প্রতিটি মানুষেরই একটা দ্বিতীয় সত্তা থাকে: মহাদেব সাহা

প্রতিটি মানুষেরই একটা দ্বিতীয় সত্তা থাকে: মহাদেব সাহা

মহাদেব সাহা— পাঠকনন্দিত এক কবি। বাংলা কাব্যধারায় তাঁর কবিতা নমনীয় স্রোতের মতো বহমান। উচ্চনিনাদে উচ্চকিত নন তিনি। কখনো তিনি বেদনার্ত ও বিধুর। দুঃখ ও কষ্টকে নানাভাবে আবিষ্কার করেন। তাঁর কবিতায় মানুষেরই জয়গান। আবার পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে এই মানুষই তাঁর কাছে ভয়ের বস্তু। প্রকৃতিপ্রেমিক এই কবির কবিতায় অসংখ্যাবার এসেছে গোলাপ, স্বর্ণচাপা, আকাশ, রোদ আর জলের উপমা। তবে মহাদেব সাহা মূলত প্রেমের কবি। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার বারবার তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া নাগরিক জীবনের জটিলতা, কৃত্রিমতা আর যান্ত্রিকতাও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি ৮০ বছরে পদার্পণ করেছেন মহাদেব সাহা। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোমিন রহমান। সেই সাক্ষাৎকারটি এখানে পুনর্মুদ্রিত হলো।

মোমিন রহমান: আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ছেলেবেলায় ভেবেছিলেন, বড় হয়ে আপনি নাবিক হবেন। প্রতীকীভাবে তো আমরা সবাই নাবিক। এক সবুজ ভূমির সন্ধানে জীবন-সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি, যেখানে শান্তি-সুখের ঠিকানা। তো আপনার ছোটবেলার কথা একটু বিশদভাবে বলুন।

মহাদেব সাহা: সব মানুষের মনেই বোধহয় একটি স্বপ্নদ্বীপ আছে। প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষ বোধহয় সারাজীবন এই স্বপ্নভূমিই খুঁজে বেড়ায়। নানাভাবে সে খোঁজে। হ্যাঁ, আমি কোনো এক সাক্ষাৎকারে নাবিক হওয়ার ইচ্ছের কথা বলেছিলাম। আসলে নদী, জলাশয় আমাকে সব সময় টানে। আমি যেখানে জন্মেছিলাম, বৃহত্তর পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে—আমার সেই গ্রামটি নানা ধরনের গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা ছিল। বলা যায়, অফুরন্ত সবুজ আর জলধারার মাঝে আমার শৈশব কেটেছে। ফুলজোড় নদীটি বয়ে গেছে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে। জোড়াফুল থেকে এসেছে এ নামটি। জানি না কখনো কেউ জোড়াফুল এ নদীটিতে ভাসিয়েছিল কি না! তবে নামটি তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও নদীটি বড় নয়। তবে বর্ষায় এ নদীর দূকুল প্লাবিত হতো। এখন বোধহয় নদীটি শুকিয়ে গেছে। শৈশব-কৈশোরে আমার মনের মাঝে নিশ্চয় এই ধরনের কোনো একটা স্বপ্নই বাসা বেঁধেছিল, নইলে কবিতায় এলাম কেন? আমি শৈশব-কৈশোরে যাদের সঙ্গে বড় হয়েছি, তাদের চেয়ে হয়তো পৃথক একটা দেখার চোখ আমার ছিল। তাই হয়তো-বা কবিতার এই আলো-আঁধারির রহস্যময়, বিমূর্ত জগতে পড়ে আছি। ছোটবেলায় নৌকায় চড়তে আমি খুব পছন্দ করতাম। বিশেষত গহনার নৌকায়। এই গহনার নৌকায় এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছিল—তাতে শব্দ করে তারা লোক ডাকত। সেই গহনার নৌকার পাশাপাশি পালতোলা  নৌকাও দেখেছি। তখন সমুদ্র দেখি নি, কিন্তু পালতোলা নৌকার মাঝিকে দেখে হিংসে হতো—কোথা থেকে কোথায় সে চলে যাচ্ছে। এ চরিত্রগুলো আমাকে আকর্ষণ করত, খুবই টানত। আবার কখনো কখনো বাড়িতে পড়া কোনো পৌরাণিক কাহিনি শুনে আমার ইচ্ছে হতো যে, আমি ছুটে যাব গ্রহ-তারার দিকে, সুদূরে। পথে বেরিয়েও পড়তাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবার পরিচিত গণ্ডিতেই ফিরে আসতে হতো।... তখন গ্রামের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে গাড়ি চলত, মোষের গাড়ি চলত—সেই গাড়ির চাকা থেকে কান্নার মতো একটা শব্দ হতো। সেই শব্দগুলো এখনো আমার মনে পড়ে, এইসবের মধ্যে আমার ছেলেবেলা কেটেছে—শস্যখেত—বিশাল প্রান্তর, মাঠ, হাটখোলা, খেয়াঘাট। আসলে এই নগরজীবনের বাইরে তখন গ্রামের ভরা জোছনা, জোছনা রাত্রি, ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক, রাখলের বাঁশি, মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, কখনো সার্কাস, কখনো যাত্রার গান, এইসব।

