নীল ধ্রুবতারা (চতুর্থ পর্ব)

নীল ধ্রুবতারা (চতুর্থ পর্ব)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।]

সিমির দীর্ঘ চিঠিটি বেশ কয়েকবার পড়ল ফাহিম।

চিঠি পড়তে পড়তেই মেয়েটির প্রতি কেমন যেন একটা টান অনুভব করতে লাগল সে। এটা কিসের টান? বন্ধুত্বের? অন্যান্য সম্পর্কের তুলনায় বন্ধুত্বের টান অনেক বেশি। যা হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও অনুভব করা যায়। অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ফাহিম দ্রুত একটা মেইল লিখে ফেলল।

হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ, সিমি!

জেনে খুশি হলাম, আমাকে তোমার বন্ধু বিবেচনা করেছ। আমার সম্পর্কে বলতে বলেছ, কিন্তু কী বলব? আমার সম্পর্কে বলার মতো তেমন কোনো কথা নেই তবুও সহজ হতো যদি নির্দিষ্ট করে কিছু জানতে চাইতে।

এটুকু লিখে ফাহিম কথা হারিয়ে ফেলল। আর কী লিখবে? হঠাৎ মনে পড়ল মুনার কথা। সেদিন মুনার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল, তখন সে সিমির সাথে তার কাকতালীয়ভাবে পরিচয়ের ঘটনাটি খুলে বলল। মুনার কথাই তাহলে কিছু লেখা যাক। ফাহিম লিখল-

সেদিন মুনার সাথে কথা হলো। বললাম তোমার কথা। সে তো ভীষণ অবাক। সে ভেবেই পাচ্ছে না, তোমার সাথে আমার পরিচয়টা হলো কী করে! আমি তাকে সব খুলে বললাম। তোমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল মুনা। বলল, তুমি অনেক ভালো এবং বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। আমি অবশ্য বলেছি সে কথা আমি জেনে গেছি ইতোমধ্যেই।মুনা অবশ্য বাঁকা হেসে বলেছে- তাই? আমিও হেসেছি। তোমার কী মনে হয়, তোমাকে কি একটু হলেও চিনেছি আমি?

আজ এটুকুই। হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ।

ফাহিম।

মেইলটি পাঠিয়ে দিয়ে ফাহিম বাসার দিকে রওয়ানা দিল।

ফাহিম একটু দেরীতেই ঘুমাতে যায়। মাঝে মাঝেই মাঝরাত পেরিয়ে যায়। রাত সাড়ে বারোটার দিকে কী মনে করে সে তার বাসার কম্পিউটারে লগইন করল এবং মুহূর্তেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এত দ্রুত সিমির মেইল আসবে সে ভাবতেও পারে নি। সিমি লিখেছে-

বন্ধু আমার,
হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ টু ইউ টু।

আমি জানি না মুনা ঠিক কী বলেছে তোমাকে আমার সম্পর্কে, কিন্তু মনে হচ্ছে সে একটু বেশিই বলেছে। একে অপরকে জানার মতো যথেষ্ট সময় কিন্তু আমরা পাই নি। তাই ঠিক কী কারণে সে আমাকে ভালো কিংবা বুদ্ধিমতী বলেছে, আমি বুঝতে পারছি না। তবুও তোমার কাছে আমার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।আমার হয়ে তুমি জানিয়ে দিয়ো।

এখন যেহেতু আমরা নিজেরাই বন্ধু হয়ে গেলাম, তুমি নিজেই ধীরে ধীরে বুঝে যাবে আমি কেমন— তখন নিজেই জাজ করতে পারবে, আমি ভালো আর বুদ্ধিমান না বোকা।

তোমার সম্পর্কে কিছুই বলো নি। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম,এই যেমন তুমি কে, কোথায় থাকো, কী করো, দেখতে কেমন, বয়স কত, পড়াশুনা কতদূর ইত্যাদি ইত্যাদি। তোমার সম্পর্কে অল্প কিছু কথা আর তোমার পরিচয়। অন্য কাউকে নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে যা বলো, ব্যস সেটুকুই।

