ইবরাহীম খাঁ ভুঞাপুরের বিরলপ্রজ সাহিত্যিক

ইবরাহীম খাঁ  ভুঞাপুরের বিরলপ্রজ সাহিত্যিক

[ইবরাহীম খাঁ, যিনি মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী লেখক হিসেবে খ্যাত। অসংখ্য ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণকাহিনি ও শিশুপাঠ্য গ্রন্থ রচনা করে অবিভক্ত বঙ্গের অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান সমাজে সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ নির্মাণে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। জন্ম তাঁর টাঙ্গাইলের শাহবাজনগরে।...এখানে তুলে ধরা হলো সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ইবরাহীম খাঁ’র জীবন ও জন্মভূমিকে।]

দেশবরেণ্য লেখক-সাহিত্যিকের শেকড় সন্ধানে আমরা এসেছি রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থানায়। এই থানার নিকটবর্তী গ্রাম শাহবাজনগরের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন বিরলপ্রজ সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ইবরাহীম খাঁ। যিনি প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নামে সমধিক পরিচিত।

সম্প্রতি সঙ্গী ফটোগ্রাফার বিশ্বজিৎ সরকারসহ ঘুরে আসি বিরলপ্রজ এই সাহিত্যিকের স্মৃতি বিজড়িত জন্মভূমি ও কর্মস্থল থেকে। আমরা প্রথমে যাই টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। উল্লেখ্য, তাঁর কর্মময় জীবনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো—করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অর্থ সাহায্যে করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এই সময়কাল থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে ‘প্রিন্সিপাল’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জুড়ে বসে। করটিয়ায় আমরা কথা বলি, কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে। কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষকমণ্ডলীর কাউকে পাওয়া সম্ভব হয় নি। তাঁর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, বর্তমানে কলেজটি যে জায়গায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠাকালে সেখানে ছিল না। প্রতিষ্ঠাকালীন বিল্ডিংটি তখনো ভগ্ন অবস্থায় বর্তমান বিল্ডিংয়ের উল্টোদিকে রাস্তার অপরপাশে অবস্থিত। তবে ওই বিল্ডিংসহ বর্তমান বিল্ডিংয়ের সঙ্গেও প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমান বিল্ডিংয়ের যে কক্ষটিতে বসে বিরলপ্রজ এই গুণী মানুষটি অধ্যক্ষের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতেন, সেটি এখন বাংলা বিভাগের রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইবরাহীম খাঁ’র স্মৃতিচিহ্ন কী রয়েছে তাঁর জবাবে তিনি যেটা জানান সেটা শুধু দুঃখজনক নয়, বেদনারও বটে। করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইবরাহীম খাঁ’র স্মৃতিচিহ্ন তেমন কিছুই সংগ্রহে নেই। শুধু তাঁর একটি ফটোগ্রাফ রয়েছে। এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাঁর অবদান মহীরুহ সমান, তাঁকে এত দ্রুতই ভুলতে বসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষকমণ্ডলী! আমাদের জন্য আরও একটি বেদনাদায়ক তথ্য ছিল। সেটা হলো—কলেজটিতে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় না।

করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে আমরা চলে যাই টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে। ভুঞাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অনতিদূরেই ইবরাহীম খাঁ কলেজ। আমরা পরিচিত হই কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শফিউদ্দীন আহম্মেদ-এর সঙ্গে। আমাদের উদ্দেশ্য অবহিত হওয়ার পর উনি সানন্দে ইবরাহীম খাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত জিনিসপত্র দেখাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল কৃতিত্বপূর্ণ। বাবা শাহবাজ খাঁ। বাবার নামানুসারেই গ্রামের নাম এখন শাহবাজনগর হিসেবে পরিচিত। মাতার নাম রতন খানম। তিনি ছোটবেলাতেই মাতৃহারা হন। শিক্ষাজীবনের পর্বগুলো হলো—১৯১২-তে পিংনা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস, ১৯১৪-তে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে এফ.এ, ১৯১৬-তে কলকাতার সেন্টপলস কলেজ থেকে ইংরেজিতে বি.এ অর্নাস। ১৯১৯-এ প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাস।