মোমিন রহমান: আপনার সত্তা কি এখনো গ্রামেই প্রোথিত?

মহাদেব সাহা: আমি সেটাই মনে করি। আসলে আমি বোঝাতে চাইছি, ওইগুলোই আমার জীবনের ঐশ্বর্য। ঝড়-বৃষ্টি দেখেছি; ঢল দেখেছি। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে—তার অদ্ভুত শব্দ শুনেছি; আমরা মেলা দেখেছি, নানা রকম পুতুল দেখেছি; পৌষ-পার্বণ দেখেছি অর্থাৎ বাংলার নিজস্ব জীবনের মধ্যে বড় হয়েছি।

মোমিন রহমান: আপনি বললেন আপনার গ্রামের প্রকৃতি, জীবনধারা, পালা-পার্বণ—যা আপনার জীবনের ঐশ্বর্য—যেগুলো আপনার কবিতায় উঠে আসে।

মহাদেব সাহা: ঐশ্বর্য যেমন ঐতিহ্যও বটে। আবহমান বাংলার লোকজ ধারার মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠা। যেমন করে একটি গাছ বড় হয়। যেমন করে শীতকালের শীর্ণ নদী বর্ষায় প্লাবিত হয়। আমার মনে পড়ে, একেকটি শব্দ, যেমন আমাদের উত্তরাঞ্চলে কাজলি মাছ—বাঁশপাতার মতো দেখতে—আমাদের ওই অঞ্চলে এটাকে বাঁশপাতা মাছ বলা হয়। আবার কাচকি মাছকে আমাদের অঞ্চলে বলা হয় সুবর্ণখড়িকা। সোনার কাঠির মতো মাছটি দেখতে বলেই বোধহয় এ নাম। সেই নামের যে দ্যোতন্য তা এখনো ভুলতে পারি না আমি। একটি ফুলের নামও মন পড়ছে। শহরে আমরা বলি শিউলি ফুল। গ্রামে এটাকে বলা শেফালি বা শেফালিকা। এই নামের মধ্যে অনেক বেশি ব্যঞ্জনা। মনে নারীর কথা উদয় হয়। আবার শিশিরকে গ্রামে ওস বলা হয়। এমনি নানা নাম হারিয়ে যাচ্ছে। সব কথা তো এই স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়।

মোমিন রহমান: প্রকৃতির কথা থাক। গ্রামের মানুষদের কথা বলুন—যারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

মহাদেব সাহা: আমি বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। কিন্তু বড় এক যৌথ পরিবারে আমি বড় হয়েছি খুড়তুতো ভাইবোনের মাঝে। লক্ষ করতাম সবাই আমাকে আলাদা চোখে দেখে। আমি তো আর ‘বিস্ময় বালক’ নই, কিন্তু সবাই প্রত্যাশা করত যে আমি বড় একটা কিছু হব। অনেক সময় এটা আমার ওপর যেন চাপিয়ে দেওয়া মনে হতো। আজ মনে হয়, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব যারা আমাকে যেভাবে দেখেছিল—তার যোগ্য আমি কোনোদিনই হয়ে উঠতে পারব না। এখন বেশ বুঝতে পারছি, তাদের ভালোবাসার চোখে আমাকে অনেক বড় করে দেখা হয়—আমি অতটা যোগ্য নই। মনে পড়ে, এক বোনের কথা, নিজের বোন নয়, খুড়তুতো এক বড় বোন—তাঁর আদর ভালোবাসার কথা এখনো মনে পড়ে। মনে হলে চোখে জল আসে। আমাদের পরিবারের লোকেরা যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। কেউ কেউ নিজেরাই গান সুর দিয়ে গাইতেন। আমার মা অবসরে রামায়ণ-মহাভারত পড়ত। এইসব জীবন আমাকে স্বপ্নাবিষ্ট করে। রামায়ণ-মহাভারত পাঠ, মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’, ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ আবৃত্তি—এইসব শুনে শুনে আমার ভেতরে একটি ছন্দের কান তৈরি হয়ে যায় তখন থেকেই।

