শেষের কবিতা।। শানজানা আলম

শেষের কবিতা।।  শানজানা আলম

দেশে ফিরেছি প্রায় দশ বছর পরে। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরলে যা হয় আর কী, প্রবাসীদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়! আত্মীয়স্বজন মুরব্বিদের সবার সাথে দেখা করা শেষ করেছি একে একে।

সবার একই কথা! এবার সংসারী হও! আমাকে সংসারী করতে বাবা-ভাইজানেরও ঘুম নষ্ট অবস্থা! রাতদিন এখানে ওখানে মেয়ে দেখে বেড়িয়েছেন কয়েকদিন। আমি আর এসব নিয়ে ভাবছি না, ভাবার লোকের যখন অভাব নেই, কী দরকার অযথা মস্তিষ্কে চাপ নেওয়ার! ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। এমনি একদিন স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরতে দেরি হয়েছিল, বাড়ির সবার খাওয়া শেষ হয়েছে আগেই। বহুমূত্রে আক্রান্ত বাবা-মা খেয়ে নেন ঘড়ি দেখে। ভাইজান ব্যবসায়ী মানুষ, সকালে উঠতে হয়, তাই তিনিও রাত জাগেন না। অগত্যা ডাইনিংয়ে একাই বসেছিলাম খেতে। বড় ভাবি পাশে এসে নিচু স্বরে বললেন, অমিত, লাবণ্য এসেছে।

এক মুহূর্তে থমকে গেলাম। লাবণ্য! নামটা বড্ড চেনা ছিল, খুব কাছের, আর সেই মানুষটাও। তবে এখন সেসবই অতীত।

লাবণ্য আমার কেউ না, কেউ হতেই পারে না।

স্বয়ং রবীঠাকুরই লাবণ্যকে অমিতের হতে দেন নি!

কিন্তু না, আমি ‘শেষের কবিতা’র ব্যারিস্টার অমিত রায় নই, আমি অমি, অমিত হায়দার।

তবে খুব ভালো হতো যদি আমি ‘অমিত রায়’ হতাম, তাহলে অন্তত ধর্মের দোহাই দিয়ে লাবণ্য চ্যাটার্জিকে আমার কাছ থেকে কেউ আলাদা করে নিতে পারত না।

নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমাদের পার্থক্যটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল! লাবণ্য সন্ধ্যায় গৃহদেবতাকে আরতি দেয় আর আমি নত হই আমার জায়নামাজে। খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, এখন বুঝি। তবে বুঝি নি আজ থেকে পনেরো বছর আগে, যখন আমি উনিশ’ আর লাবণ্য ষোলোতে ছিল।

স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে চোখাচোখি, তখনো জানতাম না ও অন্য সম্প্রদায়ের। আমাকে লাবণ্য অমিত নামেই চিনত, তাই আমার নামটা ওকে বিভ্রান্ত করেছিল। আমাদের দেশে তো নামেরও হিন্দু-মুসলিম ভেদ আছে। সেটা হয়তো আমার জন্মের সময় আমার বাবার মাথায় ছিল না। তাই ছেলের নাম অমিত হলে, ভবিষ্যতে কেউ থাকে সনাতন ধর্মাবলম্বী ভেবে ভুল করতে পারে, এটা তিনি বোঝেন নি।

কিন্তু  লাবণ্য যখন পরিচয় জানল, তখন আর পেছনে ফেরার উপায় নেই। কারণ আমরা দুজনেই দুজনকে বড্ড ভালোবেসেছিলাম। একদিন একবেলা দেখা না হলে আমাদের দমবন্ধ লাগত। অথচ যুগ পেরিয়েছে, আমরা দেখি নি কেউ কাউকে। প্রথম দিকে আমার মনে হতো, এই পৃথিবীকে ভেঙেচুড়ে ফেলি অথবা নিজেই মরে যাই। না তখন পৃথিবী ভাঙার শক্তি ছিল আর না নিজে  মরার সাহস!

