পোস্টঅফিসের একটা পরিত্যক্ত তালা দেওয়া চিঠির বাক্স। গত ঈদুল ফিতরের দিবাগত রাতে এই চিঠির বাক্সটি আমার নজরে আসে। বেশকিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই ধরনের আরেকটি ডাকবাক্স আমার নজরে এসেছিল। ছবি তোলার সুযোগ হয় নি।
ঢাকা শহরের উত্তরার নিকটবর্তী ফায়দাবাদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি পিলারের সাথে ডাকবাক্সটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জং ধরা তালাটি দেখলেই সহজেই বোঝা যায়, বহুদিন ধরে ডাকবাক্সটি খোলা হয় নি। কেউ আর এই বাক্সে চিঠি ড্রপ করে না। সাধারণ মানুষের হাতেহাতে এখন মুঠোফোনের ছড়াছড়ি। তাই দেশ-বিদেশে আপনজনের সাথে সহজে যোগাযোগ করতে মুঠোফোনকেই জনগণ আজকাল সহজ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ মাত্র দুই দশক আগেও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা তাদের আপনজনদের কাছ থেকে চিঠি প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনতো। বাড়ির কাছে ডাকহরকরাদের দেখলে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো তাদের নামে কোনো চিঠি আছে কি না?
মুঠোফোনের এই যুগে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের মধ্যে চিঠি লেখার প্রচলন বলতে গেলে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এক সময় চিঠি লেখার সাথে জড়িয়ে ছিল আমাদের প্রিয় মানুষদের গভীর মমত্ববোধ, স্নেহ-ভালোবাসার অনেক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তোবা এখন আর বেঁচে নেই। চিঠিগুলো এখন শুধু স্মৃৃতি হয়ে আছে। পুরোনো দিনের সেই আমলে প্রিয়জনদের সাথে ডাকযোগে ঈদ কিংবা নববর্ষের শুভেচ্ছা আদান-প্রদান হতো রংবেরঙের কার্ডের মাধ্যমে। বিশেষ দিনগুলোতে এখন ডাকযোগে কেউ আর শুভেচ্ছা কার্ড পাঠায় না। মুঠোফোনে অতি সহজেই মানুষজন আজকাল পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে তাদের আপনজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে কথা বলতে পারছে, শুভেচ্ছা বার্তা পঠাচ্ছে। ভিডিও কলে একে অপরকে লাইভে দেখছে।
যৌক্তিক কারণেই এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে কষ্ট করে চিঠি লেখার দরকার পড়ে না। শুধু সরকারি চিঠিগুলো আমাদের দেশে এখনো ডাক বিভাগের মাধ্যমে আদান-প্রদান করার প্রচলন রয়েছে। তা ছাড়া জরুরি কোনো ডকুমেন্টস, পার্সেল কিংবা চিঠিপত্র দেশ-বিদেশে দ্রুত আদান-প্রদান করার জন্য মানুষজন এখন পোস্ট অফিসের চেয়েবেসরকারি দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
চিঠি লেখার মধ্যে একটা বিশেষ সৃজনশীলতা রয়েছে। এতে মিশে রয়েছে স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতায় ভরা আশ্চর্য এক অদ্ভুত ক্ষমতা ও ভালোলাগা। প্রিয়জনদের কাছে মনের মাধুর্য মিশানো আবেগ প্রকাশে চিঠির কোনো জুড়ি নেই।
প্রতিবছর আজকের এই দিনে (১ সেপ্টেম্বর) পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’। এই দিবসের শুরু ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি দেশের বড় ব্যক্তিত্বদের চিঠি পাঠাতেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি সেসব চিঠির উত্তর পেতেন না। আর যখন কোনো চিঠির উত্তর পেতেন, তখন তার আনন্দের সীমা থাকত না। সেই ভালোবাসা থেকে সিম্পকিন ২০১৪ সালে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন চিঠি লেখার চর্চা আবার ফিরে আসুক।
ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রয়াত বাবা-মায়ের লেখা কিছু চিঠি ও অনেক আপনজনদের কাছে থেকে পাওয়া বেশ কিছু পুরোনো চিঠি পরম যত্নে আমার কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে। এই চিঠিগুলো আমি যখন পড়ি কিছু সময়ের জন্য সুদূর অতীতে হারিয়ে যাই। প্রয়াত বাবা-মায়ের লেখা চিঠি পড়লে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তাই বিশেষ দিনগুলোতে আপনজনের কাছে চিঠি লিখুন। চিঠি লেখা যেনো কখনোই হারিয়ে না যায়। কথা হারিয়ে যায় কিন্তু চিঠি থেকে যায় স্মৃতি হয়ে বহু বছর ধরে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.