আত্মজ।। ফারহানা সিনথিয়া

আত্মজ।। ফারহানা সিনথিয়া

মধ্যদুপুরের গনগনে রোদে বাইরে দাঁড়ানো বিমান দেখতে কেমন আগুন পাখির মতন দেখাচ্ছে। আমি আরেকবার তাকালাম। রোদে জ্বলজ্বল করছে সে ব্যাপারটা ঠিক আছে, তবে আগুন পাখির উপমা এখন আর উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। আমি হিথ্রো বিমানবন্দরের পাঁচ নম্বর টার্মিনালে বসে আছি, কস্তা নামের একটা কফিশপে। ক্যালগেরি থেকে ফ্লাইট ছেড়েছে রাতে।

আটলান্টিক পার হয়ে যে ফ্লাইটগুলো উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপের কোনো দেশে আসে সেগুলোকে বলে ‘রেড আই’ ফ্লাইট। আমি তেমন একটা রেড আই ফ্লাইটে ভোরবেলায় লন্ডনে অবতরণ করেছি। এর পরের গন্তব্য কাতারের দোহা বিমান বন্দর। রেড আই ফ্লাইটের যাত্রীরা ঠিক আমার মতো আধো ঘুমে ক্যাফেইনের সন্ধান করেন। আমার সামনে আধ খাওয়া একটা ক্রসো আর একটা ক্যাফে মোকা।

আমি মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছি। একটা নতুন গল্পের লেখা শুরু করেছি। গল্পটা সম্পাদনার প্রয়োজন। আমি গল্পের ভেতরে ডুবে গেছি এমন সময় মনে হলো কেউ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাকালাম।

আমার সামনে এক ক্লান্ত চেহারার ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তার কাঁধে একটা ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলছে আর বাম হাতে একটা খয়েরি আর সাদা রঙের কফি কাপ। তাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। নির্ঘুম রজনীর কারণে চট করে মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছি তাকে।

আমি ভদ্রতা করে একটা হাসি দিয়ে বললাম, হ্যালো কেমন আছেন?

ভালো আছি। আপনি ভালো?

জি। ভালো আছি। একটু জেগ ল্যাগ আছে।

আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?

অবশ্যই চিনেছি। প্লিজ বসুন, আমি হাসিমুখে আরেকবার মিথ্যা বললাম।

আমি দেখেছি একটা গেট টুগেদারে। ভদ্রলোক বিবাহিত। কথা কম বলছিলেন। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে কানাডা আনবার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। পুরো সন্ধ্যা এক কোনায় সাইড টেবিলের মতন চুপ করে বসেছিলেন। আমি তার নাম দিয়েছিলাম সাইড টেবিল। হঠাৎ করেই সাইড টেবিল ভদ্রলোকের নাম আমার মনে পড়ল। এই নামে বেশ কয়েকজন নায়ক চরিত্র হিন্দি সিনেমাতে ছিল। তার নাম রাহুল। তবে এই সাইড টেবিল হিন্দি সিনেমাতে বড় জোর নায়কের আঁতেল বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারবেন।

আমি এবার হেসে যোগ করলাম, আপনাকে আমি চিনেছি রাহুল ভাই। আপনিও নিশ্চয় আমার মতো দেশে যাচ্ছেন। আপনার নেক্সট স্টপ কোথায়?

আপনি ঠিক ধরেছেন। লন্ডন থেকে দুবাইগামী ফ্লাইটে আমি উঠব। দুবাই থেকে ঢাকা। মাঝখানে প্রায় আট ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। আমি চাইলে একটা লাউঞ্জে বসতে পারতাম। তবে লাউঞ্জে হাত-পা ছড়িয়ে বসার আজকাল সুযোগ নেই।

আমি লাউঞ্জ নেব তবে সেটা দোহাতে। লন্ডনে লাউঞ্জ নিতে ইচ্ছে করে নি এজন্যই। এমনিতেও দীর্ঘ বিমান যাত্রার পরে যে-কোনো মানুষের চেহারা শাকচুন্নীর মতো হয়ে যায়। এজন্য আমি দোহাতে একটু ফ্রেশ হতে চাই। ওখানে শাওয়ার নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

