অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ থাকছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন।
অম্বিকাপুর আমাদের ডাক দিয়েছে। কবি জসীমউদ্দীনের শেকড় অন্বেষণে আমরা নেমেছি পথে। ঢাকা থেকে আমরা এসেছি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায়, সেখান থেকে রিকশায় চলেছি অন্বিকাপুরের পথে। যেতে যেতে এই তথ্য মনে উদয় হলো যে, ফরিদপুরের আগের নাম ফতেহবাদ। হযরত শাহ ফরিদের নামানুসারেই ফরিদপুর নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৮৫০ সালে, ফরিদপুরকে জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। পাশাপাশি একথাও মনে হলো যে, এই যে আমার অম্বিকাপুর গ্রামে যাচ্ছি, এই গ্রামটিরও আগে নাম ছিল গোবিন্দপুর। আর এই গোবিন্দপুর অধুনা অম্বিকাপুর গ্রামে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি অবস্থিত। তবে এখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন নি। তিনি জন্মেছিলেন নানাবাড়ি তাম্বুলখানা গ্রামে—অম্বিকাপুর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে অবস্থিত।...কবি কবে জন্মেছিলেন এটি নিয়ে মতভেদ আছে। জন্মের মাস নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। তবে সবর্জন স্বীকৃত দিনটি হচ্ছে—১ জানুয়ারি, ১৯০৪।
রিকশার চাকা একসময় অম্বিকাপুরের মাটি স্পর্শ করল। চারদিকের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, অবারিত মাঠ ও পদ্মা নদী দেখে আমাদের দু’চোখ মুগ্ধ হলো। মনের মাঝে ভিড় জমাল পল্লীকবি রচিত পঙ্ক্তিমালা ‘তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করি/মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়/তুমি যাবে ভাই—যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়/ছোট গাঁওখানি—ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,/কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।/ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,/পারের খবর/টানাটানি করি/ বিনাসূতী মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;/বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।’
অম্বিকাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই শুধু আমাদের মুগ্ধ করল না, মানুষের জীবনধারাও দু’চোখ ভরে দেখার মদো। পদ্মা নদীর ওপারের গ্রামগুলো যেন হাতছানি দিয়ে আমাদের ডেকে উঠল। কোথাও কোথাও দুই গ্রামের মাঝখানের অবারিত মাঠ দেখেও চোখ জুড়াল। আবার মনে পড়ে গেল জসীমউদ্দীনের কবিতা—‘এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও—মধ্যে ধু-ধু মাঠ/, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।/এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা হেথায় হোথায় গাছ;/গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ/ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল-কায়া,/ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় ঘরের মায়া।’
একসময় রিকশার গতি রুদ্ধ হয় একটি বাড়ির সামনে। এটিই আমাদের গন্তব্যস্থান। এটিই পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি।
পথের ধারেই বাড়িটি। বাড়ির চারদিকে নানারকম গাছগাছালি। বাড়ির সামনে জসীমউদ্দীনের পারিবারিক বাগান ও পারিবারিক কবরস্থান। যে-কোনো আগন্তুকেরই দৃষ্টি চলে যাবে প্রথমে এই পারিবারিক কবরস্থানের দিকে।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বড় একটি উঠানের চারদিকে চারটি ঘর। তিনটি টিনের ঘর। একটি একতলা দালান। উত্তর দিকের টিনের ঘরটিতে থাকতেন পল্লীকবির ছোটভাই প্রফেসর নুরুদ্দীন মোল্লা, দক্ষিণ দিকে থাকতেন বড়ভাই আলহাজ মফিজ উদ্দীন মোল্লা (এখন এখানে পাকা দালান), পশ্চিম দিকে থাকতেন সেজ ভাই সাঈদ উদ্দীন মোল্লা এবং পূর্ব দিকের টিনের ঘরে থাকতেন কবি জসীমউদ্দীন। উল্লেখ্য, জসীমউদ্দীন ছিলেন ভাইদের মধ্যে মেজ।
