শ্রী বদরুজ্জামান রচিত শতবর্ষ বয়সী রচনা ‘নববর্ষ’

শ্রী বদরুজ্জামান রচিত শতবর্ষ বয়সী রচনা ‘নববর্ষ’

[প্রতি বছর নববর্ষ ঘিরে অনেক রকম রচনা প্রকাশ হয়। এ সব লেখার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু শতবর্ষ আগে নববর্ষকে ঘিরে কেমন লেখা প্রকাশিত হতো? সেসব লেখার ভাষা কেমন ছিল? কী ধরনের শব্দের প্রাধান্য ছিল? সেই ব্রিটিশ আমলের ছাপও কি থাকত? এ বিষয়ে ১১২ বছর আগের একটি রচনা সম্প্রতি আমাদের হস্তগত হয়েছে। এটি লিখেছিলেন শ্রী বদরুজ্জামান। লেখকের নামটা একটু অন্যরকম। সূত্র বলছে, সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী মুসলমান ধর্মাবলম্বী হলেও নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। বদরুজ্জামান তখন ঢাকার অদূরের গাজীপুরের কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। বিদ্যালয়ের পত্রিকায় ১৩১৯ সালের বৈশাখে রচনাটি মুদ্রিত হয়েছিল। ‘অন্যদিন’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই বিশেষ রচনা।]

                   

এই অনন্ত প্রকৃতি কি পরিবর্তনশীল! বর্ষরূপ ঘূর্ণমান চক্র অবিরাম গতিতে স্বীয় আবর্তনে ঘুরিতে ঘুরিতে পুনরায় আনন্দধ্বনি করিয়া জগৎকে নব উদ্যমে নব উৎসাহে উজ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছে। মধুময় নববর্ষ আগমনেই বুঝি তরু-লতাগুলি নানা সাজে সজ্জিত হইয়া প্রকৃতিকে পুষ্প-সম্ভার প্রদান করিতেছে; মৃদুল সমীর প্রস্ফুটিত নানা পুষ্পের সৌরভ গ্রহণ করিয়া যেন আনন্দভরে চতুর্দ্দিক সৌরভান্বিত করিতেছে; বিমানপথ-বিহারী বিহঙ্গমগুলি যেন নববর্ষ আগমনে নব জীবন প্রাপ্ত হইয়া মধুর তানে পরমেশগীতি গান করিয়া বিশ্বপাতার নিকট কতই না আবদার করিতেছে।

বস্তুতঃ নববর্ষ আগমনে সকলেই নব উৎসাহে উৎসাহিত হইতেছে, সকলেই পরম পিতা বিভুর নাম স্মরণ করতঃ কার্য-ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতেছে। সকলের হৃদয়-বৃন্তেই কুসুমদাম আশানুরূপ মৃদুল পবনে এদিক ওদিক দুদোল্যমান হইতেছে। কিন্তু উক্ত অর্ধস্ফুট কুসুমগুলি যদি কালরূপ নির্মল সলিল প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়, তাহা হইলে, উহারা ত্বরায় সংসার মার্তান্ডা শুষ্ক হইয়া যায়। তাই বলি যিনি নববর্ষের প্রারম্ভেই দৈনিক কার্য্য প্রণালী অনুসরণ করিয়া স্বকীয় কার্য্য আরম্ভ করেন, সংসার রূপ কার্য্য-ক্ষেত্রে তাঁহার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। তিনিই এই নশ্বর জগতে অবিনশ্বর কীর্তি সংস্থাপন করিতে সর্ব্বতোভাবে সমর্থ হন। উচ্ছৃঙ্খলতা মানব উন্নতির অন্তরায় স্বরূপ। যিনি নববর্ষের প্রথমেই উচ্ছৃঙ্খল হন, তাঁহার উন্নতির পথ সুদূর পরাহত। পদে পদে দুর্ব্বহ বাঁধা অবধারিত।

এই অনন্ত ব্রম্মান্ডে কি সূর্য্য, কি চন্দ্র, কি জোতিষ্কমণ্ডলী, সমস্ত প্রকৃতি-দত্ত বস্তুই সুশৃঙ্খলতা রূপ দৃঢ়সূত্রে আবদ্ধ রহিয়াছে। সুশৃঙ্খলভাবেই ষড়ঋতু প্রকাশিত হইয়া এই দিগন্তব্যাপ্ত ব্রহ্মা-ে সর্বনিয়ন্তা বিভোর সৃষ্টি-সৌকর্য বর্ণনাতীতরূপে প্রকাশ করিতেছে। একাগ্র মনে চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে ব্রহ্মা-ের প্রত্যেক বস্তুই সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হইতেছে। অতএব আমরা সকলেই পরম কারুণিক পরমেশ্বরের নিকট সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করতঃ নব উদ্যম ও নব উৎসাহে নব বর্ষের প্রারম্ভেই কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইব।