কিছু কিছু মানুষের জন্মই যেন হয়েছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো ছেলের তকমা লাগিয়ে। তারা মেয়েদের দেখলে মাথা নিচু করে বসে। এদের গলার আওয়াজ ঘরের অন্য কোনো থেকে ঠিকমতো শ্র“তিগোচর হয় না। এরা গরমের দিনেও ফুলহাতা শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট পরে দাওয়াত খেতে যায়।

প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে সাইড টেবিল আবার চুপ হয়ে গেলেন। এমন নয় তার সঙ্গে আমার অনেকদিনের বন্ধুত্ব। এখন তার সঙ্গে আমি কতক্ষণ গল্প করব? একা থাকলে আমি গল্প সম্পাদনা শেষ করতে পারতাম। আমি একটু শঙ্কিত বোধ করলাম। বাকি আট ঘণ্টা কি তিনি সিন্দাবাদের ভূতের মতন আমার ঘাড়ে চড়ে বসবেন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আপনার স্ত্রীকে আনতে দেশে যাচ্ছেন?

না। আমি আসলে একেবারে বাংলাদেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এদেশে প্রবাসী বাঙালিরা মুখে বললেও সচরাচর পাকাপাকি দেশে ফেরত যান না। গেলেও খুব দ্রুত তাদের হতাশা গ্রাস করে। পুরোনো বন্ধুবান্ধব যারা দেশে গেলে দেখা করতে হাজির হন তারা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ঢাকা পৃথিবীর ব্যস্ততম শহর। সেখানে আক্ষরিক অর্থেই সময়ের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই। বিদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে যারা অভ্যস্ত হয়ে যান, দেশে তারা আর থিতু হতে পারেন না।

নস্টালজিয়া আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরার কথা ভাবলেও বিভিন্ন কারণেই দেশ আর কখনোই কারও স্থায়ী নিবাস হয় না। ফেলে আসা আবেগের ওপর নির্ভর করে আসলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। স্মৃতি অনেক সময় আমাদের সাথে প্রতারণা করে। অতীতের মোহিনী যে দৃশ্য স্মৃতি আঁকে তা অনেক সময় নস্টালজিয়া নামক ফিল্টারে এডিট করা নিখুঁত একটি ছবি।

আমি আমার এসব ধারণা পাশ কাটিয়ে তাকে বললাম, বাহ! সে তো খুব চমৎকার ব্যাপার। অনেকেই হয়তো আপনাকে বলবেন ডিসিশনটা ঠিক হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় ফেরত গিয়ে আপনি ঠিক করছেন। ভবিষ্যতে কখনো মনে হবে না সুযোগ ছিল অথচ পুরো  জীবন আপনি প্রবাসে কাটিয়ে দিলেন।

তিনি একটা বিষাদগ্রস্ত হাসি দিয়ে বললেন, আমি স্বেচ্ছায় ফেরত যাচ্ছি না। বলতে পারেন বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছি। আমার স্ত্রী আর সন্তানের ভিসার ব্যাপারে কিছু জটিলতা হয়েছে। এখন ওদের নিয়ে আসা  সম্ভব হচ্ছে না। এজন্যে আমি স্থির করেছি আমি নিজেই বাংলাদেশে ফেরত যাব।

আপনার বাড়ি এখানে কি খালি পড়ে থাকবে?

নাহ। ঢাকা থেকে আমি বছরের পর বছর মর্গেজ পেমেন্ট টানতে পারব না। আপাতত একটা রেন্টাল এজেন্সিকে দিয়ে যাচ্ছি। তারা ভাড়াটিয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাকে অফিস থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার একটা সুবিধা দিয়েছে। আমি দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে থেকেও কাজ করতে পারব। চাকরি থাকবে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করাটা নিঃসন্দেহে অনধিকারচর্চা। পুরো ঘটনা শুনেই আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা দুঃখজনক। একজন সন্তানের কাছ থেকে বাবাকে আলাদা করবার যে ইমিগ্রেশন আইন সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আবার অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাতেও অস্বস্তি হচ্ছে।