মোমিন রহমান: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হলো কবে?

মহাদেব সাহা: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ! না না...এভাবে বলা যাবে না। কবিতা লেখা শুরু করি ছোটবেলা থেকেই। সাত-আট বছর বয়সে। আমার লেখা সেইসব কবিতা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়—ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে, আজাদের মুকুলের মাহফিলে, খেলাঘরে, কলকাতার লোকসেবক পত্রিকার সবুজ পাতায়। অষ্টম শ্রেণিতে আমি যখন পড়ি তখন গ্রামে রীতিমতো কবি হয়ে উঠেছি। সেই কবিকেই আমি বয়ে চলেছি সারা জীবন। কে যে চাপিয়ে দিয়েছিল জানি না। তখন স্কুলের শিক্ষকদের কাছে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। গ্রামে তখন প্রশান্ত জলাশয়ের স্নিগ্ধতা ছিল। এখন সেই গ্রাম্যজীবন নেই। এখন কৃত্রিমতায় ভরে গেছে। নগর জীবনের নাগরিকতা সেখানে যায় নি, বরং বিকৃতি গেছে, অনাচার গেছে। আমার দুঃখ হয় যে, এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো এসব দেখল না—পৌষ পার্বণ, পিঠা তৈরির উৎসব, নদীতে ইলিশ মাছের ঝাঁক। এখনকার ছেলেরা সেই ফুল ফোটার দৃশ্যও দেখে না, সেই কাঠালচাঁপার গন্ধ তাদের নাকে আসে না। সে এখন প্লাস্টিকের ফুল দেখে। সে বৃষ্টিকে উপভোগ করে টেলিভিশনের পর্দায়।

মোমিন রহমান: আমরা আপনার কবিতায় এক প্রকৃতিপ্রেমিক কবির দেখা পাই। প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখেছেন বলেই কি এই প্রকৃতি-মগ্নতা বারবার আপনার কবিতায় ছায়াপাত করে?

মহাদেব সাহা: আমার মধ্যে হয়তো সেই জীবনের প্রতি এক ধরনের নস্টালজিয়া আছে। তবে কবিকে তো প্রকৃতির বাইরেও আসতে হয়। যা কবিতায় থাকে—তা প্রকৃতির সত্য নয়, কিছুটা মিথ্যেও থাকে। পুরোটাই সত্য নয়। তবে প্রকৃতির ভেতর থেকে সম্পদ-ঐশ্বর্যগুলো পাওয়া এবং এগুলোকে কবিতা বা শিল্প করে তোলা যায়। প্রকৃতিমগ্নতা কবিকে ঐশ্বর্যশালী করে, সমৃদ্ধ করে বলে আমার ধারণা। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সব কবির ক্ষেত্রেই সত্যি।

মোমিন রহমান: আপনার কবিতায় লক্ষ করি, কখনো কখনো আপনি বেদনার্ত ও বিধুর। দুঃখ-যন্ত্রণায় জড়িত। এমনকি ‘দুঃখ’ এই শব্দটিই অসংখ্যবার আপনার কবিতা এসেছে। যেমন, ‘হে আমার দুঃখগুলি তোমার জন্য অমল রোদনে/ মালা গাঁথার সময় তো নেই’, কিংবা ‘আমার এ-বুকে বাঁধা এই সেই দুঃখের পাথর/ সে কি গীর্জের গভীরে আলো, খ্রিষ্টের দর্শনলাভ...’। আমরা বোধ করি যে আপনি দুঃখকে যেন বহন করছেন। আপনি কী বলেন?