আশা করি আমার মেইলের উত্তর পেয়ে যাব তাড়াতাড়ি। অপেক্ষায় রইলাম।

অনেক শুভকামনা।

সিমি।

ফাহিমের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সিমির মেইলের জন্য অপেক্ষা করা আর তার উত্তর দেওয়া একটি অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। এই অপেক্ষার অনুভূতি অন্যরকম। হঠাৎ এই ইলেকট্রনিক চিঠির প্রতি এক ধরনের ভালোলাগা শুরু হয়ে গেছে তার। এ যাবৎকালে এক অফিসের ইমেইল ছাড়া নিয়মমাফিক কখনো কারও মেইলের উত্তর দিতে হয় নি। তবে একান্ত ব্যক্তিগত আরমনের ভাব প্রকাশ করার জন্য এই মাধ্যমটির প্রতি সে কৃতজ্ঞতা অনুভব করল।

ফাহিমের মনে আছে, কলেজে থাকতে একবার বাসের সিটের পেছনে লেখা একটা মেয়ের ঠিকানা পেয়েছিল। মেয়েটির বাড়ির ছিল জয়পুরহাটে। সে কী মনে করে সেই ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়ে দিল। সে চিঠির কথা সে ভুলেও গেল। প্রায় মাস খানেক পরে হঠাৎ সেই মেয়েটির কাছ থেকে উত্তর পেয়ে ফাহিমের যে কী আনন্দ হয়েছিল, সে কথা বলে হয়তো সে বোঝাতে পারবে না। মেয়েটির সাথে তার বন্ধুত্ব টিকে ছিল বহু বছর। পরে সে উচ্চ শিক্ষার্থে রাশিয়া চলে যায়। এরপর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

চিঠি লিখে বন্ধু হওয়া বা পত্রমিতালির শখটি এখন আর নেই। তখন একটা পত্রিকায়, যারা পত্রমিতালি করতে চায়, তাদের ঠিকানা ছাপানো হতো। সেটা দেখেই চিঠি পাঠিয়ে বন্ধুত্ব করা হতো। আহা কী মধুর ছিল সেই দিনগুলি!

আর এখন মিনিটে মিনিটে মেসেজ, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ—কী নেই এই সভ্য সমাজে! সবকিছু সহজলভ্য, ডেটিং, ফিল্ডিং, কেনাকাটা, রাত জেগে ভিডিও কল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, এই দিবস, সেই দিবস।

ভাবনার ডালি সরিয়ে সিমির মেইলের উত্তর লিখতে বসল ফাহিম।

প্রিয় সিমি,
১৯৯৪ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের এক হিমশীতল দিনে আমি আমেরিকার শিকাগো শহরে আসি। প্রথম দিন থেকেই এই শহরটির প্রেমে পড়ে যাই। আমি যখন প্লেন থেকে নেমে আমার গন্তব্যে যাচ্ছিলাম, তখন চারিদিকে ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছিল। পেঁজাতুলোর মতো। আমার মনে আছে, আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্পে পড়েছিলাম ফার্গো শহরের তুষারপাতের কথা।আজ বাইরে খুব তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ঢেকে গেছে সাদা বরফে।সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য... দীর্ঘদিন আমার মাথার মধ্যে সেই দৃশ্য গেঁথে ছিল। সেদিন শিকাগো শহরের সেইতুষারের সৌন্দর্য দেখে আমিও বিমোহিত হয়েছিলাম। সেই অনুভূতির কথা কখনোই ভোলার নয়।

এবার পড়াশুনায় আসা যাক। দেশ থেকে গ্রাজুয়েশন করে এসেছিলাম, তাই শিকাগোর একটা স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। এই মুহূর্তে একটাবড় কোম্পানীতে সফটওয়্যার প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি।

আমার বয়স জানতে চেয়েছ। তারুণ্য ও যৌবনকে অনেকখানি পেছনে ফেলে এসেছি আমি। এক মাস পরেই চল্লিশের ঘরে পড়ব। সময় এত দ্রুত পার হয়ে যায় যে, মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয় সময়ের গতিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বয়স বিশ ও তিরিশের কোঠা পেরিয়ে চল্লিশের ঘরে চলে আসে। চল্লিশ বছর— একেবারেই কম নয় কিন্তু!