এতক্ষণ আমি তাকে উটকো ঝামেলা ভাবছিলাম। তার কথায় আমার মন আর্দ্র হলো। কথায় কথায় আমাদের কফির কাপ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমি ঘড়ি দেখলাম, আমার ফ্লাইটের বাকি আছে চার ঘণ্টা। ক্লান্তি স্বত্ত্বেও ক্ষুধার অনুভূতি তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এবার আমি ভদ্রতাবশত নয় আগ্রহ নিয়েই তাকে বললাম আমরা লাঞ্চ করতে টিজিআই ফ্রাইডে নামের একটা রেস্তোরাঁয় বসতে পারি। এয়ারপোর্টের ভেতরেই রেস্তোরাঁ আছে।

টিজিআই ফ্রাইডে আসলে আমেরিকান একটা চেইন রেস্তোরাঁ। মজার ব্যাপার হচ্ছে যেই সার্ভার আমাদের খাবার পরিবেশন করছেন তিনি নিখুঁত ব্রিটিশ এক্সেন্টে ইংরেজি বলছেন। আমরা দুজন কানাডা থেকে এসেছি। গন্তব্য আবার বাংলাদেশ। এয়ারপোর্টের মতো বৈচিত্র্য বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় দেখা যায় না।

খাবারের জন্য আমরা দুজনেই অপেক্ষা করছি। আমি বললাম, আমার ফ্লাইট ছাড়তে আর প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক আছে। আপনার কতক্ষণ পরে ফ্লাইট?

আমার হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই। দুই ঘণ্টা পরেই ফ্লাইট।

তাহলে তো হাতে বেশি সময় নেই আপনার। এখানে খাবার দিতে দেরি করলে?

তিনি আমাকে অভয় দিয়ে হেসে বললেন, আপনার ঠিক পেছনে একটা বড় স্ক্রিনে আমি ফ্লাইট ইনফরমেশন দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা ঠিক সময়েই উঠব।

এসব কথার মাঝে সার্ভার মেয়েটি এসে খাবার দিয়ে গেল।

তিনি বললেন, আমি এত গরম খাবার খেতে পারি না। অপেক্ষা করছি ঠান্ডা হবার জন্য। যে মেয়েটি আমাদের খাবার দিয়ে গেল তার চেহারা আমার বাড়ির ভাড়াটিয়ার মতো। তবে মেয়েটি ইউক্রেইন থেকে এসেছে।

বলেন কী? ইউক্রেনের যুদ্ধাক্রান্ত দেশের রিফুইজিদের দেখলে আমার মায়া লাগে।

আপনার ধারণা এদের অর্থাভাব আছে। যারা এসেছে তাদের অধিকাংশ মানুষ অর্থাভাবে আছে। সরকার তাদের সাহায্য করছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে।  প্রথম ধাক্কায় বেশ কিছু ধনবান লোকও এসেছে। যাদের প্রথম কাজ দামি গাড়ি, ফোন আর গ্যাজেটস কেনা। আপনি আমার ভাড়াটিয়াকে দেখলে একটা ধাক্কা খাবেন।

একথা ঠিক। বিপজ্জনক পরিস্থিতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ ধনবান লোকজন সবার আগেই পেয়ে যান। আমি রিফিউজিদের নিরাপদ আশ্রয়  দেওয়ার বিপক্ষে নই। তবে অভিবাসী আইন নিয়ে আমার একটু সমস্যা আছে। যারা ইকোনমির চাকা সচল রাখছে তাদের পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন করে রাখাটা আসলে অন্যায়।

ব্যাপারটা অত সরলও নয় যতটা আপনি ভাবছেন। বলে তিনি মুখ মুছলেন। এর পর যোগ করলেন, আমার ব্যপারটা আলাদা। আমার বিয়ে হয় কোভিডের শুরু দিকে, ২০২০ সালে । আমার বিয়েটা এরেন্জড ম্যারেজ। আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ভালো ছেলে হবার সুবাদে প্রেম করার সুযোগ পাই নি। তাছাড়া দেশের বাইরে থাকার স্ট্রাগল আপনি জানেন। আমি  অন্তর্মুখী মানুষ। প্রথমে পড়াশোনা, তারপরে চাকরির সন্ধান আর সবশেষে কানাডায় স্থায়ী হওয়া এই বাদে কোনো কিছুতে মন দেওয়ার সময় আমার ছিল না।