ইবরাহীম খাঁ কলেজে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র বেশ যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর ভেতর রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত চেয়ার, হাতঘড়ি, চশমা, জামা-কাপড়সহ বেশ কয়েকটি বইয়ের প্রথম সংস্করণের কপি। কলেজ প্রাঙ্গণেই রয়েছে তাঁর কবর। পাশাপাশি দুটি কবরের একটিতে শায়িত রয়েছেন প্রিপ্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, অন্যটিতে রয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী বিবি ‘আনজুমন্নেছা’।

উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালের ১১ নভেম্বর ইবরাহীম খাঁ’র পরমাত্মীয় স্ত্রী পরপারে যাত্রা করেন, স্ত্রী বিয়োগে ইবরাহীম খাঁ ১০/১২/১৯৭৬ তারিখে লেখেন—“আজ থেকে এক কম ষাট বছর আগে টাঙ্গাইলের কোনো পাঠান পরিবার থেকে ষোড়শী আনজুমন্নেছাকে কুড়িয়ে এনে আমার ঘরে তুলেছিলাম। সেই থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কালতক সুলভ বিনিদ্র যত্ন ও শ্রমে আনজুম আমার সে ভাঙা কুটিরকে প্রাসাদোপম আবাসস্থলে গড়ে তুললেন। তারপর একদা একলা ঘরে আমাকে করুণ কণ্ঠে বললেন—আমাদের যুগল জীবনের প্রভাতে যে বোঝা কাঁধে নিয়েছিলাম, সে বোঝা তো সরাইখানার দুয়ারে নামিয়ে দিলাম বন্ধু। এবার তবে যাই। যেতে নাহি দিব, যেতে নাহি দিব কান্নার রোলে আমার পরী বেদনামুখর হয়ে উঠল। তাঁর চোখ ছলছল জোয়ারে ভরে গেল। কিন্তু তাঁর চরণ চলল না। ঘাটে বাধা কিস্তির নোঙর টেনে নিয়ে আনজুম পরপার পানে পাল তুলে দিলেন। শূন্য কিনারে দাঁড়িয়ে আমি সেই বিলীয়মান তরীর পানে চেয়ে রইলাম।”

ইবরাহীম খাঁ’র কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। প্রথম কর্মজীবনে টাঙ্গাইলের করটিয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে ১৯২০-এ কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯২০ থেকে ১৯২২ অবধি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে করটিয়া ইংরেজি স্কুলকে জাতীয় বিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন। ১৯২৪ সালে আইন পাস করে ময়মনসিংহের ওকালতি পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯২৬-এ করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অর্থ সাহায্যে করটিয়া সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৪৭ পর্যস্ত এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।

