নাসির আহমেদ-এর গুচ্ছ কবিতা

নাসির আহমেদ-এর গুচ্ছ কবিতা

কবি নাসির আহমেদের জন্ম দ্বীপজেলা ভোলার আলীনগর গ্রামে। মৌলভী আবদুল গফুর ও উম্মে কুলসুমের চতুর্থ সন্তান নাসিরের ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতা শুরু। পেশাগত জীবনে সাপ্তাহিক গণমুক্তি, বাংলাদেশ বেতার, দৈনিক বাংলা, দৈনিক জনকণ্ঠ, সমকাল, বর্তমান ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের বার্তা পরিচালকসহ নানা গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর নাসির আহমেদ লিখছেন ১৯৭২ সাল থেকে। সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করেন। সাংবাদিকতাও দীর্ঘকালের।

লিখেছেন ছোটদের জন্য বহু গল্প-কবিতা-ছড়া আর বেতার-টিভিতে প্রায় হাজারখানেক গান। একাধিক টিভি সিরিয়ালসহ অনেক টিভি নাটকও। কিন্তু সব ছাপিয়ে তার কবি পরিচিতি মুখ্য। প্রকাশিত গ্রন্থ তিরিশের অধিক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আকুলতা শুভ্রতার জন্য’ (১৯৮৫)। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘না হয় না দিলে আশা’।

সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১০), বিষ্ণু দে পুরস্কার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি সম্মাননা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, কাব্যকলা পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক, জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার, সুকান্ত একাডেমি পুরস্কার, চন্দ্রাবতী একাডেমি পদক, কবিতালাপ পুরস্কার, জাতীয় মঙ্গল পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার, টেলিভিশন রিপোর্টার্স আসোসিয়েশন পুরস্কার, খাগড়াছড়ি থিয়েটার পদকসহ নানা সম্মাননা ও স্বীকৃতি। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য অর্জন করেছেন শিল্পী বশীর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার।

এখানে নাসির আহমেদের একগুচ্ছ কবিতা তুলে ধরা হলো।

বেজে ওঠে বিষাদ রাগিনী

অকস্মৎ থেমে যাচ্ছে হাওয়া। রোদ্দুরের রং মুছে দিচ্ছে অন্ধকার।

এই ঘোর স্তব্ধতার গহিন ভেতর থেকে পাতাঝরা শব্দ ভেসে আসে

শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা রোগীর নিঃশ্বাসে অন্ধকার ঝরে পড়ে!

কে যায়? অন্তিম জলতেষ্টা কার ফুসফুসে আগুন টেনে আনে!

 

বহুদূর থেকে ভেসে আসে বিষাদের অশ্রুফোঁটাসহ সেই

করুণ রাগিনী- যার খাঁচা ভেঙে উড়ে গেছে পাখি নিরুদ্দেশে

কয়েকটা পালক শুধু পড়ে আছে খাঁচার কিনারে অশ্রু হয়ে

কে যায় এমন রিক্ত করে চরাচর! সে আমার স্বজন সুহৃদ নয়?

 

সব চাওয়া-পাওয়া সব লেনদেন ফুরায় এভাবে প্রতিদিন

কিছু ঋণ থেকে যায়, অপরিশোধ্য ঋণ মাটির নিকটে থেকে যায়।

কাঁচা মাটি কোলে নেয় ঘুমন্ত সন্তান তার ঘাসের আড়ালে।

কে যায় এমন অন্ধকার ঘরে শূন্যহাতে সবকিছু ফেলে!

 

প্রতিটি মুহূর্ত আজ মৃত্যু গন্ধময়! স্বজন-আপন সে-ও ভয়ানক ভয় নিয়ে

চরম দূরত্বে সরে যায়! এমন নির্মম আর স্বার্থান্ধ সময়

কখনও দেখি নি আগে! কার কাছে যাব আজ সান্ত্বনার খোঁজে!

কেউ নেই, কিছু নেই, সারাটা পৃথিবী আজ চরম নিঃসঙ্গ অসহায়!