আমি মার্চ মাসে দেশে গেলাম বিয়ে করতে। গিয়ে আটকে পড়লাম। ফিরতি ফ্লাইট পাওয়া তখন অসম্ভব। আমার অফিস তেমন সমস্যা করল না। বিয়ের পরে প্রায় দুই মাস আমি বাংলাদেশে ছিলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া চমৎকার ছিল। করোনার সময়ে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকত। আমরা দুজনে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তাম। ও সামাজিকতা থেকে শুরু করে সবকিছু সুন্দর মেইনটেইন করত। 

বিরক্তিকর আত্মীয়স্বজন প্রতিটা বাঙালি পরিবারে থাকে। আমার মায়ের বেশ কয়েকজন ভাইবোন। এদের প্রধান কাজ যে-কোনো ইস্যুতে ঝামেলা লাগানো। এর আগে আমার এক কাজিনের বিয়ে হলো। তাদের হানিমুনের ছবি নিয়ে রীতিমতো বিচারসভা বসল। ভাবির পোশাক দেখে নাকি আমার এক মামির মনে হয়েছে মুসলমানের সন্তান এমন পোশাক পরতে পারে না। অথচ সেই মামির সন্তান বিদেশে এক তরুণীর সাথে লিভ টুগেদার করছে। আমি সব জানতাম।

আমার মামা আর খালারা করোনার প্রাদুর্ভাবে আমাদের বাড়িতে আসতেন না। শাপে একেবারে বর হয়েছিল। আমার বিয়ের ঠিক কিছুদিন পরেই লকডাউন ঘোষণা হয়।

রাতের বেলা অফিস। কারণ বাংলাদেশের সাথে কানাডার বারো ঘন্টা পার্থক্য। দিনের বেলা আমরা সারা দিন নেটফ্লিক্স দেখতাম। আমাদের পছন্দের মুভিগুলোও একরকম। যাই হোক আমার আনন্দের দিন এক সময় শেষ হয়ে এল। কানাডার সরকার দেশের বাইরে আটকে পড়া কানাডিয়ানদের জন্য একটা চার্টার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করল। আমি সেই বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এলাম।

আমি ফেরত এসে আমার স্ত্রীর ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করলাম। আমি এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কানাডায় ফেরত আসি। প্রায় মাস চারেক কেটে গেল। আমার স্ত্রী আমাকে চমৎকার একটা উপহার দিল। আগস্ট মাসের এক তারিখে আমার জন্মদিন। সেদিন সে আমাকে ভিডিও কলে জানাল সে প্রেগন্যান্ট। এত সুন্দর জন্মদিন আর কখনো আসে নি। আমি ভাবলাম এই জন্মদিন আমার বাবা হিসেবেও প্রথম জন্মদিন।

অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। তবে ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন তখন বিদ্যমান। এদিকে আমার ইচ্ছে করছে দুইদিনের বধ্যে বাংলাদেশ গিয়ে পৌঁছুই। যেহেতু অনেকদিন দেশে থেকে এসেছি এখন ছুটির আবেদন করা একেবারেই সম্ভব নয়। আমি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াই। তবে আমার মন খারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার স্ত্রী নিশা প্রতিদিন আমাকে ফোন করে। প্রেগন্যান্সির পুরো সময় ওর বাবার বাড়িতে ছিল নিশা। আসলে আমি দেশ ছাড়ার পরে ও আর আমাদের বাড়িতে তেমন থাকেও নি। আমারও ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে। আমি ভেবেছি উটকো আত্মীয়দের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যই ও বাবার বাড়িতে থাকে।

