‘উত্তমবাবুও আমার মতো দুঃখী ছিলেন’
কিংবদন্তি ভারতীয় চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক ও অভিনেতা রাজ কাপুর। ১৯২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ারের হাবেলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে স্বনামধন্য এই অভিনেতার একটি সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রকাশ করা হলো। ১৯৮৮ সালের তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল।
অভিনেতা পৃথ্বিরাজ কাপুরের বড় ছেলে, পুরো নাম রণবীর রাজ কাপুর। তাকে ‘ভারতীর চলচ্চিত্রের সেরা পথপ্রদর্শক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৩৫ সালে, মাত্র দশ বছর বয়সে, ক্যামেরার মুখোমুখি হন রাজ কাপুর। ছবিটির নাম ছিল ‘ইনকিলাব’। তবে বড় ধরনের ব্রেক পান ১৯৪৭ সালে, ‘নীল কমল’ চলচ্চিত্রে। ১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবির নাম ‘আগ’। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র আন্দাজ, চোরি চোরি, জাগতে রাহো। তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: আওয়ারা, শ্রী ৪২০, দিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়, সঙ্গম, মেরা নাম জোকার, ববি, রাম তেরি গঙ্গা মৈলি, প্রেমরোগ, হেনা।
১৯৮৬ সাল। এক বছর ধরে খবর নেয়ার পর শুনলাম, মুম্বাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক রাজ কাপুর আবার তাঁর আর. কে. স্টুডিওতে ফিরে আসবেন। দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি যোগাযোগ ছিল হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি চিত্রনাট্যকার তথা লেখক শচীন ভৌমিকের সঙ্গে। তাঁর কথা মতো পৌঁছে গেলাম মুম্বাইয়ের আন্ধেরীতে রাজজীর আর. কে. স্টুডিওতে। সম্বল বলতে আমার পরিচয় সম্বলিত শচীন ভৌমিকের লেখা একটি চিরকুট। ঘটনাচক্রে সেদিনই প্রায় এক বছর পরে এসেছিলেন অসুস্থ রাজ কাপুর। গেটে ঢোকার মুখেই বাধা। কারণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিস্টে আমার নাম নেই। ওয়েটিং রুমে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের অধিকাংশই বিদেশি সাংবাদিক। বেশিরভাগই রাশিয়ার। দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, ওঁদের অনেকেই টিভি চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত।
কিছুতেই দ্বাররক্ষীকে বোঝাতে পারছি না যে, লিস্টে আমার নাম না থাকলেও একটা চিঠি আছে রাজসাহেবকে দেয়ার জন্য। ইতিমধ্যে একে একে ডাক পড়ছে সাংবাদিকদের। অনেকক্ষণ পরে কিছুটা বিরক্তি সহকারে সেই চিঠিটা পাঠিয়ে দেয়া হলো স্টুডিওর ভিতরে। তারপরও প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চলল ‘শবরীর প্রতীক্ষা’। এরই মধ্যে বার কয়েক দ্বাররক্ষী বললেন, ‘আপনি ফিরে যান। কোনো আশা নেই রাজজীর সঙ্গে দেখা হওয়ার।’ রাজকাপুরের সেক্রেটারি হরিশ বিদ্রার সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল। হঠাৎ দেখলাম, হরিশজী স্বয়ং এসে আমার নাম ধরে ডাকছেন। বুঝলাম, শিকে ছিঁড়েছে। বেচারি দ্বাররক্ষীর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বিস্ময়ের চিহ্ন।
যা’ হোক, আমাকে যে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তার পাশেই বসেছিলেন রাজ কাপুর। মিনিট দশেকের মধ্যে আমার ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘কলকাতা থেকে এসেছেন?’ অবাঙালিরা যেভাবে বাংলা বলেন সেইভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কলকাতায় কোথায় থাকেন?’ বললাম, ‘আপনি যেখানে থাকতেন, সেখানেই। হাজরা পার্কের পিছনে।’ হাজরা পার্ক নামটা কানে যেতেই বললেন, ‘এখন ওখানে মিটিং-উটিং কুছু হয়?’ বললাম, মাঝে মাঝে হয়।
এইভাবে দু’ একটা কথার পর হঠাৎ বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি আমার যে ইন্টারভিউটা নেয়ার জন্য এসেছেন, তার হেডিংটা কী হোবে?’ এবার তো অবাক হওয়ার পালা আমার। সাধারণত যে-কোনো লেখা তৈরি হওয়ার পর আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী হেডলাইন কী হবে ঠিক করি। কেন জানি না, সেদিন ওঁকে বলেছিলাম, “কী আবার হবে, রাজার কাছে এসেছি, তাই হেডলাইন হবে, ‘রাজার নাম রাজ কাপুর’।” চমকে উঠে রাজজী বললেন, ‘শালা, বাঙালীরা খুব গ্যাস দ্যায়। নিন চালু করুন আপনার ইন্টারভিউ।’
ইন্টারভিউ শুরু করার আগে একটা প্রয়োজনীয় কথা পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়ে রাখি। তা হল, সেদিন কিন্তু রাজ কাপুর টেপ ব্যবহার করার অনুমতি দেন নি। তাঁকে ঘিরে ছিলেন প্রায় জনা দশেক ডাক্তার। আমার কথা চলার জন্য সময় বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র দশ মিনিট।
প্রথমেই জানতে চেয়েছিলাম, ‘মেরা নাম জোকার’-এর মতো ছবি ফ্লপ করল কেন?
