অদিতি ফাল্গুনীর একগুচ্ছ কবিতা

অদিতি ফাল্গুনীর একগুচ্ছ কবিতা

যে ছিল নার্সিসাস

ঘুরে দাঁড়াও,
বিষাদগ্রস্ত জলাশয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও
হে নার্সিসাস!
এই রূপোলি হ্রদের জল,
পাহাড়ি ঝরনার কবোষ্ণ ঘূর্ণাবর্ত...
দূরে পাহাড়ের ঢালে মেষপালকের নিভৃত বাঁশির সুর...
দুঃখিনী বনপরী ইকো কতবার ডাকছে তোমায়,
শুধু ক্রুদ্ধা হেরার অভিশাপে একটিও শব্দ পূর্ণ উচ্চারণে সমর্থ নয় সে...
কাজেই ও যদি ডাকে ‘নার্সিসাস’
শব্দটি ভেঙে আসে, ‘...সাস! সাস!’
যদি বলে ‘ভালোবাসি’...
পাহাড়ের মন্দ্র উপত্যকায় ধ্বনিত হয় শুধু, ‘...বাসি!’
একটিও প্রণয় বাক্য সে পূর্ণ উচ্চারণে অক্ষম...
 
তোমার নিদারুণ সোনালি চুলের স্তবক শ্রান্ত পিঙ্গল,
তোমার নীল চোখের নিচে ক্লান্তির কালো...
ইকো তোমাকে দু’হাতের আঁজলা ভরে জল এনে দেয়,
বুনোফল...আত্মপ্রেমে মগ্ন তুমি তা ছুঁয়েও দ্যাখো না...
তাচ্ছিল্যে ছুড়ে ফেলে দুপুরের আহার
তাকিয়ে রয়েছো একাগ্র হ্রদের জলে
নিজেরই প্রতিবিম্বের দিকে,
ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে আসে...
তুমিও গড়িয়ে পড়ো হ্রদের জলে,
আত্মপ্রেমে মৃত ও অবলুপ্ত...
ইকো ও তার সখীরা ছুটে আসে,
হ্রদের চারপাশে ফুটে ওঠে থোকা থোকা নার্সিসাস ফুল!

 


সেই তুষারকন্যা

ব্যবহার্য অব্যবহার্য গ্লানি যত,
এই যত পুরোনো তৈজস, সবজির ঝুড়ি আর আনাজের খোসা
এই যত মলিন শোকগীতি মালা
মুখোশের মানুষ যত আমার কফিন কাঁধে হাঁটছে...
হাঁটছে তারা আমার কফিন কাঁধে,
আমার কফিন কাঁধে তারা হাঁটছে...
যদিও বিষাক্ত আপেল আমায় দেওয়া হয়েছিল
(আমি ভক্ষণ করেছি সেই আপেল পরম বিশ্বাসে)
যদিও আমার চিরুনিতে বিষ মেখে রাখা হয়েছিল
আর আমি চুল আঁচড়েছি সেই চিরুনিতে নির্ভার আস্থায়...
মৃত ভেবে বনের মাঝে ফেলে রাখা
কফিন থেকে আমি কি আবার জেগে উঠব ?
অথবা উঠব না আর? ঘুম ভেঙে দেখব কি সাত
দয়ালু বামনের নৃত্য? ঢের ভালো প্রাসাদের অমাত্যদের চেয়ে ?  
 
ব্যবহার্য অব্যবহার্য গ্লানি যত,
এই যত পুরোনো তৈজস, সবজির ঝুড়ি আর আনাজের খোসা
এই যত মলিন শোকগীতি মালা
মুখোশের মানুষ যত আমার কফিন কাঁধে হাঁটছে...

 

মেঘের ডানায়

মেঘের ডানায় যাই ছুঁয়ে যাই 
মন খারাপের ভোর,
রোদের পাখায় যাই ছুঁয়ে যাই 
অব্যর্থ অক্ষর...
দিস না আমায় ভালোবাসা 
বারুদ ঠাসা ঘৃণা
ছায়াপথের দূর কিনারে
তীরের যোজনা...
করিস না তুই বুনো শিকারি 
কাল কৃতান্ত ব্যাধ...
সাতটি আকাশ পার হয়ে তাই 
গুনছি পরমাদ!

 


যে তুমি খনা

কতটা নিঃসঙ্গ তুমি?
সূর্য সন্তান অথচ সূতঃপুত্র নামে পরিচিত কর্ণের চেয়েও?
কতটা পরাজিত ? একিলিসের রথের চাকায় বেঁধে
ঘোরানো হেক্টরের লাশটির চেয়েও?
কতটা অবমানিতা? যে দ্রৌপদী আর্ত স্বরে লজ্জার ভিক্ষা চায়
দুঃশাসনের কাছে? তার চেয়েও?
কতটা বিড়ম্বিত? পিতৃব্য দুর্যোধনের হাতে বারবার নির্বাসিত
পান্ডু পুত্রদের চেয়েও? তোমার শত্রুরা বারবার তাড়িয়েছে তোমায়...
কখনো জতুগৃহে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছে,
কখনো অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছে...
শেষমেশ খা-বপ্রস্থের জঙ্গলে তক্ষক সাপের সাথে যুদ্ধ,
যে তুমি ক্যাসান্দ্রা-পলিয়েক্সেনা-এ্যান্ড্রোমেকে-হিক্যুবা,
ট্রোজান রাজ কূলবধূ ও কন্যারা
গ্রিক সৈন্যরা তোমাদের ক্রতদাসী বানিয়ে,
বানিয়ে শয্যাসঙ্গিনী নিয়ে যাচ্ছে দূর দূর দ্বীপে...
যে তুমি খনা যার জিহ্বা কেটে নিচ্ছে ক্ষমতা...
যে তোমায় পাগল বলছে লোকে,
সারা গায়ে ছিটাচ্ছে ধূলি আর থুতু
যে তুমি পদ্মিনী ষোল সহস্র নারী নিয়ে
নিজেই উঠেছো চিতায়...
যে তুমি মীরা পেয়ালায় করছো বিষ পান
যে তুমি কৃষক কন্যা, আর্ক দুহিতা জোয়ান
তোমাকে আগুনে পোড়ায় ব্রিটিশ
যে তুমি খনা যার জিহ্বা কেটে নিচ্ছে ক্ষমতা...
যে তুমি খনা যার জিহ্বা কেটে নিচ্ছে ক্ষমতা..