এরপর আমার ছেলের জন্মের সময় আমি কাউকে না জানিয়ে উপস্থিত হই। খুব কম সময়ের জন্য ছুটি পেয়েছিলাম। নিশা আমাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেঁদে ফেলেছিল। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার ছেলের নাম রাখা হলো রাতুল। আমার স্ত্রী নিজেই এই নাম পছন্দ করে রেখেছিল। অনেকদিন পরে আমি বুঝেছিলাম সেই কান্নার আসল কারণ ছিল আমার ভাবনারও অতীত।

একথাগুলো বলে তিনি থামলেন। হেসে বললেন, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার।

তিনি মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছেন। আলফ্রেডো সস দেওয়া পাস্তা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কাটাচামচে পেঁচিয়ে মুখে তুলছেন। খাবার সময় সব মনোযোগ প্লেটের দিকে।

আমার খাওয়া শেষ। এতক্ষণ তিনিই গল্প করছিলেন। আমি মনোযোগী শ্রোতা।

তিনি বললেন, আমি গল্পটা শেষ করি। যেহেতু আমার সন্তানের জন্ম আমার বিয়ের এক বছর পরে, তাই তাকে আবার আমাদের ইমিগ্রেশন ফাইলে যুক্ত করতে হলো। এমন নতুন কোনো পরিবর্তন হলে ইমিগ্রেশনে সেই ফাইল একটু পিছিয়ে যায়। যাই হোক যথা সময়ে ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে দিলেন আমার স্ত্রী। সেই সময় কানাডা পোস্টের সার্ভিস অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছিল। ফেডেক্স বা ডিএইচএল দিয়ে পাঠানো বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। আবার আমার কাছে এলেও সেটা আবার ইমিগ্রেশনে পাঠাতে সময় লাগবে।

নিশা এই সমস্যার একটা সহজ সমাধান দিল। বার্থ সার্টিফিকেট ও নিজেই পাঠাবার ব্যবস্থা করল। এখন শুধু হাসপাতালের বার্থ সার্টিফিকেট দিয়ে কাজ হয় না। সিটি কর্পোরেশন থেকে নিবন্ধিত সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। এসব জোগাড় করতেও বেশ সময় লাগে। নিশা পাঠানোর পরে আমি ধরে নিলাম খুব দ্রুত একটা ডিসিশন আসবে। প্রথমবার যে এপ্লিকেশন করেছিলাম যা গৃহীত হয়েছিল। এখন ইমিগ্রেশন কানাডা শুধু এই বার্থ সার্টিফিকেট চেয়েছে। পুরো প্রসেসিং টাইম হয়তো এক বছরের ওপরে লাগত। রাতুলের জন্য আরও বেশি সময় লাগছে। এছাড়াও অতিমারির কারণে দেখা যাচ্ছে সব সরকারি অফিসের কাজ পিছিয়ে গেছে।

আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন সেই কাক্সিক্ষত চিঠি আসবে। শরতের এক শীতল সন্ধ্যাবেলাতে আমি মেইলবক্স চেক করে দেখলাম, ইমিগ্রেশন কানাডার চিঠি। তবে সেই চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে একটি প্যাটার্নিটি টেস্টের। অর্থাৎ ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণ করতে হবে আমি ওর জন্মদাতা।

কারণ হিসাবে তারা জানালো বার্থ সার্টিফিকেটের অসঙ্গতি। আমি দেখলাম সিটি কর্পোরেশন থেকে দেওয়া বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নামের বানান ভুল। আর স্থায়ী ঠিকানাও মেলে নি। যেহেতু জমা দেওয়ার আগে ডকুমেন্ট আমি দেখার সুযোগ পাইনি এত বড় দুটো ভুল কেউ লক্ষ করে নি।  আমি নিশাকে ফোন করে রাগারাগি করলাম। এ যেন তীরে এসে তরী ডোবার মতন ব্যাপার। যাই হোক ডিএনএ স্যাম্পল জমা দিতে আমি আবার বাংলাদেশে গেলাম। সেখান থেকে আমার আর রাতুলের স্যাম্পল ভারতের একটা ল্যাবে পাঠানো হলো। বারবার দেশে গিয়ে আমার সঞ্চয়ে টান পড়ছে। আমি জানি নিশা একেবারে চলে এলে অনেক খরচ বাড়বে। আমি ঠিক করলাম দেশে অপেক্ষা করব। টেস্টের  রেজাল্ট আসার আগে পর্যন্ত।

আমাকে ইমেইল করে ইমিগ্রেশন কানাডা জানাল, আমাদের দুজনের ডিএনএ পরীক্ষার রেজাল্টে এসেছে আমি রাতুলের জন্মদাতা পিতা নই। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ধরেই নিলাম কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ভুল তো হতেই পারে। হয় না বলুন?