মহাদেব সাহা: এটি ঠিক বুঝিয়ে বলা কঠিন। কবির জীবনে যেমন অপার দুঃখ আছে তেমনি অপার সুখও আছে। অপার দুঃখ ও অপার সুখের মিলিত জীবন হচ্ছে কবির জীবন। কৃত্রিম শহরের নিষ্প্রাণ মানুষের পরিবর্তে আমি কবিতায় গ্রামজীবন তুলে এনেছি। আমি কবিতায় যে স্নিগ্ধতা, প্রাণময়তা তুলে আনি সেটা আমার তৈরি করা না, সেটা আমার জীবন থেকে আহরণ করা। আরোপিত নয়। শিল্পের সাথে বিষাদ জড়িত। বিষাদই শিল্পের উৎস। সব মানুষের মনের মধ্যেই শূন্যতাবোধ, হাহাকারবোধ, অপ্রাপ্তি আছে। কবি সেইসব মানুষের বেদনা নিজের কবিতায় তুলে আনে। আমরা কবিতা লিখি প্রতিটি মানুষের দুঃখ, গ্লানি মুছে তাকে যতটা আন্দময় করে তোলা যায় সেই লক্ষ্যে। এখন মানুষের জীবনে অবশ্য আনন্দ হারিয়ে গেছে, তার পরিবর্তে এসেছে ফুর্তি—আমোদ। আর তাই সেই আমোদের পরে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই।

মোমিন রহমান: সংসারে থেকেও আপনার মধ্যে সন্ন্যাসের মতো একটা ব্যাপার আছে?

মহাদেব সাহা: কী জানি, আমি সংসারের মধ্যে আছি বটে তবে আমি এখানে বেশ খাপছাড়া। খুব কাছে থেকে না দেখলে এটা বোঝা মুশকিল।

মোমিন রহমান: কিছুক্ষণ আগে আপনি বলছিলেন যে, আপনার গ্রামের লোকেরা লক্ষ করেছিলেন, ছেলেটা একটু অন্য ধরনের?

মহাদেব সাহা: তারা আমাকে মনে করতেন একটু ভিন্ন স্বভাবের, একটু উদাসীন, একটু নিঃসঙ্গ, হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে।

মোমিন রহমান: তার মানে তখন থেকেই আপনার মনে সেই সন্ন্যাস জীবনের বাসনা ধরা পড়েছে?

মহাদেব সাহা: সন্ন্যাসী কিনা জানি না, তবে এক ধরনের উদাসীনতা, বিভোরতা বা আচ্ছন্নতা ছিল আমার মধ্যে। গ্রামে ধরুন ১৬-১৭ বছর কাটিয়েছি তারপর থেকে তো শহরেই চলে এসেছি, এখানেও আমি এরকমই ছিলাম। ঢাকায়ই তো প্রায় ৪০ বছর ধরে আছি।

মোমিন রহমান: ঢাকার আকাশ তো খণ্ডিত আকাশ—এক টুকরো আকাশ!

মহাদেব সাহা: কিন্তু আমি চোখ বুজে যে আকাশ দেখি সে আকাশ খণ্ডিত না, বিশাল। একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করেই সে বাঁচতে হয়। সে তো কমবেশি সবাইকেই করতে হয়। নয়তো জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে যেত নগরজীবনের এই যান্ত্রিকতায়।

মোমিন রহমান: আপনার কবিতার আরেকটা দিক যার জন্য হয়তো পাঠকেরাও আকৃষ্ট হয় তা হলো—প্রেম-ভালোবাসা। তা প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে তো তফাতও তো আছে। এ বিষয়ে একটু বলবেন? এই বয়সে আপনাকে কোনটা বেশি দোলা দেয় প্রেম না ভালোবাসা?

মহাদেব সাহা: প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। দুটো অনেক দিক থেকে এক, আবার অনেকদিক থেকে এক না। ভালোবাসায় প্রতি বৎসল্য থাকে, স্নেহ থাকে, সেটা তো যে কারও, যে কিছুর প্রতি হতে পারে। কিন্তু প্রেমে একজন থাকতে হয়—নারী—এককেন্দ্রিক; ভালোবাসা বহুমুখী কিন্তু প্রেম একমুখী কিন্তু গভীর।

মোমিন রহমান: প্রেমের প্রবলতা তো আবার ভালোবাসা থেকে অনেক বেশি?