 

কিছু কি বলেছো দিন?

কিছু কি বলেছো দিন?
কিছু কি লিখেছো ও আয়ুষ্মান গ্রীষ্মকাল?
চিরন্তন রোদের দেয়ালে?
আমি কি শুনেছি তোমার কণ্ঠস্বর, হে মধ্যচৈত্রের নিভৃত স্পন্দন,
বহমান গুঞ্জন মুখরতা?
শুনে রাখো, তোমরা...যারা হত্যা করছো আমাকে
হিংসা আর জুগুস্পার অন্ধ হাড়িকাঠে,

মুখে পরিয়ে দিচ্ছ লৌহ জোয়াল,
আঘাতে আঘাতে বাড়িয়ে দিচ্ছ বহুস্তর সম্ভাবনা—
ব্যথা থেকে উৎসারিত অনন্তের শব্দসকল...
আমি তোমাদের প্রত্যেকের নাম লিখে যাব
সবিনয় কৃতজ্ঞতায়...

 

দ্যুলোক এবং স্ট্রাটোস্ফিয়ারে

পাখির ডানা ছেঁটেছে সরীসৃপ,
ছেঁটে ফ্যালো ডানা—দাও দুমড়ে-মুচড়ে,
যে ডানা উড়েছে মহাবিশ্বে আর বিষুব রেখায়
অয়নান্তিক ভর বেগে আহা মকরক্রান্তি
আর নিরক্ষীয় মহাপার্বণে...

ছাঁটো সেই ডানা আদিম হিংস্র ডায়নোসরাস,
মুচড়ে ফ্যালো তাকে...
ও পাখি, তুই উড়বি না আর?
বনহংসী তুই চকিত মরালী
জানিস না পাপ আর রাজ্যের কাদা...
কাদা থকথকে গলিত বিষ্ঠা
কারা দেয় ছুড়ে? অপাপবিদ্ধ তোর দু’ডানায়?

কতবার তোর ভাঙা হলো ডানা...
আদিম গরিলা ও সরীসৃপেরা
ভেঙে দিল ডানা...আহত ডানায়
তীব্র ব্যথায় মৌন কিছুদিন...
সব সরোবর শুকিয়ে গেল কি এই পৃথিবীর?

উরাল হ্রদ আর মানস সরোবর? ঝিলামের জলে
ডুবিয়ে ভাঙা ডানা ফের ওড় তুই
উড়ে চল আজ ভূলোক এবং  ট্রটোস্ফিয়ারে...
উড়ে চল আজ দ্যুলোক এবং স্ট্রাটোস্ফিয়ারে...

 

ব্যর্থ মোমবাতি

যেমন সুতীব্র হিমবাহ
নিজেই বুঝতে পারে না নিজের প্রবাহ
জানে না গতিপথ আর প্রদাহ অন্তর
জানে না যা শীতার্ত গ্লেসিয়ার
মহাকর্ষ, অভিকর্ষ সব সূত্র ভুলে
যেমন হিমবাহ অজানা ধারায় ছুটে চলে...
তেমন বুঝছি না আমি
এই সহসা, অকারণ অভিমুখ...
বুঝছি না নিষ্করুণ তুষারপাত
জানি না জানি না এই করুণ সংগীত,
সহসা ছায়াপথ আর
সলজ্জ তারাবীথি...
আর যদি আমি হই বা হয়ে থাকি
সেই ব্যর্থ মোমবাতি
তবু দীপিত বনানী...
হে অরণ্যঅগ্নি,
আমাকে স্পর্শ কোরো তবু
তোমার অঙ্গারে...

 


ট্রাফিক সিগন্যালে বাখতিন

তেজগাঁও খামারবাড়ি মোড়ে
প্রতি রাত নয়টার ট্রাফিক সিগন্যালে
লাল বাতিটা জ্বলতেই
সারে সারে ঘিরবে ওরা,
এক কানে দুল পরা,
হাতে বেলি ফুলের মালা পেঁচানো হিজড়া...
কিম্পুরুষ তার কাজল মাখা চোখে বলবে,
‘দে- দুইটা টাকা দে!’
আপনি পুরুষ হলে হাসবেন
আর নারী হলে ভয়ে হিম
অন্য দিকে তাকাবেন...
‘পপ কর্ন- পপ কর্ন— এক প্যাকেট দশ টাকা!’
আসবে টোকাই ভাই-বোন,
‘সফেদা ষাট টাকা...এক কেজি?’
‘আল্লার ওয়াস্তে দুইডা খয়রাত দ্যান আম্মা!’
বলবে লাঠি ভর, সাদা শ্মশ্রুর বৃদ্ধ ভিখিরি...
এমন বিবিধ কোরাসের পাখায় লাল বাতি
সবুজ হয়ে জ্বলতেই,
আবার ছুটবে গাড়ি-
শুধু মিখাইল বাখতিন এক গাল হেসে
কানে কানে বলবেন, ‘একেই পলিফনি বলে,
বুঝেছো মেয়ে?’ 

Leave a Reply

Your identity will not be published.