১৯৩৭-এ মুসলিম লীগে যোগদান করেন। একই বছর মুসলিম লীগের মনোনয়ন পেয়ে অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ততা থাকার পরেও তিনি লেখালেখির প্রতি শতভাগ নিবেদিত ছিলেন। নিজের সম্পর্কে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—“লেখা আমার কল্পনা বিলাস নয়। এ আমার আত্মার এবাদত। আমি বুঝি আমার সেবা কত অকিঞ্চিৎকর, আমি জানি আমার লেখা নগণ্য কিন্তু আমার এই তো সম্বল। আনাতোল ফ্রাঁসের বাজিকরের কথা মনে পড়ে। বুদ্ধিহীন আধপাগলা এক বাজিকর, যার বাজিতে আসলে দেখার মতো কিছু নেই, তবু পাড়াগাঁয়ের মূর্খ মানুষেরা তাই দেখে, দু’পয়সা দেয়, বাজিকরের তাতে দিন চলে যায়। হঠাৎ বাজিকরের দেখা হয় এক খ্রিষ্টান পুরোহিতের সাথে। পুরোহিত বাজিকরকে দেখিয়ে বলেন যে, ওসব বাজি কিছুই নয়, ধর্মই আসল। বাজিকর পুরোহিতের কথায় মঠে যায়। সে সেখানে গিয়ে ফাঁপড়ে পড়ে। মঠের সবাই বিদ্বান—কেউ বাইবেল ব্যাখ্যা করে শোনায়, কেউ বাইবেলের টীকা লেখে, কেউবা বাইবেলের পাতায় পাতায় ছবি আঁকে। কিন্তু বাজিকর কী করে মাতা মেরীকে তুষ্ট করবে! আর কোনো পথ না পেয়ে অবশেষে মেরীর মন্দিরের দুয়ার বন্ধ করে তার সামনে বাজি দেখাতে শুরু করে। খবর পেয়ে প্রধান পুরোহিত চুপিচুপি এসে উঁকি দেয়। দেখে, বাজিকর তন্ময় হয়ে বাজির পর বাজি দেখিয়ে যাচ্ছে : তার কপাল ঘামে ছয়লাব। তারপর দেখা গেল মেরী মূর্তি সহসা সচল হয়ে ধীরে ধীরে তার বেদি হতে নেমে এল এবং আপন আঁচল দিয়ে বাজিকরের কপালের ঘাম মুছে দিল।”

শফি উদ্দীন আহমদ ‘ইবরাহীম খাঁ’র কথিত ভাবনা : প্রাসঙ্গিক কথা’য় লিখেছেন—মহান শিক্ষাবিদ সুসাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বিংশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তদানীন্তন বাংলার পশ্চাৎপদ সমাজ জীবনে সব চেতনার দিকনিদের্শ করেছিলেন।

মানবতাবাদী এই ত্যাগী পুরুষ সমাজসেবা, সমাজসংস্কার, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্প-সাধনা, ধর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শিক্ষার মহান আলোকবর্তিকা সারা দেশময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী বীর।

‘A person should be purified in the Contest of his own time’ ইতিহাসের এই মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতেই ইবরাহীম খাঁর জীবনদর্শন, কালিক ভাবনা এবং কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন না হলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ যুগধর্ম প্রত্যেক মহামানব ও মনীষার কর্তব্যজ্ঞান তপস্যার্থক জীবন দর্শন ও কর্ম পদ্ধতির রূপরেখা নির্ধারণ করে থাকে। শুধু তাই না, চিন্তাধারা, দর্শন এবং কর্মকাণ্ড স্বভাবতই সময়ের উপযোগিতার ওপরই যুগোপযোগী ও মহীয়ান হয়ে থাকে। ইবরাহীম খাঁর সমকালীন ভাবনা, চিন্তা-চেতনা, সাধনা ও কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রেও উক্ত সত্যটি সমভাবে প্রযোজ্য। আনোয়ার ইমাম শিক্ষাবিদ ইবরাহীম খাঁ সম্পর্কে এক লেখায় উল্লেখ করেছেন—শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি প্রচুর পুস্তক রচনা করেছেন। তিনি নাটক রচনার মধ্য দিয়ে মুসলিম জাগরণের পথ দেখিয়েছেন। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না—এই বোধ থেকেই তিনি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি কেবল স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না কিংবা করটিয়া সা’দত কলেজেরই প্রিন্সিপাল ছিলেন না, তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি ছিলেন মুসলমান সমাজের পথপ্রর্দশক—মুসলমানদের শিক্ষাগুরু। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র স্মৃতিবিজড়িত করটিয়া সা’দত কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ কলেজ আজ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। অজস্র ছাত্রছাত্রী আজ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। দেশের শিক্ষা বিস্তারে এ দু’টি কলেজ শুধু টাঙ্গাইল জেলায় নয়, সমগ্র দেশেই এক গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইবরাহীম খাঁ’র রূপায়মান স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে।