মহাদেব সাহা: ভালোবাসার চেয়ে প্রেম মানুষকে বেশি আচ্ছন্ন করে। আর জীবনকে পরিপূর্ণও করে। প্রেম আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। আবার প্রেমের মধ্যে যে দেহ, নারী-পুরুষ সম্পর্ক এটাও খুব সত্য। প্রেম তো সৃজনশীলতা। যৌনতা ও কামকেই কিন্তু আমরা শিল্পিত করেছি প্রেমে। প্রতিটি মানুষেরই একটা দ্বিতীয় সত্তা থাকে। একজন পুরুষ পরিপূর্ণ না। তার একটা নারী সত্তা আছে। একজন নারীর মধ্যেও পুরুষ সত্তা থাকে। তো এইক্ষেত্রে আমার আমিটা কিন্তু সেই সত্তারই বহিঃপ্রকাশ, তা আমাদের মধ্যে যে নারী আছে তাকে কিন্তু আমরা এক নারীর মধ্যে খুঁজে পেতে চাই কিন্তু আরোপ করি আমরা কিন্তু সে কিন্তু তা নয়।

মোমিন রহমান: আসলে সৌন্দর্যবোধের মূলে আছে নারী। হ্যাঁ আপনার সীতা হয়তো বাস্তবে থাকতে পারে কিন্তু আপনি যখন কবিতায় লেখেন সেই সীতা কি বাস্তবের সীতা?

মহাদেব সাহা: দুটি নারী আমি আমার কবিতার মধ্যে বেশি এনেছি—সীতা ও রাধা। বাস্তবের কথা জানি না, তারা আমার কবিতার নারী। এক অর্থে আমার কোনো ব্যক্তিজীবন নেই। কাব্যজীবনই আমার ব্যক্তিজীবন।

মোমিন রহমান: মানে কবিতার যে রাধা বা সীতা তার মধ্যে আপনি?

মহাদেব সাহা: ভালোবাসা বা প্রেম তো একদিকে থেমে থাকে না, কখনো সীতা কখনো রাধা, আসলে বহু নারীর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়; কিন্তু নারী হচ্ছে সৌন্দর্যের উৎস। নারী না থাকলে শিল্পের ধারণাই তৈরি হতো না। ‘নারীর মুখের যোগ্য কোনো শোভা নেই।’ আমরা বিশেষ করে কবিরা নারীকে দেখতে দেখতে এত রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই যে সে যে একটা মানুষ—তা মনেই থাকে না। কবিতায় আমার ওই নারীকে হয়তো আমি আপনার করে নিচ্ছি, সে কিন্তু আমারই সৃষ্টি কিন্তু জীবনের সেই নারী দূরে সরে যায়।

মোমিন রহমান: হ্যাঁ যেমন একসময় বলা হতো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকারা কেউ বাথরুমে যায় না।

মহাদেব সাহা: এই যে নারীকে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে কিন্তু সে তো চাঁদের মতো নয় কিন্তু এই অ্যান্টি পোয়েট্রি—এটাও এক ধরনের প্রশংসা। এই নারীকে বাস্তবের রূপ দিচ্ছি তার জন্য কিন্তু নারী তার নারীত্ব হারাচ্ছে না। আমি কবিতার মধ্যে খোলাখুলিভাবে যৌনতার বিষয়টি আনি নি। তার মানে এই নয় যে, আমি বিষয়টা অস্বীকার করেছি। সব কবির মধ্যেই নারী মগ্নতা বা আচ্ছন্নতা খুব কাজ করে থাকে।

মোমিন রহমান: হ্যাঁ সে তো কবিতার নারীর কথা আমরা বলেছি, কিন্তু বাস্তবের যে নারী সে হয়তো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

মহাদেব সাহা: বাস্তবে একটি নারী থেকে হয়তো আমি দূরে সরে যাচ্ছি। কিন্তু নারীকে যদি আমি অখণ্ড করে দেখি, নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিতে যদি দেখি তাহলে সে কিন্তু আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে না, সেখানে দূরে যাওয়া মানে কাছে পাওয়া, বিচ্ছেদে আরও বেশি পাওয়া যায়, যেমন একটা সুন্দর মেয়ে আমাকে তার সাথে যেতে বলল—আমি হয়তো গেলাম না। সেই না যাওয়াটাই কিন্তু আরও বেশি করে যাওয়া।

মোমিন রহমান: হ্যাঁ যখন নারীকে দেখেন, কিন্তু সে দেখাটা কিন্তু আপনার নিজের রচিত, নিজের দেখা হয়ে যাবে। কাল্পনিক হয়ে যাবে।

মহাদেব সাহা: কিছুটা কাল্পনিক কিছুটা সত্যও হতে পারে। কিন্তু এখন তো আমার কবিতা লেখার জন্য কল্পনাই করতে হবে।

মোমিন রহমান: আচ্ছা অন্য একটা প্রসঙ্গে যাচ্ছি, প্রেম বা ভালোবাসা—এই সময়ে এসে এই বিষয়ে লিখতে কি আপনার কষ্ট হয়?