 

দিগন্ত রেখার সঙ্গে মিশে গেছে আকাশ মাটির এই ঘর

কী করুণ অসহায় বিষাদের সুর আজ হাওয়ায় ছড়ায়!

 

স্মৃতি নিয়ে তবু

সেই যে সোনারোদ, সেই যে সকালের আলোতে লীন,

একটি চঞ্চল লাটিম হাতে নিয়ে ছুটেছি পথ

কোথায় সে সময়, কোথায় সে লাটিম, খুঁজছে মন

আছে তো কোথাও না কোথাও সেই আলো, এখনো অম্লান দিন!

 

সময় মহাকালে কোথাও রয়ে যায় গোপনে

স্বপ্নগুলো আজও কোথাও একা একা আমাকে

খুঁজছে দুপুরের তপ্ত লালদিন, রৌদঝলসিত গল্প!

এখন বিকেলের স্নিগ্ধ নীল আলো কোথাও নীরবেই ঝরছে।

 

আমি তো সকালের, আমি তো দুপুরের, আমি তো বিকেলেরও সঙ্গী

কী করে ছেড়ে যাই এমন মায়াময় আলোর গতিময় ছন্দ!

আমাকে সহসাই চমকে দিয়ে ফিরে আসে সে দিন আর রাত্রি!

সন্ধ্যা নেমে এলে কোথাও মুছে যাবে সে আলো!

 

করোনাকালে এই মৃত্যুশয্যায় স্মৃতিতে

কত কী ফিরে আসে! মানুষ আসলেই একাকী।

মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে ভালোবাসে। মৃত্যু জীবনেরই অংশ

এ কথা মানে না সে, বাঁচতে চেয়ে একা নিঃস্ব!

 

আমিও জেনে যাই গোধূলিলগ্নে এ সত্য-

কিছুই স্থায়ী নয়, তবু তো স্মৃতি নিয়ে মানুষ অমরতা চাইছে।

 

এই কবিতাটি প্রার্থণা হোক

এই কবিতাটি দুফোঁটা অশ্রু শুভ্র শিশির

এই কবিতাটি চিরবিদায়ের এপিটাফ হবে তার জন্যই-

যাকে ভালোবেসে কিশোরবেলায়

জেনেছি প্রথম ভালোবাসা কী যে কুহেলী দহন!

 

এই কবিতাটি নিঃসঙ্গ রাত, রাতের শিয়রে অশ্র“র ফোঁটা

টুপটাপ ঝরে নীরব শিশির সূর্য ওঠার অনেক আগের!

এই কবিতাটি আলোর ওপর অন্ধকারের থাবায়

কাতর বেদনাবিধুর অসহায়তার নিরব আর্তি।

 

এই কবিতাটি করোনাকালের কালো কাঁটাতারে

গেঁথে যাওয়া সেই নীল প্রজাপতি, তার প্রতি শোক,

এই কবিতাটি চৈত্রের দাহে চৌচির মাঠ বৃষ্টিপিপাসু।

সে মাঠের প্রতি নীরব অশ্রু শুষ্ক চোখের।

 

এই কবিতাটি নির্জন ঘরে করজোড়ে কারও সেই প্রার্থনা

-মায়াজাদু যেন দুহাতে আশার আশ্বাস ঢালে;

যে ফিরে কখনো আর আসবে না-তারই পথ চাওয়া!

প্রতীক্ষাময়ী এই কবিতাটি ছাইয়ের আড়ালে গোপন অনল।

 

এই কবিতাটি নির্জনতার স্তব্ধতাভাঙা কলরোল হয়ে

একদিন যেন রক্তে তোমার উত্তাল ঢেউ নিয়ে ফিরে আসে

আশ্বাস হোক অসহায়তার আর্তি পেরিয়ে

এই কবিতাটি প্রার্থনা হোক জন্মদিনের সোনালি রোদের।

 

অবয়বহীন

একজন ভাস্করকে জানি-যে মাটি, কাঠ

এমনকি পাথর কুঁদে তৈরি করে শিল্পের সুন্দর!

