নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৩)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৩)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ১৩তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব 

পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২

লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড

লোকজন প্রায়ই ট্যাক্সিতে এটা ওটা ফেলে যায়। যেমন: সেলফোন, মানিব্যাগ, হাতমোজা, ক্যাপ, ল্যাপটপ কম্পিউটার, বাচ্চাদের খেলনা, গাঁজার পুরিয়া, কোকেনের ছোট্ট প্যাকেট। তবে সবচেয়ে বেশি ফেলে যায় ছাতা। আমার সংগ্রহে অনেক ছাতা আছে। ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র ফেরত দেওয়া যায়। ফোনের মালিক কল করলে আমরা ফোন ফেরত দিয়ে আসি, দুবার কম্পিউটার পেয়েছিলাম, সেগুলোও ফেরত দিয়েছি। হারানো মালপত্র ফেরত পেলে লোকজন খুশি হয়ে ভালো বকশিস দেয়। কিন্তু ছাতা? ছাতা ফেরত দেব কীভাবে? ছাতায় তো আর কেউ নিজের নাম লিখে রাখে না। একবার এক প্যাসেঞ্জার বারবেরি ব্রুট (ডিজাইনার ছাতা) ছাতা ফেলে গিয়েছিল। আমি বিকালবেলা কাজ শেষে সেই ছাতা নিয়ে বাসায় ফিরেছি। বাসায় ঢোকার সাথে সাথে আমার শ্যালিকা চোখ বড়ো করে বলল, ভাইয়া তুমি এই ছাতা পেলে কোথায়? তাকে বললাম, কেউ একজন গাড়িতে ফেলে গেছে।

সে বলল, তুমি এই ছাতার দাম জানো?

আমি জানি না। জানার কথাও না। তাছাড়া আমি কোনো ছাতা বিশেষজ্ঞ নই। আমার কাছে বাংলাদেশের ইদ্রিস ছাতা যা বারবেরি ব্রুটের অতি মূল্যবান ছাতাও তা, তবে সেই ছাতার দাম জেনে সেদিন আমি চমকে উঠেছিলাম। প্রিয় পাঠক, সেই মহামূল্যবান ছাতার দাম ছিল দু’শ নব্বই ডলার। এর কোনো মানে হয়? ছাতার দাম দু’শ নব্বই ডলার হবে কেন? এর হাতল কি স্বর্ণ দিয়ে বানানো?

যাই হোক, এই জীবনে আমি আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের প্রচুর ছাতা উপহার দিয়েছি। তবে সেই ছাতাটি আমার শ্যালিকা নিয়ে গেছে। একবার এক লোক তাঁর মানিব্যাগ ফেলে গেল। লোকজন পেছনের সিটে কী ফেলে যাচ্ছে সেটা জানা আমাদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব। নিরাপত্তাজনিত কারণে ট্যাক্সিতে পার্টিশন থাকে। নিজেকে তখন মনে হয় কবুতরের খুপড়ির মধ্যে বসে আছি, পার্থক্য শুধু এই খুপড়ির সামনে, ডানে, বায়ে জানালা আছে। ড্রাইভিং সিট থেকে পেছনের সিট বা গাড়ির মেঝের কিছুই দেখা যায় না আর আমরা যারা ট্যাক্সি চালাই সাধারণত কাজ শেষ করার পরই পেছনের সিট পরিষ্কার করি। এর আগে কে কী ফেলে যাচ্ছে সেটা জানার সুযোগ কম! ধরুন আপনি ম্যানহাটানে একটা ট্যাক্সিতে উঠেছেন। ট্যাক্সি আপনাকে আপনার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়েছে। নামার সময় অসাবধানতাবশত আপনি আপনার মানিব্যাগটি ট্যাক্সিতে ভুলে ফেলে গেলেন। আপনি নামার পর অন্য কেউ সেই ট্যাক্সিতে উঠল। এখন সে যদি ভালোমানুষ হয়, তাহলে সিটে পড়ে থাকা আপনার মানিব্যাগটি ট্যাক্সিড্রাইভারের কাছে দেবে এবং সেই ড্রাইভার যদি সৎ চরিত্রের হয় তাহলে আপনার মানিব্যাগ পাওয়ার সম্ভাবনা এক  শ’ পার্সেন্ট কিন্তু প্যাসেঞ্জার যদি নিজেই সেই মানিব্যাগটি পকেট করে, তাহলে ড্রাইভারের সেটা জানার কথা না।