যাই হোক আমি নিজের খরচে আবার ডিএনএ টেস্ট করতে দিলাম আবার নিশ্চিত হতে। এবারের ফলাফলও এক। আমার মাথায় এই পর্যায়ে আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার কানাডা ফেরত যাওয়ার ফ্লাইট ঠিক তার পরদিন ভোরে। এই ধরনের রিপোর্ট আসার একটাই অর্থ এটা এক ধরনের ইমিগ্রেশন ফ্রড।

আমি সরাসরি আমার স্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম এসবের অর্থ কী! দুইবার টেস্টের রিপোর্ট ভুল আসতে পারে না। আমার কঠিন জেরার মুখে সে স্বীকারোক্তি দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে ফাঁসির আদেশ পড়ে শোনাচ্ছিল কেউ। আমি প্রথমবার যখন বিয়ের পরে কানাডাতে ফেরত আসি ও তখনো ওর পুরোনো প্রেমিককে ভুলতে পারে নি। ওর দাবি অনুযায়ী এক দুর্বল অসতর্ক মুহূর্তের ফসল হচ্ছে রাতুল।

দেশে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই জানেন? চিৎকার করে ঝগড়া করতে পারলেও শান্তি হতো আমার। এইসব ঝগড়া চার দেয়ালের মধ্যেই রইল। আমি ঠিক করলাম একেবারে কানাডা ফেরত চলে যাব। গিয়েই নিশাকে ডিভোর্স লেটার পাঠাব।

আমি সারা রাত বারান্দায় বসে সিগারেট টানলাম। আমার অবস্থা চিন্তা করুন। বার কয়েক বারো তলার বারান্দা থেকে নিচে তাকালাম। এখান থেকে লাফ দিলে খুলি ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে। পর মুহূর্তে আমার মায়ের কথা চিন্তা করলাম। নিশাও পুরো রাত নির্ঘুম আমার মতো বসেই কাটাল।

এই যুগের মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। দিনের পর দিন এই মেয়ে আমাকে ঠকিয়েছে। ওকে আঘাত করলে বোধ হয় আমার মনে  কিছুটা শান্তি আসত। ঘরে ঢুকে দেখি, পরম মমতায় রাতুল ওর মায়ের আঙুল জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।

আমি নিশাকে বলে দিলাম আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি। ও রাতুলসহ ওর পুরোনো প্রেমিকের কাছে ফেরত যেতে পারে। উত্তরে নিশা জানাল সেই লোক এখন বিবাহিত। আর এই সন্তানের স্বীকৃতি সে দিতে অস্বীকার করবে।

ভোরের দিকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল জানেন। রাতুল বারো মাস বয়স অব্দি কোনো কথা বলে নি। আমি শেষবারের মতন রাতুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালাম। প্রতারণার জলজ্যান্ত রূপ যেন দেখছি। আমি সুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বের হব ও তখনই প্রথম শব্দটা বলল। সেই শব্দ ছিল ‘বাবা’। আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি শুরু করল। এতটুকু শিশু কী বুঝেছিল কে জানে! তবে সেই কান্না আজন্ম বিচ্ছেদের কান্না। এটুকু বলে তিনি থামলেন।