কবি জসীমউদ্দীনের বংশ অম্বিকাপুরে মোল্লা বংশ হিসেবে সুপরিচিত। মোল্লা কবির পারিবারিক উপাধি। জানা যায়, জসীমউদ্দীনের এক দাদা (পিতার চাচা) জহির মোল্লা গ্রামের মোল্লা ছিলেন। কোনো এক অজ্ঞাতে কারণে তিনি বসতি উঠিয়ে মালদহ জেলায় চলে যান এবং তখন গ্রামের ইমামতির ভার সাময়িকভাবে অর্পিত হয় কবির বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লার ওপর। পীর বাদশা মিঞার দাদা পীর দুধু মিঞা তাঁকে এ সংক্রান্ত একটি সনদও প্রদান করেন। পরে এই বংশের বচন মোল্লা প্রতিদ্বন্দ্বী হলে গ্রামের লোকদের ইচ্ছায় আনসার উদ্দীন মোল্লা ইমামতির দায়িত্ব ত্যাগ করেন। তবে তাঁকে গ্রামের মাতব্বর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
কবির পিতা আনসার উদ্দীন মোল্লা নিজের জমিজমার চাষাবাদ তদারক ছাড়াও স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। যে হিতৈষী এম.ই.স্কুলে কবি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন সেখানে তাঁর পিতা শিক্ষকতা করতেন (জসীমউদ্দীনের শিক্ষাজীবনের শুরু হয় অম্বিকাপুরের পাশের গ্রাম শোভারামপুরের অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায়। সেখান থেকে হিতৈষী এম.ই.স্কুল, তারপর ফরিদপুর জিলা স্কুল—এখান থেকেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে তিনি আইএ পাস করেন ১৯২৪ সালে। একই কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার’ বিভাগ থেকে এমএ পাশ করেন।)
মা আমিনা খাতুন স্নেহময়ী ও সরলা প্রকৃতির গৃহবধূ ছিলেন। নকশীকাঁথা সেলাই ও নকশী পিঠা তৈরিতে তাঁর সুনাম ছিল।
আমার সঙ্গী, অন্যদিন-এর ফটোগ্রাফার বিশ্বজিৎ সরকার পল্লীকবির বাড়ির চারটি ঘরের আলোকচিত্র ক্যামেরা-বন্দি করার কাজে ব্যস্ত হলো। এক সময় সে কবি যে ঘরে থাকতেন এবং যেখানে বসে কবিতা লিখতেন, সেই ঘরের ছবি তুলতে মগ্ন হলো। বর্তমানে এই ঘরে কবির ব্যবহৃত একটি চৌকি রক্ষিত রয়েছে।
জসীমউদ্দীনের কবিতা রচনায় হাতেখড়ি হয় অল্প বয়সেই। সাত-আট বছরে কবির লড়াই প্রত্যক্ষ করে নিজেও কবিগানে উৎসাহিত হন। গ্রামের তাঁতিপাড়ার কণ্ঠশিল্পী রহিম মল্লিকের সঙ্গে ‘সতী যমরাজা’ পালার অনুকরণে তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করতে শুরু করেন। অতঃপর বহু জায়গায় কবিগানের আসরে অংশ নিয়ে পদ রচনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি প্রথম কবিতা লিখেন। ১৯২১ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় মুদ্রিত ‘মিলন গান’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। তবে ১৯২৫ সালে ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত ‘কবর’ কবিতাটিই তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোর সামনে নিয়ে আসে। দীনেশচন্দ্র সেন কবির কাছে লিখিত চিঠিতে লেখেন—‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।’
আমরা পল্লীকবির বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখি। বেশ বড় বাড়ি। জানা গেল, ১৪ বিঘা জমির ওপর এই বাড়িটা পত্তন করেছিলেন জসীমউদ্দীনের দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা।...বাড়ির একপাশে পাকা টয়লেটও দেখা গেল। যখন এখানে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসে, তাদের ব্যবহারের জন্যই এই টয়লেট।