অকপটে বললেন, “আজ ডিস্ট্রিবিউটরদের মতে ফ্লপ মনে হলেও আমি মনে করি, এটি কালজয়ী ছবির তালিকায় অনায়াসে স্থান করে নিতে পারবে। জানেন, ছবিটা রিলিজ করার পর যখন সব জায়গা থেকে নেগেটিভ খবর আসছে তখন বারবার মনে হয়েছে, আমি তো এখনো আর. কে. ফিল্মসের লোগোটা বন্ধক দিয়ে দিই নি। অনেকটা সেই জোরেই আস্তে আস্তে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম নতুন ছবির তৈরি করলাম ‘ববি’।”
বললাম, ‘ববি’র যে দৃশ্যে হাতে ময়দা মাখা অবস্থায় ডিম্পল বেরিয়ে এসে দরজা খুলেছিলেন, তার সঙ্গে আপনার জীবনের কি কোনো মিল আছে?
আদ্যন্ত পেশাদার ভঙ্গিমায় রাজকাপুর বললেন, ‘আপনি তো চাইছেন আমার সঙ্গে বেবির (নার্গিস) রোমান্সের গল্প শুনতে। শুনুন, বেবির সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ প্রেমের কথা জানে না এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যতদিন বেবি আমার সঙ্গে ছিল, ততদিন আমি খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে বিরাজ করেছি। কিন্তু আমি যে বিবাহিত তা ভুলি কেমন করে? একদিকে কাপুর খানদানের আভিজাত্য, অন্যদিকে জর্দানবাঈয়ের মেয়ের সঙ্গে অনাবিল প্রেম- এ নিয়ে আমার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই, দীর্ঘদিন আমরা একে অপরের সঙ্গে কাটিয়েছি। দেখলে মনে হতো, আমরা স্বামী-স্ত্রী। রাশিয়ায় আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে সেখানকার মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত। কিন্তু বেবির সংসর্গ আমার ভাগ্যে ছিল না। বলতে দ্বিধা নেই, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার পরিবার।’
জিজ্ঞেসা করলাম, “সঙ্গম’ ছবিতে উত্তমকুমারকে কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত বাদ দিয়েছিলেন কেন?”
প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে রাজকাপুর বললেন, ‘উত্তমবাবু, রাজেন্দ্র কুমারের জায়গায় অভিনয় করতে রাজি হন নি। তবে মানতেই হবে, ওঁর মতো অভিনেতা লাখে একটাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।’
একটু উস্কে দিয়ে বললাম, ‘উত্তমকুমার আর আপনার মধ্যে কিছুটা ইগোর লড়াই ছিল?’
রাজ কাপুর ও নার্গিস
এবার কোনো রাখঢাক না করেই বললেন, ‘তা তো থাকতেই পারে। দেখুন মশাই, একটা আকাশে দুটো সূর্য থাকতে পারে না। তবে দেখা হলে আমরা দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছি, সিনেমা নিয়ে আলোচনা করেছি। এক সময় ঠিক হয়েছিল, আমরা দু'জনে মিলে ছবি তৈরি করব। আর. কে. ফিল্মসের ব্যানারে। গল্প বাছাইয়ের কাজ শেষ। এমন সময় উনি চলে গেলেন। শুধু ছবি তৈরিই নয়, ভারতীয় সিনেমার অন্যান্য বিষয়েও ওঁর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খুব ভালো গান গাইতেন উত্তমজী। কিন্তু বোধ হয় আমার মতো তিনিও খুব দুঃখী ছিলেন। সবাইকেই আঁকড়ে ধরতে চাইতেন।’
কথায় কথায় কখন যে দশ মিনিট সময় পেরিয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারি নি। সতর্ক করলেন সহকারী হরিশ বিন্দ্রা।
বললেন, ‘আর একটা প্রশ্ন করবেন হিমাংশু।’
বললাম, ‘আপনার বাঁহাতটা পরে কি জোড়া লেগেছিল?’
হো হো করে হেসে উঠলেন রাজকাপুর। বললেন, ‘সত্যি করে বলুন তো, আপনি গোয়েন্দা না সাংবাদিক? হ্যাঁ, ছোটবেলায় হাজরা পার্কে খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতের হাড় সরে গিয়েছিল। তখন গুরুদ্বারের লোকজন এসে আমার সরে যাওয়া হাড় সোজা করে দেয়। কিন্তু আজও অবধি বোধ হয় তা ঠিক হয় নি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিছুই হয় নি। আমার মতে আমার বাঁ হাতটা কমজোরই রয়ে গিয়েছে। এখন বয়স হয়েছে। শরীরটাও ঠিক সাথ দিচ্ছে না। জানি না, কতদিন বাঁচব। তবে এতদিন পরে বুঝতে পারছি, যা ভাগ্যে লেখা আছে তার বাইরে যাবার ক্ষমতা আমার নেই। তবে পাশাপাশি এও বুঝতে পেরেছি, ভগবান চিরদিন কারও জীবন অন্ধকারে ঢেকে রাখেন না। একসময় তার জীবনেও সূর্যোদয় হয়। সুদিন আসে।’
Leave a Reply
Your identity will not be published.