আমার বারান্দা থেকে দেখা যায় তার সৃষ্টি কর্মশালা;

আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি আর ভাবি: সৌন্দর্য পিপাসা!

 

আমার ব্যক্তিগত অনেক দুঃখতাপ-নিঃসঙ্গতার দহন

কেমন নিবে যায় তার এইসব আশ্চর্য সুন্দর শিল্প দেখে!

আমার শূন্য উদ্যান ভরে ওঠে সবুজে-শ্যামলে, ফুল ফোটে।

আমি অদৃশ্য ফুলের সেই ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে বসে থাকি বারান্দায় একা।

 

ভাস্কর গড়েছে এক আশ্চর্য প্রতিমা সুন্দরীর!

কী অপূর্ব স্তনের লাবণ্য ওই প্রাণহীন কাঠ থেকে ঝরে! 

চোখের তারার নীলশোভা: বোবা দৃষ্টি কথা বলে ওঠে!

ঘুমের ভেতরে আমি ওই নারীর সঙ্গে হাঁটি জ্যোৎস্নার উঠোনে।

 

একজন ভাস্কর তার প্রেম দিয়ে শিল্পে প্রাণ করেছে স্থাপন

অতঃপর জেনে যাই কী আনন্দ দূরে থেকে যৌথ যাপন!

 

ফিরে আসতে হয়

চলে গেছি অনেক দূরে ছেলেবেলার উঠোন ছেড়ে একা

কলমিলতা-ঝোপের পাশে সোনালু ফুল উঁকি দেয়া ডাল

সেই যে আমার পোষা টিয়ের খাঁচা কিংবা ঘুঘুর বাসা

এসব ছেড়ে অনেক দূরে বৃথাই আমার অচিন পথে যাওয়া।

 

সেই যে বাউল চৈত্রমাসে একতারাতে সুরের মায়ায়

ভুলিয়েছিল খুব। সেই সুরে ডুব দিত আমার কত দুপুর-রাত

কোথায় আমি সেই বাউলের খোঁজ পাব আজ আর!

ভুল ভ্রমণে হারিয়ে গেল সব।

 

নির্জনতায় পাখির বাসা, ভরদুপুরের তালপাতাদের শোঁ-শোঁ সুরের গান!

সেসব ছবি কবির মতো মন-গহণে হাহাকারের চিত্র আঁকে রোজ।

কেউ কখনো পাবে কি তার খোঁজ!

কে যে কোথায় কী হারিয়ে ফতুর হয়ে যায়!

 

ধর্ম

নদীর কী ধর্ম জানো, দুই তীর পলি দিয়ে স্রোতে বয়ে যাওয়া।

গাছের কী ধর্ম, তা-ও নয় তো অজানা।

পাতার ঝালরে স্নিগ্ধ সুরেছন্দে হাওয়া।

 

গাছেরা হাওয়ার ছন্দে ধর্মকথা বলে,

সমস্ত নদীর ভাষা অবিকল এক,

তার ধর্ম-পরিচয় বহমান জলে।

 

সমস্ত বিষের ধর্ম অভিন্ন দংশনে নীল, সব বিষ চিনি

সাপের ধর্মও জানা; নিজেকে বাঁচিয়ে চলা, এমনকি বিষাক্ত নাগিনী!

 

আঘাত না পেলে জানো সাপ তুলবে না ফণা,

পাখির স্বভাবও জানো- শান্তিপ্রিয় খুব,

খুঁটে খায় পরিত্যাক্ত ক্ষুদ্র শস্যকণা।

 

তোমার স্বভাব শুধু জানো না মানব,

মানবিকতাই ছিল মনুষ্যজন্মের ধর্ম, সেই ধর্ম ত্যাগ করে হিংস্রতায় তুমি আজ দূ-পেয়ে দানব!

 

তুমি অলৌকিক ধর্ম আর লৌকিকের বর্ণ-পরিচয় ভেদ

আবিষ্কার করে নিয়ে দেশে-দেশে রক্তপাতে ছড়িয়ে চলেছ ঘৃণা-ক্লেদ।

 

কবিতা বিভাগ থেকে আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your identity will not be published.