‘কবর’ কবিতার অমর স্রষ্টা জসীমউদ্দীন যেখানে শায়িত রয়েছেন—বাড়ির সামনে অবস্থিত সেই পারিবারিক কবরস্থানে আমরা যাই। গিয়ে দেখি— কবরস্থানের ঠিক মাঝখানটায় একটি ডালিমগাছ, তারই নিচে জসীমউদ্দীনের কবর। সংগত কারণেই আমাদের চেতনায় ভিড় জমায় পল্লীকবির ‘কবর’ কবিতার পঙক্তিমালা: ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে/এইটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ/পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।’
...জসীমউদ্দীন জীবনের অন্তিম বেলায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চের ভোররাতে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার কিছুক্ষণ পরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। জসীমউদ্দীনের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ হেলিকপ্টারে করে এখানে, তাঁর এই পরমপ্রিয় গ্রাম অম্বিকাপুরে (গোবিন্দপুর) নিয়ে আসা হয় এবং এখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অম্বিকাপুরে পল্লীকবির পারিবারিক কবরস্থানটি লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা, বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো। কবরস্থানও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ‘কবর’ কবিতাটিই যেন এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতায় যেমন দেখা যায়, নাতির হাত ধরে বৃদ্ধ দাদা পারিবারিক কবরস্থানে পরিবারের এক-একজন সদস্যের কবরের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন এবং নাতিকে বলছেন, কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে—এই কবরস্থানে তেমনি একই পরিবারের বহু মানুষ অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন। এখানে কবি জসীমউদ্দীনের ছাড়াও আর যাঁদের কবর রয়েছে, তাঁরা হলেন—কবির বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লা (মৃত্যু: ১৯৪৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি), মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছোটু (১৫.১০.৫৩), বড়ভাই আলহাজ্ব মফিজ উদ্দীন মোল্লা (১৪.০৪.৬৩), বড় ভাবি মোছাঃ জরিনা খাতুন (১৯৭৩), সেজভাই সাঈদ উদ্দীন মোল্লা (২৪.০৩.৭৫), ছোটভাই প্রফেসর নুরুদ্দীন মোল্লা (১৯৬৪), বোন নুরুন নাহার সাজু (১৯৫৩), বড় ছেলে কামাল আনোয়ার (০৩.০৬.৯০), ভাতিজি মোসাঃ হোসনে আরা দোলন, বড় মেয়ের ছেলে আসিফ (৩০.০৩.৮০)। এ ছাড়া কবির এক ভাগ্নের কবরও রয়েছে। উল্লেখ্য, পল্লীকবির স্ত্রী মমতাজ বেগম (মনিমালা) এখনো বেঁচে রয়েছেন। আরও বেঁচে রয়েছেন মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার (বর্তমানে পশ্চিম জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কর্মরত), সেজ ছেলে ফিরোজ আনোয়ার (কানাডায় কর্মরত), ছোট ছেলে খুরশীদ আনেয়ার (পশ্চিম জার্মানিতে কর্মরত) বড় মেয়ে বেগম হাসনা মওদুদ এবং ছোট মেয়ে আসমা তৌফিক।
পল্লীকবির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। তবে এখন আর পদ্মা প্রমত্তা নয়। পদ্মার এখন ক্ষীণ স্রোতধারা। যখন পল্লীকবির যৌবন ছিল তখন এই পদ্মারও যৌবন ছিল।...পদ্মা তীর সংলগ্ন সবুজ ঘাসে মোড়া বিশাল এলাকায় প্রতি বছর জানুয়ারিতে—পল্লীকবির জন্মমাসে এখানে ‘জসীম পল্লীমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় থাকে চমৎকার আলোকসজ্জা আর পুতুল নাচ। সার্কাস হয়, নাগরদোলায় শিশু-কিশোররা চড়ে আনন্দের স্রোতে ভাসে। এখানকার স্থায়ী মুক্তমঞ্চে অভিনীত হয় পল্লীকবি রচিত কাব্যনাট্য, আরও কত কী! ফরিদপুরের মানুষেরা তখন মেতে ওঠে। আশপাশের জেলা থেকে কবির গুণগ্রাহীরা আসে। এইসব মানুষের বিশ্রামের জন্যে কিছু ছাউনিও রয়েছে। এ ধরনের একটি ছাউনির নামকরণ করা হয়েছে ‘রূপাই ছায়াঘর’। এটি নির্মিত হয়েছে পূবালী ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায়।...‘জসীম পল্লীমেলা’ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ে বিশুদ্ধ পানিরও ব্যবস্থা থাকে। আর্সেনিকমুক্ত এই পানিরও নামকরণ করা হয়েছে পল্লীকবির অকাল প্রয়াত নাতির নামে— ‘আসিফ আর্সেনিক মুক্ত পানি’।