তবে সাহস একেবারে ছিল না তা নয়, লাবণ্যকে যখন বললাম, চলো, আমরা নিয়ম ভাঙি! সব নিয়ম কি মানতেই হবে? লাবণ্য আমার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়েছিল।

দুটো দিন আমরা অজানার পথে হেঁটেছি, এক বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়িতে কয়েকদিন থাকার পরে তারা যখন জানতে পারল আমাদের বিষয়ে, গোপনে খবর দিয়ে দিল আমাদের বাবা-মা কে। অগত্যা আবার পালাতে হলো আমাদের, কিন্তু পালাতে গিয়ে টের পেলাম, না আমাদের অর্থ আছে আর না লাবণ্যকে রক্ষা করার ক্ষমতা!

হোটেল রুমে থাকার সময় খেয়াল করলাম আশপাশের লোলুপ দৃষ্টিগুলো লাবণ্যকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে। যেন যে-কোনো মুহূর্তে হামলে পড়বে আমার লাবণ্যের উপরে।

শেষে আমিই বললাম, চলো ফিরে যাই। কুকুরের মুখে তোমায় রেখে আমি তো কাজেও নামতে পারছি না।

অশ্রু আটকে রেখে লাবণ্য সায় দিয়েছিল! আমরা আবেগকে সমর্পণ করে দিয়েছিলাম বাস্তবের কাছে।

ফিরে আসার পরে আমাদের কারোই পথ চলা সহজ হয় নি। লাবণ্যের বাবার অপহরণ মামলা থেকে লাবণ্য আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল এই শর্তে, আমাকে এলাকা ছাড়তে হবে। আমি চলে গেলাম প্রথমে ঢাকায়, তারপরে মধ্যপ্রাচ্যে। গল্পটা সেখাতে ইতি টানতে হয়েছিল।

লাবণ্যকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বর্ডারের ওপারে, ওদের সেকেন্ড হোম, কলকাতার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়। আর কোনোদিন জানতে পারি নি, লাবণ্য কেমন আছে।

আচ্ছা এখন কেমন আছে লাবণ্য, বিয়ে করেছে? এতদিনে নিশ্চয়ই মা হয়েছে! ওর বাচ্চাগুলো কি ওর মতোই হয়েছে! লাবণ্য নিশ্চয়ই এখন সিঁদুর পরে!

আমাকে কী আবদার করেই না বলেছিল, তোমার জন্য সব ছাড়ব, কিন্তু আমাকে প্লিজ সিঁথি রাঙাতে না কোরো না! ওর আবদারেই ওর সিঁথি রাঙিয়েছিলাম ওর আনা সিঁদুরে। আমার বিশ্বাস না থাক, ওর বিশ্বাসে ও আমার স্ত্রী হোক!

কত কথা মনে এসে ভিড় করে, কিন্তু জানার সাহস হয় না। আধখাওয়া প্লেট ঠেলে উঠে পড়ি।

ভাবি বললেন, অমিত, তোমার জন্য মেয়ে দেখা হয়েছে, সেখানেই বিয়ে করবে, সবটা ঠিকঠাক হয়েছে সেটা তো জানোই, আর কোনো কথা সেখানে যেন না তোলা হয়।

আমি আর কী কথা তুলব, তোলার কী আছে! কে শুনবে তুললে! এসব অবশ্য বাইরের কথা, আমার ভেতরে অনেক কথাই বলার বাকি আছে, মনে হয় লাবণ্যকে গিয়ে বলি, এখন আর কাউকে আমি ভয় পাই না, আসবে আরেকবার ঝড়ো বৃষ্টির মতো বুকে ঝাঁপিয়ে! 

সোনাডাঙার হোটেলে সেই ছোট্ট বদ্ধ ঘরটায়, ঝুলতে থাকা ময়লা মশারি, পায়াভাঙা চেয়ার, দেয়ালে ঝুলতে থাকা আগের বছরের ক্যালেন্ডার আর টিকটিকি দুটো, সব অগ্রাহ্য করে যেভাবে লাবণ্যকে ভালোবেসেছিলাম, আরেকবার বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