সময় রূপ অকুল পারাবারের অনন্ত হিল্লোল অবিরাম গতিতে অনন্ত পথে চলিয়া যাইতেছে; যাহা যাইতেছে তাহা আর প্রত্যাগমন করিতেছে না। সেই সময় সাগরের ভাবোদ্দীপক লহরীমালায় মর্ত্য-জীবন ক্ষনে ক্ষনে হাবুডুবু খাইতেছে। সময়ের সহিত মর্ত্য-জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্দ্ব। যাঁহার সত্যিকভাবপরিপূর্ণ সৌম্য-মূর্ত্তি সৌন্দর্শনে, যাঁহার সম্বিৎ সম্ভাষণে স্বকীয় হৃদয়-কন্দরে বিমল আনন্দ-ধারা সতত প্রবাহিত হইতÑ তিনি হয়ত এই মধুময় নববর্ষ সমাগমের পূর্বেই ভবরূপ অতিথিভবন পরিত্যাগপূর্বক কালরূপ সুদীর্ঘ পথের পথিক হইয়া অনন্তে বিলীন হইয়াছেন। হায়! তাঁহার অদৃষ্টে নববর্ষজনিত সুখরূপ অমূল্য-নিধি আর ঘটল না।

নববর্ষ আগমনে নব উদ্যম ও নব উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া কর্মক্ষেত্রে পদনিক্ষেপ করিবেন ইত্যাদি কতই না সমুজ্জল আশা তাঁহার হৃদয়ে উদ্ভূত হইয়াছিল। সেই আশালতা কতই না প্রীতি প্রফুল্ল ভাবে তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল। কিন্তু হায়! তাঁহার আশালতা কাল প্রভজনে ছিন্ন ভিন্ন হইয়াছে। যাহা হউক, যিনি স্বর্গ পথে চলিয়া গিয়াছেন তিনি আর প্রত্যাগমন করিবেন না। তাঁহার জন্য শোকান্বিত হইলে শোকাবেগ স্বতঃই বৃদ্বি পাইবে। সুতরাং তাঁহার স্বর্গ সুখ শান্তির জন্য মঙ্গলময় পরমেশ্বরের নিকট একান্তমনে প্রার্থনা করিয়া আমরা নববর্ষের প্রারম্ভেই স্বকীয় কার্য্যে রত হইব।

যাঁহাদের পরম স্নেহে শৈশবে রক্তপিন্ড সদৃশ দেহ ক্রমশঃ পরিপুষ্ট হইয়া যৌবনে পদার্পন করিয়াছে সেই প্রত্যক্ষ দেবদেবী স্বরূপ পিতামাতাকে আমরা বর্ষারম্ভে একাগ্রমনে পূজা করিতে শিক্ষা করিব এবং যিনি অপত্যনির্বিশেষে সর্ব্বদা নিজের প্রাণান্তে ও প্রজাবৃন্দের সর্ব্ব প্রকার মঙ্গল সাধনে তৎপর সেই পার্থিব দেবতা পরম পূজার্হ রাজ্-রাজেশ্বর রাজচক্রবর্তী শ্রীশ্রীমান পঞ্চম জর্জ ও তদীয় নিরুপম রূপ লাবণ্যবতী সর্ব্বগুনান্বীতা মহিষী রানীমা মেরীকেও অন্তরের অন্তঃস্থলস্থিত সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্তিরত্ন প্রদান করিব দেবতুল্য রাজ প্রতিনিধি ‘লর্ড কারমাইকেলের’ আগমনে নববর্ষে আমাদের মানস গগনে এক প্রকার সুখচন্দ্রমার আবির্ভাব হইয়া আমাদিগকে রাজ্-ভক্তি রসে ক্ষনে ক্ষনে মাতাইয়া তুলিতেছে ও তিনি যেন সুখ শান্তিতে আমাদিগকে পুত্ররূপে পালন করেন ইহাই আমাদের নব বর্ষের একমাত্র প্রার্থনা।

(শ্রী বদরুজ্জামান, ৯ম মান, কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুল, ‘ছাত্র-সুহৃদ’, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, বৈশাখ, ১৩১৯ সাল)।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.