পদ্মা পাড়ে ঘুরতে ঘুরতে পল্লীকবির অস্তিত্ব মনে মনে বোধ করলাম। কবি রচিত ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ গ্রন্থের একটি অংশ মনের মাঝে উঁকি দিয়ে গেল যেখানে তিনি বলেছেন—‘পদ্মা তীরে আমাদের বাড়ি। সেই নদীর তীরে বসিয়া নানা রকমের কবিতা লিখিতাম, গান লিখিতাম, গল্প লিখিতাম। বন্ধুরা সে সব শুনিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন। কেউবা সামান্য তারিফ করিতেন। মনে মনে ভাবিতাম, একবার কলিকাতায় যদি যাইতে পারি, সেখানকার, রসিক-সমাজ আমার আদর করিবেনই।’ সত্যিই তাই, কলকাতার রসিক-সমাজ কবির লেখার সমাদর করেছিল। এক্ষেত্রে কবি নজরুলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
এই ক্ষীণ স্রোতের পদ্মা নদীতে এখন আর বেদের বহর দেখা যায় না। কিন্তু জসীমউদ্দীনের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে এই নদীতে দেখা যেত বেদের বহর। ফলে বেদে সম্প্রদায়ের জীবন অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় পল্লীকবির। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি ‘হোমরা বাদ্যা’ লোকনাট্যটি অবলম্বনে রচনা করেন ‘বেদের মেয়ে’। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জসীমউদ্দীন লেখেন কাহিনি কাব্য ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’। এ প্রসঙ্গে তিনি ওই গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন—‘আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে চাষী বহু মুসলমান ও নমঃশূদ্রের বাস। তাহাদের মধ্যে সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়। এইসব বিবাদে ধনী হিন্দু-মুসলমানেরা উৎসাহ দিয়া তাহাদিগকে সর্বনাশের পথে আগাইয়া দেয়। মহাজন ও জমিদারদের মধ্যে কোনো জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা পৃথিবীতে সকলে একই জাতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগ্য নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয়, তাহা চোখে দেখিলে অশ্রু সংবরণ করা যায় না। এমনি একটি ঘটনা লইয়া এই পুস্তকের সূত্রপাত।’
অম্বিকাপুর আমাদের ডাক দিয়েছিল, প্রাণের মাঝে অনুভব করতে চেয়েছিলাম পল্লীকবির প্রাণস্পন্দন— সেই প্রাণস্পন্দন অনুভব করছি প্রাণে।...কবির পারিবারিক কবরস্থানের দেয়ালে কবি রচিত যে পঙ্ক্তিমালা স্থান পেয়েছে— ‘এই নদীর তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে/আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে/সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে অভাগা গাঁয়ের কবি/জীবনের কোন কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি’—কবির এই আক্ষেপ সত্যি নয়, সত্যি হয় নি; আজও এ দেশের মানুষের মনে রয়েছে তাঁর স্থান। সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। এখন যাওয়ার সময় হলো বিহঙ্গের।
আমরা আবার পথে নামলাম। কিন্তু রিকশায় চড়ে ফেরার পথে চারদিকের আঁধার দেখে কেন যেন মনে হতে লাগল—আমাদের বিদায়ে পল্লীকবির অম্বিকাপুর বড়ই বিষণ্ন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.