মনটা বড় বেপরোয়া, তাকে মানাতে পারলাম না। সাহস করে তাই লাবণ্যের বাড়ির সামনে চলে গেলাম। বাড়ির সামনেই একটা পুকুর ছিল, সেখানে ছিল ভাঙা ইটের ঘাট। এখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম, লাবণ্য কখন বের হবে, সেই আশায়।  এদিকে শহর বেড়েছে, এখন পুকুর ভরাট হয়ে মার্কেট উঠেছে। 

দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক কতক্ষণ আমার হিসেব নেই।

হয়তো আমার পরম করুণাময় অথবা লাবণ্যের ঈশ্বর আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই তাকে আমার সামনে পাঠালেন। পাঁচ বছরের একটা মেয়ের হাত ধরে লাবণ্য কিছু কিনতে বের হয়ে এসেছে।

বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত আমার জন্য, লাবণ্যকে দেখব!

তবে ও আমাকে খেয়াল করে নি। মেয়ের আবদার শুনতেই মনোযোগী ছিল। আমিই ডাকলাম, লাবণ্য!

লাবণ্য প্রচণ্ড চমকে আমার দিকে তাকাল।

লাবণ্য বড় করে কাটা ব্লাউজের সাথে সোনালি পাড়ে কালো শাড়ি পরা! গলায় পাতলা একটা স্বর্ণের চেইন! নাকের পাশের তিল দুটো এখনো আছে! চোখের পাপড়িগুলো ভাঁজ হয়েছে শৈল্পিকভাবে, যা তার দৃষ্টিকে আলাদা করে সকলের থেকে! হাতে সোনা বাধাই করা শাখা পলা!

সেই লাবণ্য, সে নিজের সমাজ সংসার ছেড়েছিল যবনের ছেলের হাত ধরে। তারপর ছেড়েছে দেশ, ভিটেমাটি বাবা-মা! কেমন থাকে লাবণ্য ওখানে! সবকিছুর জন্যই কি আমি দায়ী নই!

নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটে অচেনা হাসি ফুটিয়ে লাবণ্য বলল, কেমন আছেন আপনি? আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে শুনলাম!

আমার বিয়ের কথা শুনেছে, তার মানে নিজেই শুনতে চেয়েছে আমার কথা!

উত্তরে বললাম, ভালোই, তুমি?

ভালো, বেশ ভালো!

লাবণের কথায় ওপারের টান স্পষ্ট।

এটা কে? তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, অর্চিতা!

তোমার বর? এসেছেন? কোথায় থাকে উনি?

ও ব্যাঙ্গালরে চাকরি করছে, আমিও সেখানেই থাকি! আসে নি এবারে!

ওহ আচ্ছা! ভালো আছো তাহলে?

হ্যাঁ, চলছে ঠিকঠাক! 

আসো এদিকে নিয়মিত?

না খুব একটা নয়, দু’ বছরে একবার, এমন!

আচ্ছা।

আপনি এবারে পাকাপাকি ফিরে এলেন?

হ্যাঁ, সেরকমই ভাবছি!

হ্যাঁ, বহুদিন তো থাকা হলো ওখানে, এবারে স্থায়ী হোন, সংসার করুন, শেকড় হোক! আজ আসছি তবে!

আচ্ছা। 

চলে যাচ্ছিল, আরেকবার পিছু ডাকলাম, লাবণ্য!

মনে হলো, আরেকবার শুধাই, আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি!

লাবণ্য পেছন ফিরে ঈষৎ হাসল। সেই হাসি যেন আমাকে অব্যক্ত স্বরে বলল, তোমারে যা দিয়েছিনু, সে তোমারি দান! গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়!

সন্ধ্যা নামছে, আশপাশের বিপণি বিতানের ঝলমলে আলো অন্ধকারকে স্থান দিচ্ছে না।  তবুও অন্ধকারকে তো অস্বীকার করা চলে না। আজ এই সন্ধ্যায় আমি উপলব্ধি করলাম, আমাদের জীবনটাও এমন, চারপাশের কৃত্রিম আলো দিয়ে আমরা অন্ধকারকে অস্বীকার করে চলি প্রতিনিয়তই। 

লাবণ্য ভালো থেকো। আমার পথে আমি হেঁটে চললাম পুনরায়।

Leave a Reply

Your identity will not be published.