মহাদেব সাহা: না কষ্ট হয় না। প্রেমের কবিতা লেখার জন্য একজনকে মডেল করে কবিতা লিখি না আমি।

মোমিন রহমান: না আমি বলছি কবির মনের ওপর সময়ের প্রভাবটা—

মহাদেব সাহা: আমরা এখন যে অন্ধকার সময়টায় বসবাস করি, সে সময়ও ভালোবাসা দিয়েই সব জয় করতে হবে। ‘হিংসার অস্ত্রগুলি হতে বলি বাঁশি বা বেহালা।’ ভালোবাসা দিয়ে সব সম্ভব। ভালোবাসাহীনতায় কিছুই সম্ভব নয়।

মোমিন রহমান: আচ্ছা এ সময়ে যারা লিখছে আপনি কি তাদের কবিতা পড়েন?

মহাদেব সাহা: পড়ব না কেন, সব সময় সব কবিতা না পেলেও কিছু কিছু পড়ি।

মোমিন রহমান: গত ঈদের আগে অন্যদিন অফিসে তরুণ কবিদের একটা আড্ডা হয়েছিল। ওখানে একজন বলছিল এসময়ের সব কবিরই নিজস্ব কাব্যভাষা রয়েছে। কথাটি হাস্যকর নয় কি? আপনি কী মনে করেন?

মহাদেব সাহা: কেউ মনে করতেই পারে। তবে আমার মনে হয়, একজন কবির নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু এখনকার কবিদের কারও কারও কাব্যভাষা সংহত ও ব্যঞ্জনাময়, এটা আমি স্বীকার করি।

মোমিন রহমান: বাংলা কবিতার ভবিষৎ কী?

মহাদেব সাহা: মানুষের যে ভবিষ্যৎ—কবিতারও তাই।

মোমিন রহমান: কবিতায় আধুনিকতার প্রভাব—

মহাদেব সাহা: আমার মনে হয় কম্পিউটার আসুক ই-মেইল আসুক, যত কিছুই হোক, তার জন্য মানুষের হৃদয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে না। টেকনোলজি তৈরি করবে কবিতাকে কিন্তু টেকনোলজি কবিতা লিখবে না, লিখবে হৃদয়। কিন্তু তাতে কবিতার কোনো ক্ষতি হবে না, কবির হৃদয়ই লিখবে, হৃদয়কে যন্ত্র স্পর্শ করবে না। মাতৃস্নেহ, প্রেম, বাৎসল্য, শোক অশ্রু এসব শাশ্বত বিষয়। এ বিষয়গুলো চিরদিনই থেকে যাবে। আর এগুলো থাকলে কবিতাও থাকবে। কবিতা তো মানুষের অন্তরেরই গভীরতম নির্যাস, একফোঁটা পবিত্র অশ্রু।

মোমিন রহমান: কিন্তু আমি বলতে চাইছিলাম পঁচাত্তরের আগে আপনার মানুষের প্রতি যে বিশ্বাস— তা পঁচাত্তরের পরে কেমন হারিয়ে যাচ্ছিল। কবিতায় সেই পরিবর্তনের কথা।

মহাদেব সাহা: দেখা যাক। আমি তো ভোরই দেখতে চাই। কৃষ্ণপক্ষ নয়। আমি চাই সূর্যোদয়, আবার মানুষের জীবনে ফুলের গন্ধ, পাখির গান। সেই বিশ্বাস ফেরাতে হলে মানুষকেই ভালোবাসতে হবে। আমি কতটা পারব জানি না। আমি না পারলে পরের কবিরা পারবে। ভালোবাসা দিয়ে সবই তারা করতে পারবে।

মোমিন রহমান: সেই অনাগত দিনের দিকেই আমরা চেয়ে রইলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।

মহাদেব সাহা: ধন্যবাদ আপনাকেও।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.