নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (চতুর্থ পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (চতুর্থ পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ট্যাক্সি খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগল না। গ্যারাজের পাশের রাস্তাতেই পার্ক করা ছিল। দরজা খুলে ট্যাক্সিতে ঢুকলাম। বিলি আমাকে কীভাবে মিটার চালাতে হয় তা দেখিয়ে দিল। সাথে এও বলল, ‘ট্রিপশিট লেখা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবে না! রাস্তার উপর চোখ রাখবে। হয়তোবা তুমি ট্রিপশিট লেখা নিয়ে ব্যস্ত আছো, ওদিকে গাড়ির গিয়ার ড্রাইভে রাখা আছে, সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হলো তখন তুমি সামনের গাড়ির পেছনে দড়াম করে মেরে বসেছ! অতএব, সাবধানে চালাবে! আমাকে গুডলাক বলে সে চলে গেল।

আমি আমার হ্যাক লাইসেন্সটা পেছনে টাঙিয়ে রাখলাম, সেটাই নিয়ম। লাইট জ্বালিয়ে গাড়ির ভেতরটা দেখলাম। লাইট জ্বালানোর কারণ সূর্য তখনো ওঠে নি। গাড়ির ভেতরটা অতি নোংরা। আগের শিফটের ড্রাইভার খুব সম্ভব গাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেছে। কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ নাকে লাগছে। বিসমিল্লাহ বলে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। গাড়ির মাইল মিটার দেখে আঁতকে উঠলাম। এ গাড়িটা এখন পর্যন্ত চার লক্ষ মাইল চলেছে। পুরোনো গাড়ি। নতুন ড্রাইভারদের গ্যারাজ কখনোই নতুন গাড়ি দেয় না, যদি অ্যাক্সিডেন্ট করে ভেঙে ফেলে! ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, ‘ড্রাইভার যত নতুন, গাড়ি ততই পুরোনো আর ড্রাইভার যতই পুরোনো গাড়ি ততই নতুন।’

গাড়ি নিয়ে ম্যানহাটানের পথে রওনা হলাম। ম্যানহাটান যাওয়ার কারণ হচ্ছে শতকরা নব্বই শতাংশ যাত্রীই ম্যানহাটানের বাসিন্দা। এ শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনে বাস, সাবওয়ে থাকলেও শহরের বিত্তবানরা ট্যাক্সিতে চড়েই কাজে যান,  বাসায় ফেরেন। আমার গ্যারেজ থেকে ম্যানহাটান মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা। কুইন্সবরো ব্রিজ পার হলেই  এ এক অন্য জগৎ। কনক্রিটের জঙ্গল বলে খ্যাত। চারদিকে গগনচুম্বী সব অট্টালিকা। বিচিত্র এদের নাম, অদ্ভুত সুন্দর এদের নির্মাণশৈলী। উল্লেখযোগ্য কিছু বিল্ডিং হচ্ছে- এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, কন্ডেনাস বিল্ডিং, ক্রাইস্লার বিল্ডিং, লিপস্টিক বিল্ডিং, ফ্লাট আয়রন বিল্ডিং, উলওয়ার্ট বিল্ডিং, রকাফেলার প্লাজা, আরও কত কী! ম্যানহাটান মূলত একটি দ্বীপ, যার দৈর্ঘ্য ১৩.৪ মাইল, আর প্রস্থ ২.৩ মাইল তবে প্রস্থ সব জায়গায় এক না। ম্যানহাটানের আপটাউন, মিডটাউন এসব গ্রিড সিস্টেমে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তাঘাটও বেশ সহজ। এভিন্যুগুলোর অবস্থান উত্তর-দক্ষিণ, রাস্তাগুলো পূর্ব-পশ্চিম। জোড় সংখ্যার রাস্তাগুলো পূর্বমুখী আর বেজোড় সংখ্যার রাস্তাগুলো পশ্চিমমুখী। ম্যানহাটান আইল্যান্ডকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে-আপটাউন, মিডটাউন ও ডাউনটাউন। ডাউনটাউনের রাস্তাঘাট বেশ জটিল। অনেককাল ট্যাক্সি না চালালে এ এলাকার রাস্তাঘাট চেনা কঠিন।

ম্যানহাটানে ঢুকে আমি সেকেন্ড এভিনিউ ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। এটা মিডটাউন। অফিস পাড়া। রোববার ছুটির দিন। তাছাড়া তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যবিহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছি। একটা লোকও চোখে পড়ছে না। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ভোরের সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে নিউইয়র্ক শহর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ভোর প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে। এখনো কোনো প্যাসেঞ্জার পাই নি। কী করব ভাবছি। পার্ক এভিনিউর দিকে গেলাম। সেদিকে যাওয়ার আরেক কারণ, ওই এলাকার রাস্তাঘাট আমি ভালোমতন চিনি। তাছাড়া স্টেপলস নামের যে দোকানে আমি কাজ করি সেটাও ওই এলাকায়। ওখানে গিয়ে লাভ হলো প্রথম প্যাসেঞ্জার পেয়ে গেলাম। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। আমার বয়সী লোক। হাত উঁচু করে রাস্তার কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর সামনে গিয়ে গাড়ি থামালাম। সে গাড়িতে উঠল।

আমি কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে? (আতঙ্কিত হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। একে তো জীবনের প্রথম প্যাসেঞ্জার, তাঁর উপর রাস্তাঘাট আমি তেমন একটা চিনি না!)

লোকটা বলল, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন।

গ্র্যান্ড সেন্ট্রল আমি চিনি। ওকে নামিয়ে দিলাম। ভাড়া ছিল তিন ডলার বিশ সেন্ট। সে আমাকে পাঁচ ডলারের একটা নোট দিল, দিয়ে বলল, বাকিটা তোমার। আমি ওকে বললাম, জানো, ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে আজকে আমার প্রথম দিন। তুমি আমার প্রথম যাত্রী!।

লোকটা আমাকে ‘গুডলাক’ বলে নেমে পড়ল।

(চলবে...)

Leave a Reply

Your identity will not be published.