এক ভোরবেলা আমার ট্যাক্সিতে এক বুড়ো মহিলা উঠেছেন। ফিফথ এভিনিউর বড়োলোক মহিলা। এই ভোরেও তাঁর সাজসজ্জা চোখে পড়ার মতো। তাঁর গা থেকে দামি সেন্টের সুবাস আসছে। মনে হচ্ছে তিনি পুরো এক বোতল সেন্ট গায়ে ঢেলেছেন। মহিলা গাড়িতে উঠেই সেফটি পার্টিশনে টোকা দিয়ে বললেন, ড্রাইভার, কেউ তোমার গাড়িতে মানিব্যাগ ফেলে গেছে। এই বলে মানিব্যাগটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি মানিব্যাগ হাতে নিলাম। এ দেশে সবারই আইডি আছে। পেটমোটা কালো রঙের চামড়ার বিশাল মানিব্যাগটিতে নানা ধরনের আইডি। মানিব্যাগে লোকটির ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেলো আরও পেলাম বন্দুকের লাইসেন্স, প্লেনের প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স, ফিশিং পারমিট, হান্টিং পারমিট। নগদ পঞ্চাশ ডলার এবং একটি ভিসিটিং কার্ড। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে লোকটিকে চিনলাম। তাঁকে কিছুক্ষণ আগে অন্য এক জায়গায় নামিয়েছি তাছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সে তাঁর ঠিকানা আছে। ওই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেই মামলা ডিসমিস। একবার এক নেদারল্যান্ডের লোক তাঁর মানিব্যাগ ফেলে গিয়েছিল। নিজের গাঁটের বাইশ ডলার খরচ করে সেই মানিব্যাগও তাঁর কাছে ফেরত পাঠিয়েছি। উপহারণস্বরূপ সে আমাকে ফেডারেল এক্সপ্রেসে বিশাল এক পনির পাঠিয়েছিল। পনিরের নাম এডাম চিজ। পনিরের আকৃতি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমাদের দেশের পনিরের প্রায় চার গুণ! অতি অখাদ্য সেই পনির আমি খেতে পারি নি। আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পনির হচ্ছে আমাদের দেশি পনির, যার ধারেকাছে অন্য কোনো পনির আসবে না।

যাই হোক, মূল গল্পে ফেরা যাক। মানিব্যাগে যে ভিসিটিং কার্ড পেলাম তাতে অন্য কারও নাম লিখা ছিল। তাঁকে ফোন করলাম। প্রথমে সে কিছুই বুঝল না। অনেক কষ্টে তাঁকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। এবার সে বুঝল। সে আমার ফোন নাম্বার রেখে ফোন ছেড়ে দিল। ফোন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই মানিব্যাগ মালিকের ফোন। প্রতিটি বাক্যে বলার সাথে সাথে সে আমাকে তিনবার করে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। তাঁকে বললাম দেখো, তোমার মানিব্যাগ আমি খুঁজে পাই নি গাড়ির আরেক প্যাসেঞ্জার পেয়েছে। মানিব্যাগের টাকাপয়সা খোয়া গেলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না। সে হেসে বলল, আমার মানিব্যাগে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। যাই হোক তাঁকে সেদিন তাঁর মানিব্যাগ ফেরত দিয়েছিলাম। সে আমাকে এক  শ’ ডলার দিয়েছিল। বাংলাদেশি এক ট্যাক্সি ড্রাইভার একবার নগদ চৌদ্দ হাজার ডলার তাঁর ট্যাক্সিতে পেয়েছিলেন। তিনি সেই টাকা প্রায় পঞ্চাশ মাইল গাড়ি চালিয়ে মালিককে ফেরত দেন। আরেকজন পেয়েছিলেন ছোট্ট এক বাক্স হীরা এবং তিনি তাঁর মালিককে সেই হীরা ফেরত দিয়েছিলেন।

এখন আপনাদের যে গল্প শোনাতে যাচ্ছি, সেটা মানিব্যাগ বিষয়ক। চলুন গল্পে ঢুকে পড়া যাক!

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.