে জড়িয়ে নিল। আমার বাইকের পেছনে বসে যখন ও আমার কাঁধে হাত রাখল, সাথে সাথে আমি টের পেলাম আমার চারপাশ বদলে গেছে। বৃষ্টি থেমে যেতে শুরু করল একটু একটু করে। কোথা থেকে যেন বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাসের সাথে একটি মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আমি বাইক স্টার্ট দিলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমে আসতে থাকল। মনে হলো, কোনো একজন গল্পকার যেন বহু দূরে কোথাও নিজের ব্যাগ থেকে খাতাকলম বের করে আমার জীবনের কাহিনি নতুন করে লিখতে বসেছে। এবারের কাহিনিটা মন ভালো করার মতো হবে। আমার মনে হলো, আমার শরীরটাই যেন শুধু বাইকে আছে, বাকি সবকিছু বাতাসের মতো হালকা হয়ে গিয়েছে। চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার মনে হলো, আমার জীবনে অতীত বলে কিছু নেই, ভবিষ্যৎ বলেও কিছু না আসুক। শুধু এই পথচলা থাকুক অনন্তকালের মতো। 
এরপর কী হলো? 
আমরা কোথাও থামি নি। আমি শুধু বাইক চালিয়ে গিয়েছি, আর ও আমার বাইকের পেছনে আমাকে প্রচণ্ড শক্ত হাতে ধরে ছিল। যেন একবার হাত ছাড়লেই আমি ভিন্ন কোনো জগতে হারিয়ে যাব। 
তোরা ঢাকায় ফিরলি কখন?  
কোনো ধারণাই নেই। আমার শুধু মনে হয়েছে, কোনো এক ভিনগ্রহের লেখক আমার জীবনের গল্প লিখে যাচ্ছেন। যতক্ষণ না উনি লিখে শেষ করেন আমাদের দুজনকে এভাবেই ভ্রমণ করে যেতে হবে। পৃথিবীর সবকিছু পেছনে ফেলে। আর পাশাপাশি এটাও মনে হয়েছে যে, আমরা দুজনে মিলে একটা সুন্দর গন্তব্যে যাচ্ছি। 
মেয়েটি এখন কোথায় ? আর কী কথা হলো তোদের মাঝে? তুহিনের কথাগুলো শুনে আজগুবি লাগে বলেই হয়তো আমি প্রশ্ন করা বাড়িয়ে দিই। ও ক্লান্ত স্বরে বলে, ভোরের দিকে আমি ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়েছি। বাসা শান্তিনগরে। ঢাকায় আসার পুরো পথে মেয়েটি একবারই শুধু আমার সাথে কথা বলেছে। একটা উঁচুনিচু বাঁক পার হবার সময় বাজে রকমের ঝাঁকি খেয়েছিলাম। তখন মেয়েটি কণ্ঠে একইসাথে সংকোচ ও দুশ্চিন্তা মিলিয়ে বলেছিল, আপনি ঠিক আছেন? 
অল সেট। তাহলে তো হয়ে গেল বন্ধু। কবে দেখা করিয়ে দিচ্ছ আমাদের সাথে? দুই হাতে তুড়ি বাজিয়ে জানতে চাইল রবি।
সমস্যাটা এখানেই... একটু গলা খাকড়ে নিল তুহিন। তারপর ম্লান একটা হাসি দিয়ে বলল, মেয়েটির বাসায় ওকে পৌঁছে দিতে গিয়ে জানতে পারি ওরা দু বোন। শান্তিনগরে এটা ওর বড় বোনের বাসা। আর মেয়েটি পাঁচ বছর বয়সে নিজের বাকশক্তি হারিয়েছে। সাইন ল্যাগুঙ্গুয়েজে কথা বলে। নয়তো কাগজে লিখে। 
মানে ? আমি আর রবি কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এটা কীভাবে সম্ভব? তুই কি ড্রাঙ্ক নাকি?  
প্রশ্নই ওঠে না। গত তিন মাসে ছুঁয়েও দেখি নি। 
তুই কি শিওর, মেয়েটি আসলেই তোর সাথে কথা বলেছিল? ঠিকানা দিয়েছিল? 
শতভাগ নিশ্চিত আমি। জোর গলায় বলল তুহিন। তবে এই অভিজ্ঞতা দিয়ে যাবার কারণে আমি আসলে একটা বিষয় খুব স্পষ্টভাবে টের পেয়েছি। সেটা বলতেই তোদের দুজনকে ডেকেছি। 
কী সেটা? 
তোরা দুজন কি নিজেদের সারা জীবনের স্মৃতি মনে করতে পারবি? 
না...পারছি না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম আমি।
আমিও না। রবি বলল।

কারণ আমার ধারণা আমরা সবাই কাল্পনিক চরিত্র। কোনো না কোনো ছোটগল্পের চরিত্র। তাই আমাদের সাময়িক সময়ের স্মৃতি থাকলেও দীর্ঘ অতীত বলে কিছু নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন রাতে যেই লেখককে আমি আমার জীবনের গল্প নতুন করে লিখতে দেখেছি সেটা কোনো বিভ্রম ছিল না। বাস্তবতা ছিল। আমাদের সবার জীবনের কাহিনি লেখার জন্য কোনো না কোনো গল্পকার আছে। তারা লিখেও যাচ্ছে। বৃষ্টির রাতে মেয়েটি যে আমার সাথে কথা বলল, অথচ ওর বাকশক্তি নেই সেই পাঁচ বছর থেকে, এটাও কোনো কল্পনা নয়। বাস্তবতাই। হয় সেটা গল্পের কোনো গ্লিচ, কিংবা গল্পকার ইচ্ছে করেই গল্পের রুল ব্রেক করে মেয়েটিকে দিয়ে কথা বলিয়েছে, যেন আমার মাঝে বিস্ময় জাগে; যেন আমাদের দুজনের মাঝে যোগসূত্র সৃষ্টি হয়। সে দিনের গোটা রাতটা সেই গল্পকারেরই সৃষ্টি।

তার মানে কি আমরা সবাই গল্পের চরিত্র? গল্পের মাঝেই বেঁচে আছি? থমথমে স্বরে বললাম আমি। কিছু একটা ছিল আমার কণ্ঠে, যা লক্ষ করে রবি চমকে উঠল। খোলা জানালা দিয়ে হঠাৎ করেই যেন ঘরের ভেতর একটু বেশি হাওয়া বয়ে গেল।
তার মানে আমার চারপাশের সবকিছুই কাল্পনিক? সবকিছুই গল্প? আমি সত্যিকারের কেউ নই! এটুকু ভেবেই কিছুটা যেন শিউরে উঠলাম আমি। তুহিন সেটা লক্ষ করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে নরম স্বরে বলে উঠল, আহা। ভয় কী! গল্পই তো!  

Leave a Reply

Your identity will not be published.