লেখালেখি আর শিক্ষা বিস্তারে নিজেকে উৎসর্গ করার পাশাপাশি তিনি রাজনীতির সঙ্গেও প্রবলভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৬-এ মুসলিম লীগের টিকিটে মধুপুর-গোপালপুর কেন্দ্র থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তিনি প্রাদেশিক প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪-তে পূর্ববঙ্গ পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হাতেম আলী তালুকদারের কাছে পরাজিত হন। ১৯৫৭-তে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের (কাইয়ুমপন্থী) মনোনয়নে টাঙ্গাইল জেলা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানি আদর্শের সমর্থক। ১৯৬৭-র ২২ জুন পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি বিবৃতি প্রদান করেন।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন সরকারের আমন্ত্রণে তিনি পূর্ববাংলার মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। এবং ১৯৫৩ সালের ১৪ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভুঞাপুর কলেজ (বর্তমানে ইবরাহীম খাঁ বিশ্ববিদ্যাল কলেজ) এবং পরবর্তীকালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম-এর সহযোগিতায় বাংলা কলেজ (বর্তমানে ঢাকার মিরপুরস্থ সরকারি বাংলা কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ইবরাহীম খাঁ এবং অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম।

লেখক হিসেবে ইবরাহীম খাঁ ছিলেন সব্যসাচী লেখক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন—ছড়াকার, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, রচনাকার, ভ্রমণকাহিনি রচয়িতা, শিশুসাহিত্যিক, পত্রলেখক, স্মৃতিকথক। তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য সাধনার জীবনে অসংখ্য রচনায় ঋদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্যভান্ডার।

বিভিন্ন সময়ে ইবরাহীম খাঁ যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন তার মধ্যে রয়েছে ভুয়াপুর কলেজ (বর্তমানে ইবরাহীম খাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ), ভুয়াপুর বালিকা বিদ্যালয়, ভুয়াপুর হাইস্কুল, করটিয়া জুনিয়র গার্লস মাদ্রাসা ইত্যাদি। ইবরাহীম খাঁ’র প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ যমুনা সেতু’র টাঙ্গাইল জেলার স্থানের নামকরণ করা হয়েছে ইব্রাহীম নগর।

ইবরাহীম খাঁ প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো—নাটক : কামাল পাশা (১৩৩৪), আনোয়ার পাশা (২৩৩৭), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), ভিস্তি বাদশা (১৩৫৭), কাফেলা। উপন্যাস : বৌ বেগম (১৯৫৮)। গল্পগ্রন্থ : আলু বোখরা (১৯৬৪), উস্তাদ (১৯৬৭), দাদুর আসর (১৯৭১) মানুষ। স্মৃতিকথা : বাতায়ন (১৩৭৪), লিপি সংলাপ। ভ্রমণকাহিনি : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র (১৯৫৪)। শিশুসাহিত্য : ব্যাঘ্রমামা (১৯৫১), শিয়াল পণ্ডিত (১৯৫২), নিজাম ডাকাত (১৯৫০), বেদুঈনদের দেশে (১৯৫৬), ছোটদের মহানবী (১৯৬১), ইতিহাসের আগের মানুষ (১৯৬১), গল্পে ফজলুল হক (১৯৭৭), ছোটদের নজরুল ইত্যাদি।

ইবরাহীম খাঁ ব্রিটিশ আমলে ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর’ এবং পাকিস্তান আমলে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৩-তে নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৭৬-এ একুশে পদক পান। ইবরাহীম খাঁ শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজসেবা ও রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অবদান রাখেন তা কালিক বিচারে শুধু অতুলনীয় নয়, অনন্যও বটে।

 

(অন্যদিন, ফেব্রুয়ারি ২০০৪)

Leave a Reply

Your identity will not be published.