আমার তৃতীয় ইন্দ্রিয় বলছে, আমি কম করে হলেও তোমার থেকে দশ বছরের বড় হবো। আমি কি ঠিক?

এবার তোমার পালা। অপেক্ষায় রইলাম

ফাহিম।

পুনশ্চঃ আমার কিন্তু মনে হয় না যে মুনা তোমার সম্পর্কে বাড়িয়ে কিছু বলেছে।

সেন্ড বাটনে চাপ দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ফাহিম। কেমন যেন একটু অস্বস্ত্বি বোধ করল। সে হঠাৎ করেই সেন্ড ফোল্ডারে গিয়ে তার পাঠানো মেইলটি আরেকবার পড়ল। প্রায় প্রতিবারই সে এই কাজটি করে থাকে। অথচ কাজটি করা উচিত মেইল পাঠানোর আগে। একবার পাঠানো হয়ে গেলে তো আর কিছু করার থাকে না। তার অবচেতন মনের অস্বস্তির বিষয়টি তখনই চোখে পড়ল। আর সেটি হচ্ছে বয়স। তার বয়স চল্লিশ সে কথা জানিয়ে সে সূক্ষèভাবে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটা সে কেন করছে? সিমি যদি অন্যরকম কিছু একটা ভেবে বসে তাহলে বিষয়টা কেমন হবে? ফাহিমের অস্বস্তিবোধ আরও বেড়ে গেল।

সেদিন দুপুরেই সিমির উত্তর এল।

হ্যালো ফাহিম,
তোমার মেইল পেয়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ। তোমার তৃতীয় ইন্দ্রিয় সঠিক আন্দাজটিই করেছে-ইউ আর কোয়াইট ওল্ড, ম্যান! এতদিন আমি কল্পনায় যাকে দেখেছি সেই মানুষটি আমার থেকে দশ বছরের বড় হবে ভাবি নি কখনো। আমি ভেবেছিলাম তুমি যেহেতু মুনার বন্ধু, তুমি হয়তো আমাদের বয়সীই কেউ হবে। কী একটা ঝামেলা হয়ে গেল বলো তো। আর এদিক থেকে আমি সমানে তুমি তুমি করে বলে যাচ্ছি। আই অ্যাম সো সরি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

অবশ্য তুমি চাইলে আমি আপনিতে ফিরে যেতে পারি। যদিও আমি তুমি বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছি।

আমার সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই। এক সময় আমি ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতাম। আমাদের ছোট একটা ব্যবসাও ছিলইন্টেরিয়র ডিজাইনিং ফার্ম, যেটা আমি আর রাশেদ একসাথেই চালাতাম। এখন যেহেতু রাশেদ নেই আর আমি একা, ব্যবসাটা আমি আর চালাতে চাচ্ছি না। আমি একটা চাকরি খুঁজছিলাম। ইনফ্যাক্ট, আমি একটা চাকরি পেয়েও গেছি- একটা আইএসপি কোম্পানিতে। ইনশাল্লাহ আগামী মাস থেকেই শুরু করব।

আগামী মাসেই যেহেতু তুমি চল্লিশে পড়ছ, তোমার জন্ম তারিখটা জানিয়ো।

অশেষ ধন্যবাদ তোমার মেইলটির জন্য। এবং অবশ্যই দ্রুত উত্তর দেওয়ার জন্য। তোমার চিঠিগুলো আমার একাকীত্বে কিছুটা হলেও সঙ্গ দিচ্ছে, এটাই বা কম কী?

ভালো থেকো।

সিমি।

পুনশ্চঃ আমি তোমাকে ফাহিম বলব নাকি শেষে একটা ‘ভাই’ জুড়ে দেব- ফাহিম ভাই?

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.