তিনি বললেন, আমরা একটা মানব সন্তানকে পৃথিবীতে এনেছি অথচ ওকে জিজ্ঞেস করা হয় নি ও আসলে কাকে চায়। আমি ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে টিকেট বদলাতে বললাম। এর পর থেকে নিশার সঙ্গে আমার স্বাভাবিক সম্পর্ক আর নেই। থাকা উচিতও নয়। আমিও তো একজন মানুষ;  এত বড় প্রতারণা কী করে মানি বলুন? তবে রাতুলের মায়া আমি ছাড়তে পারলাম না। কিছু বন্ধন যেন অদৃষ্টের লিখন। তা ছেদ করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয় নি।  কাগজ-কলমে আমরা এখনো স্বামী-স্ত্রী। তবে আমি ওদের কানাডা আনতে পারব না। এজন্য আমি দেশে ফেরত যাচ্ছি।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, বিদেশে অনেক বাবার ভূমিকা শুধু জন্মদাতা হওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। শুধু সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলেই বাবা হওয়া যায় না। আপনার জীবনের গল্প বড় অদ্ভুত। একটা ব্যাপার জানেন, প্রকৃতি অন্যায়  করে কাদের সাথে? যারা অন্যায় করে কম, কারও ক্ষতি করেন না—তাদের সঙ্গে প্রকৃতি মাঝে মাঝে সীমাহীন অবিচার করে। আমি নিশ্চিত বলতে পারি রাতুলের জন্মদাতার চেয়েও ভালো বাবা আপনিই হয়েছেন।

তিনি মনোযোগ দিয়ে প্লেটের বাকি পাস্তা শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমার দেখায় ভুল হতে পারে তবে তার দুই চোখ লাল।

একটু পরে বললেন, আপনাকে অবলীলায় এই গল্প বললাম ভেবে অবাক হচ্ছেন, না? এই গল্প আমার অফিসের এইচআরকে বলতে হয়েছে। আমি কিছুদিন চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। তারপরে একজন কাউন্সেলিং সাইকলজিস্টকেও বলেছি। তবে আমার পরিবারপরিজন বা বন্ধুবান্ধব কেউই কিছু জানে না। আপনার কাছে নকল জীবনে পদার্পণের আগে কথাগুলো বলতে পেরে ক্লান্তি কমেছে। দীর্ঘদিন কাউন্সেলিংয়ের পরে আমি এখন একজন সুস্থ মানুষ। নাটক-সিনেমায় দেখায় না হুট করে সব ঠিক হয়ে যায়? আসলে কোনো কিছুই ঠিক হয় না।

আমি বললাম, আপনার মন শান্ত হোক। আমি মন থেকে আপনার জন্য প্রার্থনা করব।

তিনি হেসে বললেন, ধন্যবাদ। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে। গেট এখান থেকে বেশ দূরে।

তিনি হাত ধুতে ওয়াশরুমে গেলে আমি বিল চুকিয়ে দিলাম। তিনি বের হয়ে বললেন কেন আমি এমন করলাম।

আমি হাসিমুখে বিদায় দিলাম তাকে। আমার কেন যেন মনে হলো আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। তবু একটা মিথ্যে জীবন কাটানোর আগে তিনি জীবনের চরম সত্য একজন স্বল্প পরিচিতার কাছে বলেছেন। কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্তি পেয়েছেন। তিনি যে পথটাকে সহজ পথ হিসাবে বেছে নিয়েছেন সেই একই পথ ভীষণ বন্ধুরও বটে।

মানুষ মাত্রেই অভিনয় করে। আমরা প্রায়ই অন্যদের সাথে বাধ্য হয়ে অভিনয় করি। সেটা প্রয়োজনের তাগিদে অথবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। সবচেয়ে কঠিন অভিনয় মানুষ করে নিজের সঙ্গে। নিজের সঙ্গে অভিনয় করার চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার বোধ করি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমার তাকে দেখে মনে হলো, একজন পাকা অভিনেতা এখন মঞ্চে পদার্পণ করবেন। ঠিক তার আগ মুহূর্তে পর্দার এপাশে যেন আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়েছে। মঞ্চে যে আত্মবিশ্বাসী মানুষকে সবাই দেখবে সেই মুখোশ মুখে লাগানোর ঠিক আগের মুহূর্তে আমি তার অন্যরূপ দেখছি। মুখোশহীন মুখে যে লজ্জা, দ্বিধা, ভয় আর অনিশ্চয়তার ছাপ তা দেখে আমার মায়া হচ্ছে।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.